সূরা কাফেরূন
(ইসলামে অবিশ্বাসীগণ)
সূরা মা‘ঊন-এর পরে মক্কায় অবতীর্ণ।
সূরা ১০৯, আয়াত ৬, শব্দ ২৭, বর্ণ ৯৫।
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।
(১) তুমি বল! হে অবিশ্বাসীগণ! | قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ |
(২) আমি ইবাদত করি না তোমরা যাদের ইবাদত কর | لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ |
(৩) এবং তোমরা ইবাদতকারী নও আমি যার ইবাদত করি | وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ |
(৪) আমি ইবাদতকারী নই তোমরা যাদের ইবাদত কর | وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَا عَبَدْتُمْ |
(৫) এবং তোমরা ইবাদতকারী নও আমি যার ইবাদত করি | وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ |
(৬) তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন এবং আমার জন্য আমার দ্বীন। | لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ |
বিষয়বস্ত্ত :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পক্ষ হ’তে কাফের সম্প্রদায়কে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে যে, তোমরা যাদের ইবাদত কর, আমি তাদের ইবাদত করি না (১-৫ আয়াত)। সর্বশেষ ৬ আয়াতে শিরকের সাথে পরিষ্কারভাবে বিচ্ছিন্নতা ঘোষণা করে বলা হয়েছে যে, তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আমার দ্বীন আমার।
গুরুত্ব :
ইবনু কাছীর বলেন, هذه السورة سورة البراءة من العمل الذي يعمله المشركون، وهي آمرة بالإخلاص فيه، ‘এ সূরাটি হ’ল মুশরিকরা যে সকল কাজ করে তা থেকে বিচ্ছিন্নতা ঘোষণাকারী এবং আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতার আদেশ দানকারী সূরা’ (ইবনু কাছীর)।
সূরাটির অন্য নাম হ’ল ‘মুনাবিযাহ’ (المنابذة) ‘শিরক নিক্ষেপকারী’। ‘মুক্বাশক্বিশাহ’ (المقشقشة) ‘ময়লা ছাফকারী’। ‘ইখলাছ’ (الإخلاص) ‘বিশুদ্ধ করা’। যে ব্যক্তি এই সূরা পাঠ করে, সে যেন এক চতুর্থাংশ কুরআন পাঠ করে। বিদ্বানগণ উক্ত মর্মে বর্ণিত হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন, কুরআনের মধ্যে আদেশ ও নিষেধসমূহ (مأمورات ومنهيات) রয়েছে। প্রত্যেকটিই হৃদয় ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে সম্পর্কিত (يتعلق بالقلب والجوارح)। বর্তমান সূরাটি ‘হৃদয়’ অর্থাৎ তৃতীয় প্রকারের সাথে জড়িত। যার উপরে ইবাদত ভিত্তিশীল। যার জন্যই জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে সূরাটি কুরআনের এক চতুর্থাংশের গুরুত্ব বহন করে (তাফসীর ইবনু জারীর-হাশিয়া)।
(১) আনাস ও ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন যে, সূরা যিলযাল কুরআনের অর্ধাংশের, সূরা ইখলাছ কুরআনের এক তৃতীয়াংশের ও সূরা কাফেরূন কুরআনের এক চতুর্থাংশের সমান’।[1]
(২) জাবের বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ত্বাওয়াফের দু’রাক‘আতে সূরা কাফেরূন ও সূরা ইখলাছ পাঠ করেন’।[2] সূরা কাফিরূন ও সূরা ইখলাছ হ’ল শিরক মুক্তির সূরা। সূরা দু’টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, রাসূল (ছাঃ) এ দু’টি সূরা প্রায় সর্বদা ফজর ও মাগরিবের এবং ত্বাওয়াফের দু’রাক‘আত সুন্নাতে পাঠ করতেন।
(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফজরের দু’রাক‘আতে সূরা কাফেরূন ও সূরা ইখলাছ পাঠ করেন।[3]
(৪) উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিন রাক‘আত বিতরের ১ম রাক‘আতে সূরা আ‘লা, ২য় রাক‘আতে সূরা কাফেরূন ও ৩য় রাক‘আতে সূরা ইখলাছ পাঠ করতেন। ঐসাথে সূরা ফালাক্ব ও নাস পাঠ করতেন’।[4]
(৫) আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, رَمَقْتُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَرْبَعاً وَعِشْرِينَ مَرَّةً أَوْ خَمْساً وَعِشْرِيْنَ مَرَّةً يَقْرَأُ فِى الرَّكْعَتَيْنِ قَبْلَ الْفَجْرِ وَالرَّكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْمَغْرِبِ بِـ (قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُوْنَ) وَ (قُلَ هُوَ اللهُ أَحَدٌ)- ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ফজরের পূর্বে দু’রাক‘আতে এবং মাগরিবের পরের দু’রাক‘আতে সূরা কাফেরূন ও সূরা ইখলাছ ২৪ দিন বা ২৫ দিন যাবত পাঠ করতে দেখেছি’।[5]
(৬) ফারওয়া বিন নওফেল স্বীয় পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন যে, আমি একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে গেলাম এবং তাঁকে বললাম, নিদ্রাকালে কি বলব তা আমাকে শিক্ষা দিন। তখন রাসূল (ছাঃ) আমাকে বললেন, তুমি নিদ্রাকালে সূরা কাফেরূন পাঠ কর। কেননা এটি হ’ল শিরক হ’তে মুক্তি ঘোষণার সূরা (براءة من الشرك)।[6]
(৭) আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ليس في القرآن أشد غيظا لإبليس منها، لأنها توحيد وبراءة من الشرك- ‘কুরআনে এই সূরাটির চাইতে ইবলীসের জন্য অধিক ক্রোধ উদ্দীপক সূরা আর নেই। কেননা এটি তাওহীদের এবং শিরক মুক্তির সূরা’ (কুরতুবী)।
(৮) আছমা‘ঈ বলেন, সূরা কাফেরূন ও সূরা ইখলাছ হ’ল শুকনা ঘায়ের খোসা ছাফকারী (المقشقشتان)। কেননা এ দু’টি সূরা (لأنهما تبرئان من النفاق) তার পাঠককে কপটতা হ’তে মুক্ত করে’ (কুরতুবী)।
ফায়েদা :
এদেশে এই সূরাগুলি বিদ‘আতী কাজে ব্যবহার করা হয়, যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। যেমন মাইয়েতের দাফনের সময় সূরা ফাতিহা, ক্বদর, কাফিরূন, নছর, ইখলাছ, ফালাক্ব ও নাস এই সাতটি সূরা বিশেষভাবে পাঠ করা; সূরা কাফিরূন, ইখলাছ, ফালাক্ব ও নাস এই চারটি ‘কুল’ সূরার প্রতিটি ১ লক্ষ বার পড়ে মৃতের নামে বখশে দেওয়া। যাকে এদেশে ‘কুলখানী’ বলা হয়। এগুলি ধর্মের নামে চালু হয়েছে। অথচ রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগে এসবের কোন অস্তিত্ব ছিল না।
শানে নুযূল :
(১) ইবনু ইসহাক ও অন্যান্যগণ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, অলীদ বিন মুগীরাহ, ‘আছ বিন ওয়ায়েল, আসওয়াদ বিন আবদুল মুত্ত্বালিব, উমাইয়া বিন খালাফ প্রমুখ মক্কার বিশিষ্ট নেতৃবর্গ একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসে আপোষ প্রস্তাব দিয়ে বলেন, هلم فلنعبدْ ما تعبد، وتعبدْ ما نعبد، ونشترك نحن وأنت في أمرنا كله- ‘এসো আমরা ইবাদত করি যার তুমি ইবাদত কর এবং তুমি ইবাদত কর যাকে আমরা ইবাদত করি। আমরা এবং তুমি আমাদের সকল কাজে পরস্পরে শরীক হই’।[7] তুমি যে দ্বীন নিয়ে এসেছ, তা যদি আমাদের দ্বীনের চাইতে উত্তম হয়, তাহ’লে আমরা সবাই তোমার সাথে তাতে শরীক হব। আর যদি আমাদেরটা উত্তম হয়, তাহ’লে তুমি আমাদের সাথে শরীক হবে। তখন অত্র সূরাটি নাযিল হয় (ইবনু জারীর, কুরতুবী)।
(২) অন্য বর্ণনায় এসেছে, তারা বলেছিল যে, যদি তুমি আমাদের কোন একটি মূর্তিকে চুমু দাও, তাতেই আমরা তোমাকে সত্য বলে মেনে নিব। তখন জিব্রীল অত্র সূরা নিয়ে আগমন করেন এবং তারা নিরাশ হয়ে যায়।[8]
(৩) তারা একথাও বলেছিল যে, তুমি চাইলে আমরা তোমাকে এত মাল দেব যে, তুমি সেরা ধনী হবে। তুমি যাকে চাও, তার সাথে তোমাকে বিয়ে দেব। আর আমরা সবাই তোমার অনুসারী হব। কেবল তুমি আমাদের দেব-দেবীদের গালি দেওয়া বন্ধ কর। যদি তাতেও তুমি রাযী না হও, তাহ’লে একটি প্রস্তাবে তুমি রাযী হও, যাতে আমাদের ও তোমার মঙ্গল রয়েছে। আর তা হ’ল, তুমি আমাদের উপাস্য লাত, উযযার এক বছর পূজা কর এবং আমরা তোমার উপাস্যের এক বছর পূজা করব। এইভাবে এক বছর এক বছর করে সর্বদা চলবে’। তখন এই সূরা নাযিল হয় (ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।
তাফসীর :
(১) قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُوْنَ ‘তুমি বল! হে অবিশ্বাসীগণ!’
অর্থাৎ তুমি কাফেরদের বল! হে কাফেরগণ!’ এখানে কুরায়েশ কাফেরদের উদ্দেশ্যে বলা হ’লেও এর দ্বারা যুগে যুগে বিশ্বের সকল কাফের ও অবিশ্বাসী সমাজকে বুঝানো হয়েছে। চাই সে ইহুদী, খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, নাস্তিক-কম্যুনিষ্ট, ধর্মনিরপেক্ষ বা নামধারী ও কপট মুসলিম যেই-ই হৌক না কেন। كَفَرَ يَكْفُرُ كُفْرًا وَكَافِرٌ অর্থ ‘গোপন করা’। বীজ বপন করার পর তা মাটিতে ঢেকে দেওয়া হয় বিধায় কৃষককে আরবীতে আভিধানিক অর্থে ‘কাফের’ বলা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, اِعْلَمُوْا أَنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَّلَهْوٌ وَّزِيْنَةٌ وَّتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلاَدِ كَمَثَلِ غَيْثٍ أَعْجَبَ الْكُفَّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيْجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا- ‘তোমরা জেনে রাখ, পার্থিব জীবন খেল-তামাশা, সাজ-সজ্জা, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধন ও সন্তানের আধিক্যের প্রতিযোগিতা ছাড়া কিছুই নয়। যেমন বৃষ্টির অবস্থা, (যার ফলে উদ্গত) সবুজ ফসল কৃষকদের চমৎকৃত করে। এরপর তা শুকিয়ে যায়। ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও..’ (হাদীদ ৫৭/২০)। এখানে الْكُفَّارَ (কৃষকদের) কথাটি আভিধানিক অর্থে এসেছে।
পক্ষান্তরে আল্লাহ বলেন, ياَ أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِيْنَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيْرُ ‘হে নবী! তুমি কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর এবং তাদের প্রতি কঠোর হও। তাদের ঠিকানা জাহান্নাম। সেটা কতই না নিকৃষ্ট স্থান’ (তাহরীম ৬৬/৯)। এ আয়াতে الْكُفَّارَ (কাফেরদের) কথাটি পারিভাষিক অর্থে এসেছে। উল্লেখ্য যে, এখানে মুনাফিকদের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ অর্থ মৌখিক জিহাদ। সশস্ত্র জিহাদ নয়। কেননা তারা প্রকাশ্যে মুসলমান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে হত্যা করেননি।
(২-৫) لاَ أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَ، وَلاَ أَنْتُمْ عَابِدُوْنَ مَا أَعْبُدُ، وَلاَ أَنَا عَابِدٌ مَّا عَبَدتُّمْ، وَلاَ أَنْتُمْ عَابِدُوْنَ مَا أَعْبُدُ- ‘আমি ইবাদত করিনা তোমরা যাদের ইবাদত কর’ (২)। ‘এবং তোমরা ইবাদতকারী নও আমি যার ইবাদত করি’ (৩)। ‘আমি ইবাদতকারী নই তোমরা যাদের ইবাদত কর’ (৪) ‘এবং তোমরা ইবাদতকারী নও আমি যার ইবাদত করি’ (৫)।
আয়াতে مَا أَعْبُدُ -এর مَا অর্থ مَنْ ‘যাকে’। অর্থাৎ আল্লাহকে। কেননা (اسم موصول) مَا যখন আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তিত হয়, তখন তার অর্থ হয় مَنْ। সাধারণতঃ مَا আসে প্রাণহীন বস্ত্তর জন্য। পক্ষান্তরে مَنْ আসে প্রাণী ও জ্ঞানবান সত্তার জন্য। এক্ষণে আয়াতের অর্থ হবেلا أعبد الآن ما تعبدون ‘আমি এখন ইবাদত করি না তোমরা যাদের ইবাদত কর’।ولا أنتم عابدون فى المستقبل ما اعبد الآن ‘তোমরা ভবিষ্যতে ইবাদতকারী নও এখন আমি যার ইবাদত করি’। ولا انا عابد فى المستقبل ما عبدتم فى الماضى ‘আর আমি ভবিষ্যতে ইবাদতকারী নই যার ইবাদত তোমরা পূর্ব থেকে করে আসছ’। ولا أنتم عابدون فى المستقبل ما اعبد الآن ‘এবং তোমরা ভবিষ্যতে ইবাদতকারী নও এখন আমি যার ইবাদত করি’ (ইবনু জারীর)। কেননা فعل مضارع বর্তমান কালের অর্থ দেয় এবং اسم فاعل ভবিষ্যৎ কালের অর্থ দেয়।
এর মধ্যে কাফের নেতাদের ইসলাম কবুলের প্রতি রাসূল (ছাঃ)-কে অধিক আগ্রহী না হওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়েছে এবং আপোষ প্রস্তাবকারীরা যে ভবিষ্যতে কখনো ইসলাম কবুল করবে না, সেকথাও বলে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবে সেটাই হয়েছিল। তাদের অধিকাংশ নেতা বদরের যুদ্ধে নিহত হয় এবং বাকী প্রায় সবাই কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে (ইবনু জারীর)। বস্ত্ততঃ এর মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সত্যনবী হওয়ার দলীল রয়েছে। আল্লাহ বলেন, قُلْ أَفَغَيْرَ اللهِ تَأْمُرُونِّي أَعْبُدُ أَيُّهَا الْجَاهِلُوْنَ ... بَلِ اللهَ فَاعْبُدْ وَكُنْ مِنَ الشَّاكِرِيْنَ- ‘তুমি বল, হে মূর্খরা! তোমরা কি আমাকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত করতে বলছ’? ... ‘বরং আল্লাহকেই তুমি ইবাদত কর ও কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হও’ (যুমার ৩৯/৬৪, ৬৬)।
আলোচ্য সূরায় ২-৩ আয়াতে বর্ণিত কথাটি পুনরায় ৪-৫ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। উদ্দেশ্য হ’ল তাকীদ করা (ইবনু জারীর) এবং মুশরিকদের থেকে বিচ্ছিন্নতার বিষয়টি জোরালোভাবে ব্যক্ত করা। অর্থাৎ তোমরা ইবাদতের নামে যেসব মনগড়া দেব-দেবী ও পন্থা-পদ্ধতি আবিষ্কার করেছ, ঐসব মাধ্যম ও পদ্ধতি আমি অনুসরণ করি না। আমি কেবল আল্লাহর ইবাদত করি এবং কেবল সেই পদ্ধতিতে ইবাদত করি, যে পদ্ধতি আল্লাহ আমাকে বাৎলে দিয়েছেন এবং যে ইবাদত তিনি ভালবাসেন ও যাতে তিনি খুশী হন। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنْ يَّتَّبِعُوْنَ إِلاَّ الظَّنَّ وَمَا تَهْوَى الْأَنْفُسُ وَلَقَدْ جَاءَهُمْ مِنْ رَّبِّهِمُ الْهُدَى- ‘তারা অনুমান ও খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে মাত্র। অথচ তাদের নিকটে তাদের পালনকর্তার পক্ষ হ’তে পথনির্দেশ এসেছে’ (নাজম ৫৩/২৩)। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর অনুসারীগণ আল্লাহ প্রেরিত বিধান অনুযায়ী তাঁর ইবাদত করে থাকেন। অর্থাৎ لا معبود إلا الله ولا طريق إليه إلا بما جاء به الرسول صلى الله عليه وسلم- ‘আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই এবং যে শরী‘আত নিয়ে রাসূল (ছাঃ) আগমন করেছেন, তার অনুসরণ ব্যতীত আল্লাহর নিকটে পৌঁছবার কোন পথ নেই’। অথচ মুশরিকরা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত করে এবং নিজেদের মনগড়া ধর্মীয় পদ্ধতির অনুসরণ করে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি। আর সেকারণেই এগুলির বিরুদ্ধে তাকীদের জন্য বারবার বলা হয়েছে, وَلاَ أَنَا عَابِدٌ مَا عَبَدْتُمْ وَلاَ أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ ‘আমি ইবাদতকারী নই তোমরা যার ইবাদত কর’। ‘এবং তোমরা ইবাদতকারী নও আমি যার ইবাদত করি’।
এরূপ পুনরুক্তি বা তাকীদের দৃষ্টান্ত কুরআনের অন্যান্য স্থানেও রয়েছে। আর এটা আরবদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাকরীতি। যেমন সূরা রহমানে فَبِأَيِّ آلآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ- ৩১ বার, সূরা মুরসালাতে وَيْلٌ يَّوْمَئِذٍ لِّلْمُكَذِّبِيْن ১০ বার, সূরা নাবা-তে كَلاَّ سَيَعْلَمُوْنَ، ثُمَّ كَلاَّ سَيَعْلَمُوْنَ ২ বার, সূরা শারহতে فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْراً، إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْراً ২ বার, সূরা তাকাছুরে كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُوْنَ، ثُمَّ كَلاَّ سَوْفَ تَعْلَمُوْنَ ২ বার, অতঃপর لَتَرَوُنَّ الْجَحِيْمَ، ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَيْنَ الْيَقِيْنِ ২ বার, সূরা ইনশিক্বাক্বে وَأَذِنَتْ لِرَبِّهَا وَحُقَّتْ ২ বার, সূরা নিসাতে إِنَّ اللهَ لاَ يَغْفِرُ أَن يُّشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذَلِكَ لِمَنْ يَّشَآءُ ৪৮ ও ১১৬ আয়াতে ২ বার এবং একই মর্মে সূরা মায়েদাহ ৭২ আয়াতেإِنَّهُ مَنْ يُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ- এসেছে। অনুরূপভাবে إِنَّكَ لاَ تُسْمِعُ الْمَوْتَى আয়াতটি সূরা নমল ৮০ ও রূম ৫২ তে ২ বার এসেছে।
তবে ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুফাসসিরগণ এর অর্থ বর্ণনা করেছেন যে, ‘অতীতে তোমরা যাদের ইবাদত করেছ, আমি তাদের ইবাদত করিনি এবং ভবিষ্যতে তোমরা যাদের ইবাদত করবে, আমি তাদেরও ইবাদতকারী নই’ (ইবনু কাছীর)। অর্থাৎ অতীতে ও ভবিষ্যতে সর্বকালে আমি তোমাদের ইবাদতের সাথে আপোষকারী নই।
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, لاَ أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَ দ্বারা ‘ইবাদত না করা’ (نفى الفعل) বুঝানো হয়েছে এবং وَلاَ أَنَا عَابِدٌ مَّا عَبَدتُّمْ দ্বারা ‘একেবারেই কবুল না করা’ (نفى القبول بالكلية) বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ তাদের শিরকী পদ্ধতির ইবাদতের বাস্তবায়ন এবং উক্ত আক্বীদা কবুল করার সম্ভাবনা পুরোপুরি নাকচ করা হয়েছে। হাফেয ইবনু কাছীর বলেন, وهو قول حسن ‘এটাই উত্তম কথা’ (ইবনু কাছীর)। অথবা এর অর্থ এটাও হ’তে পারে যে, ليست عبادتى كعبادتكم ولا عبادتكم كعبادتى ‘আমার ইবাদত তোমাদের ইবাদতের মত নয় এবং তোমাদের ইবাদত আমার ইবাদতের মত নয়’। এর মাধ্যমে তাদের ইবাদতকে অস্বীকার করা হচ্ছে, মা‘বূদকে নয়। কেননা তাদের ইবাদত শিরক মিশ্রিত এবং আমার ইবাদত শিরক বিমুক্ত, যা খালেছভাবে কেবল আল্লাহর জন্য নিবেদিত।
আরবরা আল্লাহকে বিশ্বাস করত এবং নবী ইবরাহীমকে মানত। কিন্তু তারা বিগত নেককার লোকদের মূর্তিপূজা করত এবং তাকে আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের মাধ্যম গণ্য করত। অথচ তাওহীদ বিশ্বাস হ’তে হবে খালেছ ও অবিমিশ্র। যেমন আল্লাহ বলেন, أَلاَ لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلاَّ لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللهِ زُلْفَى إِنَّ اللهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِي مَا هُمْ فِيْهِ يَخْتَلِفُوْنَ إِنَّ اللهَ لاَ يَهْدِي مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ ‘জেনে রাখ, খালেছ আনুগত্য কেবল আল্লাহরই প্রাপ্য। অথচ যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে, তারা বলে, আমরা তো এদের পূজা এজন্যেই করি যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যশীল করে দিবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ফায়ছালা করে দিবেন তারা যেসব বিষয়ে মতভেদ করছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মিথ্যাবাদী কাফিরকে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (যুমার ৩৯/৩)। তারা আরও বলত, هَؤُلاَءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللهِ ‘ওরা আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট সুফারিশকারী’ (ইউনুস ১০/১৮)। আল্লাহ বলেন, إِنَّكَ لاَ تُسْمِعُ الْمَوْتَى وَلاَ تُسْمِعُ الصُّمَّ الدُّعَاءَ إِذَا وَلَّوْا مُدْبِرِيْنَ ‘নিশ্চয়ই তুমি শুনাতে পারো না কোন মৃতকে এবং শুনাতে পারো না কোন বধিরকে, যখন তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়’ (নমল ২৭/৮০; রূম ৩০/৫২)। তিনি আরও বলেন,وَمَا أَنْتَ بِمُسْمِعٍ مَنْ فِي الْقُبُورِ ‘তুমি কোন কবরবাসীকে শুনাতে সক্ষম হবে না’ (ফাত্বির ৩৫/২২)। ছবি-মূর্তি, ভাষ্কর্য, বেদী-মিনার-সৌধ ও কবরপূজারীরা এ থেকে উপদেশ গ্রহণ করবেন কি?
কুরতুবী বলেন, এটা মুশরিকদের কথার পাল্টা কথা হ’তে পারে। যেমন তারা বলেছিল, تعبد آلهتنا ونعبد إلهك ثم تعبد آلهتنا ونعبد إلهك ‘তুমি ইবাদত কর আমাদের উপাস্যদের এবং আমরা ইবাদত করব তোমার উপাস্যের। অতঃপর তুমি ইবাদত করবে আমাদের উপাস্যদের এবং আমরা ইবাদত করব তোমার উপাস্যের’। একথার জওয়াবে আল্লাহ নাযিল করলেন لاَ أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَ، وَلاَ أَنْتُمْ عَابِدُوْنَ مَا أَعْبُدُ ‘আমি ইবাদত করিনা তোমরা যার ইবাদত কর’। ‘এবং তোমরা ইবাদতকারী নও আমি যার ইবাদত করি’ (কুরতুবী)।
এক্ষণে বর্ণিত পাঁচটি আয়াতের বক্তব্য একত্রে দাঁড়াচ্ছে এই যে,قل يا أيها الكافرون لا أعبد الأصنام التى تعبدونها ولا أنتم عابدون الله عزوجل الذى أعبده لإشراككم به، ولا أعبد كعبادتكم، فأنتم كاذبون فى دعوى عبادتكم لله- ‘তুমি বল, হে কাফের সমাজ! আমি মূর্তিপূজা করি না, যা তোমরা করে থাক এবং তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো না, যার ইবাদত আমি করে থাকি। কেননা তোমরা তাঁর সাথে অন্যকে শরীক করে থাক। আর আমি ইবাদত করি না তোমাদের ইবাদতের ন্যায়। অতএব তোমরা আল্লাহর ইবাদতের দাবীতে মিথ্যাবাদী’।
বাক্যে ما অব্যয়টি مصدرية হ’তে পারে। অর্থাৎ ولا أنتم عابدون مثل عبادتى ‘তোমরা ইবাদতকারী নও আমার ইবাদতের ন্যায়’ (কুরতুবী)। যা হ’ল শিরক বিমুক্ত নির্ভেজাল তাওহীদ বিশ্বাস। পক্ষান্তরে তোমাদের ইবাদত হ’ল শিরক মিশ্রিত ভেজাল বিশ্বাস। দু’টি বিশ্বাস ও ইবাদতের পন্থা ও পদ্ধতি সম্পূর্ণ পৃথক। যেখানে আপোষের ক্ষীণতম কোন সুযোগ বা সম্ভাবনা নেই। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِيْ كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُوْلاً أَنِ اعْبُدُوااللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ ‘আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট রাসূল পাঠিয়েছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত থেকে বিরত হও’ (নাহ্ল ১৬/৩৬)। এখানে আল্লাহ ও ত্বাগূতকে পরস্পরের বিপরীত হিসাবে পেশ করা হয়েছে। এতে বুঝা যায় যে, إِنَّ الْعِبَادَةَ لاَ تَحْصُلُ اِلاَّ بِالْكُفْرِ بِالطَّاغُوْتِ ‘ত্বাগূতের সাথে কুফরী করা ব্যতীত আল্লাহর ইবাদত হাছিল হয় না’। কেবল ‘ইল্লাল্লাহ’ বললে তাওহীদের স্বীকৃতি বুঝায় না ‘লা ইলাহা’ ব্যতীত। কেননা ‘ত্বাগূত’ হ’ল, كُلُّ مَا عُبِدَ مِنْ دُوْنِ اللهِ ‘আল্লাহ ব্যতীত সকল উপাস্য’। সেটা কোন জীবিত বা মৃত মানুষ হ’তে পারে, কোন মূর্তি-প্রতিমা, প্রতিকৃতি, জিন-ফেরেশতা, সূর্য-চন্দ্র, পাহাড়-বৃক্ষ বা যে কোন উপাস্য বস্ত্ত হ’তে পারে। মক্কার মুশরিকরা আল্লাহতে বিশ্বাসী ছিল। অথচ বিভিন্ন মৃত মানুষের মূর্তি গড়ে তার অসীলায় তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করত (যুমার ৩৯/৩)। এযুগের পৌত্তলিকরাও এক ঈশ্বরে বিশ্বাসের কথা বলে। অথচ নিজেদের মনগড়া মূর্তি বানিয়ে তার পূজা করে।
বস্ত্ততঃ এটাই হ’ল বড় শিরক। কেননা এরূপ অবস্থায় আল্লাহর সন্তুষ্টির চাইতে অসীলার সন্তুষ্টি মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। যাবতীয় নযর-নেয়ায, ভেট-তোহফা, ভক্তি ও শ্রদ্ধাঞ্জলি কথিত অসীলার কবরে, মূর্তিতে, ছবি ও প্রতিকৃতিতে, মিনারে ও বেদীতে নিবেদিত হয়। অথচ যাকে অসীলা ভেবে পূজা করা হচ্ছে, শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করা হচ্ছে, যার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে নীরবতা পালন করা হচ্ছে, সে কিছুই দেখছে না, শুনছে না বা জানছে না। বাস্তব কথা এই যে, জাহেলী আরবের এই শিরকী প্রথা বিভিন্ন নামে আধুনিক যুগের উচ্চ শিক্ষিত ও নেতৃস্থানীয় লোকেরা পালন করে যাচ্ছে অবলীলাক্রমে দ্বিধাহীন চিত্তে। সেদিন যেমন কুরায়েশ মুশরিকরা দাবী করত আমরা ইবরাহীমী দ্বীনের খাঁটি অনুসারী ‘হানীফ’। আজও তেমনি আমরা মুখে ও কলমে দাবী করছি আমরা ‘মুসলমান’। অথচ কাজ করছি মুশরিকের। এর চেয়ে বড় মূর্খতা আর কি হ’তে পারে? এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন, وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللهِ إِلاَّ وَهُمْ مُشْرِكُوْنَ ‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহকে বিশ্বাস করে। কিন্তু তারা শিরক করে’ (ইউসুফ ১২/১০৬)।
(৬) لَكُمْ دِيْنُكُمْ وَلِيَ دِيْنِ ‘তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন এবং আমার জন্য আমার দ্বীন’।
دِيْنِ অর্থ الملة والحساب والعادة والحال والسيرة والورع والاعتقاد والاسلام والقضاء والحكم والسلطان والتدبير واسم لجميع ما يعبد به الله ‘দল, হিসাব, অভ্যাস, অবস্থা, চরিত, পরহেযগারী, তাওহীদ বিশ্বাস, ইসলাম, ফায়ছালা, নির্দেশ, রাজত্ব, ব্যবস্থাপনা এবং আল্লাহর দাসত্বপূর্ণ সকল কাজ’ (আল-মু‘জাম)। এতদ্ব্যতীত এর অর্থ বদলা, আনুগত্য, যবরদস্তি, বাধ্যতা, অবাধ্যতা, মাযহাব, পাপ, গ্লানি ইত্যাদি (মিছবাহুল লুগাত)।
কুরতুবী বলেন, ‘দ্বীন’ অর্থ ‘কর্মফল’ হ’তে পারে। অর্থাৎ لكم جزاءكم ولى جزائى ‘তোমাদের কর্মফল তোমাদের এবং আমার কর্মফল আমার’ (কুরতুবী)। তানতাভী বলেন, فلكم شرككم ولى توحيدى ‘তোমাদের জন্য তোমাদের শিরক এবং আমার জন্য আমার তাওহীদ’। তিনি বলেন, দ্বীন অর্থ হিসাব, কর্মফল, দো‘আ, ইবাদত ইত্যাদি হয়ে থাকে’ (তানতাভী)।
অত্র আয়াতে কাফের-মুশরিকদের বিরুদ্ধে ধমকি রয়েছে। অর্থাৎ إن رضيتم بدينكم فقد رضينا بديننا ‘যদি তোমরা তোমাদের দ্বীন নিয়ে সন্তুষ্ট থাক, তবে আমিও আমার দ্বীন নিয়ে সন্তুষ্ট রয়েছি’ (কুরতুবী)। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে, لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ ‘আমাদের জন্য আমাদের কর্ম এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কর্ম’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৫)। আরও এসেছে, وَإِنْ كَذَّبُوْكَ فَقُلْ لِّيْ عَمَلِيْ وَلَكُمْ عَمَلُكُمْ أَنْتُمْ بَرِيْئُوْنَ مِمَّا أَعْمَلُ وَأَنَا بَرِيءٌ مِّمَّا تَعْمَلُوْنَ- ‘আর যদি ওরা তোমাকে মিথ্যারোপ করে তাহ’লে তুমি বল, আমার কর্ম আমার এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের। আমি যা করি, তা থেকে তোমরা মুক্ত এবং তোমরা যা কর, তা থেকে আমি মুক্ত’ (ইউনুস ১০/৪১)।
ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন, এখানে ‘তোমাদের দ্বীন’ বলতে ওদের ‘কুফরী’কে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ ওটা হ’ল دين الطاغوت ‘ত্বাগুতের দ্বীন’। আর ‘আমাদের দ্বীন’ বলতে ‘ইসলাম’-কে বুঝানো হয়েছে’ (ইবনু কাছীর)। ‘দ্বীন’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এজন্য যে, তারা তাদের কুফরীকেই দ্বীন বলে মনে করত (কুরতুবী)।
এখানে دِيْنِ আসলে ছিল دِيْنِى কিন্তুى বিলুপ্ত করা হয়েছে এবং তার নিদর্শন স্বরূপ শেষে যেরযুক্ত নূন হয়েছে। এটা করা হয়েছে আয়াতের শেষে ওয়াক্ফ বা বিরতির কারণে। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে, الَّذِيْ خَلَقَنِيْ فَهُوَ يَهْدِيْنِ، وَالَّذِيْ هُوَ يُطْعِمُنِيْ وَيَسْقِيْنِ، وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِيْنِ، وَالَّذِيْ يُمِيتُنِيْ ثُمَّ يُحْيِيْنِ- ‘(ইবরাহীম তাঁর কওমের নিকটে আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরে বলেন,) যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন অতঃপর সুপথ প্রদর্শন করেছেন’। ‘যিনি আমাকে খাদ্য ও পানীয় দান করেন’। ‘যখন আমি পীড়িত হই, তখন যিনি আমাকে আরোগ্য দান করেন’। ‘এবং যিনি আমাকে মৃত্যু দান করবেন, অতঃপর জীবিত করবেন’ (শো‘আরা ২৬/৭৮-৮১)।
হাফেয ইবনু কাছীর বলেন যে, ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু ইদরীস শাফেঈ (রহঃ) এবং অন্যান্য বিদ্বানগণ আলোচ্য আয়াত দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছেন যে, الْكُفْرُ كُلُّهُ مِلَّةٌ وَاحِدَةٌ ‘কাফেরকুল সবাই এক দলভুক্ত’ (ইবনু কাছীর)।
ইসলামই মানবজাতির জন্য একমাত্র দ্বীন :
আল্লাহ বলেন, إِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلاَمُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট মনোনীত একমাত্র দ্বীন হ’ল ইসলাম’ (আলে ইমরান ৩/১৯)। তিনি বলেন, وَمَن يَّبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلاَمِ دِيْناً فَلَنْ يُّقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ- ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করবে, কখনোই তা কবুল করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৩/৮৫)। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يَسْمَعُ بِى أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِىٌّ وَلاَ نَصْرَانِىٌّ ثُمَّ يَمُوْتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِى أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ ‘যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন নিহিত তাঁর কসম করে বলছি, ইহুদী হৌক বা নাছারা হৌক এই উম্মতের যে কেউ আমার আগমনের খবর শুনেছে, অতঃপর মৃত্যুবরণ করেছে, অথচ আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তার উপরে ঈমান আনেনি, সে ব্যক্তি অবশ্যই জাহান্নামী হবে’।[9]
কোন কোন বিদ্বান বলেছেন, অত্র সূরাটি জিহাদ ফরয হওয়ার পূর্বে নাযিল হয়েছে বিধায় এর হুকুম রহিত হয়ে গেছে (কুরতুবী)। কাফিররা মুসলিম দেশে জিযিয়া কর দিয়ে বসবাস করবে। তবে সঠিক কথা এই যে, আমরা আমাদের ইবাদত করব, তারা তাদের ইবাদত করবে। কোন অবস্থাতেই মুসলমান আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারু ইবাদত করবে না, অন্য কারু বিধান মানবে না, অন্যদের ইবাদতের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে না। বরং সর্বাবস্থায় শিরক বিমুক্ত নির্ভেজাল তাওহীদের অনুসারী থাকবে।
অত্র আয়াতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের জন্য কোন সান্ত্বনা নেই। কেননা শিরক ও কুফর কোন দ্বীন নয়। এটা শয়তানী ফাঁদ মাত্র। ওটার পরিণাম জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নয়। জান্নাতপিয়াসী মুমিন অবশ্যই সর্বাবস্থায় আল্লাহ প্রেরিত ইসলামের অনুসারী হবে। পক্ষান্তরে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রথমে মুমিনকে ঈমানের গন্ডীমুক্ত করে। অতঃপর গণতন্ত্র মানুষকে মানুষের দাসত্বে বন্দী করে। অতঃপর তা আল্লাহর সন্তুষ্টি বাদ দিয়ে মানুষের সন্তুষ্টি তালাশ করে। যা তাকে জাহান্নামের পথে নিয়ে যায়। তাই তাওহীদের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের আপোষের কোনই সুযোগ নেই।
সারকথা :
তাওহীদের আক্বীদা মানুষের সার্বিক জীবনকে আল্লাহর দাসত্বে গড়ে তোলে। পক্ষান্তরে শিরকের আক্বীদা মানুষকে আল্লাহ থেকে ফিরিয়ে শয়তানের গোলামীতে আবদ্ধ করে। দু’টির জীবন ও কর্মধারা হয় সম্পূর্ণরূপে পৃথক ও বিপরীতধর্মী। তাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ কর্মফল ভোগ করতে হবে এবং উভয়ের পরিণতি হবে সম্পূর্ণ পৃথক।[1]. তিরমিযী হা/২৮৯৪, মিশকাত হা/২১৫৬; ছহীহাহ হা/৫৮৬; ছহীহুল জামে’ হা/৬৪৬৬।
[2]. মুসলিম হা/১২১৮ ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ‘নবী (ছাঃ)-এর হজ্জ’ অনুচ্ছেদ, মিশকাত হা/২৫৫৫।
[3]. মুসলিম হা/৭২৬, মিশকাত হা/৮৪২ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ১২ অনুচ্ছেদ।
[4]. হাকেম ১/৩০৫, আবুদাঊদ, দারেমী, মিশকাত হা/১২৬৯, ১২৭২ ‘বিতর’ অনুচ্ছেদ।
[5]. আহমাদ হা/৫৬৯৯, সনদ ছহীহ।
[6]. তিরমিযী হা/৩৪০৩; আবুদাঊদ হা/৫০৫৫; আহমাদ হা/২৩৮৫৮; মিশকাত হা/২১৬১।
[7]. ইবনু জারীর, কুরতুবী; সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৩৬২ ‘সূরা কাফেরূন নাযিলের কারণ’ অনুচ্ছেদ।
[8]. সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৩৬২; কুরতুবী।
[9]. মুসলিম হা/১৫৩; মিশকাত হা/১০।