হাদীছের প্রতি সন্দেহবাদ:
বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রচারিত অতি যুক্তিবাদী এই দর্শনটি ইসলামী আইনের দ্বিতীয় উৎস হাদীছ শাস্ত্র সম্পর্কে সন্দেহবাদ আরোপ করেছে । এবং পরবর্তীকালে রচিত ভুল-শুদ্ধ পারস্পরিক ইখতেলাফে ভরা ফিক্বহ শাস্ত্রকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীছের উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে চেষ্টা করেছে। এমনকি আল্লাহর কিতাবের পরে দুনিয়ার বিশুদ্ধতম হাদীছ গ্রন্থ বুখারী শরীফ সম্পর্কে কথা বলতেও এই আধুনিক দর্শন মোটেই পিছপা হয়নি। যেমন বলা হয়েছে,
كوئى شريف آدمى يه نهيں كه سكتا که حديث كا جو مجموعه هم تك پهونچا هــے وه قطعى طور پر صحيح هـے- مثلاً بخارى جسكے بارے ميں أصح الكتب بعد كتاب الله كها جاتا هـے، حديث ميں كوئـۍ بڑے سے بڑا غلو كرنيوالا بهى يه نهيں که سكتا که اس ميں جو چهـ سات هزار احاديث درج هيں وه سارى كى سارى صحيح ھے-
‘কোন শরীফ লোক এ কথা বলতে পারে না যে, হাদীছের যে সমষ্টি আমাদের নিকট পৌঁছেছে তার সবটা অকাট্যভাবেই ছহীহ? উদাহরণ স্বরূপ বুখারী শরীফ, যাকে আল্লাহর কেতাবের পরে সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধতম কেতাব বলা হয়, হাদীছের অতি বড় ভক্তও এ কথা বলতে পারে না যে, এর মধ্যে যে ছয়-সাত হাযার হাদীছ সংকলিত আছে, তার সবটাই ছহীহ’।[1] (নাঊযুবিল্লাহ)। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। কেবল ভারতগুরু শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রহঃ)-এর একটি উক্তি উপহার দিয়েই প্রসংগের ইতি টানতে চাই। তিনি বলেন,
أما الصحيحان فقد اتفق المحدثون على أن جميع ما فيها من المتصل المرفوع صحيح بالقطع وإنهما متواتران الى مصنفيهما وانه كل من يهوِّن أمرهما فهو مبتدع متبع غير سبيل المؤمنين-
‘ছহীহায়েন অর্থাৎ বুখারী ও মুসলিম সম্পর্কে হাদীছ বিশারদ পন্ডিতগণ একমত হয়েছেন যে, এ দু’য়ের মধ্যে মু্ত্তাছিল মরফূ‘ যত হাদীছ রয়েছে, সবই অকাট্যভাবে ছহীহ। যে ব্যক্তি ঐ দুই গ্রন্থ সম্পর্কে হীন ধারণা পোষণ করবে সে বিদ‘আতী এবং মুসলিম উম্মাহর বিরোধী তরীকার অনুসারী’।[2]
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ১৯৩৪ সালের জুলাই সংখ্যা তারজুমানুল কুরআনে ‘মাসলাকে ই‘তিদাল’ নামে প্রকাশিত ও ১৯৭৯ সালের জানুয়ারীতে ‘তাফহীমাত’ ১ম খন্ডে সংকলিত ৩৫০ হ’তে ৩৭০ পর্যন্ত ২১ পৃষ্ঠার বিরাট প্রবন্ধটি হাদীছ অস্বীকারকারীদের জন্য একটি বড় সান্ত্বনা বৈ-কি। প্রবন্ধটির বঙ্গানুবাদ ‘সুষম মতবাদ’ নামে ১৯৬০ সালে ঢাকা থেকে বের হয়েছে।
হাদীছ সম্পর্কে সন্দেহবাদ সৃষ্টি করলেও ফিক্বহ সম্পর্কে এই দর্শন তার অগাধ বিশ্বাস ব্যক্ত করেছে। যেমন বলা হয়েছে,
امام ابو حنيفة کى فقه ميں آپ بكثرت ايسـے مسائل ديكهتے هيں جو مرسل اور معضل اور منقطع احاديث پر مبنى هيں، يا جن ميں ايک قوى الاسناد حديث كو چهوڑ كر ايك ضعيف الاسناد حديث كو قبول كيا گيا ھے، يا جن ميں احاديث کچھـ كهتى هيں اور امام ابو حنيفه اور انكے اصحاب کچھـ كهتے هيں– يهى حال امام مالك كا ھے- باوجوديكه اخبارى نقطۂ نظر ان پر زيادة غالب ھے، مگر پهر بهى انكے تفقه نے بهت سے مسائل ميں انكو ايسى احاديث كے خلاف فتوى دينے پر مجبور كر ديا جنهيں محدثين صحيح قرار ديتـے هيں- چنانچه ليث بن سعد نے انكى فقه سے تقريباً 70 مسئلے اس نوعيت كے نكالے هيں- امام شافعى كا حال بهى اس سـے كچهـ بهت مختلف نهيں-
অর্থ: ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর ফিক্বহের মধ্যে আপনারা এমন বহু মাসআলা দেখবেন যা মুরসাল, মু‘যাল এবং মুনক্বাতে‘[3] হাদীছ সমূহের উপর ভিত্তিশীল। অথবা উক্ত কোন মাস’আলা ছহীহ হাদীছ বাদ দিয়ে যঈফ হাদীছ গ্রহণ করা হয়েছে। কোন কোন মাসআলায় দেখা যাবে যে, হাদীছ সমূহ একরূপ বলছে, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বা তাঁর শিষ্যমন্ডলী অন্য রূপ বলছেন। একই অবস্থা ইমাম মালিক (রহঃ)-এর। তথ্য নির্ভরতার দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর মধ্যে জোরালো থাকা সত্ত্বেও ফিক্বহের বুঝ তাঁকে এমনামন হাদীছ সমূহের খেলাফ ফৎওয়া দিতে বাধ্য করেছে, যেগুলি মুহাদ্দিছগণ ছহীহ সাব্যস্ত করেছেন। লাইছ বিন সা‘দ নিজের ফেক্বহী বুঝ অনুযায়ী এই ধরনের প্রায় ৭০টি ফৎওয়া দিয়েছেন। ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর অবস্থাও এ থেকে ভিন্ন নয়’।[4]
উপরোক্ত আলোচনার আগেই মাননীয় লেখক নিজের মন্তব্য পেশ করে বলেন,
جسطرح حديث كو بالكليه رد كر دينيوالا غلطى پر هيں اسى طرح وه لوگ بهى غلطى سے محفوظ نهيں هيں جنهوں نے حديث سے استفاده كرنے ميں صرف روايات هى پر اعتماد كرليا هے- مسلک حق ان دونوں كے درميان ھے – اور يه وهى مسلک هے جو ائمۂ مجتهدين نے اختيار كيا ھے - تفهيمات ج 1 ص 360 طـ 979 ام-
অর্থাৎ হাদীছকে একেবারে অস্বীকারকারীরাও যেমন ভুলের উপরে আছে, অমনিভাবে ঐ লোকেরাও ভুল থেকে নিরাপদ নয়, যারা কেবল হাদীছের রেওয়ায়াত বা বর্ণনার উপরে ভরসা করেছেন। সঠিক রাস্তা ঐ দু’টির মাঝখানে আছে, যে পথ অনুসরণ করেছেন মুজতাহিদ ইমামগণ’।[5]
কাদিয়ানী বিজয়ী শেরে পাঞ্জাব মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (১৮৬৮-১৯৪৮ খৃঃ) উপরোক্ত আলোচনার জওয়াবে বলেন, ‘আসলে ইমাম আবূ হানীফা মুরসাল হাদীছকে যঈফ গণ্য করতেন না, যা সকলের বিরুদ্ধ মত। ইমাম মালেক ও শাফেঈ সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে, তা একেবারেই ভিত্তিহীন। তাঁরা জেনে-শুনে ছহীহ হাদীছের বিরুদ্ধে কোন ফৎওয়া দেননি। লাইছ বিন সা‘দ সম্পর্কে ৭০টি ফৎওয়ার ব্যাপারে যে দাবী করা হয়েছে, সেটাও একেবারে ভিত্তিহীন। থাকলে দু’চারটে পেশ করা হউক’।[6]
উপরের আলোচনায় হাদীছের বর্ণনার উপরে ভরসা না করে মুজতাহিদ ইমামগণের রায়কে যদি তা ছহীহ হাদীছ বিরোধীও হয়, তবুও তাকে সঠিক পথ বলা হয়েছে। অথচ মুজতাহিদগণের অবস্থা এই যে, তাঁদের পরস্পরের ইখতেলাফে ফিক্বহের কিতাবসমূহ ভরপুর। খোদ ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর সমস্ত ফৎওয়ার দুই তৃতীয়াংশের বিরোধিতা করেছেন তাঁর দুই প্রধান শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ) ও ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ)। যেমন ইমাম গাযযালী (রহঃ) বলেন,
قال الامام الغزالى فى كتابه المنخول انهما خالفا ابا حنيفية فى ثلثى مذهبه-[7]
অমনিভাবে আল্লামা তাজুদ্দীন সুবকী বলেন যে, ‘শুধু মাসায়েল বিষয়েই নয়, বরং ফেক্বহী মূলনীতিতেও উক্ত শিষ্যদ্বয় তাদের উস্তাদের বিরোধিতা করেছেন إنهما) يخالفان اصول صاحبهما- )’।[8]
এবারে আসুন স্বয়ং ইমাম ছাহেবের কথা শুনি। তিনি স্বীয় প্রধান শিষ্য আবু ইউসুফকে বলেন, لا ترو عنى شيئا فإنى والله ما أدرى مخطئ أنا أما مصيب؟ ‘তুমি আমার পক্ষ হ’তে কোন মাসআলা বর্ণনা করো না। আল্লাহর কসম আমি জানি না আমি নিজ সিদ্ধান্তে বেঠিক না সঠিক’।[9] তিনি আরও বলেন,
ويك يا يعقوب لا تكتب كل ما تسمعه منى فانى قد ارى الرأى اليوم واتركه غدا و ارى الرأى غدا وأتركه بعد غد رواه الخطيب باسناد متصل-
‘সাবধান হে ইয়াকুব (আবু ইউসুফ)! আমার নিকট থেকে যা-ই শুনো তাই-ই লিখে নিয়ো না। কেননা আমি আজ যে রায় দেই, কাল তা পরিত্যাগ করি। কাল যে রায় দেই পরশু তা প্রত্যাহার করি।’ ইমাম খতীব বাগদাদী অবিচ্ছিন্ন সনদে একথা রেওয়ায়াত করেছেন।[10] বরং ইমাম আবু হানীফা সহ প্রসিদ্ধ চার ইমামের প্রত্যেকেই বলেছেন, إذا صح الحديث فهو مذهبنا ‘যখন হাদীছ ছহীহ পাবে, জেনো সেটাই আমাদের মাযহাব’।[11]
যারা হাদীছের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে ফক্বীহ ও মুজতাহিদগণের রায়ের উপর নির্ভরশীল হতে চান, তাদের জন্য উপরোক্ত আলোচনাটিই যথেষ্ট বলে মনে করি। তবুও এখানে হযরত আলী (রাঃ)-এর একটি উক্তি উপহার দিতে চাই। তিনি বলেন,لو كان الدينُ بالرأى لكان أسفلُ الْخُفِّ أَوْلىَ بالمسح من أعلاهُ- ‘যদি দ্বীন রায় অনুযায়ী হ’ত তাহ’লে মোযার নীচের অংশ মাসাহ করা অধিক উত্তম হ’ত উপরের অংশের চেয়ে’।[12]
পরিশেষে ঐ সকল ভাইদেরকে নিম্নের কয়েকটি আয়াতের দিকে নযর দিতে বলি।-
(১) সূরা হিজ্র ৯ম আয়াত, যেখানে আল্লাহ পাক বলছেন, إنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإنَّا لَهُ لَحَافِظُوْنَ- ‘নিশ্চয়ই আমরা উপদেশ (কুরআন) নাযিল করেছি এবং আমরাই এর হেফাযত করব’।
(২) إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا بِالذِّكْرِ لَمَّا جَاءهُمْ وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيْزٌ، لاَ يَأتِيْهِ الْبَاطِلُ مِن بَيْنِ يَدَيْهِ وَلاَ مِنْ خَلْفِهِ تَنزِيْلٌ مِّنْ حَكِيْمٍ حَمِيْدٍ- ‘নিশ্চয়ই যারা উপদেশ (কুরআন) আসার পর তা অস্বীকার করে, (তারা কঠিন শাস্তিপ্রাপ্ত হবে)। বস্ত্ততঃ এটি অবশ্যই একটি মহিমময় গ্রন্থ’। ‘এতে বাতিলের কোন প্রবেশাধিকার নেই, না সম্মুখ থেকে না পিছন থেকে। এটি প্রজ্ঞাময় ও প্রশংসিত সত্তার (আল্লাহর) পক্ষ হ’তে অবতীর্ণ’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৪১-৪২)। অর্থাৎ সম্মুখ থেকে কাফের-মুশরিকরা এবং পিছন থেকে ফাসিক-মুনাফিকরা এর শব্দে বা অর্থে বাতিল কিছু ঢুকাতে পারবে না বা কোনরূপ পরিবর্তন করতে পারবে না।
(৩) রাসূলুল্লাহ(ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) কুরআন মুখস্থ করতে যখন ব্যস্ততা দেখাচ্ছিলেন, তখন নাযিল হ’ল, لاَ تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ، إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ، فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ، ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ- ‘তাড়াতাড়ি ‘অহি’ আয়ত্ত করার তাগিদে আপনি জিহবা সঞ্চালন করবেন না’। ‘নিশ্চয়ই অহি সংরক্ষণ ও তা পড়ানোর দায়িতব আমাদের’। ‘যখন (জিব্রীলের মাধ্যমে) আমরা কুরআন পড়াব, তখন আপনি তার পিছে পিছে পড়ে যাবেন মাত্র’। ‘অতঃপর ওটাকে (আপনার কথা, কর্ম ও সম্মতির মাধ্যমে) ব্যাখ্যা করার দায়িত্বও আমাদের’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৬-১৯)।
অতঃপর নবী (ছাঃ)-এর দ্বীন সংক্রান্ত সকল কথাই যে আল্লাহর ‘অহি’ নিম্নের আয়াতটি তার বাস্তব সাক্ষী। যেমন (৪) আল্লাহ বলেন, وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى ، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُّوْحَى- ‘তিনি নিজের ইচ্ছামত (দ্বীনের ব্যাপারে) কোন কথা বলেন না। যা কিছু বলেন, আল্লাহর অহি মোতাবেক বলেন’ (নাজম ৫৩/৩-৪)।[13]
উপরে বর্ণিত আয়াতগুলি একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, পবিত্র কুরআন ও হাদীছ সংরক্ষণের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপরে। তিনি তাঁর নির্বাচিত বান্দাদের মাধ্যমে অভ্রান্ত সত্যের এ দুই উৎসের হেফাযত করেছেন। ইসলামের প্রথম যুগের ইতিহাস এর জাজ্বল্যমান সাক্ষী। ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যারা কুরআনের হাফেয ছিলেন, একটি হরফও তাদের স্মৃতিতে হেরফের হয়নি। পরবর্তীকালে হাদীছের হাফেযগণ যে অনুপম স্মৃতিশক্তির আধার ছিলেন, তা ছিল সর্বকালের ইতিহাসে বিস্ময়কর। যেখানে আধুনিক বিজ্ঞান বলছে তিন লক্ষ শব্দের বেশী স্মৃতিতে ধারণ করা মানুষের ক্ষমতার বাইরে।[14] সেখানে রাবীদের নাম, সনদ ও হাদীছের মূল বর্ণনা সহ ছয় লক্ষ, সাত লক্ষ এমনকি দশ লক্ষ হাদীছের সনদ ও মতন হুবহু মুখস্থ রাখা অলৌকিক ব্যাপার ছাড়া আর কি হতে পারে? ইমাম আহমাদ, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম প্রমুখ মুহাদ্দেছীনের চেয়ে স্মৃতিধর কোন পুরুষ তাঁদের আগেও ছিলেন না, এযাবত হয়নি। আর পরে যদি কোন কালে হয়ও, তবুও তাকে দিয়ে তো আর হাদীছের হিফ্য বা যাচাই-বাছাইয়ের খিদমত হবে না।
এ কথা বলা হয়তবা অযৌক্তিক হবে না, যাঁরা হাদীছের উপর সন্দেহারোপ করেন, তাঁরা প্রকারান্তরে কুরআনের উপরেও সন্দেহ আরোপ করেন। কেননা কুরআন যাঁরা হিফ্য করেছিলেন, হাদীছও তাঁরাই হিফ্য করেছেন। একই ছাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে আমরা অহিয়ে মাত্লু (কুরআন) ও অহিয়ে গায়র মাত্লু (হাদীছ) লাভ করেছি। এমতাবস্থায় চৌদ্দশ’ বছর পরে এসে হাদীছের উপরে সন্দেহবাদ আরোপকারী পন্ডিতদেরকে করুণা করা ভিন্ন আমাদের মত সাধারণ মুসলমানদের আর কি-ইবা করার থাকে? ট্রাজেডী এই যে, যাঁরা সুন্নাহ্তে সন্দেহ করেন, তাঁরাই আবার দেশে কুরআন ও সুন্নাহর আইন চালু করার জন্য দিন রাত গলদঘর্ম হচ্ছেন। আমরা এই সকল যুক্তিবাদীদের নিকট হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী ফারূকে আযম হযরত ওমর (রাঃ)-এর একটি দ্ব্যর্থহীন উক্তি পেশ করে ক্ষান্ত হ’তে চাই। তিনি বলেন,
والذى نفسُ عُمَرَ بيده ما قبَضَ اللهُ روحَ نبيهِ صلى الله عليه وسلم ولا رفَعَ الوحىَ عنه حتى أغنىَ امتَه كلَّهم عن الرأى-
‘যার হাতে ওমরের জীবন তাঁর কসম খেয়ে বলছি, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর নবীর রূহ কবয করেননি এবং অহি উঠিয়ে নেননি, যতক্ষণ না তাঁর উম্মত সকল প্রকার যুক্তিবাদ হ’তে মুক্ত হ’তে পেরেছে’।[15]
[1]. লাহোরের বরকত আলী হলের বক্তৃতা। লাহোর হ’তে প্রকাশিত উর্দূ সাপ্তাহিক আল-ই‘তিছাম ২৭শে মে ও ৩রা জুন সংখ্যা ১৯৫৫-এর বরাতে আল্লামা দাউদ রায (মোমেনপুরা, বোম্বাই) প্রণীত ‘তাহরীক’ পৃঃ ৭০।
[2]. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, (মিসর: খায়রিয়া প্রেস ১৩২৩ হি:) ১/১০৬ পৃঃ ; ঐ (কায়রো: দারুত তুরাছ ১৩৫৫হিঃ/ ১৯৩৬ খৃ:) ১/১৩৪ পৃঃ।
[3].‘মুরসাল’ যার শেষ সনদে তাবেঈর উস্তাদের নাম বিচ্ছিন্ন। ‘মু‘যাল’ যার মধ্য সনদে পর পর দুই বা তদোধিক রাবীর নাম বিচ্ছিন্ন। ‘মুনক্বাতে‘ যার মধ্য সনদে এক বা একাধিক রাবীর নাম অসংলগ্নভাবে বিচ্ছিন্ন’। সকল হাদীছের হুকুম অগ্রাহ্য’। =আস্-সাহ্লুল মুসাহ্হাল ফী মুছত্বালাহিল হাদীছ (মদীনা) ১৮-১৯ পৃঃ ।
[4]. তাফহীমাত (দিল্লী-৬ : মারকাযী মাকতাবা ইসলামী, ১৯৭৯) ১/৩৬০ পৃঃ ।
[5]. তাফহীমাত ১/৩৬০ পৃঃ।
[6]. পাঞ্জাবের অমৃতসর হ’তে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘আখবারে আহলেহাদীছ’ ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ হ’তে ৩০শে নভেম্বর ’৪৫ পর্যন্ত ১১ কিস্তিতে সমাপ্ত বিরাট প্রবন্ধের সমষ্টি, ‘খেতাব’ ১৩ পৃঃ দ্রষ্টব্য।
[7]. আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী কৃত ‘শরহ বেক্বায়াহর ভূমিকা’ পৃঃ ৮ শেষ লাইন (দিল্লী ছাপা ১৩২৭ হিঃ); ঐ, (দেউবন্দ, মাকতাবা থানবী, তাবি) পৃ: ঐ।
[8]. তাক্বীউদ্দীন সুবকী, তাবাক্বাতুশ শাফেঈয়াহ কুবরা (বৈরুত: দারুল মা‘রিফাহ, তাবি), ১/২৪৩ পৃঃ।
[9]. খতীব বাগদাদী, ‘তারীখু বাগদাদ’ (মিসর: সা‘আদাহ প্রেস ১৩৪৯/১৯৩১ খৃঃ) ১৩শ খন্ড ৪০২ পৃঃ ১১শ লাইন।
[10]. তারীখু বাগদাদ ১৩শ খন্ড ৪০২ পৃঃ ৮ম লাইন।
[11]. শা‘রানী, কিতাবুল মীযান, ১/৭৩ পৃঃ।
[12]. হুজ্জাতুল্লাহ ১/১৫০ পৃঃ ; আবুদাঊদ; সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৫২৫ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায় ‘মোযার উপর মাসাহ’ অনুচ্ছেদ।
[13]. হাদীছ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে। কখনো জিব্রীল নিজে এসে শিক্ষা দিয়েছেন যেমন (ক) কা‘বা চত্বরে রাসূলকে দু’দিন ছালাতের প্রশিক্ষণ দেওয়া (আবুদাঊদ, তিরমিযী, মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত, হা/৫৮৩-৮৪ ‘ছালাতের ওয়াক্ত সমূহ’ অনুচ্ছেদ)। (খ) ছাহাবীগণের মজলিসে এসে মানুষের বেশ ধরে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে দ্বীন শিক্ষা দেওয়া (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২)। (গ) ভূপৃষ্ঠে কোন্ ভূখন্ড উত্তম এরূপ এক প্রশ্নের উত্তর সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে এনে রাসূলকে জানিয়ে দেওয়া (আহমাদ, হাকেম, সনদ হাসান, মিশকাত হা/৭৪১ ‘ছালাত’ অধ্যায় ‘মসজিদ ও ছালাতের স্থানসমূহ’ অনুচ্ছেদ) ইত্যাদি। এধরনের অসংখ্য নযীর রয়েছে।
[14]. নয়াদিল্লী-২৫ হ’তে প্রকাশিত উর্দু মাসিক ‘আত-তাও‘ইয়াহ’ আগষ্ট-সেপ্টেম্বর সংখ্যা ১৯৮৬, পৃঃ ২৭।
[15]. শা‘রানী, কিতাবুল মীযান, ১/৬২ পৃঃ ১৮শ লাইন।