ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার উপায়
(طريق إقامة الخلافة الإسلامية)
মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য হ’ল আল্লাহর ইবাদত করা, অর্থাৎ সার্বিক জীবনে তাঁর দাসত্ব করা। ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হ’ল পূর্ণ নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততার মধ্যে যাতে আল্লাহর ইবাদত সহজতর হয়। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একজন মুসলমান তার ব্যক্তি জীবনে স্বাধীন থাকলেও সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সে অনৈসলামী আইনে শাসিত হয় এবং মানুষের দাসত্ব করতে বাধ্য হয়। সূদ-ঘুষের পুঁজিবাদী অর্থনীতি কিংবা সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ অনুসরণের ফলে মুমিনের রূযী হারাম রূযীতে পরিণত হয়। অন্যদিকে দেশের আদালতগুলিতে ইসলামী বিধান অনুযায়ী বিচার ব্যবস্থা না থাকায় সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতা ব্যাহত হয়। আর এ সকল কারণেই একজন মুমিনকে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠায় সর্বদা তৎপর থাকতে হয়। এক্ষণে ইসলামী খেলাফত কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তার উপায়গুলি মোটামুটি দু’ভাগে ভাগ করা যায়। - বস্ত্তগত ও নৈতিক ।
১. বস্ত্তগত উপাদান (الأسباب المادية) : এ বিষয়ে প্রথম প্রয়োজন-
(ক) ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা : আল্লাহ বলেন, وَاعْتَصِمُواْ بِحَبْلِ اللّهِ
جَمِيْعاً وَّلاَ تَفَرَّقُوْا ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে সমবেতভাবে আঁকড়িয়ে ধর এবং দলে দলে বিভক্ত হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)।
(খ) ঝগড়া পরিহার করা : আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَنَازَعُواْ فَتَفْشَلُواْ وَتَذْهَبَ رِيْحُكُمْ وَاصْبِرُوْا ‘আপোষে ঝগড়া করো না, তাহ’লে হিম্মত হারিয়ে ফেলবে এবং তেজ উবে যাবে। আর তোমরা ছবর কর’ (আনফাল ৮/৪৬)।
(গ) অলসতা পরিহার করা : وَلاَ تَهِنُوْا وَلاَ تَحْزَنُوْا وَأَنتُمُ الأَعْلَوْنَ إِنْ كُنتُم مُّؤْمِنِيْنَ ‘অলস হয়ো না, শংকিত হয়ো না, তোমরাই বিজয়ী, যদি তোমরা মুমিন হও’ (আলে ইমরান ৩/১৩৯)।
(ঘ) আমীরের আনুগত্য করা : আল্লাহ বলেন, أطِيْعُوا الله وَأَطِيْعُوا الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنْكُمْ ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের ও তোমাদের আমীরের আনুগত্য কর’ (নিসা ৪/৫৯)।
(ঙ) দৃঢ়পদে সংগ্রাম করা : আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِذَا لَقِيْتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوْا ‘হে বিশ্বাসীগণ! লড়াইয়ের সময় দৃঢ় কদম থাক’ (আনফাল ৮/৪৫)।
(চ) শক্তি অর্জন করা : وَأَعِدُّوْا لَهُمْ مَّا اسْتَطَعْتُمْ مِّنْ قُوَّةٍ وَّمِن رِّبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِينَ مِنْ دُونِهِمْ لاَ تَعْلَمُونَهُمُ اللَّهُ يَعْلَمُهُمْ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فِيْ سَبِيلِ اللَّهِ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لاَ تُظْلَمُوْنَ- ‘তাদের বিরুদ্ধে তোমরা সাধ্যপক্ষে শক্তি সঞ্চয় কর, ঘোড়া ইত্যাদি উপকরণের মাধ্যমে। এর দ্বারা তোমরা ভয় দেখাও আল্লাহর শত্রুদের ও তোমাদের শত্রুদের এবং তাদের বাইরে অন্যদের, যাদের তোমরা জানো না। আল্লাহ তাদের জানেন। আর যা তোমরা আল্লাহর পথে খরচ করবে, তা পুরোপুরি তোমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবেনা’ (আনফাল ৮/৬০)।
২. নৈতিক উপাদান (الأسباب الروحانية) ঃ
(ক) ধৈর্যশীলতা ও (খ) আল্লাহভীরুতা: আল্লাহ বলেন,
إِنْ تَصْبِرُوْا وَتَتَّقُوْا وَيَأْتُوْكُم مِّنْ فَوْرِهِمْ هَـذَا يُمْدِدْكُمْ رَبُّكُمْ بِخَمْسَةِ آلافٍ مِّنَ الْمَلآئِكَةِ مُسَوِّمِيْنَ -
‘যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর ও আল্লাহভীরু থাক, তবে ওরা তোমাদের দিকে অতর্কিতে এগিয়ে এলে তোমাদের প্রভু তোমাদেরকে সাহায্য করবেন পাঁচ হাযার চিহ্নিত ফেরেশতা দ্বারা’ (আলে ইমরান ৩/১২৫)।
(গ) দৃঢ়চিত্ততা : إنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْةَقاَمُوْا ةَةَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلاَئِكَةُ ‘নিশ্চয়ই যারা বলে ‘আমাদের প্রভু আল্লাহ’ এবং এ কথার উপরে দৃঢ়চিত্ত থাকে, তাদের উপরে রহমতের ফেরেশতাগণ নাযিল হবে’ (হামীম সাজ্দাহ ৪১/৩০)।
(ঘ) ঈমান ও (ঙ) সৎকর্মশীলতা : وَعَدَ اللَّهُ الَّذِيْْنَ آمَنُوْا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ ‘আল্লাহ তা‘আলা ওয়াদা করেছেন তোমাদের মধ্যকার ঐ সব লোকদের যারা দৃঢ় বিশ্বাসী হয় এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে। তাদেরকে তিনি অবশ্যই পৃথিবীতে শাসন কর্তৃত্ব দান করবেন’ (নূর ২৪/৫৫)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সময়ে আরবে ইসলামী খেলাফত কায়েমের পিছনে উপরোক্ত দু’টি কারণ বিদ্যমান ছিল। ইমাম ইবনে তায়মিয়াহর মতে ‘তৎকালীন আরবরা একটি বিজয়ী শক্তির গুণাবলীতে ভূষিত ছিল’। বস্ত্তগত উপাদানে তারা অন্যদের তুলনায় যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। কিন্তু নৈতিকতার মান তাদের দারুণ নীচু ছিল। তাদের মধ্যে বে-ঈমানী, চরিত্রহীনতা ও দলাদলি ছিল। কিন্তু এসব ত্রুটিগুলি পরে ইসলামের বরকতে বিদূরিত হয়ে যায়।
এইভাবে বস্ত্তগত ও নৈতিক উপাদানে বলীয়ান হওয়ার পরেই আল্লাহ পাক তাদের উপরে পুরষ্কার অথবা পরীক্ষা স্বরূপ ইসলামী খেলাফত পরিচালনার গুরুভার ন্যস্ত করেন। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
উপরোক্ত দু’টি উপাদান অর্জিত হওয়ার সাথে সাথে বাড়তি আরেকটি কারণ ঐ সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। সেটি হ’ল ঐ সময়ে জগতে নেতৃত্ব দানকারী শক্তিগুলি তাদের নৈতিক বল হারিয়ে ফেলেছিল এবং জনসাধারণ তাদের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হ’য়ে পড়েছিল।[1]
উপরোক্ত আলোচনায় এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য নৈতিক ও বস্ত্তগত উভয়বিধ উপাদান অবশ্য প্রয়োজনীয়। বস্ত্তগত উপাদানে দু’টি শক্তি সমান হ’লে সে ক্ষেত্রে নৈতিক শক্তিতে অধিকতর বলীয়ান দলটিই জয়লাভ করবে। সূরায়ে নূর-এ উল্লেখিত আয়াতে ইসতিখলাফ-এর মধ্যেও ‘ঈমান’ ও ‘আমলে ছালেহ’-কে খেলাফত প্রাপ্তির পূর্বশর্ত হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যারা মনে করেন শুধুমাত্র দো‘আর মাধ্যমেই দেশে ইসলামী হুকূমত কায়েম হয়ে যাবে অথবা যারা ভাবেন ক্ষমতা দখলের মাধ্যমেই কেবল ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব, এরা উভয়েই দুই চরমপন্থী ধারণার শিকার হয়েছেন। বরং যে দেশে আমরা ইসলামী আইন জারী করতে চাই, সে দেশের জনগণের মন-মানসিকতাকে আগে নির্ভেজাল ইসলামী ছাঁচে গড়ে নিতে হবে। ইসলামের প্রকৃত বুঝ হাছিল হয়ে গেলে তাদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা অবশ্যই ইসলামী খেলাফত হবে ইনশাআল্লাহ।
বলাবাহুল্য উপরের এই নিয়মটি কেবল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, বরং অন্যান্য আদর্শবাদী রাষ্ট্রের বেলায়ও এ নিয়মের বাস্তবতা দেখা গিয়েছে। ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, চীনা বিপ্লব সব কিছুর পূর্বে একদল নিবেদিতপ্রাণ আদর্শবাদীকে আমরা দেখেছি বছরের পর বছর ধরে নিরলসভাবে সে সব দেশের জনগণের মন-মগজ তৈরী করতে। এভাবে সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমেই রাষ্ট্র বিপ্লব সংঘটিত হয়ে থাকে।
বর্তমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ তার পুরাতন আদল পাল্টিয়ে আদর্শিক সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হযেছে। ধর্ম ও আদর্শ প্রচারের স্বাধীনতার সুযোগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিভিন্ন বস্ত্তগত সুযোগ-সুবিধা সহ ধর্মের মিঠা বুলি শুনিয়ে তারা এদেশের গরীব জন সাধারণকে ধর্মান্তরিত করে চলেছে। দু’দিন পরে সংখ্যা কিছু বাড়লে তাদের জন্য আলাদা একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশ কিংবা স্বাধীন ভূখন্ড দাবী করা মোটেও বিচিত্র নয়।[2]
অন্যদল এদেশের মুসলিম তরুণ ও বুদ্ধিজীবীদেরকে আদর্শচ্যুত করে চলেছে। যদিও ঐসব তরুণ ও বুদ্ধিজীবীরা এদেশে মুসলিম হিসাবেই পরিচিত। উদ্দেশ্য একটাই এ দেশীয় সেবাদাসদের মাধ্যমে নতুন কায়দায় বিদেশী শাসন-শোষণ কায়েম রাখা। লেবাননে মুসলিম-খৃষ্টান দ্বন্দ্ব, শ্রীলঙ্কায় সিংহলী-তামিল দ্বন্দ্ব, আফগানিস্তানে মুজাহিদ-কম্যুনিষ্ট যুদ্ধ এরই প্রমাণ বহন করে। অমনিভাবে এদেশীয় তরুণদের মুখে ও দেওয়ালের ভাষায় বিদেশী আদর্শের পরস্পর বিরোধী শ্লোগান ও তাদের পরিবেশিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলি পরিষ্কারভাবে বিদেশী গোলামীর স্বাক্ষর বহন করে। এমতাবস্থায় আমরা যদি নির্ভেজাল তাওহীদ ও ছহীহ সুন্নাহর ভিত্তিতে আমাদের দাওয়াতী ও সাংগঠনিক প্রচেষ্টা যোরদার না করি, তাহ’লে এমন দিন আর বেশী দূরে নয়, যেদিন আমরা আমাদের দেশেই বিদেশী কারাগারে বন্দী হব কিংবা নিজেদের ভাইদের হাতে বিদেশী বন্দুকের খোরাক হব।[1]. উপরোক্ত আলোচনায় আমরা শায়খুল হাদীছ মু হাম্মাদ গোন্দলবী (গুজরানওয়ালা, পাকিস্তান) কৃত ‘তানক্বীদুল মাসায়েল’ বই থেকে সাহায্য নিয়েছি।- লেখক।
[2]. ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমূর যার বাস্তব প্রমাণ। সাহায্য দানের মুখোশে গরীব মুসলমানদের খৃষ্টান বানিয়ে এবং সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উসকে দিয়ে অবশেষে ২০ মে ২০০২ সালে এ প্রদেশটিকে ইন্দোনেশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক স্বাধীন ‘রাষ্ট্র’ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।