একটি শিক্ষণীয় ঘটনা
ছিফ্ফীন যুদ্ধে মীমাংসার জন্য হযরত আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ) উভয় পক্ষের দু’জনকে শালিশ নির্বাচন করেন। এই শালিশ নির্বাচনকে হযরত আলী (রাঃ)-এর সৈন্যদের একটি বিরাট অংশ ‘কুফরী’ ধারণা করে বসল। তারা আলী ও মু‘আবিয়া উভয়কে কাফির (নাঊযুবিল্লাহ) গণ্য করে উভয়কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আলী (রাঃ) তখন বাধ্য হয়ে এই দলত্যাগী (খারেজীদের) বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন ও তাদের নির্মূল করে দেন। এই সময়কার ঘটনায় হযরত আলীর নিকট হ’তে অনুমতি নিয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) খারেজীদের নিকট গমন করেন ও তাদের মনোভাব পরিবর্তনের শেষ চেষ্টা করেন। ইবনে আববাসের নিকট তখন খারেজীরা তিনটি অভিযোগ পেশ করে। -
১. আলী (রাঃ) কেন দ্বীনী ব্যাপারে মানুষকে শালিশ সাব্যস্ত করলেন? অথচ আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন إِنِ الْحُكْمُ إِلاَّ لِلّهِ ‘আল্লাহ ছাড়া কারও হুকুম দেয়ার অধিকার নেই’ (ইউসুফ ১২/৪০)।
২. তিনি প্রতিপক্ষকে গালিও দেন না, তাদের মাল-সম্পদও লুট করেন না। যদি মু‘আবিয়ার দল কাফির হয়, তবে তাদের মাল হালাল। আর যদি মুমিন হয়, তবে তাদের রক্ত হারাম।
৩. শালিশনামা লেখার সময় আলীকে ‘আমীরুল মুমিনীন’ (মুমিনদের নেতা) লেখা হয়নি। তা হ’লে নিশ্চয়ই তিনি আমীরুল কাফেরীন (কাফিরদের নেতা) হবেন।’
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) যিনি অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছাহাবী ছিলেন, সংক্ষেপে যুক্তিপূর্ণ ভাষায় উপরের প্রশ্নগুলির যে জওয়াব দিয়েছিলেন, তা আমাদের সবারই জন্য শিক্ষণীয় বিষয়।
উক্ত জওয়াবগুলি ছিল নিম্নরূপ :-
১. যদি কেউ ইহরাম অবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে কোন প্রাণী শিকার করে, তাহ’লে তাকে অনুরূপ একটি প্রাণী বদলা দিতে হবে। প্রাণীটি পূর্বের প্রাণীর অনুরূপ কি-না, তা যাচাইয়ের জন্য দু’জন ন্যায়নিষ্ঠ লোককে মধ্যস্থ নিযুক্ত করতে হবে। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, يَحْكُمُ بِهِ ذَوَا عَدْلٍ مِّنْكُمْ (মায়েদা ৫/৯৫)। অমনিভাবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গন্ডগোল হ’লে দু’পক্ষের দু’জনকে শালিশ নিয়োগের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوْا حَكَماً مِّنْ أَهْلِهِ وَحَكَماً مِّنْ أَهْلِهَا- (নিসা ৪/৩৫)।
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) উপরোক্ত দু’টি আয়াতের বরাত দিয়ে খারেজীদেরকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলেন, ইহরাম অবস্থায় শিকার করা খরগোশ যার মূল্য সিকি দিরহামও নয়, তার জন্য শালিশ নিয়োগ করার চাইতে মুসলমানদের জানমালের হেফাযতের জন্য একটি বৈষয়িক ব্যাপারে মীমাংসার উদ্দেশ্যে শালিশ নিয়োগ করা কি অধিকতর যুক্তি সংগত নয়? তারা বলল, হ্যাঁ।
২. তোমাদের দ্বিতীয় প্রশ্নের জওয়াব এই যে, তোমরা কি তাহ’লে মা আয়েশাকেও (যিনি হযরত আলীর বিরুদ্ধে ‘জামাল যুদ্ধে’ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন) গালি দিবে? তাঁকেও কি কাফের বলবে? (ইন্নালিল্লাহ)। তারা ভুল স্বীকার করল।
৩. তোমরা কি হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে দেখোনি যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে ‘রাসূলুল্লাহ’ শব্দ কেটে দিয়ে সন্ধিপত্রে শুধুমাত্র ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’ লিখতে হযরত আলীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। খারেজীরা তাদের ভুল স্বীকার করল এবং বিশ হাযার লোক তওবা করে ফিরে এল। মাত্র চার হাযার রয়ে গেল। যারা যুদ্ধে হতাহত হ’ল।[1]
উপরোক্ত ঘটনায় একথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ছাহাবায়ে কেরাম রাজনৈতিক বিষয়কে ধর্মীয় গন্ডির মধ্যে টেনে আনেননি। তাঁদের যা গন্ডগোল রাজনৈতিক ও বৈষয়িক ব্যাপারেই ছিল, ধর্মীয় ব্যাপারে নয়। আর রাজনৈতিক বা বৈষয়িক ব্যাপারে মতবিরোধ এমনকি পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে কেউ কাউকে ‘কাফির’ বলতেন না। মরলে ‘শহীদ’ বাঁচলে ‘গাযী’ হবার গৌরব করতেন না। সাবাঈ, শী‘আ, খারেজী এই ধরনের কিছু লোক রাজনৈতিক বিষয়গুলিকে ধর্মীয় বিষয়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে মুসলমানদের মধ্যে ফিৎনার সৃষ্টি করেছিল মাত্র। আজও কিছু লোক সে ফিৎনার মধ্যে রয়েছে।[1]. মীর ইবরাহীম শিয়ালকোটি, তারীখে আহলেহাদীছ (নয়াদিল্লী : ১৯৮৩) পৃঃ ৪৬; গৃহীত: ফাওয়াতেহুর রাহমূত (গাযযালীর মুসতাছফা সহ) ২য় খন্ড ৩৮৮ পৃঃ।