তিনটি মতবাদ

পর্যালোচনা

১. বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রচারিত উক্ত চরমপন্থী দর্শনের অনুসারী হওয়ার ফলে মুসলিম সমাজের একটি অংশ যেনতেন প্রকারেণ রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনকেই মূল ইবাদত ভাবতে শুরু করেছে এবং ইসলামের ফারায়েয-ওয়াজিবাত প্রভৃতিকে ‘ছোট-খাট বিষয়’ বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

২. এই দর্শন দ্বীনকে দুনিয়া হাছিলের মাধ্যম রূপে গণ্য করেছে। অথচ ইসলামের যাবতীয় ইবাদতের মূল লক্ষ্য হ’ল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, কোনমতেই দুনিয়া অর্জন নয়। আল্লাহ বলেন, فَأعْبُدِ اللهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّيْنَ   ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত কর কেবলমাত্র তাঁরই জন্য খালেছ আনুগত্য সহকারে’ (যুমার ৩৯/২)।

৩. এই দর্শন স্বীয় লক্ষ্য হাছিলের জন্য কুরআনে কারীমের কয়েকটি পরিভাষার অপব্যাখ্যা করেছে। যেমন ‘দ্বীন’ অর্থ হুকূমত। ‘ইক্বামতে দ্বীন’ অর্থ ইক্বামতে হুকূমত। ‘ইবাদত’ অর্থ আনুগত্য। এখানে আল্লাহর উপাসনা ও সরকারের আনুগত্যকে এক করে দেখানো হয়েছে।[1] যার বাস্তব ফলশ্রুতিতে মানুষের নিজের নফস বা দেশের সরকার সবই মা‘বূদ-এর আসন দখল করে নিয়েছে। অথচ এই আক্বীদা পোষণ করলে অনৈসলামী সরকারের আনুগত্যকারী কিংবা নফসের পূজারী প্রত্যেক মুসলিমকে মুশরিক ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী বলতে হয়, যা কুরআন ও হাদীছের সম্পূর্ণ বরখেলাফ মু‘তাযিলী ও খারেজী আক্বীদার সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যায়। খারেজীদের মতে কবীরা গুনাহগার ব্যক্তি তওবা না করে মারা গেলে সে কাফের এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে।[2] মু‘তাযিলীদের মতে সে মুমিন নয়, কাফিরও নয়। তওবা না করে মারা গেলে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে।

৪. ‘দ্বীন আসলে হুকূমত’ এই দর্শনটি আরেকটি দার্শনিক প্রশ্নের জন্ম দেয়। সেটি হ’ল দ্বীনের জন্য দুনিয়া, না দুনিয়ার জন্য দ্বীন? আরও একটু অগ্রসর হয়ে বলা যায় ‘ধর্মের জন্য মানুষ, না মানুষের জন্য ধর্ম’? ইসলামের মতে দ্বীনের জন্য যিনি জীবন দেন, তিনি হন ‘শহীদ’। নাস্তিক পন্ডিতগণের মতে ধর্মের জন্য মানুষ নয়, বরং মানুষ নিজেই ধর্মকে বা আল্লাহ্কে সৃষ্টি করেছে (নাঊযুবিল্লাহ)। যার অর্থ দাঁড়ায় দ্বীনের জন্য দুনিয়া নয়, বরং দুনিয়ার জন্য দ্বীন।

এক্ষণে যদি দ্বীন আসলে হুকূমত হয় এবং ইসলামের বুনিয়াদী ফরয সমূহ তথা ছালাত-ছিয়াম, যাকাত-হজ্জ প্রভৃতি উক্ত হুকূমত বা রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্জনের অনুশীলন বা ট্রেনিং কোর্স হয়, তাহ’লে এই দর্শনটি উপরোক্ত বস্ত্তবাদী দর্শনের সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যায়।

এখানে আরেকটি প্রশ্ন দেখা দেয় যে, হুকূমত বা রাষ্ট্র ক্ষমতা হাছিলের পরে ছালাত-ছিয়াম ইত্যাদির ট্রেনিং কোর্স অব্যাহত থাকবে কি? এ বিষয়ে উক্ত দর্শনের মূল হোতা ইসমাঈলী শী‘আ ও গ্রীক দর্শনের উচ্ছিষ্ট ভোজী তথাকথিত ছূফীবাদের অনুসারীদের মধ্যে দু’ধরনের লোক দেখতে পাওয়া যায়। এক দলের মতে সাধনার উচ্চমার্গে পেঁŠছনোর পরে কিংবা আমল ও আচরণ ভাল হয়ে গেলে, তার জন্য ইসলামের অবশ্য পালনীয় ছালাত-ছিয়াম ইত্যাদি অনুষ্ঠানাদি পালনের কোন প্রয়োজন নেই। আর একদল সর্বাবস্থায় এগুলি যরূরী মনে করেন।[3]

৫. এই দর্শনের অনুসারীগণ মনে করেন যে, দুনিয়ায় নবীদের আগমনের উদ্দেশ্য ছিল ‘হুকূমতে ইলাহিয়াহ’ বা আল্লাহর হুকূমত কায়েম করা। আর সেটাই হ’ল প্রকৃত তাওহীদ, যার দিকে প্রত্যেক নবী মানব জাতিকে আহবান জানিয়েছিলেন। অতঃপর ঐ কথাটি বাদ দিয়ে কুরআনের সূরায়ে শূরার ১৩ নং আয়াতাংশের অনুকরণে ‘হুকূমতে ইলাহিয়ার’ বদলে ‘ইক্বামতে দ্বীন’ পরিভাষাটি চালু করা হয়েছে। অথচ পবিত্র কুরআনে নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে যে, তাঁরা প্রেরিত হয়েছিলেন দুনিয়াতে আত্মভোলা মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে। তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিতে ও জাহান্নামের ভয় দেখাতে। তাদের সামনে আল্লাহ প্রেরিত আয়াত সমূহ শুনাতে, তাদেরকে পবিত্র করতে এবং কিতাব ও সুন্নাতের শিক্ষা দিতে (আহযাব ৩৩/৪৫-৪৬; জুম‘আ ৬২/২)।

হুকূমত কায়েম করাই যদি নবী আগমনের উদ্দেশ্য হ’ত তাহ’লে তো বলতেই হয় যে, লক্ষাধিক নবীর মধ্যে কেবলমাত্র হযরত দাঊদ, সুলায়মান ও মুহাম্মাদ (ছাঃ) ব্যতীত আর সকলেই তাঁদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছিলেন (নাঊযুবিল্লাহ)। যে ইবরাহীম (আ:) আগুনে পুড়লেন না, তিনি কেন স্বীয় নবুঅতী শক্তি বলে নমরূদকে হটিয়ে সিংহাসনে না বসে বরং দেশ ছেড়ে চলে যাওয়াকেই উত্তম মনে করলেন। প্রথমেই সম্রাট বিরোধী শ্লোগান না দিয়ে তিনি কেন নিষ্প্রাণ মূর্তিগুলোকে ভাঙ্গতে গেলেন? অত্যাচারী ফেরাঊন সদলবলে নীলনদে ডুবে মরার পরে কেন মূসা (আঃ) তার শূন্য সিংহাসন দখল করে বীরদর্পে ‘হুকূমতে ইলাহিয়াহ’ কায়েমের সুন্দর সুযোগ হাতে পেয়েও ছেড়ে দিলেন? মোর্দাকে যিন্দা করার অলৌকিক ক্ষমতা দান করা সত্ত্বেও আল্লাহ পাক কেন হযরত ঈসা (আঃ)-কে তৎকালীন সম্রাট তোতিয়ানূসের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর নির্দেশ না দিয়ে তাকে আসমানে উঠিয়ে নিলেন? আমাদের নবীকেই বা কেন মক্কার গুটিকয়েক কাফেরের মোকাবিলায় আল্লাহ পাক রাতের অন্ধকারে সুদূর মদীনায় হিজরতের নির্দেশ দিলেন?

বুঝা গেল আক্বীদা সংশোধনের মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজ গঠনই ছিল নবীদের সমস্ত দাওয়াত ও তাবলীগের মূল লক্ষ্য। আর এটা অত্যন্ত সহজ কথা যে, সমাজ বিপ্লবের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হ’ল ব্যক্তির আক্বীদায় বিপ্লব আনা। আক্বীদায় পরিবর্তন এলে তার রাজনীতি-অর্থনীতি তথা কর্মজীবনের বিস্তীর্ণ পরিসরে পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক। নবীগণ এই মৌলিক কাজটিই করে গিয়েছেন।

৬. এই দর্শনের অনুসারীরা তাঁদের মতের পক্ষে পবিত্র কুরআনের কয়েকটি অতি পরিচিত আয়াতকে প্রায়ই ব্যবহার করেন। যেমন-إِنِ الْحُكْمُ إِلا للهِ  ‘নাই কারো হুকুম আল্লাহ ব্যতীত’ (ইউসুফ ১২/৪০)।

وَ مَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ فَاُوْلئِكَ هُمُ الْكَافِرُوْنَ.... هُمُ الظَّالِمُوْنَ... هُمُ الْفَاسِقُوْنَ-

‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত হুকুম অনুযায়ী ফায়ছালা করে না, তারা কাফের,.. যালেম...ফাসেক’ (মায়েদাহ ৫/৪৪, ৪৫, ৪৭)

প্রথম আয়াতটি হযরত ইউসুফ (আঃ) তাঁর জেলখানার কয়েদী বন্ধুদেরকে যে দাওয়াত দিয়েছিলেন, তার বর্ণনা। তিনি পরে জেল হ’তে মুক্তি পেয়ে তৎকালীন মিসরের কুফরী হুকূমতের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ‘আযীযে মিছরে’র অধীনে খাদ্যবিভাগের দায়িত্ব পালন করেছিলেন (যারা অনৈসলামী সরকারের অধীনে চাকুরী করা নাজায়েয বলতে চান, তারা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন)। পরবর্তী সূরা মায়েদাহর আয়াতগুলি আহলে কিতাবগণকে তাওরাত ও ইঞ্জীলের বিধান অনুযায়ী বিচার-ফায়ছালা করার জন্য বলা হয়েছে।

এক্ষণে আয়াতগুলি যদি সাধারণ অর্থে নেওয়া হয়, তাহ’লে প্রথম আয়াতটি ‘হুকমে তাকভীনী’ বা প্রাকৃতিক বিধান অর্থে নিতে হবে, যার একচ্ছত্র মালিকানা আল্লাহর হাতে। এর অর্থ কখনোই রাষ্ট্রীয় বিধান নয়, যা পরিষ্কারভাবে ‘হুকমে আক্বলীর’ অন্তর্ভুক্ত। এটির অর্থ ‘হুকমে শারঈ’ও নয়। তা যদি হ’ত তাহ’লে হযরত ইউসুফ (আঃ) নিজে নবী হয়ে এবং নিজে এই আয়াতের প্রবক্তা হয়ে তার বিরোধিতা করে কুফরী হুকূমতের অধীনে কোন দায়িত্ব পালন করতেন না। বরং হুকূমতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করতেন।

অতঃপর সূরা মায়েদাহর আয়াতগুলি ইসলামী রাষ্ট্রের আদালতের বিধান হিসাবে গণ্য হবে। যেন বিচারকগণ আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার-ফায়ছালা করেন। অবশ্য যদি কোন বিষয়ে কুরআন ও হাদীছের স্পষ্ট দলীল না পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে বিচারক ইজতেহাদের ভিত্তিতে রায় দিতে পারবেন।[4]

৭. অনৈসলামী হুকূমতের কোন আইন মানা চলবে না। এই ভুল চিন্তা-ধারার প্রসার ঘটার ফলে এদেশের তরুণ সমাজ যেমন সরকার বিরোধিতাকেই বড় জিহাদ ভাবতে শুরু করেছে, ভারতীয় মুসলিমদের একাংশ তেমনি সে দেশের বিভিন্ন সরকারী পদ ও দায়িত্ব হ’তে চলে আসার ফলে সেখানে সংখ্যালঘু মুসলমানদের অবস্থা ক্রমেই করুণ হ’তে করুণতর হ’তে চলেছে।[5] 

৮. আল্লাহর হুকুম ও সরকারের হুকুমকে এক করে দেখার এই দর্শনটি কোন নতুন আবিষ্কার নয়। ইসলামের প্রথম যুগে চতুর্থ খলীফার আমলে সৃষ্ট খারেজী ফিতনার মূল শ্লোগান ছিল এটা। ঐতিহাসিক ছিফ্ফীন যুদ্ধের শেষে হযরত আলী (রাঃ) ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মধ্যকার শালিশী বৈঠকের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট ও হযরত আলীর (রাঃ) দলত্যাগী আট হাযার সৈন্য যারা ইতিহাসে ‘খারেজী’ বা দলত্যাগী নামে খ্যাত, তারাও হযরত আলী (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে لاَ حُكْمُ إِلاَّ للهِ ‘নাই কারও শাসন আল্লাহ ছাড়া’ এই শ্লোগান তুলেছিল। হযরত আলী (রাঃ) তাদের জওয়াবে বলেছিলেন,

كلمة عادلة يراد بها جور، إنما يقولون أَلاَّ إمارةَ، ولا بُدَّ من إمارةٍ برةً او فاجرةً-

‘কথা ঠিক কিন্তু বাতিল অর্থ নেওয়া হয়েছে। এরা বলতে চায় যে, (আল্লাহ ছাড়া কারও) শাসন নেই। অথচ অবশ্যই শাসন ক্ষমতায় ভাল ও মন্দ সব ধরনের লোকই আসতে পারে’।[6]

হযরত আলী (রাঃ), হযরত মু‘আবিয়া (রাঃ) ও দু’পক্ষের মধ্যস্থতাকারী হযরত আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) ও হযরত আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) প্রত্যেকেই ছিলেন অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদার ছাহাবী। তাঁরা অবশ্যই সূরা ইউসুফের উক্ত আয়াতের মর্ম বুঝতেন। তাঁরা হুকূমত পরিচালনাকে হুকমে শারঈ বা ইবাদতের পর্যায়ে ফেলেননি। বরং এটাকে হুকমে আক্বলী বা বৈষয়িক ব্যাপার বলে গণ্য করেছিলেন। যতক্ষণ না সেটা শরী‘আতের কোন হুকুমকে অর্থাৎ হুকমে শারী‘আকে লংঘন করে। এই পার্থক্য না বুঝার ফলে কলেজ-মাদ্রাসার বাচ্চা ছেলেরাও যখন এই সব মহান ব্যক্তিদের সমালোচনা করে, তখন সত্যিই দুঃখ হয়। এ বিষয়ের আলোচনা ‘মধ্যপন্থা’ অধ্যায়ে দেখুন।

এখানে একটি সর্বসম্মত মূলনীতি মনে রাখা প্রয়োজন যে, ইসলামী শরী‘আতের অন্তর্ভুক্ত কোন বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের প্রদত্ত ও গৃহীত ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত। পরবর্তীকালে দেওয়া কারো কোন কপোলকল্পিত ব্যাখ্যা যদি ছাহাবায়ে কেরামের প্রদত্ত ব্যাখ্যার প্রতিকূলে হয়, তবে তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য হবে।

৯. এই দর্শন ইসলামকে ‘কুল দ্বীন’ বা সর্বব্যাপী জীবন বিধান হিসাবে পেশ করেছে। বলা হয়েছে,

يه كوئى بنۓ كى دكان كا سودا ‌نهيں هـے كه جو سودا چاها اورجتنا چـاھا لے ليا اور جو چاها چهوڑ ديا- ايسا كرنا دين کے بعض حصھ پر إيمان لانا اور بعض كا كفر كرنا هـے- ياتو پورے كا پورا سودا لينا هوگاَ يا سب كا سب چهوڑنا پڑيگاً-

‘ইসলাম কোন বণিকের দোকান নয় যে, ইচ্ছামত দোকানের কোন মাল কিনবে, কোন মাল ছাড়বে। এরূপ করা দ্বীনের কোন অংশের উপর ঈমান আনা ও কোন অংশের সঙ্গে কুফরী করার শামিল। হয় (ইসলাম রূপী দোকানের) সবকিছু খরিদ করতে হবে, নয় সবটুকুই ছাড়তে হবে।[7]

কথাগুলি আপাত মধুর হ’লেও এর মধ্যে রয়েছে বিরাট শুভংকরের ফাঁকি। ভ্যারাইটি স্টোরে রকমারি জিনিষের বিরাট স্টক থাকতে পারে, তাই বলে একজন খরিদ্দারকে সবকিছুই একত্রে কিনতে হবে, এটা কেমন দাবী? ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এতে মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধান নিহিত আছে। একথা শতকরা একশত ভাগ সত্য। কিন্তু তাই বলে ইসলাম গ্রহণকারী একজন মুসলিমকে একই সাথে জীবনের সকল দিক ও বিভাগে বিচরণ করতে হবে এবং সবকিছুতেই সমান পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে এটা কেমন কথা? ইসলাম তো এ দাবী কোন মুসলমানের নিকট করেনি যে তাকে একই সঙ্গে ভাল আলেম, ভাল চাষী, ভাল শিল্পী, ভাল ব্যবসায়ী, ভাল ডাক্তার, ভাল রাজনীতিক, ভাল সমাজনেতা সবকিছুই হ’তে হবে। বরং এটাই স্বাভাবিক যে, একজন মানুষ কখনোই সকল কাজে পারদর্শী হ’তে পারে না। এমনকি একজন ভাল মুসলমান শত চেষ্টায় হয়তবা জীবনে যাকাত বা ওশর আদায়ের কিংবা হজ্জ করার মত বুনিয়াদী ফরয আদায়ের যোগ্যতাও অর্জন করতে পারেন না।

এক্ষণে একজন লোক স্বীয় অযোগ্যতা বা অন্য কোন কারণে রাজনীতি করেন না। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে তিনি পূর্ণভাবে ইসলামী চরিত্রের অধিকারী। ইনি পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হবেন কি? আধুনিক এই দর্শনের মতে ঐ ব্যক্তি আর যাই হোক পূর্ণাঙ্গ মুসলিম নন। কারণ ইসলামের মূল ইবাদতটিই তার জীবন থেকে বাদ পড়ে গেছে। তবে হাঁ ঐ ব্যক্তি আর কোন দিক দিয়ে তেমন যোগ্য না হ’লেও যদি রাজনীতিতে পারঙ্গম হন, তাহ’লে বোধ হয় এই দর্শনের অনুসারীদের মতে তিনি পূর্ণাঙ্গ মুমিন (?) হ’তে পারেন। কারণ রাজনীতির আলোকেই তাঁরা মুসলমানকে বিচার করেন। বিচার বুদ্ধির এই মাপকাঠির কারণেই বিগত যুগের বড় বড় মুজাদ্দিদগণ কেউই এঁদের দৃষ্টিতে পূর্ণাঙ্গ মুজাদ্দিদ হ’তে পারেননি। কেননা তাঁরা নিজ নিজ আমলের সরকারের বিরুদ্ধে এদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কোন রাজনৈতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হননি কিংবা স্বাধীনভাবে কোন ইসলামী হুকূমত কায়েম করেননি।


[1]. তাফহীমাত ১/৪৯-৬৩ পৃঃ ।

[2]. উক্ত চরমপন্থী আক্বীদার কারণেই তারা খলীফা আলী, মু‘আবিয়া ও আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ)-এর রক্তকে হালাল গণ্য করেছিল এবং হযরত আলীকে হত্যা করেছিল। -লেখক।

[3]. বিস্তারিত দেখুন: ইবনু তায়মিয়াহ, আর-রাদ্দু ‘আলাল মানতেক্বিইঈন, পৃঃ ১৪৫; ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালেকীন, ১ম খন্ড ৯৬ পৃঃ।

[4]. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) সূরা মায়েদাহ ৪৪ আয়াতের فَاُوْلئِكَ هُمُ الْكَافِرُوْنَ -এর ব্যাখ্যায় বলেন, ليس بالكفر الذی يذهبون اليه ‘এর অর্থ কুফরী নয়, যেদিকে লোকেরা গিয়েছে’ (হাকেম ২/৩১৩ পৃঃ হাদীছ ছহীহ)। ত্বাঊস বলেন, ليس بكفر ينقل عن الملة  ‘এর অর্থ ঐ কুফরী নয় যা তাকে ইসলামী মিল্লাত থেকে খারিজ করে দেয়’। আত্বা বলেন, এটি কুফরীর পরেই সবচেয়ে বড় পাপ’ (তাফসীর ইবনু কাছীর)। এক্ষণে আয়াতগুলির মর্ম হ’ল এই যে, যদি কোন মুসলিম বিচারক আল্লাহকৃত কোন হারাম কে হারাম বলে বিশ্বাস করেন, কিন্তু বাসত্মবে উক্ত হারাম কর্ম সম্পাদন করেন, তাহ’লে তিনি ফাসেক ও পাপিষ্ঠ মুসলিম হিসাবে গণ্য হবেন। তার বিষয়টি আল্লাহর উপরে ছেড়ে দেওয়া হবে। চাইলে তিনি তাকে আযাব দিবেন, চাইলে ক্ষমা করবেন। কেননা কবীরা গুনাহগার মুসলিম ‘কাফের’ হয়না। তবে খারেজীদের মতে ঐ ব্যক্তি কাফের (কুরতুবী)। সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং তার রক্ত হালাল। [আলোচ্য তৃতীয় মতবাদটির অনুসারীগণ সূরা মায়েদাহর অত্র আয়াত তিনটিকে তাদের চরমপন্থী আন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন। যেটা স্রেফ অপব্যাখ্যা বৈ কিছুই নয়]।

[5]. আল-হারাকাতুস্ সালাফিইয়াহ বে-কেরেলা, পৃঃ ১৮।

[6]. ইবনু কুতায়বা, আল-ইমামাতু ওয়াস সিয়াসাহ্ ১/১৫৬ পৃঃ।

[7]. হাকীম ওবায়দুল্লাহ খান, ইসলামী সিয়াসাত ইয়া সিয়াসী ইসলাম (শ্রীনগর,   কাশ্মীর ১৯৭৮ খৃঃ) ২৩ পৃঃ ।