প্রশ্ন-৮ : কুরআনে চুম্বন দেওয়ার হুকুম কি?
উত্তর : আমাদের মতে বিষয়টি সাধারণ হাদীছ সমূহের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। যেমন إِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُوْرِ فَاِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ ‘তোমরা দ্বীনের মধ্যে নবোদ্ভূত বিষয় সমূহ হ’তে দূরে থাক। কেননা প্রত্যেক নবোদ্ভূত বস্ত্তই বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’। অন্য হাদীছে এসেছে, وَكُلُّ ضَلاَلَةٍ فِى النَّارِ ‘এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম’।
এইসব বিষয়ে কিছু লোকের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তারা বলেন, এতে আর এমন কি? এটা তো কুরআন মজীদকে সম্মান করা ভিন্ন অন্য কিছু নয়? কিন্তু প্রশ্ন হ’ল, এমন সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শনের বিষয়টি কি প্রথম যুগের মুসলমানদের নিকটে গোপন ছিল? অর্থাৎ ছাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের শিষ্য তাবেঈনে এযাম ও তাঁদের শিষ্য তাবে-তাবেঈনের নিকটে? নিঃসন্দেহে এর জওয়াব হবে সেটাই যা পূর্ববর্তী বিদ্বানগণ বলেন, لوكان خيرًا لسبقونا إليه ‘যদি এটা উত্তম হ’ত, তাহ’লে অবশ্যই তাঁরা আমাদের আগেই একাজ করতেন’।
এটা হ’ল একটি দিক। আরেকটি দিক হ’ল, কোন বস্ত্তকে চুম্বন দেওয়ার মূলে কি নিহিত রয়েছে? সিদ্ধতা না নিষিদ্ধতা? এখানে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য ছহীহায়নে বর্ণিত সেই প্রসিদ্ধ হাদীছটি আমরা অবশ্যই পেশ করব, যাতে বর্তমান যুগের মুসলমানরা তাদের পূর্ববর্তীদের বুঝ থেকে কত দূরে অবস্থান করছে, তা উপলব্ধি করতে পারে এবং তারা ঐসব বিষয়ে সমাধানে আসতে পারে, যেসব বিষয় তাদের কাছে আলোচনা করা হয়।
হাদীছটি হ’ল, আবেস বিন রাবী‘আহ হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-কে হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করতে দেখলাম যে এ সময় তিনি বলছেন,
إِنِّيْ لَأَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لاَ تَضُرُّ وَلاَ تَنْفَعُ، فَلَوْلاَ أَنِّيْ رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى اللهُ عليه وسلم يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ ، متفق عليه-
‘আমি অবশ্যই জানি যে তুমি একটা পাথর। না ক্ষতি করতে পার, না উপকার করতে পার। আমি যদি না দেখতাম যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তোমাকে চুম্বন দিচ্ছেন, তাহ’লে আমি তোমাকে চুম্বন দিতাম না’।[1] এক্ষণে ওমর (রাঃ) হাজারে আসওয়াদ কেন চুম্বন দিলেন? কেননা ছহীহ হাদীছে এসেছে, اَلْحََجَرُ الأَسْوَدُ مِنَ الْجَنَّةِ ‘হাজারে আসওয়াদ জান্নাতের পাথর’।[2] এখানে ওমর (রাঃ) কি এই যুক্তির ভিত্তিতে চুম্বন দিয়েছেন যে, এটি জান্নাতের একটি নিদর্শন, মুমিনদেরকে যার ওয়াদা করা হয়েছে; অতএব আমি একে চুম্বন করব? এজন্য চুম্বন বিষয়ে রাসূলের নির্দেশনা আমার নিকটে স্পষ্ট হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। যেমন প্রশ্নকারী তার আলোচ্য প্রশ্নে বলেছেন যে, এটি আল্লাহর কালাম। অতএব আমরা একে চুম্বন করব। নাকি এসব প্রশাখাগত বিষয়ে আমরা ঐরূপ আচরণ করব, যেরূপ কিছু লোক আজকাল নামকরণ করেছেন ‘সালাফী তর্কশাস্ত্র’ (المنطق السلفي) বলে, যার বক্তব্য হ’ল, খালেছভাবে আল্লাহর রাসূলের পদাংক অনুসরণ করা এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাঁর সুন্নাতের পায়রবী করা’। আর এটাই ছিল ওমর (রাঃ)-এর দৃষ্টিভঙ্গি’। যেজন্য তিনি বলেছিলেন, ‘যদি আমি না দেখতাম যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তোমাকে চুম্বন দিচ্ছেন, তাহ’লে আমি তোমাকে চুম্বন দিতাম না’।
অতএব এই ধরনের চুম্বনের বিষয়ে মূলনীতি হ’ল এই যে, আমরা বিগত সুন্নাতের উপরে চলব। এসব বিষয়ে আমরা এমন হুকুম দেব না যে, هذا حسن وماذا في ذلك ‘এটা ভাল কাজ। এতে এমন আর কি আছে’?
এ বিষয়ে যায়েদ বিন ছাবিত (রাঃ)-এর পদক্ষেপ দেখুন। যখন কুরআনকে হেফাযতের উদ্দেশ্যে আবুবকর ও ওমর (রাঃ) তাকে সংকলনের প্রস্তাব দেন, তখন তিনি বলে ওঠেন, كَيْفَ تَفْعَلُوْنَ شَيْئًا مَا فَعَلَهُ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ ‘আপনারা কিভাবে এরূপ কাজ করবেন, যা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) করেননি?’ আজকাল মুসলমানদের নিকটে দ্বীনের বিষয়ে এরূপ বুঝ আদৌ নেই।
কুরআনে চুম্বনকারী ব্যক্তিকে যখন বলা হয়, কিভাবে তুমি একাজ করছ, যা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) করেননি, তখন সে আপনার মুখের উপরে কয়েকটি বিস্ময়কর জওয়াব দিবে। যেমন (১) আরে ভাই! এতে কি এমন এসে যায়? এর মধ্যে তো কুরআনের তা‘যীম রয়েছে। তখন আপনি তাকে বলুন, হে ভাই! একথা আপনার বিরুদ্ধে ফিরে যাবে। আচ্ছা, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কি কুরআনের তা‘যীম করতেন না? নিঃসন্দেহে তিনি কুরআনের তা‘যীম করতেন। এতদসত্ত্বেও তিনি তাতে চুমু দিতেন না।
(২) অথবা বলবে, আপনি আমাদেরকে কুরআনে চুমু দিতে নিষেধ করছেন। অথচ আপনি বাস-ট্যাক্সি, বিমান ইত্যাদিতে চড়ে ভ্রমণ করেন। আর এগুলি সবই নবাবিষ্কৃত বা বিদ‘আত।
এর জবাবে বলা হবে যে, যে বিদ‘আত ভ্রষ্টতা, তা হ’ল দ্বীনের বিষয়ে নবাবিষ্কৃত বস্ত্ত। এক্ষণে দুনিয়াবী বিষয়ে এটি কখনো সিদ্ধ, আবার কখনো নিষিদ্ধ, যে বিষয়ে কিছু পূর্বেই আমরা ইঙ্গিত করে এসেছি। এটি খুবই প্রসিদ্ধ বিষয়। যার জন্য উদাহরণের প্রয়োজন নেই।
ধরুন যে ব্যক্তি হজ্জের সফরে বিমানে ভ্রমণ করেন, নিঃসন্দেহে তা সিদ্ধ। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি বিমানে চড়ে পাশ্চাত্য দেশ সমূহে গমন করে ও সেখানকার সংকল্প করে, নিঃসন্দেহে তা পাপকর্ম। এরূপ অন্যান্য বিষয়।
অতঃপর দ্বীনী বা উপাসনাগত বিষয়সমূহ সম্পর্কে যদি প্রশ্নকারীকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, কেন আপনি এগুলি করেন? জবাবে তিনি বলবেন, আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের জন্য। তখন আমি বলব, আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের কোন পথ নেই আল্লাহর দেখানো পথ ব্যতীত। আমি একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, كُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ ‘প্রত্যেক নবোদ্ভুত বস্ত্তই ভ্রষ্টতা’ এই মূলনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমার ধারণা মতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, لا مجال لاستحسان عقلى بتاتا ‘শরী‘আত বিষয়ে জ্ঞানগত ইস্তেহসান অর্থাৎ আমার জ্ঞান যেটাকে ভাল মনে করে সেটাই করব, এরূপ কথা বলার আদৌ কোন সুযোগ নেই’। এজন্য বিগত কোন বিদ্বান বলেছেন, ما أحدثة بدعة إلا وأميةة سنة ‘যখন একটি বিদ‘আতের উদ্ভব হয়, তখনই একটি সুন্নাত মিটে যায়’। বিদ‘আতের বিষয়ে তালাশী চালাতে গিয়ে বিষয়টির বাস্তবতা আমি নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছি। কিভাবে মানুষ বিভিন্ন সময়ে রাসূলের আনীত শরী‘আতের বিরোধিতা করে যাচ্ছে।
গভীর ইল্ম ও মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তিগণের কেউ যখন তেলাওয়াতের জন্য কুরআন হাতে নেন, আপনি তাদেরকে চুমু খেতে দেখবেন না। তারা কুরআন অনুযায়ী আমল করে থাকেন। পক্ষান্তরে সাধারণ মানুষ যাদের ভালোবাসার কোন নিয়ম-নীতি নেই- তারা বলবে, এতে আর এমন কি? অথচ তারা কুরআনের বিধানের উপরে আমল করে না। অতএব আমরা বলব, ‘যখন একটি বিদ‘আতের উদ্ভব হয়, তখনই একটি সুন্নাত মিটে যায়’।
এই বিদ‘আতের অনুরূপ আরেকটি বিদ‘আত হ’লঃ আমরা লোকদের দেখি এমনকি ঐসব ফাসেকদের, যাদের অন্তরে ঈমানের তলানিটুকুই কেবল অবশিষ্ট আছে, যখন তারা আযান শুনতে পায়, অমনি উঠে দাঁড়ায়। যদি আপনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, দাঁড়ালেন কেন? সে বলবে تعظيمًا لله عز و جل ‘মহান আল্লাহর সম্মানে’। অথচ তারা মসজিদে যাবে না। তারা তাদের তাস, পাশা, জুয়া ইত্যাদি খেলা নিয়ে মত্ত থাকবে। কিন্তু তারা ধারণা করে যে, এই দাঁড়ানোর মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রভুকে সম্মান করলাম। দাঁড়ানোর এই রীতি এল কোত্থেকে? এসেছে সেই ভিত্তিহীন জাল হাদীছের অনুসরণে إِذَا سَمِعْتُمُ الأَذَانَ فَقُوْمُوْا ‘যখন তোমরা আযান শুনবে, তখন দাঁড়িয়ে যাবে’।[3]
উক্ত হাদীছটির একটি ভিত্তি রয়েছে। কিন্তু তা কিছু যঈফ ও মিথ্যা হাদীছ রচনাকারীদের দ্বারা পরিবর্তিত হয়েছে। অত্র হাদীছে বর্ণিত قُوْمُوْا ‘তোমরা দাঁড়াও’ শব্দটি তারা ছহীহ হাদীছে বর্ণিত قُوْلُوْا বানিয়েছে)। সংক্ষেপে ছহীহ হাদীছটি হ’লঃ إِذَا سَمِعْتُمُ الْأَذَانَ فَقُوْلُوْا مِثْلَ مَا يَقُوْلُ ثُمَّ صَلُّوْا عَلَيَّ তোমরা আযান শোন, তখন তোমরা বল যেমন মুওয়াযযিন বলেন। অতঃপর আমার উপরে দরূদ পাঠ কর’...।[4]
এঘটনায় তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, শয়তান কিভাবে মানুষের জন্য বিদ‘আতকে সুন্দরভাবে পেশ করেছে। আর তাকে আশ্বস্ত করেছে এই বলে যে, সে একজন ঈমানদার। সে আল্লাহর নিদর্শন সমূহকে সম্মান করে। তার প্রমাণ হ’ল এই যে, সে যখন কুরআন হাতে নেয়, তখন তাতে চুম্বন দেয় এবং যখন আযান শোনে, তখন তার সম্মানে উঠে দাঁড়ায়!!
কিন্তু প্রশ্ন হ’লঃ ঐ ব্যক্তি কি কুরআনের উপর আমল করে? না। সে কুরআনের উপর আমল করে না। উদাহরণ স্বরূপঃ ঐ ব্যক্তি ছালাত আদায় করে। কিন্তু সে কি হারাম খায় না? সেকি সূদ খায় না? সে কি সূদ খাওয়ায় না? সে কি ঐসব প্রচার মাধ্যমের প্রসার ঘটায় না, যার দ্বারা জনগণের মধ্যে আল্লাহর অবাধ্যতা বৃদ্ধি পায়? এরূপ প্রশ্নের কোন শেষ নেই। সেকারণ আমরা আল্লাহ যেসব সৎকর্ম ও ইবাদাত সমূহ আমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন, তার উপরে দৃঢ় থাকি। তার উপরে একটি হরফও বৃদ্ধি করি না। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, مَا تَرَكْتُ شَيْئًا مِمَّا أَمَرَكُمُ اللهُ بِهِ إِلاَّ وَقَدْ أَمَرْتُكُمْ بِهِ ‘আল্লাহ তোমাদেরকে যা কিছু নির্দেশ দান করেছেন, তার কোন কিছুই আমি তোমাদের নির্দেশ দিতে ছাড়িনি’।[5]
অতএব এখন এই যে কাজ তুমি করছ, এর দ্বারা কি তুমি আল্লাহর নৈকট্য কামনা করো? যদি জবাব হয়- হাঁ, তাহ’লে তার দলীল রাসূলের কাছ থেকে নিয়ে এস। অথচ এর জবাব এই যে, সেখানে এর কোন দলীল নেই। তাহ’লে এটি বিদ‘আত! আর প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা। প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।
কেউ যেন এ বিষয়ে সমস্যায় না পড়ে এবং বলে যে, এ মাসআলাটি তো একটি নিম্নস্তরের মাসআলা। এতদসত্ত্বেও এটি ভ্রষ্টতা? এবং এই বিদ‘আতকারী ব্যক্তি জাহান্নামী হবে? একথার জবাব দিয়েছেন ইমাম শাত্বেবী। তিনি বলেছেন, كل بدعة مهما كانة صغيرة فهى ضلالة ‘প্রত্যেক বিদ‘আত তা যতই ছোট হৌক না কেন তা ভ্রষ্টতা।’
এখানে ভ্রষ্টতার হুকুমটির দিকে দেখা হবে না, দেখা হবে এর স্থানের দিকে, যে স্থানে বিদ‘আতটি সৃষ্টি করা হয়েছে। আর তা হ’ল ইসলামী শরী‘আত। যা সম্পূর্ণ ও পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। অতএব ছোট হৌক বড় হৌক কোনরূপ বিদ‘আত সংযোজনের কোন সুযোগ সেখানে নেই। এখান থেকেই বিদ‘আতের ভ্রষ্টতা এসেছে। কেবল নতুন উদ্ভবের কারণে নয়। বরং এর দ্বারা আল্লাহ ও রাসূলের দেয়া বিধান সমূহের উপরে সংশোধনী আরোপ করা হয়।
[1]. ছহীহ তারগীব ১/৯৪/৪১; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৫৮৯ ‘মানাসিক’ অধ্যায় ‘মক্কায় প্রবেশ ও ত্বাওয়াফ’ অনুচ্ছেদ।
[2]. ছহীহুল জামে‘ হা/৩১৭৪; আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/২৫৭৭।
[3]. আবু নু‘আইম ২/১৭৪ পৃঃ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৭১১।
[4]. মুসলিম, মিশকাত হা/৬৫৭, ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘আযান ও আযানের জওয়াব দানের ফযীলত’ অনুচ্ছেদ।
[5]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/১৬৪৭; আহমাদ ৫/১৫৩,১৬২; ছহীহাহ হা/১৮০৩।