তাক্বলীদ-এর পরিণাম (عاقبة التقليد)
(১) তাক্বলীদের সর্বাপেক্ষা বড় কুফল হ’ল দলীল বিমুখতা। মুক্বাল্লিদ ব্যক্তি আলেম হউক বা জাহিল হউক, কুরআন ও হাদীছ হ’তে সরাসরি জ্ঞান আহরণ করার অধিকার তার থাকে না। তাকে স্বীয় ইমাম বা মাযহাবী ফৎওয়া অনুসারে কথা বলতে হয়। এই দলীল বিমুখতার ফলে প্রায় হাযার বছর পূর্বেকার বিভিন্ন ক্বিয়াসী সিদ্ধান্ত, যার কোন কোনটি কুরআন ও হাদীছের সরাসরি বিরোধী, ইসলামের নামে মুসলমানের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং যা আজও চলছে।
(২) তাক্বলীদের ফলে অনুসরণীয় ব্যক্তির প্রতি যেমন সৃষ্টি হয় অন্ধ ভক্তি, বিরোধী মতের প্রতি সৃষ্টি হয় তেমনি অন্ধ বিদ্বেষ। আর এর ফলেই সৃষ্টি হয় পারস্পরিক বিভেদ ও দলাদলি। এক ও অখন্ড মুসলিম মিল্লাত বিভিন্ন মাযহাবী দল ও উপদলে বিভক্ত হওয়ার মূল কারণ হ’ল এই তাক্বলীদ। ৬৫৬ হিজরীতে বাগদাদের ইসলামী খেলাফতের নির্মম পরিণতি, ৮০১ হিজরীতে সৃষ্ট কা‘বা শরীফে চার মাযহাবের জন্য চার মুছাল্লা কায়েমের বিদ‘আত এবং আজও মুসলিম সমাজে বিভিনণ ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ে যে পারস্পরিক অনৈক্য বিরাজ করছে, তার অধিকাংশেরই মূল কারণ হ’ল তাক্বলীদী অসহিষ্ণুতা। এক্ষণে আমরা যদি সত্যিকার অর্থে মুসলিম ঐক্য কামনা করি, তাহ’লে প্রত্যেকের সকল যিদ ও অহমিকা ছেড়ে দিয়ে শরী‘আতের আওতাধীন জীবনের সকল ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্তকে নিঃশর্তভাবে মেনে নিতে হবে। আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদেশ-নিষেধকে বিনাশর্তে গ্রহণ করার একটিমাত্র শর্ত যদি আমরা পূরণ করতে পারি, তাহ’লে ইনশাআল্লাহ শতধা বিচ্ছিন্ন মুসলিম উম্মাহ পুনরায় একটি অখন্ড মহাজাতিতে পরিণত হবে। বলা বাহুল্য, যুগে যুগে আহলেহাদীছ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য সেটাই।
(৩) তাক্বলীদের অনুসারী ব্যক্তি স্পষ্ট ছহীহ হাদীছ পাওয়া সত্ত্বেও তা মানতে পারেন না কেবল এই কারণে যে, হাদীছটি তাঁর মাযহাবের অনুকূলে নয়। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছের উপরে বিদ্বানগণের সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দানকারী ব্যক্তি কখনোই মুমিন হ’তে পারে না (নিসা ৪/৬৫)।
(৪) মুক্বাল্লিদ ব্যক্তি এক ইমামের তাক্বলীদ কতে গিয়ে বাস্তবে অসংখ্য বিদ্বানের মুক্বাল্লিদ হয়ে পড়েন। ফলে বিনা দলীলে ফৎওয়া গ্রহণের সুযোগে ধর্মের নামে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে রকমারি শিরক ও বিদ‘আত। অথচ যার নামে মাযহাবী ফৎওয়া প্রদান করা হচ্ছে, গবেষণায় দেখা যাবে যে, তিনি এ সবের নাড়ী-নক্ষত্রও খবর রাখেন না।[1]
(৫) তাক্বলীদের সর্বাপেক্ষা মারাত্মক পরিণতি হ’ল ইজতিহাদ বা শরী‘আত গবেষণার দুয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া। যেমন বাহরুল উলূম আবদুল আলী লাক্ষ্ণৌবী (মৃ: ১২২৫হিঃ/১৮১০খৃঃ) বলেন,
و اما الاجتهاد المطلق فقالوا اختتم بالأئمة الأربعة حتى اوجبوا تقليد واحد من هؤلاء على الأمة و هذا كله هوس من هوساتهم لم يأتوا بدليل ولايُعْبأ بكلامهم-
অর্থঃ ‘তারা বলেন, মুৎলাক্ব ইজতিহাদ ইমাম চতুষ্টয় পর্যন্ত শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন এঁদের যে কোন একজনের তাক্বলীদ করা উম্মতের উপর ওয়াজিব। অথচ এ সব কথা লোকদের খোশখেয়াল মাত্র। এ সবের কোন দলীল তারা পেশ করেনি এবং তাদের কথার কোন তোয়াক্কা করা যাবে না’।[2] অতএব অনাগত ভবিষ্যতের অসংখ্য সমস্যার সমাধান হিসাবে ইসলামকে পেশ করতে হ’লে ‘ইজতিহাদ’ যে অবশ্যই যরূরী, সে কথা যে কোন নিরপেক্ষ বিদ্বান এক বাক্যে স্বীকার করবেন আশা করি।[1] . যেমন মুহাম্মাদ আল-মুঈন সিন্ধী বলেন,
وليس كل ما يُنسَب إليهم (أى الائمة الأربعة) من القياسات البعيدة التى تشبه التشريع الجديد و يُنقَل فى كتب مذهبهم فهو ثابت النسبة إليهم بل أكثر ذالك أو كله مما ارتكبه من غلب عليه الرأى من أتباعهم الخ-
‘চার ইমামের দিকে সম্বন্ধ করে মাযহাবী কিতাবসমূহে যে সকল দূরতম ক্বিয়াসী মাসআলা বর্ণনা করা হয়েছে, যা নতুন শরী‘আত রচনার শামিল, তা প্রমাণিত নয়। বরং তার অধিকাংশ কিংবা সবটুকুই তাঁদের অনুসারীদের নিজস্ব রায় মাত্র’। -দিরাসাতুল লাবীব (লাহোর : বায়তুস সালত্বানাহ ১২৮৪/১৮৬৮ খৃঃ) পৃঃ ১৫৬। বরং ইবনু দাক্বীকুল ঈদ (মৃ: ৭০২হি:) বলেন, نسبة هذه المسائل إلى الأئمة المجتهدين حرام ‘এই মাসআলাগুলি মুজতাহিদ ইমামহগণের প্রতি সম্বন্ধ করা হারাম’ (ঈক্বাযু হিমাম, পৃঃ ৯৯)।
[2]. আবদুল আলী. ফাওয়াতেহুর রাহমূত শরহ মুছাল্লামুছ ছুবূত (লাক্ষ্ণৌ: নওলকিশোর প্রেস ১২৯৫/১৮৭৮ খৃঃ) পৃঃ ৬২৪।