তাক্বলীদের বিরোধিতায় চার ইমাম
(الأئمة الأربعة خلاف التقليد)
অনেকের ধারণা প্রসিদ্ধ চার ইমাম প্রচলিত চার মাযহাবের জন্মদাতা এবং তাঁরাই একমত হয়ে চার মাযহাবের যে কোন একটির অনুসরণ উম্মতের জন্য ফরয (?) করে গিয়েছেন। এমনকি ঈমান-একীনের মেহনতের নামে ‘চিল্লাহ’তে গিয়েও তাবলীগী ভাইয়েরা কবিতাকারে তাদের লোকদের ১৩০ ফরযের মধ্যে চার মাযহাবকেও চার ফরয হিসাবে তা‘লীম দিয়ে থাকেন ও মুখস্ত করিয়ে থাকেন।[1] নিম্নে প্রদত্ত মাননীয় ইমাম ছাহেবদের জন্ম-মৃত্যু সন ও তাঁদের উক্তিগুলি বিচার করলেই উপরের ধারণাগুলির অসারতা বুঝা যাবে।
এক নযরে চার ইমাম :
নাম |
জন্ম |
মৃত্যু |
প্রাপ্ত বয়স |
জন্মস্থান |
আবূ হানীফা নু‘মান বিন ছাবিত (রহঃ) |
৮০ হি:
|
১৫০ হি: |
৭০ বছর
|
ইরাকের কূফা নগরী |
মালিক বিন আনাস (রহঃ) |
৯৩ হি: |
১৭৯ হি: |
৮৬ বছর |
মদীনা শরীফ |
মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফেঈ (রহঃ) |
১৫০ হি: |
২০৪ হি: |
৫৪ বছর |
সিরিয়ার (বর্তমান ফিলিস্তীন) গাযা এলাকায় জন্ম, বসবাস মক্কায় |
আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) |
১৬৪ হি: |
২৪১ হি: |
৭৭ বছর |
বাগদাদ নগরী |
১. ইমাম আবু হানীফা (৮০-১৫০ হি:) বলেন,
إيَّاكم والقولِ فى دين الله تعالى بالرأىِ وعليكم باةباع السنةِ فَمَنْ خرج عنها ضَلَّ- ‘তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে নিজ নিজ রায় অনুযায়ী কথা বলা হ’তে বিরত থাক, তোমাদের জন্য সুন্নাতের অনুসরণ করা অপরিহার্য। যে ব্যক্তি সুন্নাতের অনুসরণ থেকে বেরিয়ে যাবে, সে পথভ্রষ্ট হবে।[2] তিনি আরও বলেন,
حرامٌ على مَنْ لم يَعْرِفْ دليلى أن يُّفْتِىَ بكلامى- ‘আমার কথা অনুযায়ী ফৎওয়া দেওয়া হারাম ঐ ব্যক্তির জন্য যে আমার গৃহীত দলীল সম্পর্কে অবগত নয়’।[3]
এখানে বুযর্গ ইমাম সকলকে তাঁর তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন এবং তাঁর গৃহীত দলীল যাচাই করে সেই অনুযায়ী ফৎওয়া দেওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন। তিনি তাঁর কথার নয় বরং দলীলের অনুসরণ করতে বলেছেন। যাকে ইত্তেবায়ে সুন্নাত বলা হয়, তাক্বলীদে ইমাম নয়।
অতঃপর ইমাম আবু হানীফার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা শ্রবণ করুন, তিনি বলেন, إذا صَحَّ الحديثُ فهو مذهبى ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমার মাযহাব’।[4] وكان إذا أَفْتَى يقولُ هذا رأى أبى حنيفةَ وهو أحسنُ ما قدَّرنا عليه فمن جاء بأحسنَ منه فهو أولَى بالصوابِ- ‘তিনি ফৎওয়া দিলে বলে দিতেন যে, এটি আবু হানীফার রায়। আমাদের সাধ্যপক্ষে এটিই উত্তম মনে হয়েছে। এর চেয়ে উত্তম পেলে সেটিই সঠিকতর বলে গণ্য হবে’।[5]
২. ইমাম মালিক (৯৩-১৭৯ হি:) বলেন,
إنما أنا بشر أُخطى وأصيب فانظُروا فى رائى فكلُّ ما وافقَ الكتابَ والسنةَ فخذُوه وكلُّ ما لم يُوَافِقْ فاتْرُكوه-
‘আমি একজন মানুষ মাত্র। আমি ভুল করি, সঠিকও বলি। অতএব আমার সিদ্ধান্তগুলি তোমরা যাচাই কর। যেগুলি কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী পাও, সেগুলি গ্রহণ কর, যেগুলি না পাও, সেগুলি পরিত্যাগ কর’।[6]
তিনি মূলনীতির আকারে বলেন,ما من أَحَدٍ إلا ومأخوذٌ من كلامه ومردودٌ عليه إلا رسولُ الله صلى الله عليه وسلم- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত দুনিয়াতে এমন কোন ব্যক্তি নেই, যার সকল কথা গ্রহণীয় অথবা বর্জনীয়।[7] অন্য বর্ণনায় এসেছে, إلا صاحبُ هذه الروضة ‘এই কবরবাসী ব্যতীত’।[8]
৩. ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪ হি:) বলেন,
إذا رأيتم كلامى يُخَالِفُ الحديثَ فاعْمَلُوا بالحديث واضْرِبُوا بكلامى الحائِطَ و قال يوماً للمُزَنِى يا إبراهيمُ لا تُقَلِّدْنى فى كلِّ ما أقولُ وانظُرْ فى ذالك لنفسك فانه دينٌ-
‘যখন তোমরা আমার কোন কথা হাদীছের বরখেলাফ দেখবে, তখন হাদীছের উপর আমল করবে এবং আমার কথাকে দেওয়ালে ছুঁড়ে মারবে’। তিনি একদা স্বীয় ছাত্র ইবরাহীম মুযানীকে বলেন, ‘হে ইবরাহীম! তুমি আমার সকল কথার তাক্বলীদ করবে না। বরং নিজে চিন্তা-ভাবনা করে দেখবে। কেননা এটা দ্বীনের ব্যাপার’।[9]
৪. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হি:) বলেন,
لا تُقَلِّدْنى ولا تُقَلِّدَنَّ مالكاً ولا الأوزاعِىَّ ولا النَّخْعِىَّ ولا غيرَهم و خُذِ الأحكامَ من حَيْثُ أَخذُوا من الكتابِ والسنةِ -
‘তুমি আমার তাক্বলীদ কর না। তাক্বলীদ কর না ইমাম মালেক, আওযাঈ, নাখ্ঈ বা অন্য কারও। বরং নির্দেশ গ্রহণ কর কুরআন ও সুন্নাহর মূল উৎস থেকে, যেখান থেকে তাঁরা সমাধান গ্রহণ করতেন’।[10]
মহামতি চার ইমামের উপরোক্ত বক্তব্য সমূহের পর আমরা দ্বাদশ শতকের ইমাম মুহাম্মাদ বিন আলী শাওকানী (১১৭২-১২৫০ হি:)-এর একটি আলোচনা উপহার দিয়েই অধ্যায়ের উপসংহার টানব ইনশাআল্লাহ। ইমাম শাওকানী (রহ:) বলেন,
و قد علم كل عالم أنهم (أى الصحابة والتابعين و تابعيهم) لم يكونوا مقلدين ولا منتسبين إلى فرد من أفراد العلماء بل كان الجاهل يسئل العالم عن الحكم الشرعى الثابت فى كتاب الله أو بسنة رسوله صلى الله عليه وسلم فيفةيه به و يرويه له لفظا أو معنى فيعمل بذلك من باب العمل بالرواية لا بالرأى و هذا أسهل من التقليد-
‘প্রত্যেক বিদ্বান এ কথা জানেন যে, ছাহাবা, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈন কেউ কারো মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। ছিলেন না কেউ কোন বিদ্বানের প্রতি সম্বন্ধযুক্ত। বরং জাহিল ব্যক্তি আলেমের নিকট থেকে কিতাব ও সুন্নাহ হ’তে প্রমাণিত শরী‘আতের হুকুম জিজ্ঞেস করতেন। আলেমগণ সেই মোতাবেক ফৎওয়া দিতেন। কখনও শব্দে শব্দে বলতেন, কখনও মর্মার্থ বলে দিতেন। সে মতে লোকেরা আমল করত (কুরআন ও হাদীছের) রেওয়ায়াত (বর্ণনা) অনুযায়ী, কোন বিদ্বানের রায় অনুযায়ী নয়। বলা বাহুল্য, কারও তাক্বলীদ করার চেয়ে এই তরীকাই সহজতর’।[11]
মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) বলেন,
ومن المعلوم أن الله تعالى ما كلَّف أحدا أن يكون حنفيا أو مالكيا أو شافعيا و حنبليا بل كلَّـــــــــــــــــــــــــــــــــــ৩، حقيقة الفقه ৮৫)-
‘এটা জানা কথা যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা কাউকে বাধ্য করেননি এজন্যে যে, সে হানাফী, মালেকী, শাফেঈ বা হাম্বলী হৌক। বরং বাধ্য করেছেন এজন্য যে, তারা সুন্নাত অনুযায়ী আমল করুক’। বলা বাহুল্য আহলেহাদীছ আন্দোলনের মূল কথা এটাই।
উপরের আলোচনা সমূহ হ’তে এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, বিগত কোন ইমামই পরবর্তীকালে সৃষ্ট বিভিন্ন মাযহাবী ফের্কাবন্দীর জন্য দায়ী ছিলেন না, বরং দায়ী আমরাই। যেমন হযরত ঈসা (আঃ)-কে ‘ইলাহ’ বানানোর জন্য তিনি দায়ী ছিলেন না। দায়ী ছিল পরবর্তীকালে তাঁর কিছু সংখ্যক তথাকথিত ভক্তের দল।
আল্লাহ পাক আমাদেরকে তাক্বলীদী সংকীর্ণতা হ’তে মুক্তি দিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর নিরপেক্ষ অনুসরণের মাধ্যমে নির্ভেজাল ইসলামী সমাজ কায়েমের তাওফীক দান করুন-আমীন![1]. ইঞ্জিনীয়ার মু.জু.আ. মজুমদার রচিত ‘এক মুবাল্লেগের পয়লা নোট বই’ (ঢাকা-৫, পপুলার প্রিন্টিং প্রেস, নিউমার্কেট, অক্টোবর ১৯৭৮) পৃঃ ৪৭।
[2]. আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী (৮৯৮-৯৭৩হিঃ) কিতাবুল মীযান (দিল্লী : আকমালুল মাতাবে, ১২৮৬ হিঃ) ১ম খন্ড, পৃঃ ৬৩, লাইন ১৮।
[3]. ঐ, লাইন ২২।
[4]. ইবনু আবেদীন, শামী রাদ্দুল মুহতার শরহ দুর্রে মুখতার (দেউবন্দ: ১২৭২হি:) ১/৪৬ পৃঃ ; ঐ, (বৈরুত: দারুল ফিক্র ১৩৯৯/১৯৭৯) ১/৬৭-৬৮ পৃঃ ; শা‘রানী, কিতাবুল মীযান ১/৬৬ পৃঃ ; লাক্ষ্ণৌবী, মুক্বাদ্দামা শরহ বেক্বায়াহ (দেউবন্দ ছাপা, তাবি) ১৪ পৃঃ ৬ষ্ঠ লাইন।
[5]. কিতাবুল মীযান, ১ম খন্ড ৬৩ পৃঃ ।
[6]. ইউসুফ জয়পুরী, হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ (বোম্বাই :পরিবর্ধিত সংস্করণ, তাবি) পৃঃ ৭৩।
[7]. শাহ ওয়ালিউল্লাহ, ইক্বদুল জীদ উর্দূ অনুবাদসহ(লাহোর: তাবি)৯৭ পৃঃ ৩য় লাইন।
[8]. কিতাবুল মীযান ১/৬৪ পৃঃ।
[9]. ইক্বদুল জীদ ৯৭ পৃঃ ৭ম লাইন।
[10]. ইক্বদুল জীদ, ৯৮ পৃঃ ৩য় লাইন।।
[11]. শাওকানী, আল-ক্বাওলুল মুফীদ (মিসরী ছাপা ১৩৪০/১৯২১ খৃ:), পৃঃ ১৫।