উদাত্ত আহবান

[২২ ও  ২৩শে সেপ্টেম্বর ’৯৪ রাজশাহী মহানগরীর নওদাপাড়ায় ‘আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী’ মাদরাসা প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা ও সুধী পরিষদের ‘আমীর’ হিসাবে নিয়মিত চতুর্মাসিক সম্মেলনের ২য় দিন শুক্রবার সকালে প্রদত্ত ভাষণ]

বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম

আস্সালামু আলায়কুম ওয়া রহমাতুল্লা-হি ওয়া বারাকা-তুহু

নাহ্মাদুহূ ওয়া নুছাল্লী ‘আলা রাসূলিহিল কারীম, আম্মা বা‘দ

সম্মানিত সাথী ও বন্ধুগণ!

আহলেহাদীছ আন্দোলনের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের আন্তরিক আহবানে সাড়া দিয়ে দেশের সে সকল আন্দোলনমুখী সুধী ও বিদগ্ধ ওলামায়ে কেরাম আজকের এ সুধী সম্মেলনে তাশরীফ এনেছেন, কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা ও সুধী পরিষদের পক্ষ হ’তে আমি তাঁদের সকলকে আন্তরিক মুবারকবাদ  জানাচ্ছি। আহলেহাদীছ আন্দোলনের অগ্রগতির স্বার্থে আপনাদের এখানে আগমন, এজন্য ব্যয়িত আপনাদের মূল্যবান সময়, শ্রম ও আর্থিক কুরবানী, দেহের প্রতি ফোঁটা স্বেদবিন্দু, প্রতিটি নিঃশ্বাস ও প্রতিটি মুহূর্তের বিনিময়ে আল্লাহ পাক আপনাদেরকে উত্তম জাযা প্রদান করুন, তিনি আমাদের ছোট-বড় সকল গোনাহ মাফ করুন, আহলেহাদীছ আন্দোলনকে আমাদের পরকালীন মুক্তির অসীলা হিসাবে কবুল করুন, আন্তরিকভাবে এই দো‘আ করি- আমীন!

প্রেক্ষিত পর্যালোচনা

বন্ধুগণ!

একই ভাষাভাষী ও একই বঙ্গীয় বদ্বীপ অঞ্চলের শরীক পশ্চিমবঙ্গ হ’তে পূর্ব বঙ্গ পৃথক হয়ে পাকিস্তানের স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তায় মিশে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক মানচিত্রের উপরে বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম হওয়ার মূল আদর্শিক প্রেরণা ছিল ‘ইসলাম’। বর্ণভেদ প্রথার অত্যাচারে অতিষ্ঠ সাধারণ হিন্দু সমাজ ও ব্রাক্ষণ্যবাদী হিন্দু রাজাদের অবর্ণনীয় শোষণ ও নিপীড়নে জর্জরিত এতদঞ্চলের সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগণ প্রথমতঃ আরব বণিকদের মাধ্যমে প্রচারিত ইসলামের উদার ও সাম্য নীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করার ফলে এদেশের মুসলিম জনগণের সংখ্যা শনৈঃশনৈঃ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। তারও বহু পরে আফগান বীর ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজীর নেতৃত্বে ৬০২ হিজরী মোতাবেক ১২০৬ খৃষ্টাব্দে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ইসলামের সামরিক ও রাজনৈতিক বিজয় ঘটে এবং ব্রাক্ষণ্যবাদী শাসনের অবসান হয়। সেই থেকে এদেশ আফগান, পাঠান, মোগল, আরবী, ইরানী, সুন্নী, শী‘আ প্রভৃতি স্বাধীন মুসলিম সালত্বানাতের অধীনে শাসিত হয়। পরবর্তীতে ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে তুর্কী শী‘আ অবাংগালী স্বাধীন দেশপ্রেমিক নওয়াব সিরাজুদ্দৌলার পতনের পর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৯০ বৎসর বঙ্গদেশ মূলতঃ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তথা খৃষ্টান ইংরেজ শাসনাধীনে থাকলেও এদেশের ইসলামী চেতনা বিনষ্ট করতে পারেনি। ফলে দ্বি-জাতি তত্ত্বের (Two nation theory) ভিত্তিতে ইসলামের স্বাধীন আবাসভূমি হিসাবে পূর্ব বঙ্গ স্বাধীন পাকিস্তানের অঙ্গ হিসাবে পরিগণিত হয়।

সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন পাকিস্তানের অভ্যুদয় আন্তর্জাতিক ইহুদী-খৃষ্টান ও ব্রাক্ষণ্যবাদী চক্র প্রথম থেকেই সুনযরে দেখেনি। তাই চক্রান্ত অব্যাহত থাকে। একখানা আস্ত রুটি একত্রে গিলে খাওয়া সম্ভব নয়। অতএব তাকে ছিঁড়ে দু’টুকরা করার ষড়যন্ত্র হ’ল। মিঃ গান্ধী এক সময় ভারতবর্ষে রাজনৈতিক ঐক্য রক্ষার জন্য বলেছিলেন, We are first Indian, then we are Hindu or Muslim. অর্থাৎ ‘আমরা প্রথমে ভারতীয় অতঃপর হিন্দু অথবা মুসলিম’। তার উত্তরে এককালে ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অগ্রদূত’ বলে খ্যাত প্রথমে কংগ্রেস ও পরে মুসলিম লীগ নেতা কুশাগ্রবুদ্ধি রাজনীতিক কায়েদে আযম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ (জন্ম : ২৫শে ডিসেম্বর ১৮৭৬ইং, মৃঃ ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৮) দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছিলেন, We are first Muslim, then we are Indian. ‘আমরা প্রথমে মুসলিম অতঃপর ভারতীয়’। কায়েদে আযমের মুখ দিয়ে উপমহাদেশের কোটি কোটি মুসলিম জনসাধারণের হৃদয়ে মণিকোঠায় লালিত আপোষহীন ইসলামী চেতনা ও স্বাতন্ত্র্যের কথাই সেদিন বিঘোষিত হয়েছিল। শুধুমাত্র ইসলামের স্বার্থেই একটি স্বাধীন দেশের জন্মলাভ আধুনিক পৃথিবীতে সম্ভবতঃ একটি অতুলনীয় ঘটনা ছিল। মুসলিম উম্মাহ তো বটেই, সমগ্র পৃথিবী গভীর বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের অগ্রযাত্রার পানে। কিন্তু না। কুচক্রী ইংরেজ এদেশ থেকে পাততাড়ি গুটানোর সময় তার হাতে গড়া ক্রীড়নক অমুসলিম কাদিয়ানী যাফরুল্লাহ খানকে করে গেল ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরে আইনমন্ত্রী। ফলে দেশের মূল হৃৎপিন্ডে ক্যান্সার হ’ল। ওদিকে মুসলিম এলাকা কাশ্মীরকে করে গেল দ্বিধাবিভক্ত; যাতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্থায়ীভাবে রক্ত ঝরার ব্যবস্থা হয়। তাদের দূরদর্শী পরিকল্পনা স্বার্থক হয়েছে। পাকিস্তানী শাসনযন্ত্র কখনই কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী চলেনি। সেখানে কুরআন-সুন্নাহর শ্লোগান উচ্চারিত হয়েছে। এই নামে জনগণের ভোট আদায় করা হয়েছে। কিন্তু কুরআন-সুন্নাহতে পারদর্শী কোন আলেম বা কুরআন-সুন্নাহর সনিষ্ঠ অনুসারী কোন যোগ্য ব্যক্তিকে কখনই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি। পরিণাম স্বরূপ পাকিস্তান তার ঐক্য রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে।

আজ পাকিস্তান বিভক্ত হয়েছে এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভূখন্ডগত কোন মিল ছিল না। আড়াই হাযার মাইল দূরত্বের দু’টি ভূখন্ডকে এক করে রেখেছিল শুধুমাত্র একটি আদর্শ- ‘ইসলাম’। আর কিছুই নয়। শাসকরা যখন সেই মূল সূত্রটিকেই দুর্বল করলেন ও সেই সাথে চরম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করলেন, তখন আর ঐক্য টিকিয়ে রাখার কোন সূত্র বাকী রইল না। 

স্বাধীনতার ভিত্তি

আজকে যে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র নিয়ে আমরা গর্ববোধ করছি, এর স্বাধীনতার ভিত্তি কিসের উপরে প্রতিষ্ঠিত? ভাষাভিত্তিক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ না অঞ্চলভিত্তিক বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ? যদি প্রথমটি হয়, তাহ’লে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীদের সাথে মিলে প্রাচীন যুগের বৃহত্তম বঙ্গদেশ গড়াতে বাধা কোথায়? যদি দ্বিতীয়টি হয়, তবে তার স্থায়িত্ব অত সময়, যত সময় নিজের শক্তি ও সামর্থ্য বলে এ দেশটি তার আঞ্চলিক অখন্ডতা টিকিয়ে রাখতে পারবে। তিনদিকে ব্রাক্ষণ্যবাদী ভারত ও একদিকে বঙ্গোপসাগর দিয়ে ঘেরা অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্থ এই দুর্বল স্বাধীন ছোট্ট দেশটি আয়তনে তার অন্যূন ২২ গুণ বড় বৃহৎ প্রতিবেশীর সাথে মিশে একাকার হয়ে বৃহত্তর ভারতবর্ষ গড়তে আপত্তি কোথায়? মূলতঃ এখানেও কোন পৃথক প্রেরণা নেই। ‘বাঙ্গালী’ ও ‘বাংলাদেশী’ উভয় বিবেচনায় ভারতবর্ষ থেকে পৃথক হয়ে থাকার জন্য আমাদের কোন যুক্তি নেই। কেবলমাত্র একটি কারণেই আমরা ভারতবর্ষ থেকে পূর্বেও পৃথক হয়েছিলাম এবং আজও পৃথক থাকতে পারি, সেটা হ’ল আমাদের প্রাণপ্রিয় ধর্ম ‘ইসলাম’। ইসলামের কারণেই আমরা স্বাধীন ভূখন্ড বাংলাদেশ লাভ করেছি, ইসলামের কারণেই বাংলাদেশ তার স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখতে পারে এবং ইসলামের স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই আমরা আমাদের এ ভূখন্ডের প্রতি ইঞ্চি মাটির স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চেষ্টিত থাকব ইনশাআল্লাহ। ইসলামের জন্যই স্বাধীনতা পেয়েছি- এটি যেমন ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক সত্য। তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যও ইসলাম অপরিহার্য- এটাও তেমিন অকাট্ট সত্য। আর একারণেই আন্তর্জাতিক ইহুদী-খৃষ্টান ও ব্রাক্ষণ্যবাদী শক্তির প্রধান টার্গেট হ’ল ‘ইসলাম’।

প্রতিবেশী দেশে মুসলমানদের অবস্থা

ইউরোপের একমাত্র ইসলামী দেশ জাতিসংঘের স্বাধীন সার্বভৌম সদস্য রাষ্ট্র ‘বসনিয়া’কে ইউরোপের মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য যেভাবে খৃষ্টান ও অমুসলিম বিশ্ব অঘোষিত ‘ক্রুসেড’ চালিয়ে যাচ্ছে, প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্রটি তেমিন তার দেশের বৃহত্তম সংখ্যালঘু মুসলিম জনগণকে বিতাড়িত ও নিশ্চিহ্ন করার যাবতীয় প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সেদেশের প্রগতিশীল পত্রিকা Front Line ১৫ই নভেম্বর ১৯৯১-এর হিসাব মতে ১৯৬১ থেকে ’৯১ পর্যন্ত ৩০ বছরে সেখানে ৭৯৪৬টি মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে এবং ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত হয়েছে প্রায় ১৩,৯৫০টি দাঙ্গা। ১৯৭৮ সালের ২৭শে মার্চ তারিখে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রাদেশিক বিধান সভায় প্রদত্ত তালিকায় বলেন যে, ঐ সময় পর্যন্ত খোদ কলিকাতা শহরেই ৪৬টি মসজিদ এবং ৭টি মাযার ও গোরস্থান হিন্দুরা দখল করে নিয়েছে।[1] উক্ত হিসাব মতে দেখা যায় যে, বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ ‘গণতান্ত্রিক’ দেশ বলে খ্যাত ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে কথিত ভারতে তার স্বাধীনতা লাভের ৪৫ বছরে গড়ে প্রতি বছরে ৩০৯টি মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। জান-মাল-ইযযত হারিয়েছে কত অগণিত মুসলিম ভাই-বোন তার সঠিক হিসাব  কে রাখে? ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বরে ৪৬৫ বছরের সুপ্রাচীন ‘বাবরী মসজিদ’ ভেঙ্গে সেখানে তারা ‘রামমন্দির’ গড়েছে। এখনো প্রতিদিন কাশ্মীরে মুসলিন নিধন চলছে, চলছে আসামে বোড়ো মুসলিম হত্যা ও বিতাড়ন। সারা ভারত থেকে বাংলাভাষী মুসলমানদেরকে হাঁকিয়ে এনে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করার চেষ্টা চলছে হরহামেশা। বি.এস.এফ-এর গুলীতে নিহত হচ্ছে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রায় প্রতিদিন দু’একজন করে বাংলাদেশী নাগরিক। ফারাক্কা সহ ৫৪টি নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে এবং দক্ষিণ তালপট্টি ও মুহুরীর চর দখল করে এই স্বাধীন মুসলিম দেশটিকে গ্রাস করার সকল রাজনৈতিক পাঁয়তারা ইতিমধ্যেই সে প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছে। এরপরেও পর্বত প্রমাণ অসম বাণিজ্য ও ব্যাপক চোরাচালানীর মাধ্যমে এবং দেশের উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক খরা পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে বছরে সর্বমোট অন্যূন ১৫ হাযার কোটি টাকার সম্পদ ঘরে তুলে নিয়ে তারা এদেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে প্রায় নিঃশেষ করে ফেলেছে এবং এভাবে ২৫ বছরের গোলামী চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে তাদের নিকটে করুণার ভিখারী হয়ে থাকার সকল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। এখন আবার রেল ও নৌ ট্রানজিট সুবিধা আদায়ের পাঁয়তারা করছে। আমাদের এই প্রিয় দেশটির বিরুদ্ধে তাদের এই আক্রোশের মূল কারণ হ’ল ‘ইসলাম’। কেননা একই ভাষাভাষী পশ্চিমবঙ্গ হ’তে পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়ার মূল কারণ ছিল ‘ইসলাম’। ইসলাম তাই স্বাধীনতা রক্ষার মূল গ্যারান্টি। ইসলাম আমাদের গর্ব, ইসলাম আমাদের অহংকার।

দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট

বন্ধুগণ! গত দু’তিন মাস থেকে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার যেভাবে দ্রুত পট-পরিবর্তন ঘটছে, তাতে যেকোন চিন্তাশীল ব্যক্তির উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দাঊদ হায়দার ও সালমান রুশদীর পরে তাসলীমা নাসরীনকে মঞ্চে এনে আন্তর্জাতিক ইহুদী-খৃষ্টান ও ব্রাক্ষণ্যবাদী চক্র এদেশের মুসলমানদের ঈমানী চেতনাকে আরেকবার পরখ করে দেখল। ৮,৫০০ জন পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবী ও ৬,৩০০ পাশ্চাত্য সংগঠন এমনকি মানবাধিকারের স্বঘোষিত আন্তর্জাতিক মোড়ল বর্তমান বিশেবর একক পরাশক্তি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের পক্ষ  থেকে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর নিকটে তাসলীমা নাসরীনের নিরাপত্তার জন্য আবেদন পেশ করা হয়েছে (দৈনিক সংগ্রাম)। অথচ আমেরিকার সরকারী হিসাব মতে সেদেশের শতকরা ৬০ জন মহিলা নিহত হচ্ছেন বর্তমানে তাদের স্বামীদের হাতেই (দৈনিক ইনকিলাব)। নিজ দেশের মা-বোনদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারে না যে আমেরিকা, সে কোন স্বার্থে ভিনদেশের একজন মহিলার নিরাপত্তার জন্য আবেদন করে? ৩০ লাখ রূপী খরচ করে কলিকাতার সল্ট লেকে তাসলীমার জন্য বাড়ী নির্মাণ করে দেওয়া ইত্যাদি ঘটনা প্রমাণ করে যে, পবিত্র কুরআন পরিবর্তন ও সংশোধনের দাবীদার তাসলীমা নাসরীন কেবল একজন নষ্টা চরিত্রের লেখিকা নয়, সে আন্তর্জাতিক ইসলাম বৈরী শক্তির ক্রীড়নকও বটে। একটি জাতিকে কব্জা করতে গেলে সর্বপ্রথম সে জাতির সংস্কৃতি ও সে জাতির আক্বীদা-বিশ্বাসকে কব্জা করতে হয়। তাসলীমা ও তার এদেশীয় দোসরদেরকে দিয়ে দীর্ঘদিন যাবত লেখনী ও প্রচারণার মাধ্যমে উক্ত আন্তর্জাতিক চক্র জনগণের মধ্যে ইসলামের অনুভূতিকে ভোঁতা করে দিতে চেয়েছিল। কারণ এতে সমর্থ হ’লেই কেবল তাদের পরিকল্পিত নাটকের দ্বিতীয় পর্ব শুরু করা সম্ভব হবে। আর তখনই তাসলীমার এদেশীয় দোসররা রাতারাতি ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’র মহামিলনের অগ্রদূত হিসাবে ইতিহাসে নায়কের মর্যাদা লাভ করবেন। তবে নাটকের সেই দৃশ্যগুলি এখনো বাকী রয়েছে।

আন্দোলনের ধারা

প্রিয় সাথী ও বন্ধুগণ!

বাংলাদেশে বর্তমানে মূলতঃ দু’ধরনের আন্দোলন চলছে। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘ইসলামী’। প্রত্যেকটিই দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথমতঃ ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির একভাগ ব্যক্তি জীবনে আস্তিক বা ধর্মভীরু, কিন্তু বৈষয়িক জীবনে নাস্তিক বা ধর্মহীন। ব্যক্তি জীবনে ধর্মের অনুসারী হ’লেও তারা বৈষয়িক জীবনে ধর্মহীন বিজাতীয় মতাদর্শের অন্ধ অনুসরণ করে থাকেন। ফলে রাজনীতির নামে ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বৈরাচার এবং অর্থনীতির নামে সূদ-ঘুষ-জুয়া-লটারী, মওজুদদারী ইত্যাদি পুঁজিবাদী শোষণ-নির্যাতনকে তারা বৈধ ভেবে নেন, এই কারণে যে এগুলি ধর্মীয় বিষয় নয় বরং বৈষয়িক ব্যাপার। আর তাই হারাম পয়সা দিয়ে রসগোল্লা কিনে নিজ নিষ্পাপ সন্তানের মুখে তুলে দিতেও এদের হাত কাঁপেনা। রাজনীতির নামে ধর্মঘট-অবরোধ-হরতাল করে জনগণের ক্ষতি সাধন করতে, সূদ-ঘুষ ও ব্যভিচারের মত প্রকাশ্য  হারামকে হালাল করতে, অন্যদলের লোকের বুকে চাকু বসাতে, রগ কাটতে ও বন্দুকের গুলীতে তার বুক ঝাঝরা করে দিতে এইসব রাজনীতিকদের বিবেকে একটুও বাঁধে না। কারণ এসব ধর্ম নয় বরং বৈষয়িক ব্যাপার। এইভাগে লোকের সংখ্যাই সর্বত্র বেশী।

ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির অন্য ভাগটি ব্যক্তি ও বৈষয়িক উভয় জীবনে ‘নাস্তিক’ অর্থাৎ উভয় জীবনে তারা ধর্মহীন বিজাতীয় মতাদর্শের অনুসারী। যদিও তাদের কেউ কেউ ইসলামী নাম নিয়েই ময়দানে চলাফেরা করেন। এদের জনৈক নেতা কয়েক বৎসর পূর্বে মারা গেলে একজন মৌলবী ছাহেবকে ডেকে নিয়ে জানাযা দেওয়া হয়েছে বটে। তবে এদের নমস্য পার্শ্ববর্তী ভারতের সাবেক ভাইস প্রেসিডেণ্ট ও সেদেশের সুপ্রীম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি হেদায়াতুল্লাহ বিগত ১৯শে সেপ্টেম্বর ১৯৯২ তারিখে মারা গেলে তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মৃতদেহ বৈদ্যুতিক চুল্লীতে পুড়িয়ে ফেলা হয়। সে দেশের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম, করীম চাগলা এবং বিশিষ্ট নেতা হামীদ দেলওয়াঈকেও একইভাবে পোড়ানো হয়। কম্যুনিষ্ট নেতা কমরেড মুযাফফর আহমদকে লাল কাপড় জড়িয়ে জানাযা ছাড়াই পুঁুতে ফেলা হয়। সেদেশের বিখ্যাত কম্যুনিষ্ট তাত্ত্বিক আব্দুল্লাহ রাসূল এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হুমায়ূন কবীর-এরও জানাযা হয়নি।[2] অতএব বাংলাদেশের কম্যুনিষ্টদেরও উপরোক্তদের পদাংক অনুসরণ করা উচিত- যাতে জনসাধারণের কাছে তারা খাঁটি ‘নাস্তিক’ হিসাবে শ্রদ্ধা কুড়াতে সক্ষম হন।

দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে ইসলামী দলগুলি। এরা মূলতঃ দু’ভাগে বিভক্ত। একভাগের দলগুলি তাক্বলীদের অনুসরণে এবং অধিকাংশ জনগণের আচরিত মাযহাব অনুযায়ী ব্যক্তি ও বৈষয়িক জীবনে ইসলামী আইন ও শাসন চান। এঁরা বাহ্যিকভাবে বিশেষ একজন সম্মানিত ইমামের তাক্বলীদের দাবীদার হ’লেও বাস্তবে পরবর্তী ফক্বীহদের রচিত বিভিন্ন ফিক্বহ এবং পীর-মাশায়েখ, মুরববী ও ইসলামী  চিন্তাবিদ নামে পরিচিত বিভিন্ন ব্যক্তির অনুসারী। কুরআন পরিবর্তনের মত একটি মৌলিক প্রতিবাদের ইস্যুতেও এঁরা এক হয়ে কয়েকটি ঘণ্টার জন্য এক মঞ্চে বসতে পারেননি। গত ২৯শে জুলাই ’৯৪ শুক্রবার বাদ জুম‘আ একই দিনে একই সময়ে রাজধানীর মানিক মিয়াঁ  এভেনিউ ও বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেইটে প্রধানতঃ একই মাযহাবের অনুসারী ইসলামী দলগুলির দু’টি মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ইসলামী দলগুলির আপোষ বিভক্তির এই নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ইসলাম বৈরী শক্তির নিকটে স্বস্তির বিষয় বৈ কি!

আর এক ভাগে রয়েছেন তাঁরাই যারা তাক্বলীদমুক্তভাবে কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী নিজেদের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন এবং দেশের আইন ও শাসন ব্যবস্থা কামনা করেন। যারা ব্যক্তি ও বৈষয়িক উভয় ক্ষেত্রে জাতীয় ও বিজাতীয় উভয় প্রকার তাক্বলীদ হ’তে মুক্ত থেকে নিরপেক্ষভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী নিজেদের সার্বিক জীবন পরিচালনা করতে চান। এরাই হলেন ‘আহলেহাদীছ’। যদিও তাদের অনেকের মধ্যে বর্তমানে বিভিন্ন জাহেলী মতবাদ ঢুকে পড়েছে।

পবিত্র কুরআন সংশোধন ও পরিবর্তনের উদ্ভট দাবীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার ঈমানী তাকীদেই আমরা বিগত ২৯শে জুলাই ’৯৪ শুক্রবার মানিক মিয়াঁ এভেনিউয়ে ‘সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ’ আহূত লংমার্চ শেষে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে নিজস্ব উদ্যোগে সাংগঠনিকভাবে যোগদান করেছিলাম। আন্দোলনের ইতিহাসে সর্বপ্রথম রাজধানী ঢাকার বুকে জাতীয় পর্যায়ে সকল ইসলামী দলের মধ্যে নিজেদেরকে ‘আহলেহাদীছ’ হিসাবে আত্মপরিচয়ের সাথে সাথে এদেশের অন্যূন দেড়কোটি আহলেহাদীছ জনতার পক্ষ থেকে আমাদের মৌলিক বক্তব্য জাতির সামনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তুলে ধরেছিলাম। দুর্ভাগ্য, অবাধ গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী প্রগতিবাদী বা ইসলামপন্থী কোন জাতীয় পত্রিকাই আমাদের মূল বক্তব্যটুকু তুলে ধরেনি। এমনকি ঐ মহাসমাবেশের প্রধান মুখপত্র বলে পরিচিত জাতীয় দৈনিকটি (দৈনিক ইনকিলাব) আমাদের অংশগ্রহণ ও বক্তৃতা প্রদানের খবরটুকুও ছাপেনি। যদিও ঐ পত্রিকার সহ-সম্পাদক নিজে বক্তৃতা মঞ্চে উপস্থিত থেকে আমাদের প্রতি উচ্ছ্বসিত আবেগ দেখিয়েছিলেন ও অনেক আশ্বাস বাক্য শুনিয়েছিলেন।

ঐ মহাসমাবেশ থেকে ফেরার পথে এদেশের একটি চিহ্নিত ধর্মনিরপেক্ষ দলের একটি জমায়েত থেকে আমাদের কর্মীদের বহনকারী ২৬টি বাস ও ট্রাক বহরের এক অংশের উপরে বোমা ছুঁড়ে মারা হয় এবং আরেকটি চিহ্নিত বামদলের ঢাকা জিপিও-র সম্মুখস্থ সড়কের বিপরীতে তাদের অফিসের দোতলা থেকে চোরাগুপ্তাভাবে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। যাতে আমাদের মোট ছয়জন তরুণ কর্মী গুরুতরভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে নীত হয়। ১৯৭৯ সালের জুন মাসে ঢাকায় কবরপূজারীদের বিরুদ্ধে মিছিল করতে গিয়ে তাদের নিক্ষিপ্ত ইট-পাথরের আঘাতে সর্বপ্রথম আমাদের দু’জন সাথী ভাইয়ের রক্ত ঝরেছিল। আর এবারে ১৯৯৪-এর জুলাইয়ে কুরআন বিরোধী নাস্তিক-মুরতাদদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল করতে গিয়ে আমাদের ৬ জন সাথীর রক্ত ঝরলো। হে আল্লাহ! তোমার দ্বীনের বিজয়ের স্বার্থে আমাদের এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আত্মত্যাগ কবুল করে নাও এবং আমাদের সময়, শ্রম ও আর্থিক কুরবানী সমূহকে পরকালীন মুক্তির অসীলা হিসাবে গ্রহণ কর- আমীন!

আমরা সকল জাতীয় ইস্যু ও সামগ্রিক ইসলামী স্বার্থে সকল ইসলামী দলকে যাবতীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা ও সমন্বিত কর্মসূচী গ্রহণের উদাত্ত আহবান জানাই।

আন্দোলনের লক্ষ্য

বন্ধু ও সাথীগণ!

দেশের ও জাতির উপরোক্ত প্রেক্ষাপট সামনে রেখে এক্ষণে আহলেহাদীছদের ভূমিকা কি হবে, তা আমাদেরকে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। কোন আন্দোলন পরিচালিত হ’তে পারে না, যতক্ষণ না তার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়। একটি গাড়ী চালনাও সম্ভব নয় যতক্ষণ না তার গন্তব্য নির্দিষ্ট হয়। এক্ষণে আহলেহাদীছ আন্দোলনের লক্ষ্য কি? একটিমাত্র বাক্যে যা আমরা ঘোষণা করেছি তা এই ‘নির্ভেজাল তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে কিতাব ও সুন্নাতের যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা’। আরও সংক্ষিপ্তভাবে ঢাকার মহাসমাবেশে মাত্র দু’মিনিট ১০ সেকেন্ডের সংক্ষিপ্ত ভাষণে যা আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে জাতির সম্মুখে পেশ করেছি, তা হ’ল- ‘সকল বিধান বাতিল কর, অহি-র বিধান কায়েম কর’[3]

অর্থাৎ জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ অহি-র বিধান কায়েম করাই আহলেহাদীছ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। যে লক্ষ্যে জাতীয় বা বিজাতীয় কোন মতাদর্শের মিকশ্চার থাকবে না। যে লক্ষ্য হবে নির্ভেজাল ও নিষ্পংক। আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত যে লক্ষ্য অর্জনের বিনিময়ে আর কিছুই চাওয়ার নেই, কিছুই পাওয়ার নেই। এই লক্ষ্যের পথিকদের জন্য দা‘ওয়াত ও জিহাদে ব্যয়িত সময়টুকুর মূল্য দুনিয়ার সকল আনন্দঘন মুহূর্তের চাইতে অতীব মূল্যবান। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে হালাল পথে উপার্জিত দু’মুঠো চিড়া-মুড়ি, হারাম পথে উপার্জিত লক্ষ টাকার চেয়েও তার নিকটে অধিক বরকতময়। আল্লাহর রাস্তায় মেহনত করতে গিয়ে নিজ দেহ থেকে ঝরে পড়া দু’ফোঁটা ঘর্ম বা এক ফোঁটা রক্তবিন্দু তার নিকটে দুনিয়ার মহামূল্যবান হীরকখন্ডের চাইতে অমূল্য। এই মহান লক্ষ্যে আগুয়ান মুজাহিদ দুনিয়াতে সকল লোভনীয় পদ ও বস্ত্তসম্ভারের চেয়ে পরকালে জান্নাতুল ফেরদৌসের এক কোণে স্থান পাওয়াকে সবচাইতে সৌভাগ্যের বিষয় বলে মনে করে। তার জীবন, তার মরণ, তার ইবাদত, তার কুরবানী সব কিছুই হয় স্রেফ আল্লাহর জন্য, স্রেফ তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য। যেমন আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ ِللهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ- ‘তুমি বল! নিশ্চয়ই আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবকিছুই বিশ্বপ্রভু আল্লাহর জন্য নিবেদিত’ (আন‘আম ৬/১৬২)।

আমরা এদেশের আহলেহাদীছ জামা‘আতের সকল ভাইবোনকে ও আপামর মুসলিম জনসাধারণকে উক্ত মহান লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে দৃঢ় কদমে এগিয়ে চলার আন্তরিক আহবান জানাই।

লক্ষ্যে উত্তরণের উপায়

বন্ধুগণ!

আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারিত হওয়ার পর এক্ষণে তা অর্জনের উপায় হিসাবে প্রথম যে বিষয়টি যরূরী, তা হ’ল সচেতন ও নিবেদিতপ্রাণ একদল নেতা ও কর্মী সৃষ্টি করা। যারা অবশ্যই হবেন শারঈ জ্ঞানে অভিজ্ঞ, সমসাময়িক জ্ঞানে পরিপক্ক ও উপযুক্তভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। শারঈ বিধানের অনুসরণে তারা লক্ষ্য পানে এগিয়ে যাবেন। গন্তব্য যত ভাল হৌক, গাড়ীটি যত সুন্দর হৌক, যদি তার চালক যোগ্য ও অভিজ্ঞ না হয় এবং চালকের সাথে কিছু নিবেদিতপ্রাণ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহযোগী না থাকে, তাহ’লে যেমন একটি ছোট গাড়ীও চালানো সম্ভব নয়। আহলেহাদীছ আন্দোলনের এই জান্নাতী পরিবহন পরিচালনার জন্য তেমনি অবশ্যই প্রয়োজন জান্নাতী গুণাবলী সম্পন্ন কিছু যোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণ নেতা ও কর্মীর। এই নেতা ও কর্মীদল নিশ্চয়ই আসমান থেকে  নেমে আসবেন না বা যমীন থেকে উদ্গত হবেন না। আপনাদের মধ্য থেকেই তাঁদেরকে বেছে বেছে সামনে আনতে হবে। তারা কখনোই দায়িত্ব নিতে চাইবেন না, কখনই সামনে আসতে চাইবেন না, কখনই কোন কিছুর প্রার্থী বা প্রত্যাশী হবেন না। কিন্তু আপনাদের দায়িত্ব তাদেরকে বাছাই করে সামনে আনার ও যথাযোগ্য স্থানে তাদেরকে বসিয়ে দেওয়ার। যেমন বসিয়েছিলেন আবুবকর (রাঃ) ওমর ফারূককে। হাসিমুখে তাঁকে বরণ করেছিলেন ছাহাবায়ে কেরাম ও সকল মুসলিম জনসাধারণ। আসুন! আমরা দো‘আ করি আল্লাহর নিকটে আল্লাহর ভাষায়-

وَاجْعَلْ لَنَا مِن لَّدُنْكَ وَلِيًّا وَّاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَّدُنكَ نَصِيْراً- (نساء ৭৫) ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জন্য তোমার পক্ষ হ’তে একজন নেতা দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী প্রেরণ কর’ (নিসা ৪/৭৫)। -আমীন!!

 

কর্মীদের গুণাবলী

আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রত্যেক সদস্য ও সদস্যাকে প্রধানতঃ চারটি গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হ’তে হবে। খালেছ তাওহীদে বিশ্বাস, সুন্নাতের পূর্ণ ইত্তেবা, সর্বদা জিহাদী জায্বা ও সর্বোপরি আল্লাহর নিকটে বিনীত হওয়া। উক্ত চারটি গুণ একত্রিত হওয়া ব্যতীত জাতির জন্য কল্যাণকর কিছু অর্জিত হওয়া সম্ভবপর নয়। আখেরাতেও তেমন কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। বিভিন্ন দলের দিকে তাকিয়ে দেখুন। সেখানে তাওহীদ আছে তো ইত্তেবায়ে সুন্নাত নেই। ইত্তেবায়ে সুন্নাত আছে তো জিহাদের জায্বা নেই। যিক্র-ফিক্র আছে তো সুন্নাতের অনুসরণ নেই। যদি কোথাও তিনটি গুণ একত্রে পাওয়া যায়, তবে হয়ত দেখা যাবে আল্লাহর নিকটে বিনীত হওয়ার গুণ নেই। শ্রবণ করুন রোম সম্রাটের প্রেরিত জনৈক আরব খৃষ্টান গুপ্তচরের দেওয়া সেই সারগর্ভ রিপোর্টটি- যে রিপোর্ট তিনি ভূখা-নাঙ্গা মুসলিম সেনাবাহিনীর বিজয় লাভের অন্তর্নিহিত মৌলিক কারণ হিসাবে বর্ণনা করতে গিয়ে পেশ করেছিলেন একটি মাত্র বাক্যে- وَهُمْ فِى اللَّيْلِ رُهْبَانٌ وَفِى النَّهَارِ فُرْسَانُ ، وَاللهِ لَوْ سَرَقَ فِيْهِمْ اِبْنُ مَلِكِهِمْ لَقَطَعُوْهُ، أَوْ زَنَى لَرَجَمُوْهُ - ‘তারা রাতের বেলায় ইবাদতগুযার ও দিনের বেলায় ঘোড় সওয়ার। আল্লাহর কসম! যদি তাদের বাদশাহর ছেলে চুরি করে, তাহ’লে তারা তার হাত কেটে দেয়। আর যদি যেনা করে, তাহ’লে তারা তার মাথা চূর্ণ করে হত্যা করে ফেলে’।[4] মুসলমানদের এই নিঃস্বার্থ ও প্রবল ঈমানী শক্তির সম্মুখে সে যুগের উন্নত মারণাস্ত্র সমৃদ্ধ পরাশক্তিগুলো যেমন পরাজয় বরণ করেছিল, পুনরায় সেই আত্মশক্তির উন্মেষ ঘটাতে পারলে এযুগের পরাশক্তিগুলিও হার মানতে বাধ্য হবে ইনশাআল্লাহ। ১২ কোটি জনতার বিপুল সম্ভাবনাময় এই সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা ইসলামী দেশটিতে একদল আল্লাহর বান্দা যখন উপরোক্ত গুণ ও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়ে নিজেদেরকে প্রস্ত্তত করে তুলবেন, তখনই আল্লাহর বিশেষ রহমত নেমে আসবে। যেমন নেমে এসেছিল বদরের প্রান্তরে, সিন্ধুর দেবল রণভূমিতে, ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজীর ১৭ জনের ছোট্ট বাহিনীর উপরে বাংলার সবুজ মাটিতে। এদেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণে আল্লাহ পাক ইচ্ছা করলে উপরোক্ত গুণসম্পন্ন যোগ্য ও ক্ষুদ্র দলের হাতেই দেশের দায়িত্বভার অর্পণ করবেন। যদি অনুরূপ দলের সংখ্যা একাধিক হয়, তবে অবশ্যই তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৃহত্তর সমাজশক্তিতে পরিণত হবে। এইভাবে ‘ইমারতে শারঈ’-র পথ বেয়ে একদিন বৃহত্তর ‘ইমারতে মুল্কী’ কায়েম হবে ইনশাআল্লাহ।

বিজয়ী দলের বৈশিষ্ট্য

চিরকাল যোগ্য সংখ্যালঘু দল সংখ্যাগুরুর উপরে জয়লাভ  করেছে ও তাদেরকে পরিচালিত করেছে। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী প্রতিভাবান ও নেতৃত্বের যোগ্যতাসম্পন্ন বান্দার সংখ্যা চিরকালই কম থাকে। ক্লাসে প্রথম হওয়ার সৌভাগ্য একটা ছেলেরই হয়ে থাকে। এতে অন্যদের হিংসা করলে চলবে না। ইচ্ছায় হৌক অনিচ্ছায় হৌক সমাজের সংখ্যাগুরু জনগণ নিজেদের স্বার্থেই তাদের মধ্যকার যোগ্য ব্যক্তিকে সবসময় সম্মুখে এগিয়ে দিয়েছে ও তার আনুগত্য করেছে। এটাই জগত সংসারের চিরন্তন নিয়ম। আল্লাহর ঘোষণা শুনুন-

كَمْ مِنْ فِئَةٍ قَلِيْلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيْرَةً بِإِذْنِ اللهِ ، وَاللهُ مَعَ الصَّابِرِيْنَ- (بقرة ২৪৯)-

‘কতই না সংখ্যালঘু দল সংখ্যাগুরু দলের উপরে জয়লাভ করেছে, আল্লাহর হুকুমে। আল্লাহ সর্বদা ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/২৪৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী শ্রবণ করুন-

بَدَأَ الْإِسْلاَمُ غَرِيْبًا وَسَيَعُوْدُ كَماَ بَدَأَ فَطُوْبىَ لِلْغُرَبَاءِ، رواه مسلم- ‘ইসলাম এসেছিল গুটিকতক মানুষের মাধ্যমে। আবার অনুরূপ সংখ্যক মানুষের মধ্যেই তা ফিরে যাবে। অতএব সুসংবাদ সেই অল্পসংখ্যক মুমিনের জন্যই’।[5] এই অল্প সংখ্যক উন্নত গুণাবলী সম্পন্ন মুমিনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কেমন হবে? আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন,

وَهُمُ الَّذِيْنَ يُصْلِحُوْنَ مَا أَفْسَدَ النَّاسُ مِنْ بَعْدِىْ مِنْ سُنَّتِىْ، رواه أحمد بإسناد صحيح- ‘যারা আমার ঐসব সুন্নাতকে পুনর্জীবিত করবে, যেগুলিকে আমার মৃত্যুর পরে লোকেরা বিনষ্ট করে ফেলেছে’।[6] এক্ষণে অল্পসংখ্যক সংস্কারবাদীদের নিরন্তর প্রচেষ্টার ফল কি দাঁড়াবে? এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী শ্রবণ করুন-

ফলাফল

وَعَنِ الْمِقْدَادِ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ : لاَ يَبْقَى عَلَى ظَهْرِ الْأَرْضِ بَيْتُ مَدَرٍ وَّلاَ وَبَرٍ إلاَّ أَدْخَلَهُ اللهُ كَلِمَةَ الْإسْلاَمِ بِعِزِّ عَزِيْزٍ وَّ ذُلِّ ذَلِيْلٍ، إمَّا يُعِزُّهُمُ اللهُ فَيَجْعَلُهُمْ مِنْ أَهْلِهَا، أوْ يُذِلُّهُمْ فَيَدِينُونَ لَهَا، قُلْتُ فَيَكُوْنُ الدِّيْنُ كُلُّهُ ِللهِ، رواه أحمد بإسناد صحيح-

মিক্বদাদ বিন আসওয়াদ (রাঃ) বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছেন যে, ভূপৃষ্ঠে এমন কোন মাটির ঘর বা তাঁবু থাকবে না, যেখানে আল্লাহ ইসলামের বাণী পৌঁছে দিবেন না- সম্মানীর ঘরে সম্মানের সাথে এবং অসম্মানীর ঘরে অসম্মানের সাথে। অতঃপর আল্লাহ যাদেরকে সম্মানিত করবেন, তাদেরকে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণের যোগ্য করে দিবেন। আর যাদেরকে তিনি অসম্মানিত করবেন, তারা (জিযিয়া দানে) ইসলামের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হবে’। আমি বললাম, তাহ’লে তো দ্বীন পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যাবে’ (অর্থাৎ সকল দ্বীনের উপরে ইসলাম বিজয় লাভ করবে)। [7]

উক্ত হাদীছে ইসলামের বিশ্বব্যাপী প্রসারের সাথে সাথে তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক বিজয়ের ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। যা আরও পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিম্নোক্ত বাণীগুলিতে।-

রাজনৈতিক বিজয়ের ধারা

একদা মা আয়েশা (রাঃ) সূরায়ে ছফ-৯ আয়াতে[8] বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণী উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার ধারণা মতে আপনার আগমনের ফলে ইসলামের বিজয় পূর্ণতা লাভ করেছে। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন- إنَّهُ سَيَكُوْنُ مِنْ ذَلِكَ مَا شَآءَ اللهُ، رواه مسلم ‘ভবিষ্যতে এটা বাস্তবায়িত হবে যতটুকু আল্লাহ ইচ্ছা করবেন’।[9] তিনি আরও বলেন,

لاَ تَقُوْمُ السَّاعَةُ حَتَّى تَعُوْدَ أَرْضُ الْعَرَبِ مُرُوْجًا وَّ أَنْهَارًا، رواه مسلم- ‘ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না আরব উপদ্বীপ চারণভূমি ও নদীনালার দেশে রূপান্তরিত হবে’।[10] অন্য হাদীছে ইসলামের রাজনৈতিক বিজয়ের কালানুক্রমিক বর্ণনা দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে (১) নবুঅত থাকবে যতদিন আল্লাহ পাক ইচ্ছা করবেন, অতঃপর তা উঠিয়ে নিবেন। (২) এরপরে নবুঅতের তরীকায় খেলাফত কায়েম হবে। যতদিন ইচ্ছা আল্লাহ পাক সেটা রেখে দিবেন, অতঃপর উঠিয়ে নিবেন’।[11] অন্য বর্ণনায় এই খেলাফতের মেয়াদকাল স্পষ্টভাবেই চার খলীফার আমলের ৩০ বছরের কথা উল্লেখিত হয়েছে, যা ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত হয়ে গেছে’।[12] (৩) অতঃপর অত্যাচারী রাজাদের আগমন ঘটবে। আল্লাহ পাক যতদিন ইচ্ছা তাদেরকে বহাল রাখবেন। অতঃপর উঠিয়ে নিবেন। (৪) এরপর জবরদখলকারী শাসকদের আমল শুরু হবে। আল্লাহপাক যতদিন ইচ্ছা তাদেরকে বহাল রাখবেন। অতঃপর উঠিয়ে নেবেন। (৫) এরপরে নবুঅতের তরীকায় পুনরায় খেলাফত কায়েম হবে। এ পর্যন্ত বলার পরে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) চুপ হয়ে গেলেন’।[13]

উপরে বর্ণিত হাদীছের আলোকে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বিশ্বব্যাপী এখন নামে ও বেনামে অধিকাংশ দেশেই ৪র্থ যুগ অর্থাৎ জবরদখলকারী শাসকদের যামানা চলছে। গণতন্ত্রের নামে দলীয় স্বৈরাচার ও নেতৃত্বের লড়াই এখন ঘরে ঘরে ও অফিসের চার দেয়ালের মধ্যে প্রবেশ করেছে। ন্যায়নীতি ও ন্যায়বিচার সবকিছুই এ যুগে দলীয় শক্তিমানদের একচ্ছত্র অধিকারে। জাহেলী যুগের গোত্রদ্বন্দ্ব এখন নগ্ন রাজনৈতিক দলীয় দ্বন্দ্বে রূপ লাভ করেছে। বিশ্বের সর্বত্র যালেমদের জয়জয়কার চলছে, মযলূম মানবতা সর্বত্র কেঁদে ফিরছে।

পুঁজিবাদ, সমাজবাদ ও গণতন্ত্রের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানবতা আজ ব্যাকুল হয়ে চেয়ে আছে এক সর্বব্যাপী রেনেসাঁর দিকে, পূর্ণাঙ্গ সামাজিক বিপ্লবের দিকে, একটি নির্ভেজাল আদর্শ ও তার নির্ভেজাল অনুসারীদের দিকে। সেই আদর্শ আর কিছুই নয়- সে হ’ল ইসলাম। আল-হেরা ও আল-মদীনার ইসলাম, আল-কিতাব ও আল-হাদীছের ইসলাম। আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ ‘অহি’ ভিত্তিক শাশ্বত ইলাহী জীবনবিধান।

সেই জীবন বিধানের অতন্দ্র প্রহরী ও নির্ভেজাল অনুসারী হওয়ার দাবীদার হে আহলেহাদীছ জামা‘আত! উঠে এসো, জড়তা ঝেড়ে ফেল, অলসতার চাদর ছুঁড়ে ফেল, কুরআন ও ছহীহ  হাদীছের ঝান্ডা হাতে নিয়ে সকল অপবাদ ও ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে এগিয়ে চল। তুচ্ছ দুনিয়াবী স্বার্থ ও ভোগবিলাসের মায়া ছাড়। জান্নাত যে তোমায় ডাকছে বারবার হাতছানি দিয়ে, একবার তাকিয়ে দেখ। ঐ শোন তোমার পালনকর্তার স্নেহমিশ্রিত অমিয় বাণী-

يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ، قُمْ فَأَنْذِرْ، وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ، وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ، وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ، وَلاَ تَمْنُنْ تَسْتَكْثِرْ، وَلِرَبِّكَ فَاصْبِرْ- (مُدَّثِّر ১-৭)-

‘হে চাদরাবৃত! উঠে দাঁড়াও, লোকদেরকে জাহান্নামের ভয় দেখাও, তোমার প্রভুর মাহাত্ম্য ঘোষণা কর, তোমার পোষাককে (গুনাহের নাপাকী হ’তে) পবিত্র কর, (শিরকের) গুনাহ থেকে হিজরত কর, (দুনিয়ায়) অধিক পাওয়ার আশায় কাউকে কোন অনুগ্রহ করো না, তোমার পালনকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনে দৃঢ় থাক’ (মুদ্দাছছির ৭৪/১-৭)

অতএব, ওহে অলস মুসলিম সমাজ! আর কতকাল ঘুমিয়ে থাকবে, আর কতকাল কুটতর্কে সময় কাটাবে। তোমার ঘর-বাহির সব যে বিজাতীয়দের দখলে চলে গেল। তোমার তরুণদের মুখে বিজাতীয় শ্লোগান, তোমার নারীদের সর্বাঙ্গে ও তোমার গৃহের চার দেওয়ালে নগ্নতার হিংস্র ছোবল, তোমার খাদ্যের প্লেটে হারামের ক্রিমিকীট কিলবিল করছে। কোথায় তোমার সেই জিহাদী জায্বা, কোথায় সেই বালাকোট আর নারিকেলবাড়িয়ার জিহাদী হুংকার, কোথায় বিজাতীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তোমার তীব্র ঘৃণাবোধ যা আপোষহীন যুদ্ধ ঘোষণা করবে সূদ-ঘূষ-জুয়া-লটারীর হারামী অর্থনীতির বিরুদ্ধে, অহি-র বিধান বিরোধী যাবতীয় অপতৎপরতার বিরুদ্ধে। তওবা কর, পাপ-পংকিলতা ঝেড়ে ফেল। নবুঅতের তরীকায় খেলাফত কায়েমের চূড়ান্ত লক্ষ্যে জান-মাল বাজি রেখে সম্মুখ পানে এগিয়ে চল।

আসুন! আমরা সমাজ সংস্কারে ব্রতী হই! সাথে সাথে স্ব স্ব চরিত্র সংস্কারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করি। খেয়ানতকারী ও ফাসেকী চরিত্রের নেতৃত্বে জান্নাতী কাফেলার অগ্রযাত্রা সম্ভব নয়। সমাজে সর্বস্তরের মানুষ আল্লাহভীরু সৎ নেতৃত্বের মুখাপেক্ষী। আল্লাহর নিকটে দুর্বল মুমিনের চেয়ে শক্তিশালী মুমিন অধিক প্রিয়।[14] নির্দিষ্ট ইসলামী লক্ষ্যে নির্দিষ্ট ‘ইমারতের’ অধীনে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী একদল মুমিনকে একটি জামা‘আত’ বলা হয়। যার উপরে আল্লাহর বিশেষ রহমত থাকে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يَدُ اللهِ عَلَى الْجَمَاعَةِ ‘জামা‘আতের উপর আল্লাহর হাত রয়েছে’।[15]

তাই আসুন! আমরা আমাদের বিছিন্ন প্রতিভাগুলিকে, বিচ্ছিন্ন শক্তিগুলিকে একত্রিত করে অধিকতর শক্তিশালী জনশক্তিতে পরিণত হই। সর্বত্র ‘শক্তিশালী ও আমানতদার’ (الْقَوِيُّ الْأَمِينُ ) নেতৃত্ব[16] কায়েম করি। কেননা শক্তিশালী নেতৃত্ব যদি খেয়ানতকারী হয়, তাহ’লে সে সবকিছু খেয়ে হযম করে ফেলবে। পক্ষান্তরে আমানতদার নেতৃত্ব যদি দুর্বল হয়, তাহ’লে তার সাথীরাই তাকে ভক্ষণ করবে।

উদাত্ত আহবান

পরিশেষে আমরা আমাদের সম্মানিত আলেম সমাজ, সম্ভাবনাময় তরুণ ও যুব সমাজ, মণি-কাঞ্চনের উৎস সম্মানিতা মা-বোনদেরকে উপরে বর্ণিত সার্বিক প্রেক্ষাপট সামনে রেখে অন্যদের সাথে মিশে যাওয়ার আত্মঘাতী প্রবণতা পরিত্যাগ করে নিজস্ব আদর্শিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে নিজেদের মধ্যকার যাবতীয় সংকীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে আল্লাহর ওয়াস্তে আহলেহাদীছ আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নেওয়ার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।

فَبَشِّرْ عِبَادِ، الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ، أُوْلَئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللهُ وَأُوْلَئِكَ هُمْ أُولُوا الْأَلْبَابِ- ( زمر ১৭-১৮)-

‘হে রাসূল! আপনি জান্নাতের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন আমার ঐ সকল বান্দাকে, যারা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে ও তার মধ্যে সুন্দরগুলি অনুসরণ করে। তারাই হ’ল ঐসব বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত, যাদেরকে আল্লাহ হেদায়াত দান করেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে তারাই হ’ল জ্ঞানী’ (যুমার ৩৯/১৭-১৮)। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন। আমীন!!


[1]. হারুনুর রশীদ, খোলা চিঠি (ঢাকা : জুন ১৯৯৩), পৃঃ ৪৮-৪৯।

[2]. খোলা চিঠি, পৃঃ ৬১।

[3]. ‘ঈমান’-এর উপরে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের বক্তৃতার সিডির শেষাংশে উক্ত ভাষণটি সংযুক্ত করা হয়েছে। -প্রকাশক।

[4]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৭/৭ পৃ:।

[5]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৫৯ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ-৫।

[6]. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হ’তে, মুসনাদে আহমাদ, সনদ ছহীহ, মিশকাত-আলবানী হা/১৭০।

[7]. আহমাদ, সনদ ছহীহ, মিশকাত-আলবানী হা/৪২ ‘ঈমান’ অধ্যায়।

[8]. هُوَ الَّذِيْ أَرْسَلَ رَسُوْلَهُ بِالْهُدَى وَدِيْنِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّيْنِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ ‘তিনি তাঁর রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীন সহকারে প্রেরণ করেছেন। যাতে তাকে সকল দ্বীনের উপরে বিজয়ী রূপে প্রতিষ্ঠা দান করেন। যদিও মুশরিকগণ তা অপসন্দ করে থাকে’ (ছফ ৬১/৯।

[9]. মুসলিম হা/৭২৯৯ ‘ফিতান ও ক্বিয়ামতের আলামত’ অধ্যায় ১৭ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/৫৫১৯ ‘ফিতান’ অধ্যায় ৭ অনুচ্ছেদ।

[10].মুসলিম, মিশকাত হা/৫৪৪০ ‘ফিতান’ অধ্যায়, ‘ক্বিয়ামতের আলামত’ অনুচ্ছেদ-২।

[11]. আবুদাঊদ, তিরমিযী, আহমাদ হা/১৭৬৮০ ‘সনদ হাসান’।

[12]. আহমাদ, তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৫৩৯৫ ‘ফিতান’ অধ্যায়; ছহীহাহ হা/৪৫৯।

[13]. আহমাদ, মিশকাত হা/৫৩৭৮ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায় ‘ভয় প্রদর্শন ও সাবধান করা’ অনুচ্ছেদ-৮; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫।

[14]. মুসলিম, মিশকাত হা/৫২৯৮ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, ‘আল্লাহর উপরে ভরসা ও ধৈর্য’ অনুচ্ছেদ।

[15]. তিরমিযী, মিশকাত হা/১৭৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৮০৬৫।

[16]. নমল ২৭/৩৯, ক্বাছাছ ২৮/২৬।