তাফসীরুল কুরআন - (৩০তম পারা)

সূরা কাওছার

(হাউয কাওছার)

সূরা তাকাছুর-এর পরে মক্কায় অবতীর্ণ।

সূরা ১০৮, আয়াত ৩, শব্দ ১০, বর্ণ ৪২।

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।                  

(১) নিশ্চয়ই আমরা তোমাকে ‘কাওছার’ দান করেছি
إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ
(২) অতএব তোমার প্রভুর উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় কর ও কুরবানী কর।
فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
(৩) নিশ্চয়ই তোমার শত্রুই নির্বংশ।
إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْأَبْتَرُ

বিষয়বস্ত্ত :

আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে যে অফুরন্ত নে‘মত দান করেছেন এবং তাঁর শত্রুরাই যে নির্বংশ সেকথাগুলিই বলা হয়েছে অত্র সূরাতে।

শানে নুযূল :

কুরায়েশ নেতা ‘আছ বিন ওয়ায়েল একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে দাঁড়িয়ে কোন বিষয়ে কথা বলছিলেন। তখন অন্য নেতারা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কার সাথে কথা বলছিলেন?’ ‘আছ বিন ওয়ায়েল জওয়াবে বলেন, مع ذلك الأبتر ‘নির্বংশ ঐ লোকটার সাথে’। আবু লাহাব, আবু জাহ্ল, ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব প্রমুখ নেতাদের সম্পর্কেও প্রায় একই মর্মে বর্ণিত হয়েছে (কুরতুবী, ইবনু কাছীর, ক্বাসেমী)। এই ঘটনার পূর্বে হযরত খাদীজা (রাঃ)-এর গর্ভজাত রাসূল (ছাঃ)-এর দ্বিতীয় ও সর্বশেষ পুত্র আব্দুল্লাহ শিশু অবস্থায় মারা যান। তাঁর প্রথম সন্তান ক্বাসেম আগেই মারা গিয়েছিলেন। অথচ চার মেয়ের সবাই বেঁচেছিলেন। কিন্তু মক্কায় জন্মগ্রহণকারী প্রথম ও শেষ    পুত্রসন্তানের কেউ বেঁচে না থাকায় শত্রুরা সুযোগ নেয় এবং তাদের প্রথানুযায়ী রাসূল (ছাঃ)-কে ‘আবতার’ বা লেজকাটা বলে তাচ্ছিল্য করতে থাকে। কারণ তাদের ধারণায় মুহাম্মাদ-এর মৃত্যুর পরে তার নাম নেওয়ার লোক কেউ থাকবে না এবং তার দাওয়াতও শেষ হয়ে যাবে। আমরাও এর হাত থেকে বেঁচে যাব। এতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বভাবতই মনে কষ্ট পান। তখন এই সূরাটি নাযিল হয় এবং এর মাধ্যমে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়া হয় (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। পরবর্তীতে ৮ম হিজরী সনে মদীনায় জন্মগ্রহণকারী মারিয়া ক্বিবতিয়ার গর্ভজাত সর্বশেষ ও তৃতীয় পুত্র ইবরাহীম ১০ম হিজরীর ২৯ শাওয়ালে মারা গেলে কুরায়েশরা বলতে থাকে, بُتِرَ مُحَمَّدٌ، فَلَيْسَ لَهُ مَنْ يَقُومُ بِأَمْرِهِ مِنْ بَعْدِهِ ‘মুহাম্মাদ নির্বংশ হয়ে গেল। এখন আর কেউ রইল না যে তার পরে তার কাজ চালিয়ে যাবে’ (কুরতুবী)

উল্লেখ্য যে, ‘আবতার’-এর আলোচনায় তাফসীরে কুরতুবীতে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর নামে রাসূলপুত্র ইবরাহীমের মৃত্যুর পর কুরায়েশদের উক্ত কুট মন্তব্য সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে, তা ছহীহ নয় এবং ইতিহাসগতভাবে তা অগ্রহণযোগ্য। কেননা মন্তব্যকারী কুরায়েশনেতারা প্রায় সবাই ২য় হিজরীতে বদরের যুদ্ধে ও তার পরে নিহত বা মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাছাড়া ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর কুরায়েশরা সবাই মুসলমান হয়ে যায়। তখন রাসূল (ছাঃ)-কে গালি দেবার মত কোন নেতা সেখানে অবশিষ্ট ছিলেন না। বরং এসব ছিল হিজরতের অনেক পূর্বে ইসলামের প্রথম দিকের ঘটনা। আর জমহূর মুফাসসিরগণের নিকট এটি মাক্কী সূরা।

তাফসীর :

(১) إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ ‘নিশ্চয়ই আমরা তোমাকে ‘কাওছার’ দান করেছি’ । ‘কাওছার’ (الكوثر) অর্থ الخير الكثير অজস্র কল্যাণ। মাদ্দাহ হ’ল الكثرة আধিক্য। الكثرة থেকে الكوثر যেমন الجهر থেকে الجوهر। আরবরা সংখ্যা, পরিমাণ ও ভীতির আধিক্য প্রকাশ করার জন্য ‘কাওছার’ শব্দ ব্যবহার করে থাকে। যেমন ব্যবসা বা সফর থেকে ফিরে আসা ছেলের মাকে জিজ্ঞেস করা হ’লে মা বলেন, رجع بكوثر অর্থ رجع بمال كثير ‘বহু মাল নিয়ে ফিরে এসেছে’। অনুরূপভাবে الكوثر من الرجال অর্থ السيد الكثير الخير ‘বহু কল্যাণময় নেতা’। الكوثر من العدد অর্থ العدد الكثير من الأصحاب والأشياع ‘সাথী ও সম্প্রদায়ের অগণিত লোক’ (কুরতুবী)। এখানে অর্থ ‘হাউয কাওছার’ যা জান্নাতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে দান করা হবে।

আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, الْكَوْثَرُ نَهَرٌ فِى الْجَنَّةِ حَافَتَاهُ مِنْ ذَهَبٍ مَجْرَاهُ عَلَى الْيَاقُوْتِ وَالدُّرِّ تُرْبَتُهُ أَطْيَبُ مِنَ الْمِسْكِ وَمَاؤُهُ أَحْلَى مِنَ الْعَسَلِ وَأَشَدُّ بَيَاضًا مِنَ الثَّلْجِ- ‘আল-কাওছার’ হ’ল জান্নাতের একটি নদী। যার দুই তীর স্বর্ণের, গতিপথ মণি-মুক্তার, মাটি মিশকের চাইতে সুগন্ধিময় এবং পানি মধুর চাইতে মিষ্ট ও বরফের চাইতে স্বচ্ছ’।[1]

আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন, আমরা একদিন রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে বসেছিলাম। এমন সময় তিনি তন্দ্রালু হয়ে পড়লেন। তারপর মাথা উঁচু করে মুচকি হাসলেন। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কোন্ বস্ত্ত আপনাকে হাসালো? তিনি বললেন, এখুনি আমার উপরে একটি সূরা নাযিল হয়েছে। বলেই তিনি বিসমিল্লাহ সহ সূরা কাওছার পাঠ করে শুনালেন। অতঃপর বললেন, তোমরা কি জানো ‘কাওছার’ কি? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সর্বাধিক অবগত। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এটি সেই নদী, যার ওয়াদা আল্লাহ আমাকে করেছেন। যাতে অসংখ্য নে‘মত রয়েছে। এটি হ’ল সেই ‘হাউয’ যেখানে ক্বিয়ামতের দিন আমার উম্মত অবতরণ করবে। যার পাত্ররাজির সংখ্যা হবে নক্ষত্ররাজির ন্যায় অগণিত। অতঃপর কিছু লোককে সেখান থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হবে। তখন আমি বলব, يَا رَبِّ إِنَّهُ مِنْ أُمَّتِىْ সাহল বিন সা‘দের বর্ণনায় এসেছে, إِنَّهُمْ مِنِّى হে প্রভু! এরা তো আমার উম্মত! তখন বলা হবে, إِنَّكَ لاَ تَدْرِىْ مَا أَحْدَثُوْا بَعْدَكَ ‘তুমি জানো না তোমার পরে এরা দ্বীনের মধ্যে কত কিছু নতুন সৃষ্টি করেছিল। তখন আমি বলব, سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِى ‘দূর হও দূর হও! যে আমার পরে আমার দ্বীনে পরিবর্তন করেছে’।[2] আনাস (রাঃ) হ’তে অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, মি‘রাজের ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, دَخَلْتُ الْجَنَّةَ فَإِذَا أَنَا بِنَهَرٍ ‘আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম। হঠাৎ একটি নদী পেলাম। যার দুই তীর মণি-মুক্তা দিয়ে গড়া। আমি তখন ঐ নদীর পানিতে হাত দিলাম। দেখলাম তা ‘আযফার মিশক’ (فَإِذَا مِسْكٌ أَذْفَرُ)। বললাম, জিব্রীল এটা কি? তিনি বললেন, هَذَا الْكَوْثَرُ الَّذِىْ أَعْطَاكَهُ اللهُ- ‘এটা হ’ল ‘কাওছার’ যা আল্লাহ আপনাকে দান করেছেন’।[3] এ হাদীছ থেকে অনেক বিদ্বান দলীল নিয়েছেন যে, সূরাটি মাদানী (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। তবে মক্কায় নাযিল হওয়া সূরাটি পুনরায় মদীনায় শুনানোটা মোটেই বিচিত্র নয়।

ইমাম বুখারী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি ‘কাওছার’-এর ব্যাখ্যায় বলেন, اَلْكَوْثَرُ الْخَيْرُ الْكَثِيْرُ ‘কাওছার’ অর্থ ‘অজস্র কল্যাণ’। তিনি বলেন, هُوَ الْخَيْرُ الَّذِىْ أَعْطَاهُ اللهُ إِيَّاهُ ‘এটি সেই কল্যাণ, যা কেবল তাঁকেই (অর্থাৎ রাসূলকে) আল্লাহ দান করেছেন। রাবী আবু বিশ্র (أبو بشر) বলেন, আমি (আমার ঊর্ধ্বতন রাবী) সাঈদ ইবনু জুবায়েরকে জিজ্ঞেস করলাম, লোকেরা ধারণা করে যে, এটা কেবল জান্নাতের একটি নদী? তখন সাঈদ বিন জুবায়ের বললেন, اَلنَّهَرُ الَّذِىْ فِى الْجَنَّةِ مِنَ الْخَيْرِ الَّذِىْ أَعْطَاهُا اللهُ إِيَّاهُ ‘জান্নাতের উক্ত নদী ঐসব কল্যাণের অন্তর্ভুক্ত যা আল্লাহ তাঁকে দান করেছেন’। ইবনু আববাসও একই কথা বলেছেন।[4]

মুজাহিদ বলেন, هو الخير الكثير فى الدنيا والآخرة ‘কাওছার হ’ল দুনিয়া ও আখেরাতের অশেষ কল্যাণ সমূহ’ (ইবনু কাছীর)। যার মধ্যে রয়েছে তাঁকে দেওয়া বিশ্বব্যাপী নবুঅত ও রিসালাত, কিতাব ও সু্ন্নাত, ইলম ও শাফা‘আত, হাউযে কাওছার, মাক্বামে মাহমূদ, সর্বাধিক সংখ্যক উম্মত, সকল দ্বীনের উপরে ইসলামের বিজয়, শত্রুদের উপরে জয়লাভ, অসংখ্য বিজয়াভিযান এবং ইসলামী খেলাফতের প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি।

কুরতুবী কাওছারের ব্যাখ্যায় বিদ্বানগণের ১৬টি মতামত উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত হ’ল ‘হাউয কাওছার’। যেবিষয়ে স্পষ্ট ছহীহ হাদীছসমূহ এসেছে (কুরতুবী)

(২) فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘অতএব তোমার প্রভুর উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় কর ও কুরবানী কর’।

অর্থাৎ অন্যেরা যখন আল্লাহকে ছেড়ে অন্যের উপাসনা করছে এবং আল্লাহকে ছেড়ে অন্যের নামে পশু যবেহ করছে, তখন তুমি তাদের বিপরীতে কেবল এক আল্লাহর ইবাদত কর এবং স্রেফ আল্লাহর রেযামন্দীর উদ্দেশ্যে কুরবানী কর। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ ‘তুমি বল আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ কেবলমাত্র বিশ্বপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত’ (আন‘আম ৬/১৬২)। ইবনুল ‘আরাবী বলেন, আমি মনে করি আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ বলতে চাচ্ছেন, أعبد ربك وانحر له فلا يكن عملك إلا لمن خصك بالكوثر- ‘তুমি তোমার রবের ইবাদত কর এবং তাঁর জন্য কুরবানী কর। তোমার আমল যেন হয় কেবলমাত্র সেই মহান সত্তার জন্য যিনি তোমাকে ‘কাওছার’ দানের জন্য খাছ করেছেন’ (কুরতুবী)।

نحر অর্থ সীনার উপরের অংশ। উট দাঁড়ানো অবস্থায় তার কণ্ঠনালীর গোড়ায় অস্ত্রাঘাত করে রক্ত বের করে দিয়ে কুরবানী করা হয় বিধায় একে ‘নহর’ করা বলা হয়। অন্য সকল গবাদিপশু দক্ষিণ দিকে মাথা রেখে বাম কাতে মাটিতে ফেলে ক্বিবলামুখী হয়ে যবহ করা হয়।

বস্ত্ততঃ ছালাত ও কুরবানীর আদেশ কেবল নবীর জন্য খাছ নয়। বরং তাঁর উম্মতের জন্যও প্রযোজ্য। কেননা কেবলমাত্র তাঁর উম্মতই পৃথিবীর সেরা উম্মত। যারা শেষনবী (ছাঃ)-এর অনুসারী হয়েছে। কুরআন ও সুন্নাহ লাভে ধন্য হয়েছে। পরকালে সর্বাধিক জান্নাতী হবার সৌভাগ্য কেবল তাদেরই হবে। অতএব কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাদেরই কর্তব্য ছালাত ও কুরবানী করা। এখানে ‘ছালাত’ বলতে ফরয-নফল সকল ছালাত বুঝানো হয়েছে এবং ‘নহর’ বলতে উট ও গরু-ছাগল সব কুরবানীকে বুঝানো হয়েছে।

(৩) إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْأَبْتَرُ ‘নিশ্চয়ই তোমার শত্রুই নির্বংশ’।

شَنَأَ يَشْنَأُ او شَنِئَ يَشْنَئُ شَنْأً و شَنْأَةً অর্থ বিদ্বেষ পোষণ করা, দুশমনী করা। সেখান থেকে اسم فاعل (কর্তৃকারক) شَانِئٌ অর্থ مُبْغِضٌ او عَدُوٌّ ‘বিদ্বেষী’ বা ‘শত্রু’। بَتَرَ يَبْتُرُ بَتْرًا অর্থ قَطَعَ ‘কর্তন করা’। সেখান থেকে اسم تفضيل হয়েছে الْأَبْتَرُ অর্থ الأقطع যা المقطوع ذكره من كل خير من الدنيا والآخرة ‘দুনিয়া ও আখেরাতের সকল কল্যাণময় স্মৃতি হ’তে বিচ্যুত’। আরবদের পরিভাষায় পশুদের মধ্যে ‘আবতার’ (الأبتر) ঐ পশুকে বলা হয়, যার লেজকাটা এবং মানুষের মধ্যে ঐ পুরুষকে বলা হয়, যার কোন পুত্রসন্তান বেঁচে থাকেনা (কুরতুবী)। কাফেররা তাঁকে ‘আবতার’ বলত এই ধারণায় যে তাঁর ও তাঁর অনুসরণের মধ্যে কোন কল্যাণ ও বরকত নেই। কারণ তাঁর তাওহীদের দাওয়াত ছিল প্রচলিত শিরকী প্রথার বিরোধী। যা ধনিক শ্রেণী ও সমাজনেতারা কবুল করেননি। অতএব তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে উক্ত দাওয়াত আপনা থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস, মুজাহিদ, সাঈদ বিন জুবায়ের, ক্বাতাদাহ প্রমুখ বিদ্বানগণ বলেন, ‘অত্র আয়াতে ‘তোমার শত্রু’ বলতে রাসূল বিদ্বেষী ‘আছ বিন ওয়ায়েলকে বুঝানো হয়েছে’। যে ব্যক্তি প্রথমে রাসূল (ছাঃ)-কে ‘আবতার’ বলেছিল। তবে যুগে যুগে সকল রাসূল বিদ্বেষীই এর মধ্যে শামিল।

অত্র আয়াতের মাধ্যমে শত্রুদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, কেবল পুত্রসন্তানই পিতার বংশরক্ষার একমাত্র মাধ্যম নয়। বরং কন্যা সন্তানের মাধ্যমেও আল্লাহ সে উদ্দেশ্য সাধন করতে পারেন। যেমন ফাতেমার সন্তান হাসান ও হোসায়েনের মাধ্যমে আল্লাহ সেটা করেছেন। তাছাড়া ঈসা (আঃ) ছিলেন মারিয়ামের সন্তান এবং তাঁর কোন বাপ ছিলনা। অথচ আল্লাহ তাঁকে ইবরাহীম (আঃ)-এর সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন (আন‘আম ৬/৮৪)। দ্বিতীয়তঃ পুত্রসন্তান না থাকলে কি হবে, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর রয়েছে এবং থাকবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত লাখো-কোটি অনুসারী উম্মতে মুহাম্মাদী, যারা তাঁর আদর্শিক সন্তান। যারা পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নাম উচ্চারণ করবে, তাঁকে ভালোবাসবে এবং তাঁর রেখে যাওয়া দ্বীনে ইসলামের অনুসরণ করবে। অতএব পুত্র-সন্তান না থাকায় তিনি নির্বংশ নন, বরং তোমরা যারা পুত্রসন্তান রেখে যাচ্ছ অথচ তারা বেদ্বীন, তারা তোমাদের ইহকালে ও পরকালে কোন কাজে লাগবে না। তোমাদের সুনাম করার মত কেউ থাকবে না। ফলে তোমাদের নাম একদিন স্মৃতির পাতা থেকে মুছে যাবে এবং তোমরাই কার্যতঃ নির্বংশ হবে। কিন্তু পুত্রসন্তান না থাকা সত্ত্বেও মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নাম পৃথিবীর দিকে দিকে দরূদসহ সর্বদা শ্রদ্ধাভরে পঠিত, লিখিত, উচচারিত ও গুঞ্জরিত হবে। অতএব হে নবী! তুমি নির্বংশ নও, বরং তোমার শত্রুরাই প্রকৃত অর্থে নির্বংশ ও লেজকাটা।

অত্র সূরায় রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি অজস্র কল্যাণ প্রদানের কথা বলা হয়েছে এবং তজ্জন্য তাঁকে ছালাত ও কুরবানীর মাধ্যমে ইখলাছের সাথে আল্লাহর ইবাদতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে একথাও বলে দেওয়া হয়েছে যে, যারা রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর আনীত ইসলামী শরী‘আতের বিরোধী ও বিদ্বেষী, তারাই প্রকৃত অর্থে ‘আবতার’। তাদের মধ্যে ও তাদের রচিত বিধানের মধ্যে কোন কল্যাণ নেই, কোন বরকত নেই। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন-আমীন!

সারকথা :

কল্যাণধর্মী জ্ঞান ও মঙ্গলময় স্মৃতিই মানুষকে অমর করে রাখে।


[1]. বুখারী হা/৪৯৬৬; তিরমিযী হা/৩৩৫৯; ইবনু মাজাহ হা/৪৩৩৪, হাদীছ ছহীহ।

[2]. বুখারী হা/৪৯৬৪; মুসলিম হা/৪০০; মিশকাত হা/৫৫৭১ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়, ‘হাউয ও শাফা‘আত’ অনুচ্ছেদ।

[3]. তিরমিযী হা/৩৩৫৯; ছহীহ ইবনে হিববান হা/৬৪৭৩; আহমাদ হা/১২০২৭; হাকেম হা/২৬৬; ছহীহ বুখারী তাফসীর অধ্যায় হা/৪৯৬৬ আনাস (রাঃ) থেকে প্রায় একই শব্দে বর্ণিত হয়েছে।

[4]. বুখারী হা/৪৯৬৬ ‘তাফসীর’ অধ্যায়; নাসাঈ কুবরা হা/১১৭০৪ ‘তাফসীর’ অধ্যায়।