কয়েকটি দলীল
সকল বিষয়ে শরী‘আতের স্পষ্ট হেদায়াত মওজুদ থাকলেও মানবজীবনের একটি বিরাট অংশকে শরী‘আতের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। যেখানে মানুষ নিজ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা মতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। একেই দুনিয়াবী জীবন বলা হয়। যারা নাস্তিক তারা মানুষের ধর্মীয় জীবনকে অস্বীকার করে বলে, إِنْ هِيَ إِلاَّ حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوْتُ وَنَحْيَا وَمَا نَحْنُ بِمَبْعُوْثِيْنَ ‘এই দুনিয়াবী জীবনের বাইরে কিছু নেই। এখানে আমরা মরি ও বাঁচি। আমাদের পুনরুত্থান হবে না’ (মুমিনূন ২৩/৩৭)। পক্ষান্তরে আলোচ্য দর্শন এর উল্টো দুনিয়াবী জীবনকে অস্বীকার করে মানুষের সার্বিক জীবনকে ধর্মীয় জীবন গণ্য করেছে। অথচ ইসলামের নবী (ছাঃ) এর বিপরীত হেদায়াত দিয়েছেন। যেমন- (১) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) মদীনায় হিজরত করে দেখলেন যে, মদীনাবাসীগণ পুং খেজুরের ফুলের রেণু নিয়ে মাদী খেজুরের ফুলের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। তাতে খেজুরের ফলন ভাল হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই নিয়ম পসন্দ করলেন না। ফলে লোকেরা এটা বাদ দিল। দেখা গেল ফলন দারুণভাবে কম হ’ল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের বললেন,
إنما أنا بشرٌ إذا أمرتُكم بشىء من أمر دينكم فخُذُوا به وإذا أمرتُكم بشئ من رأيى فإنما أنا بشرٌ، رواه مسلم-
‘নিশ্চয়ই আমি একজন মানুষ। যখন আমি তোমাদেরকে দ্বীনী বিষয়ে হুকুম দেব, তখন তোমরা সেটা অবশ্যই পালন করবে। কিন্তু যখন আমি আমার রায় অনুযায়ী কোন নির্দেশ দিব, তখন নিশ্চয়ই আমি একজন মানুষ মাত্র’।[1]
(২) হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর মুক্ত দাসী বারীরাহ্ তার স্বামী মুগীছ থেকে মুক্ত হ’তে চায়। বেচারা মুগীছ মদীনার অলিতে-গলিতে বারীরাহ্কে ফিরে পাওয়ার জন্যে কেঁদে বুক ভাসায়। দয়ার নবী এই দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে বারীরাহকে ডেকে বললেন, لو راجعته ‘আহ্! যদি তুমি স্বামীর কাছে ফিরে যেতে’? বারীরাহ্ জওয়াবে বলল, হে রাসূল (ছাঃ)! أتأمرنى ‘আপনি কি আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, إنما أشفَعُ ‘না আমি মুগীছের জন্য তোমার নিকট সুফারিশ করছি মাত্র’। বারীরাহ্ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিল, لا حاجة لى فيه ‘তার কাছে আমার কোন প্রয়োজন নেই’। বুঝা গেল নবীর উক্ত সুফারিশ রাসূল হিসাবে কোন দ্বীনী নির্দেশ ছিল না। নইলে তো বারীরাহকে অবশ্যই তা মেনে নিতে হ’ত। কিন্তু আসলে এ সুফারিশ ছিল একজন দরদী মানুষ হিসাবে, যা গ্রহণ করা না করার ব্যাপারে বারীরাহর স্বাধীনতা ছিল। প্রকাশ থাকে যে, বারীরাহর এই ঘটনাটি বুখারী শরীফে বিভিন্ন প্রসঙ্গে পuঁচশ জায়গায় এসেছে।[2]
(৩) বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামরিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের নিকট পরামর্শ নিতেন। এই পরামর্শ পুরোপুরি সমতার ভিত্তিতে হ’ত। কখনো নিজের মতে, কখনও ছাহাবায়ে কেরামের মতের উপরে সিদ্ধান্ত হ’ত। একটি বর্ণনা অনুযায়ী মোট তেইশটি ঘটনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চাইতে হযরত ওমরের রায় সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি হ’ল বদরের যুদ্ধে বন্দী কাফিরদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে। হযরত ওমর (রাঃ) স্ব স্ব আত্মীয় কর্তৃক সকল শত্রুকে হত্যা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু আবুবকর (রাঃ) তাদেরকে রক্তমূল্যের বিনিময়ে ছেড়ে দিতে বলেন। আল্লাহর নবী (ছাঃ) আবুবকরের পরামর্শ গ্রহণ করে সবাইকে রক্তমূল্যের বিনিময়ে মুক্ত করে দিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই আয়াত নাযিল করে আল্লাহ ওমরের রায়কেই সমর্থন করলেন।
হযরত ওমরের দৃষ্টিভঙ্গি এখানে পুরো রাজনৈতিক ছিল। তিনি শত্রুসৈন্যকে বন্দী না করে প্রথম সুযোগেই খতম করে দিতে চেয়েছিলেন। আল্লাহ সেটাই পসন্দ করেছিলেন। ফলে مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَنْ يَكُونَ لَهُ أَسْرَى حَتَّى يُثْخِنَ فِي الْأَرْضِ تُرِيدُونَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللَّهُ يُرِيدُ الْآخِرَةَ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ অর্থ: ‘দেশে ব্যাপকভাবে শত্রুকে পরাভূত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোন নবীর জন্য সংগত নয়। তোমরা চাও পার্থিব সম্পদ, আল্লাহ চান পারলৌকিক কল্যাণ। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (আনফাল ৮/৬৭) আয়াতটি নাযিল হওয়ার সাথে সাথে আল্লাহর নবী ও হযরত আবুবকর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
এ সকল ঘটনা একথাই প্রমাণ করে যে, মানুষ তার বৈষয়িক জীবনে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যতক্ষণ না সেখানে কোন শারঈ হুকুম মওজূদ থাকে। সে রাজনৈতিক ব্যাপারে যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যে কোন আইন রচনা করতে পারে। কিন্তু উদাহরণ স্বরূপ সার্বভৌম ক্ষমতা আল্লাহর বদলে জনগণকে কিংবা জনগণের নামে পার্টির বা সরকারের কুক্ষিগত করা চলবে না। সূদের হারামকে হালাল করে অর্থনৈতিক আইন চালু করতে পারবে না। জুয়া-লটারী-হাউজী-মওজূদদারী, মুনাফাখোরী, ঘুষখোরীর প্রচলন ঘটাতে পারবে না। কারণ তা করলে শরী‘আতের সীমা লংঘন করা হবে।[1]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৪৭ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।
[2]. বুখারী হা/৫২৮৩ ‘তালাক’ অধ্যায় ১৬ অনুচ্ছেদ; হা/২৭২৬ ‘শর্তসমূহ’ অধ্যায় ১০ অনুচ্ছেদ ও অন্যান্য; মিশকাত হা/৩১৯৯, ‘বিবাহ’ অধ্যায় ৬ অনুচ্ছেদ।