মীলাদ প্রসঙ্গ

মীলাদ প্রসঙ্গ

بسم الله الرحمن الرحيم

إن الحمد لله نحمده ونصلى على رسوله الكريم وعلى آله وصحبه أجمعين وعلى من تبعهم بإحسان إلى يوم الدين، أما بعد:

আল্লাহ পাক এরশাদ করেন,

قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِيْنَ أعْمَالاً؟ اَلَّذِيْنَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فى الْحَيوةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُوْنَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُوْنَ صُنْعًا-

‘আপনি বলে দিন, আমি কি তোমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারীদের সম্পর্কে খবর দিব? দুনিয়ার জীবনে যাদের সমস্ত আমল বরবাদ হয়েছে। অথচ তারা ভাবে যে, তারা সুন্দর আমল করে যাচ্ছে’ (কাহ্ফ ১০৩-৪)

১. বিদ‘আত-এর ব্যাখ্যা ও তার পরিণাম

পারিভাষিক অর্থে সুন্নাতের বিপরীত বিষয়কে ‘বিদ‘আত’ বলা হয়। আভিধানিক অর্থে বিদ‘আত হ’ল- 

اَلْبِدْعَةُ هِىَ كُلُّ مَا أَحْدَثَ عَلَى غَيْرِ مِثَالٍ سَابِقٍ

‘ঐ সকল নতুন সৃষ্টি, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল না’। শারঈ অর্থে-

اَلْبِدْعَةُ هِىَ الطَّرِيْقَةُ الْمُخْتَرَعَةُ فِى الدِّيْنِ تُضَاهِى الشَّرِيْعَةَ يُقْصَدُ بِهَا التَّقَرُّبُ إِلىَ اللهِ وَلَمْ يَقُمْ عَلَى صِحَّتِهَا دَلِيْلٌ شَرْعِىٌّ صَحِيْحٌ اُصْلاً أَوْ وَصَفًا كما قاله الشاطبى

‘আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের উদ্দেশ্যে ধর্মের নামে নতুন কোন প্রথা চালু করা, যা শরী‘আতের কোন ছহীহ দলীলের উপরে ভিত্তিশীল নয়’।[1]

মা আয়েশা (রাঃ) প্রমুখাত  বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

مَنْ أَحْدَثَ فِىْ أَمْرِنَا هذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ، متفق عليه- ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[2] তিনি আরও বলেন, ... ‘তোমাদের উপরে পালনীয় হ’ল আমার সুন্নাত ও আমার খুলাফায়ে রশেদীনের সুন্নাত। তোমরা উহা কঠিনভাবে আকড়ে ধর এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধর’।

وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ

‘আর তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি করা হ’তে সাবধান থাক। নিশ্চয়ই প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদ‘আত ও প্রত্যেক বিদ‘আতই গোমরাহী’। জাবের  (রাঃ) হ’তে নাসাঈ শরীফের অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَكُلَّ ضَلاَلَةٍ فِى النَّارِ   ‘এবং প্রত্যেক গোমরাহীর পরিণাম জাহান্নাম’।[3] খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত মূলতঃ রাসূলেরই সুন্নাত। কারণ তাঁরা কখনোই রাসূলের  প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অনুমোদনের বাইরে কোন কাজ করতেন না। যুগে  যুগে বৈষয়িক প্রয়োজনে সৃষ্ট বিভিন্ন আবিষ্কার সমূহ  যেমন সাইকেল, ঘড়ি, চশমা, মটরগাড়ী, উড়োজাহায ইত্যাদি বস্ত্তসমূহ আভিধানিক অর্থে বিদ‘আত বা নতুন সৃষ্টি হ’লেও শারঈ পরিভাষায় কখনোই বিদ‘আত নয়। তাই এগুলোকে গুনাহের বিষয় বলে গণ্য করা অন্যায়। অনেকে এগুলোকে অজুহাত করে ধর্মের নামে  সৃষ্ট মীলাদ,  ক্বিয়াম, শবেবরাত, কুলখানি, চেহলাম ইত্যাদিকে শরী‘আতে বৈধ কিংবা ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’ বলে থাকেন, যেটা আরো অন্যায়। যদি কেউ জেনে শুনে  এগুলো বলেন বা করেন, তাহ’লে নিজেরা কবীরা গোনাহগার হবেন এবং তাদের কথা শুনে বা তাদের দেখাদেখি যারা ঐসব বিদ‘আত করবেন, তাদের সমপরিমাণ গুনাহ ঐ সকল ব্যক্তিদের আমলনামায় যুক্ত হবে। যেমন আল্লাহ বলেন,

لِيَحْمِلُوْا أَوْزَارَهُمْ كَامِلَةٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمِنْ أَوْزَارِ الَّذِيْنَ يُضِلُّوْنَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ أَلاَ سَآءَ مَا يَزِرُوْنَ-

‘ক্বিয়ামতের দিন ওরা পূর্ণমাত্রায় বহন করবে নিজেদের পাপভার এবং ঐসব লোকের পাপভার যাদেরকে ওরা তাদের অজ্ঞতাহেতু বিপথগামী করে। সাবধান! খুবই নিকৃষ্ট বোঝা তারা বহন করে থাকে’ (নাহল ২৫)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

مَنْ دَعَا إِلى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الْأجْرِ مِثْلُ اُجُوْرِ مَنْ تَبِعَهُ لاَيَنْقُصُ ذلِكَ مِنْ اُجُوْرِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الْإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَيَنْقُصُ ذلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا،

‘যে ব্যক্তি মানুষকে হেদায়াতের পথে আহবান করল, তার জন্য ঐ পরিমাণ পুরস্কার রয়েছে, যে পরিমাণ পুরস্কার তার অনুসারীগণ পাবে। তাদেরকে তাদের পুরস্কার হ’তে এতটুকুও কম করা হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মানুষকে ভ্রষ্টতার দিকে আহবান জানালো, তার উপরে ঐ পরিমাণ গুনাহ চাপানো হবে, যে পরিমাণ গুনাহ তার অনুসারীদের উপরে চাপবে। তাদেরকে তাদের গুনাহ থেকে এতটুকুও কম করা হবে না’।[4] সুফিয়ান ছাওরী (রাঃ) এজন্য বলেন, ‘ইবলীসের নিকটে অন্যান্য গুনাহের চাইতে বিদ‘আত অধিক প্রিয়। কেননা গোনাহগার তওবা করে, কিন্তু বিদ‘আতী তওবা করে না’ (এজন্য যে, সে সেটাকে নেকীর কাজ ভেবেই করে থাকে)।[5]

২.  ঈদে মীলাদুন্নবী

জন্মের সময়কাল (وقة الولادة )-কে আরবীতে ‘মীলাদ’ বা ‘মাওলিদ’ বলা হয় (আল-ক্বামূসুল মুহীত্ব)। সে হিসাবে ‘মীলাদুন্নবী’-র অর্থ দাঁড়ায় ‘নবীর জন্মমুহূর্ত’। নবীর জন্মের বিবরণ, কিছু ওয়ায ও নবীর রূহের আগমন কল্পনা করে তার সম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে ‘ইয়া নবী সালাম আলায়কা’ বলা ও সবশেষে জিলাপী বিলানো-এই সব মিলিয়ে ‘মীলাদ মাহফিল’ বর্তমানে একটি সাধারণ ধর্মীয় (?) অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বরং ধর্মের নামে সৃষ্ট এই অনুষ্ঠানটি ইসলামে স্বীকৃত দু’টি ‘ঈদ’ অনুষ্ঠানের সঙ্গে তৃতীয় আরেকটি ‘ঈদ’ হিসাবে সংযোজিত হয়েছে। অন্য দুই ঈদের ন্যায় এদিনও সরকারী ছুটি ঘোষিত হয়। মিল, কল-কারখানা, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। মুসলিম সমাজে প্রচলিত বহুবিধ শিরক ও বিদ‘আতী অনুষ্ঠান সৃষ্টির মূলে রয়েছে হীন রাজনৈতিক স্বার্থ ও দুনিয়াদার কিছু আলিমের দুঃখজনক ফৎওয়া। সরকারী পলিসি হিসাবে কিছু মুসলিম শাসক ও তাদের উত্তরসূরীগণ ধর্মের নামে বিভিন্ন কুসংস্কার চালু করেছেন। আর সেটাকে সাধারণ মুসলমানের নিকটে গ্রহণযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব নিয়েছেন যুগে যুগে কিছু সংখ্যক নামধারী আলেম। প্রচলিত ‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ বা ‘মীলাদুন্নবী’র অনুষ্ঠান অনুরূপভাবে ধর্মের নামে সৃষ্ট একটি বিদ‘আতী অনুষ্ঠান মাত্র।

৩- মীলাদের আবিষ্কর্তা

ক্রুসেড বিজেতা মিসরের  সুলতান ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী (৫৩২-৫৮৯ হিঃ) কর্তৃক নিয়োজিত ইরাকের ‘এরবল’ এলাকার গভর্ণর আবু সাঈদ মুযাফ্ফরুদ্দীন কুকুবুরী (৫৮৬-৬৩০ হিঃ) সর্বপ্রথম কারো মতে ৬০৪ হিঃ ও কারো হিসাব মতে ৬২৫ হিজরীতে মীলাদের প্রচলন ঘটান বলে কথিত আছে।[6] প্রতি  বৎসর মীলাদুন্নবীর মওসুমে প্রাসাদের নিকটে  তৈরী অন্যূন ২০টি খানকাহে তিনি গান-বাদ্যের আসর বসাতেন। কখনও মুহাররম কখনও ছফর মাস থেকে এই মওসুম শুরু হ’ত। মীলাদুন্নবীর দু’দিন আগে থেকেই খানক্বাহের আশে পাশে গরু-ছাগল যবাই-এর ধুম পড়ে যেত। কবি, গায়ক, ওয়ায়েয সহ অসংখ্য লোক সেখানে ভিড় জমিয়ে মীলাদুন্নবী উদযাপনের নামে চরম স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হ’ত।[7] ইবনুল জাওযী বলেন, গভর্ণর নিজে নাচে অংশ নিতেন।’ মুইয্যুদ্দীন হাসান বলেন, তিনি আলেমদেরকে উপঢৌকন ও চাপ দিয়ে মীলাদের পক্ষে জাল হাদীছ ও বানাওয়াট গল্প লিখতে বাধ্য করতেন’।[8] উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, মিথ্যা নবী-প্রেমের মহড়া দেখিয়ে জনসাধারণের মন জয় করা।

৪- আলেমদের সহযোগিতা

আবিষ্কৃত এই মীলাদ অনুষ্ঠানের সমর্থনে তৎকালীন আলেম সমাজের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি এগিয়ে আসেন, তিনি হ’লেন আবুল খাত্ত্বাব ওমর বিন দেহিইয়াহ (৫৪৪-৬৩৩)। তিনি ‘আত্তান্ভীর ফী মাওলিদিস সিরাজিল মুনীর’ নামে একটি বই লেখেন এবং সেখানে বহু জাল ও বানাওয়াট হাদীছ জমা করেন। অতঃপর বইটি ৬২৬ হিজরীতে গভর্ণর কুকুবুরীর নিকট পেশ করলে তিনি খুশী হয়ে তাকে সঙ্গে সঙ্গে এক হাযার স্বর্ণমুদ্রা বখশিশ দেন (দেখুনঃ তারীখ ইবনে খাল্লিকান)

ক্রমে ক্রমে অন্যান্য আলেমগণও ঐ একই পথ ধরলেন। কেউ বা সরকারের ভয়ে চুপ থাকলেন অথবা বদ দো‘আ  করেই ক্ষান্ত হ’লেন। কিন্তু বিদ‘আত চালু হয়েই গেল, যা আজও চলছে।

 

৫- মীলাদ বিদ‘আত হওয়ার ব্যাপারে চার মাযহাবের ঐক্যমত

‘আল-ক্বাওলুল মু‘তামাদ’ কিতাবে বলা হয়েছে যে, চার মাযহাবের সেরা বিদ্বানগণ সর্বসম্মতভাবে প্রচলিত মীলাদ অনুষ্ঠান বিদ‘আত হওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছেন। তাঁরা বলেন, এরবলের গভর্ণর কুকুবুরী এই বিদ‘আতের হোতা। তিনি তার আমলের আলেমদেরকে মীলাদের পক্ষে মিথ্যা হাদীছ তৈরী করার ও ভিত্তিহীন ক্বিয়াস করার হুকুম জারি করেছিলেন।[9]

৬- উপমহাদেশের ওলামায়ে কেরাম

মুজাদ্দিদে আলফে ছানী শায়খ আহমাদ সারহিন্দী, আল্লামা হায়াত সিন্ধী, রশীদ আহমাদ গাংগোহী, আশরাফ আলী থানভী, মাহমূদুল হাসান দেউবন্দী, আহমাদ আলী সাহারানপুরী প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম ছাড়াও আহলেহাদীছ বিদ্বানগণ সকলে এক বাক্যে প্রচলিত মীলাদ অনুষ্ঠানকে বিদ‘আত ও  গুনাহের কাজ বলেছেন।[10]

৭- মৃত্যুদিবসে জন্মবার্ষিকী

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্ম ও মৃত্যুদিবস যে সোমবার, সে বিষয়ে ছহীহ হাদীছে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু জন্মের তারিখ নেই। আধুনিক  জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব মতে, ৮ হ’তে ১২ই রবীউল আউয়ালের মধ্যে ৯ই ব্যতীত সোমবার ছিল না। অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঠিক জন্মদিবস হয় ৯ রবীউল আউয়াল সোমবার, ১২ই রবীউল আউয়াল বৃহস্পতিবার নয়।[11] দুর্ভাগ্য এই যে, আমরা ১২ই রবীউল আউয়াল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুদিবসেই তাঁর জন্মবার্ষিকী বা মীলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান করছি।

৮-  কোন্টি বেশী গুরুত্বপূর্ণ?

নবী (ছাঃ)-এর জন্ম দিবস ৯ই রবীউল আউয়াল সোমবার, প্রথম নবুঅত প্রাপ্তি ৯ই রবীউল আউয়াল সোমবার, হিজরতের পর মদীনায় প্রথম প্রবেশ ১২ই রবীউল আউয়াল শুক্রবার, মৃত্যুর তারিখ ১২ই রবীউল আউয়াল সোমবার।[12] উক্ত দিনগুলির মধ্যে নবুঅত লাভের তারিখটিই যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সেদিনের স্মরণেও ইসলামে  কোন অনুষ্ঠানের বিধান রাখা হয়নি।

৯- ক্বিয়াম প্রথা

সপ্তম শতাব্দী হিজরীতে মীলাদ প্রথা চালু হওয়ার প্রায় এক শতাব্দীকাল পরে আল্লামা তাক্বিউদ্দীন সুবকী (৬৮৩-৭৫৬ হিঃ) কর্তৃক  ক্বিয়াম প্রথার প্রচলন ঘটে বলে কথিত  আছে।[13] তবে  এর সঠিক তারিখ ও আবিষ্কর্তার নাম জানা যায় না এবং এর ব্যাপারে আল্লামা সুবকীকে দায়ী করারও কোন যুক্তি নেই।[14] আরো আশ্চর্য হ’তে হয় তখন, যখন জালালুদ্দীন সৈয়ূতী (৮৪৯-৯১১ হিঃ)-এর ন্যায় জগদ্বিখ্যাত বিদ্বান বলেন যে, ‘আমি শরী‘আতে মীলাদের দলীল খুঁজে পেয়েছি’।[15]

এদেশে দু’ধরনের মীলাদ চালু আছে। একটি ক্বেয়ামী, অন্যটি বে-ক্বেয়ামী। ক্বেয়ামীদের যুক্তি হলো, তারা রাসূলের ‘সম্মানে’ উঠে দাঁড়িয়ে থাকেন। এর দ্বারা তাদের ধারণা যদি এই হয় যে, মীলাদের মাহফিলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রূহ মুবারক হাযির হয়ে থাকে, তবে এই ধারণা সর্বসম্মতভাবে কুফরী। কারণ তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে এ বিষয়ে আগে ভাগেই জানতে হবে যে, (১) অমুক এলাকার অমুক বাড়ীর অমুক কক্ষে মীলাদ হবে (২) বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতি মিনিটে অসংখ্য মীলাদের মাহফিলে তাঁকে প্রায় একই সময়ে হাযির হ’তে হবে।

প্রথমটি গায়েব জানার বিষয়,  যা আল্লাহ ছাড়া কারুর পক্ষে সম্ভব নয়। দ্বিতীয়টির ক্ষমতাও কেবলমাত্র আল্লাহর, অন্য কারু নয়। কেননা আল্লাহ বলেন,

وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلى يَوْمٍ يُّبْعَثُوْنَ-

‘(মৃত্যুর পরে) তাদের সামনে পর্দা আছে ক্বিয়ামত পর্যন্ত’ (মুমিনূন ১০০)। হানাফী ‘ফিক্হে আকবরে’ পরিষ্কার বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি ধারণা করে যে, আল্লাহর নবী (ছাঃ) গায়েব জানতেন, সে ব্যক্তি কাফের’। অনুরূপভাবে ‘তুহফাতুল কুযাত’ কেতাবে বলা হয়েছে, ‘যারা ধারণা করে যে, মীলাদের মজলিসগুলিতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রূহ মুবারক হাযির হয়ে থাকে, তাদের এই ধারণা স্পষ্ট শিরক’। হানাফী মাযহাবের কিতাব ‘ফাতাওয়া বাযযারিয়া’তে বলা হয়েছে,

مَنْ ظَنَّ أنَّ أرواحَ الأمواتِ  حاضرةٌ نَعْلَمُ يَكْفُرُ-

‘যে ব্যক্তি ধারণা করে যে, মৃত ব্যক্তিদের রূহ হাযির হয়ে থাকে, সে ব্যক্তি কাফের’।[16] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় জীবদ্দশায় তাঁর সম্মানার্থে উঠে দাঁড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর ধম্কি প্রদান করেছেন (তিরমিযী, আবূদাঊদ)[17] অথচ মৃত্যুর পর তাঁরই কাল্পনিক রূহের সম্মানে দাঁড়ানোর উদ্ভট যুক্তি ধোপে টেকে কি?

১০- অন্যান্যদের সাথে সামঞ্জস্য

শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন উপলক্ষে জন্মাষ্টমীতে হিন্দুরা যে অনুষ্ঠান করে থাকেন, সেখানে একজন ভাল বক্তা আসেন। ধূপদান, লোবান ও মোমবাতির মাঝে বক্তার ডাইনে থাকে পবিত্র গ্রন্থ ‘গীতা’ এবং পিছনে থাকে শিষ্যের দল। অতঃপর বক্তা বিভিন্ন ভঙ্গীতে মহামতি শ্রীকৃষ্ণের জীবনী বর্ণনা শুরু করেন এবং ফাঁকে ফাঁকে সুরেলা কণ্ঠে প্রশংসা সূচক কবিতা আওড়াতে থাকেন।

উপস্থিত শ্রোতা ও শিষ্যমন্ডলীর সকলে মাথা দুলিয়ে তালে তাল মিলিয়ে ঐ সুর ভাঁজতে থাকেন। এমন সময় হঠাৎ এক পর্যায়ে বক্তা দাঁড়িয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে অন্য সকলে দাঁড়িয়ে ঢোল-করতাল বাজিয়ে সমস্বরে গাইতে থাকেন ‘স্বর্গে ছিল রামের নাম, মর্ত্যে কে আনিল রে...?’[18]

হে মীলাদ ভক্ত পাঠক! একবার তাকিয়ে দেখুন আপনার মৌলবী ছাহেব কি পড়ছেন। তিনি রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে মীলাদের মাহফিলে হাযির জেনে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেছেন। আপনিও তাঁর সঙ্গে কলের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে গেলেন এবং নবীর কাল্পনিক রূহকে সম্মান জানিয়ে সকলে একই সুরে ‘ইয়া নবী সালাম আলায়কা’ (হে নবী তোমাকে সালাম) শুরু করে দিলেন।

অতঃপর আপনার মৌলবী ছাহেব মাথা দুলিয়ে সুরের তরঙ্গ উঠিয়ে ভক্তিরসে গলা ডুবিয়ে আরবী, ফার্সী, উর্দূ, বাংলাতে নবীর প্রশংসায় কবিতা শুরু করলেন। হিন্দু বক্তারা স্বর্গের রামকে দুনিয়ার শ্রীকৃষ্ণ ভেবেছেন। আর আপনার মৌলবী ছাহেব আল্লাহর নবীকে স্বয়ং আল্লাহ ভেবে নিলেন। ঐ শুনুন তাঁর শ্রুতিমধুর উর্দূ কবিতার একটি অংশ-

وه جو مستوى عرش تها خدا هو كر

اتر يرا هــ مدينه مين مصطفى هو كر

ওহ্ জো মুস্তাবী আরশ থা খোদা হো কর্

উতার পড়া হ্যায় মদীনা মেঁ মোছতফা হো কর্

অর্থঃ আরশের অধিপতি আল্লাহ ছিলেন যিনি, তিনিই মুছতফা রূপে মদীনায় অবতীর্ণ হলেন’ (নাঊযুবিল্লাহ)। শী‘আরা তাদের তৈরী তা‘যিয়াকে ‘হাসান-হোসায়েন-এর রূহ নাযিলের স্থান’ (محل نزول أرواح إمامين) বলে মনে করেন এবং তা‘যিয়া-র যেয়ারতকে ‘দুই ইমামের যেয়ারত’ বলে গণ্য করে থাকেন। মীলাদী ভাইয়েরা মীলাদ মাহফিলকে ‘রাসূলের রূহ নাযিলের স্থান’ (محل نزول روح ير فتوح) মনে করে তাকে দাঁড়িয়ে বা কেউ বসে সালাম দিয়ে থাকেন।[19] খৃষ্টানদের অবস্থাও তাই। তারা গীর্জায় উপাসনাকালে শ্রদ্ধাভরে দাঁড়িয়ে যীশুর গুণগান করেন। যীশুর সঠিক জন্ম তারিখ তাদেরও জানা নেই। কল্পনার উপরে ভিত্তি করে ২৫শে ডিসেম্বরকে তারা যীশুর জন্মদিবস ধরে নিয়ে ‘বড়দিন’ (Christmas day) পালন করে চলেছেন। কি সুন্দর আন্তর্জাতিক ঐক্য!!

১১- একটি সাফাই

মীলাদী ভাইয়েরা বলে থাকেন যে, মীলাদ বিদ‘আত হ’লেও ওটা ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’।  অতএব জায়েয তো বটেই বরং করলে ছওয়াব আছে। কারণ এর মাধ্যমে মানুষকে কিছু ওয়ায তো শুনানো যায়। উত্তরে বলা চলে যে, আপনি ছালাত আদায় করছেন, দেহ-পোষাক সবই পবিত্র, নিয়ত অত্যন্ত স্বচ্ছ। কিন্তু স্থানটি হ’ল কবরস্থান, আপনার ছালাত হলো না। কারণ ঐ স্থানে ছালাত আদায় করতে আল্লাহর নবী (ছাঃ) নিষেধ করেছেন।[20] অথচ আপনি সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলেন।

আপনি বিদ‘আতী অনুষ্ঠানে নেকী করবেন? হাড়ি ভর্তি গো-চেনায় এক কাপ দুধ ঢালবেন? পান করবেন তো? তাছাড়া যেখানে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সমস্ত বিদ‘আতকেই গুমরাহী বলেছেন।[21] সেখানে বিদ‘আতকে ভাল ও মন্দ দুই ভাগে ভাগ করাটাই তো আরেকটা বিদ‘আত হ’ল।

আমরা বলি আপনি ওয়ায করবেন করুন। কিন্তু তার জন্য মীলাদ অনুষ্ঠান কেন? সাধারণ ওয়ায মাহফিল তো বছরের  যে কোন সময়ে যে কোন স্থানে করা চলে। এছাড়াও রয়েছে সাপ্তাহিক জুম‘আয় খুৎবা দানের চিরন্তন ওয়ায মাহফিলের সুন্দরতম ব্যবস্থা। কিন্তু তা না করে একটি বিদ‘আতকে টিকিয়ে রাখার জন্য এভাবে সাফাই গাওয়ার  তো কোন অর্থ হয় না।

১২- মীলাদ অনুষ্ঠানে প্রচারিত বানাওয়াট হাদীছ ও গল্পসমূহ

(১) ‘(হে মুহাম্মাদ!) আপনি না হ’লে আসমান-যমীন কিছুই সৃষ্টি করতাম না’।

(২) ‘আমি আল্লাহর নূর হ’তে সৃষ্ট এবং মুমিনগণ আমার নূর হ’তে’।

(৩) ‘নূরে মুহাম্মাদী’ হ’তেই আরশ-কুরসী, বেহেশত-দোযখ, আসমান-যমীন সব কিছু সৃষ্টি হয়েছে’।

(৪) ‘আদম সৃষ্টির সত্তর হাযার বছর পূর্বে আল্লাহ পাক তাঁর নূর হ’তে মুহাম্মাদের নূরকে সৃষ্টি করে আরশে মু‘আল্লায় লটকিয়ে রাখেন’।

(৫) ‘আদম সৃষ্টি হ’য়ে উপরের দিকে তাকিয়ে জ্যোতির্ময় নক্ষত্ররূপে মুহাম্মাদের নূর অবলোকন করে মুগ্ধ হন’।

(৬) ‘মে‘রাজের সময় আল্লাহ পাক তাঁর নবীকে জুতা সহ আরশে আরোহন করতে বলেন, যাতে আরশের গৌরব বৃদ্ধি পায়’ (নাঊযুবিল্লাহ)।

(৭) রাসূলের জন্মের খবরে খুশী হ’য়ে আঙ্গুল উঁচু করার কারণে ও সংবাদ দানকারিনী দাসী ছুওয়াইবাকে মুক্ত করার কারণে জাহান্নামে আবু লাহাবের হাতের মধ্যের দু’টি আঙ্গুল পুড়বে না। এছাড়াও প্রতি সোমবার রাসূল (ছাঃ)-এর জন্ম দিবসে জাহান্নামে আবু লাহাবের শাস্তি মওকূফ করা হবে বলে হযরত আববাস (রাঃ)-এর নামে প্রচলিত তাঁর কাফের অবস্থার একটি স্বপ্নের বর্ণনা।

(৮) মা আমেনার প্রসবকালে জান্নাত হ’তে বিবি  মরিয়ম, বিবি আসিয়া, মা হাযেরা সকলে দুনিয়ায় নেমে এসে সবার অলক্ষ্যে ধাত্রীর কাজ করেন।

(৯) নবীর জন্ম মুহূর্তে কা‘বার প্রতিমাগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে, রোমের অগ্নি উপাসকদের ‘শিখা অনির্বাণ’ গুলো দপ করে নিভে যায়। বাতাসের গতি, নদীর প্রবাহ, সূর্যের আলো সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায় ইত্যাদি...।[22]

উপরের বিষয়গুলি সবই বানাওয়াট। দেখুনঃ মওযূ‘আতে কবীর প্রভৃতি। মীলাদী ভাইদের এই সব মিথ্যা ও জাল হাদীছ বর্ণনার দুঃসাহস দেখলে শরীর শিউরে ওঠে। যেখানে আল্লাহর নবী (ছাঃ) হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার নামে মিথ্যা হাদীছ রটনা করে, সে জাহান্নামে তার ঘর তৈরী করুক’ (বুখারী)[23]

তিনি আরও বলেন,

لاتَطِرُنى كما أطَرَتِ النصارى إبنَ مريمَ فإِنما أنا عبدُه فقُولوا عبدُ الله ورسولُه-

‘তোমরা আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না, যেভাবে নাছারাগণ ঈসা (আঃ) সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করেছে। ... বরং তোমরা বল যে, আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল’।[24]

যেখানে আল্লাহ পাক এরশাদ করছেন, ‘যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত জ্ঞান নেই, তার পিছনে ছুটো না। নিশ্চয়ই তোমার কান, চোখ ও বিবেক সবকিছুকে (ক্বিয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে’ (বনী ইস্রাঈল ৩৬), সেখানে এই সব লোকেরা কেউবা জেনে শুনে কেউবা অন্যের কাছে শুনে ভিত্তিহীন সব কল্পকথা ওয়াযের নামে মীলাদের মজলিসে চালিয়ে যাচ্ছেন। ভাবতেও অবাক লাগে।

‘নূরে মুহাম্মাদী’র আক্বীদা মূলতঃ উপাসক ও হিন্দুদের অদ্বৈতবাদী ও সর্বেশ্বরবাদী আক্বীদার নামান্তর। যাদের দৃষ্টিতে স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে কোন পার্থক্য নেই। এরা ‘আহাদ’ ও ‘আহমাদের’ মধ্যে মীমের পর্দা ছাড়া আর কোন পার্থক্য দেখতে পায় না।[25] তথাকথিত মা‘রেফাতী পীরদের মুরীদ হ’লে নাকি মীলাদের মজলিসে সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর জীবন্ত চেহারা দেখা যায়। ঢাকার পীর দেওয়ানবাগী বর্তমানে এ বিষয়ে সর্বাধিক পারঙ্গম বলে শোনা যায়। এই সব কুফরী দর্শন ও আক্বীদা প্রচারের মোক্ষম সুযোগ হ’ল মীলাদের মজলিসগুলো। বর্তমানে সরকারী রেডিও-টিভিতেও চলছে যার জয়জয়কার। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন- আমীন!!

জেনে রাখা উচিত যে, আমাদের নবী নূরের সৃষ্টি ফেরেশতাদের নবী ছিলেন না। তিনি ছিলেন মানুষের নবী। তাই মানুষের সকল উপাদান তাঁর মধ্যে ছিল, একথা স্বয়ং কুরআন মজীদ আমাদেরকে বলে দিয়েছে (কাহ্ফ ১১০)

১৩- আনুষ্ঠানিকতায় বন্দী ইসলাম

বাপ-মায়ের স্মৃতি যেমন সন্তানের রক্তের সঙ্গে  জড়িত,  প্রিয়নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর স্মৃতি তেমনি মুসলিম জীবনের প্রতি স্তরের সঙ্গে জড়িত। বছরের একদিন, দু’দিন বা মাস ব্যাপী মীলাদুন্নবী, সীরাতুন্নবী, ইয়াওমুন্নবী বা দা‘ওয়াতুন্নবীর জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করা বরং নবীর চিরন্তন আদর্শকে খাটো করারই শামিল। ইসলামী সংস্কৃতিতে একারণেই কারো জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী বা অন্য কোন বার্ষিকী পালনের অনুমতি নেই। এমনকি অতি পবিত্র জুম‘আর দিবসকে ছিয়াম ও রাত্রিকে ইবাদতের জন্য খাছ করে নিতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করেছেন’।[26] বার্ষিকী পালনের রেওয়াজ বিভিন্ন মুসলিম দেশে অমুসলিমদের অনুকরণে চালু হয়। মরক্কোতে বার্ষিকী পালনকে ‘মওসুম’ (موسَم) বলে। কারণ তারা বছরে একবার উৎসব আকারে এটা পালন করে। আলজিরিয়ায় ‘যারদাহ’ (زردة) বলা হয়। কেননা তারা ‘অলি’র নামে উৎসর্গীত খানা-পিনায় বরকত আছে মনে করে খুব জলদি খেতে ভালবাসে। কোন কোন দেশে এটাকে ‘হযরত’ (حضرت) বলা হয় লোকদের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে অথবা তাদের বিশ্বাসমতে ঐ অনুষ্ঠানে তাদের প্রিয় অলি বা ভক্তিভাজন ব্যক্তির রূহ মুবারক হাযির হওয়ার কারণে। তবে মিসর বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যত্র জন্মবার্ষিকীকে বিশেষভাবে ‘মাওলিদ’ (مولد) বলা হয়। অতঃপর ঐসব অনুষ্ঠানের পরিধি ও উপাচার-উপাদান তার আয়োজকদের সচ্ছলতার হিসাবে কমবেশী হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উৎসবের সাধারণ রীতি অনুযায়ী প্রচুর খানা-পিনা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, নাচ-গান, বাদ্য-বাজনা, মেলা বসানো ও সাথে সাথে মৃত অলি বা ভক্তিভাজন ব্যক্তির উদ্দেশ্যে জোরে-শোরে নিজেদের কামনা-বাসনা নিবেদন ইত্যাকার হরেক রকমের অনুষ্ঠানে  এইসব বার্ষিকীগুলি মুখর থাকে।

তবে বার্ষিকী পালন ও উদযাপনে সরকারী উৎসাহ-উদ্দীপনা ব্যাপকভাবে কাজ করে থাকে। ইচ্ছায় হৌক অনিচ্ছায় হৌক সরকারী সুবিধাদির সুযোগে বা লৌকিকতার কারণে অনেকে এইসব শিরক ও বিদ‘আতী অনুষ্ঠানে যোগদান বা সহযোগিতা করতে বাধ্য হন। ক্রমেই এটা একপ্রকার রেওয়াজে পরিণত হয়ে যায়। যেমন বর্তমানে অনেক মুসলিম দেশে সরকারী ও বেসরকারীভাবে এটা নিয়মিত ও সাধারণ অনুষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেছে। আলেম সমাজের কাছেও এটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। অথচ ধর্মের নামে এইসব বাড়তি ও বাজে খরচের অনুষ্ঠানে কত কোটি কোটি টাকা যে প্রতি বৎসর মুসলমানের ঘর থেকে চলে যাচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সমাজে ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে অহেতুক বিবাদের ও মন কষাকষির কারণ হচ্ছে, তার খবর কে রাখে? সর্বোপরি এই সব অনুষ্ঠান মুসলিম জীবনের সহজ-সরল জীবনধারাকে যে নির্মম আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব করে ফেলে, তার চাইতে বড় ক্ষতি দুনিয়াতে আর কিছুই  হ’তে পারে না। এছাড়া আখেরাতে জাহান্নামের  কঠোর শাস্তি তো আছেই।

একদা ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হিঃ) স্বীয় ছাত্র ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪ হিঃ)-কে বলেন,

إِنَّ كُلَّ مالم يَكُنْ على عهد رسولِ اللهِ (ص) وأصحابِه دِينًا لم يَكُنِ اليومَ دينًا وقال: مَنِ ابْتَدَعَ فى الإسلامِ بدعةً فَرَأَها حسنةً فقد زَعَمَ أنَّ محمدًا (ص) قد خَانَ الرسالةَ-

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের সময়ে যেসব বিষয় ‘দ্বীন’ হিসাবে গৃহীত ছিল না, বর্তমানকালেও তা ‘দ্বীন’ হিসাবে গৃহীত হবে না। যে ব্যক্তি ধর্মের নামে ইসলামে কোন নতুন প্রথা চালু করল, অতঃপর তাকে ভাল কাজ (বা ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’) বলে রায় দিল, সে ধারণা করে নিল যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় রিসালাতের দায়িত্ব পালনে খেয়ানত করেছেন’ (নাঊযুবিল্লাহ)।[27]

আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন, ‘আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপরে আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম ও ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম... (মায়েদাহ ৩)

এই সব বার্ষিকী ইসলামের স্বর্ণযুগে পরিপূর্ণ দ্বীনের মধ্যে ছিল না বরং বিভ্রান্তির যুগে ইসলামের লেবাস পরিধান করে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। এসব থেকে দূরে থাকা আমাদের একান্তভাবেই ধর্মীয় কর্তব্য।

দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশে ইসলাম বন্দী হয়ে পড়েছে সরকারী ও বেসরকারী কতকগুলি রেওয়াজ ও আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের  আলোকে গড়ে  তুলবার নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব যেন মুসলমান  আজ ভুলতে বসেছে।

১৪- প্রেমের প্রদর্শনী

আল্লাহ বলেন, হে নবী! ‘আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে তিনি তোমাদেরকে ভালবাসবেন ও তোমাদের গুনাহ সমূহ মার্জনা করবেন’ (আলে ইমরান ৩১)

কিন্তু প্রচলিত মীলাদ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা কার অনুসরণ করছি? নবী (ছাঃ) কি জীবনে কখনো তাঁর নিজের মীলাদ বা জন্মবার্ষিকী পালন করেছেন? তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ চার সাথী, সংকট মুহূর্তের সঙ্গী, দু’জন শ্বশুর ও দু’জন জামাই, জীবনের চেয়ে যারা নবীকে বেশী ভালবাসতেন, সেই মহান চার খলীফা দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর খেলাফতে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁরা তো কখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে কিংবা ব্যক্তিগতভাবে প্রিয়নবীর উদ্দেশ্যে ‘মীলাদ’ অনুষ্ঠান করেননি। উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম কেউ তো কখনো মীলাদ অনুষ্ঠান করেননি। বাংলাদেশে বর্তমানে একদিন শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকলে নাকি কমপক্ষে সাড়ে চার শত কোটি টাকা লোকসান হয়। মাননীয় বর্তমান অর্থমন্ত্রীর দেওয়া এই হিসাব যদি সঠিক হয়, তবে কেন ধর্মের নামে একজন গভর্ণরের আবিষ্কৃত বিদ‘আতী অনুষ্ঠান পালনের জন্য সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়? কেনইবা এই বিদ‘আতী অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতি বছর মিথ্যা নবীপ্রেমের প্রদর্শনী করা হয়? আমরা কি তবে অনুসরণ করছি আল্লাহর নবীর, না গভর্ণর কুকুবুরীর?

এখন আর মীলাদ কেবল বার্ষিকী নয়, বরং হর-হামেশা বিভিন্ন উপলক্ষে মীলাদ হচ্ছে। মীলাদ যেন কল্যাণ ও মুক্তির অসীলা। নামাযীদের চেয়ে বে-নামাযীদের ঘরেই যেন মীলাদের সরগরম বেশী। অমনিভাবে মীলাদী মৌলবী ছাহেবরা নিজ বাড়ীতে সম্ভবতঃ কখনোই মীলাদ করেন না। অন্যের বাড়ীতে মীলাদ পড়া বা পড়ানোর ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহ খুবই বেশী দেখা যায়।

বর্তমানে মীলাদ রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বিগত যুগে গভর্ণর কুকুবুরী যেমন  মীলাদ চালু করে জনসাধারণের ধর্মীয় অনুভূতিকে আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন। বর্তমান যুগে তেমনি আমাদের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলি সেই পথ অনুসরণ করছে।  এরা মুখে আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা বললেও আসলে চান ভোটারদের মনস্ত্তষ্টি। শিরক ও বিদ‘আতকে  এরা শুধু বরদাশত-ই করেন না, বরং লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে বড় বড় অনুষ্ঠান করেন। অধুনা নবীপ্রেমের মহড়া দেখিয়ে শহরে-নগরে বড় বড় মিছিলের প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। অথচ অতি পবিত্র ছালাতও যদি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে হয়, তাহ’লে ছওয়াব তো দূরের কথা সেই ছালাত শিরকে পরিণত হয় এবং ঐ মুছল্লী কবীরা গোনাহগার হয়’।২৮

যদি তারা সত্যিকার অর্থে ইসলামের খাদেম হ’তেন, তাহ’লে শিরক ও বিদ‘আতকে উৎখাত করাই তাদের আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য হ’ত। যুগের দোহাই পেড়ে পাশ্চাত্য রাজনীতির সাথে আপোষ না করে ইসলামের  নিজস্ব রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আপোষহীনভাবে এগিয়ে যেতেন। ইসলামের খিদমতের বদৌলতেই হয়তোবা আল্লাহপাক তাদের উপরে রহম করতেন। অথবা  যদি তারা সত্যিকার অর্থে জনগণের  খাদেম হ’তেন, তাহ’লে কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন  শেরেকী ও বিদ‘আতী অনুষ্ঠানের পিছনে অপচয় না করে ঐ টাকা দিয়ে এদেশের  অগণিত ভূখা-নাঙ্গা মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান ও চিকিৎসার ন্যূনতম ব্যবস্থা করে অশেষ ছওয়াবের অধিকারী হ’তেন এবং সাথে সাথে দেশী-বিদেশী সূদখোর এনজিও-দের খপ্পরে পড়ে অর্থ-সম্পদ ও ঈমান হারানো থেকে দরিদ্র জনসাধারণকে কিছুটা হ’লেও বাঁচাতে পারতেন। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে সুন্নাতের অনুসারী হয়ে তাঁর প্রিয় বান্দা হওয়ার তাওফীক দান করুন। -আমীন!!

مسلك سنت يه ايــ سالك جلـ جايــ دهرك

جنت الفردوس تك سيدهى جلى كئى يه سرك

‘সুন্নাতের রাস্তা ধরে নির্ভয়ে চল হে পথিক! জান্নাতুল ফেরদৌসে সিধা চলে গেছে এ সড়ক’।

 



[1] . সলীম  হেলালী, আল-বিদ‘আহ, পৃঃ ৬; গৃহীতঃ শাত্বেবী, আল-ই‘তিছাম (বৈরুতঃ দারুল মা‘রিফাহ), ১/৩৭ পৃঃ।

[2] . মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪০।

[3] . আহমাদ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৬৫; নাসাঈ হা/১৫৭৯ ‘ঈদায়েন-এর খুৎবা’ অধ্যায়।

[4] . মুসলিম, মিশকাত, হা/১৫৮, ২১০।

[5] . ইবনু তায়মিয়াহ।

[6] . মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, মীলাদে মুহাম্মাদী (মউ, ইউ পি ১৯৬৭), পৃঃ ৫; আবুবকর আল-জাযায়েরী, অধ্যাপক মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েত ছাপা, তাবি), পৃঃ ৩১।

[7] . বিস্তারিত দেখুনঃ তারীখু ইবনে খাল্লিকান, (বৈরুত ছাপা, তাবি), ৪/১১৩-২১ পৃঃ; আহমাদ তায়মূর পাশা, যাবতুল আ‘লাম (কায়রো ১৯৪৭), পৃঃ ১৩৭।

[8] . আব্দুস  সাত্তার দেহলভী, মীলাদুন্নবী (করাচী ছাপা, তাবি), পৃঃ ২০, ৩৫।

[9] . মীলাদুন্নবী পৃঃ ৩৫।

[10] . মীলাদুন্নবী পৃঃ ৩২-৩৩; মীলাদে মুহাম্মাদী পৃঃ ১৬-২০, ৩০-৩২; গাংগোহী ও সাহারানপুরী, ‘ফাতাওয়া মীলাদ শরীফ’ সংকলনেঃ মুহাম্মাদ আতহার উছমানী (দেউবন্দ, ভারতঃ মুহাম্মাদী প্রিন্টিং প্রেস, তাবি), পৃঃ ৩-৪।

[11] . আকরম খাঁ, মোস্তফা চরিত (ঢাকাঃ ঝিনুক পুস্তিকা, ১৯৭৫), পৃঃ ২২৫।

[12] . সুলায়মান মানছুরপুরী, রাহমাতুল লিল আলামীন (দিল্লীঃ ১৯৮০), ১ম খন্ড, পৃঃ ৪০, ৪৭, ৯১, ২৫১।

[13] . আবু ছাঈদ মোহাম্মাদ, মিলাদ মাহফিল (ঢাকা ১৯৬৬), পৃঃ ১৭।

[14] . দ্রঃ তাজুদ্দীন সুবকী, তাবাক্বাতু শাফেঈয়াহ কুবরা (বৈরুতঃ দারুল মা‘রিফাহ, তাবি, ১৩২২ হিঃ ছাপা হ’তে ফটোকৃত), ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ  ১৭৪।

[15] . হাভী (ঐ, ফৎওয়া)-এর  বরাতে ‘আল-ইনছাফ’ পৃঃ ৪০।

[16] . মীলাদে মুহাম্মাদী পৃঃ ২৫, ২৯।

[17] .عن معاوية قال قال رسول الله (ص) من سره أن يتمثل له الرجال قياما فليتبوأ مقعده من  النار، رواه الترمذى وأبوداود بإسناد  صحيح، مشكوة للألبانى كتاب الاداب ح/৪৬৯৯

মিশকাত, তাহকীক  আলবানী (বৈরুত ছাপা, ১৯৮৫) ‘আদাব’ অধ্যায়, হা/৪৬৯৯।

[18] . মিলাদ মাহফিল পৃঃ ৬৩।

[19] . আহমাদ আলী সাহারাণপুরী ও রশীদ আহমাদ গাংগোহী, ফাতাওয়া মীলাদ শরীফ (দেওবন্দঃ মাকতাবা রাশেদ কোং, ১৩১৭ হিঃ), পৃঃ ৪।

[20] . মুসলিম, মিশকাত হা/৭১৩।

[21] . মুসলিম, মিশকাত হা/১৪১।

[22] . মৌলুদে দিলপছন্দ, মৌলুদে ছাদী, আল-ইনছাফ, মিলাদ মাহফিল প্রভৃতি দ্রষ্টব্য।

[23] .   عن عبد الله بن عمرو قال قال رسول الله (ص) بَلَّغُوا عنى ولو آيةً.. ومَنْ كَذَبَ علىَّ مُتَعَمَّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ من النارِ، رواه البخارى وفى رواية لمسلم عن سمرة و المغيرة قالا قال رسول الله (ص) مَنْ حَدَّثَ عنى بحديثٍ يَرَى أنه كَذِبٌ فهو أحدُ الكاذبين- مشكوة للألبانى كتاب العلم ح/১৯৮، ১৯৯

[24] . বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৮৯৭।

[25] . যেমন বলা হয়ে থাকে ‘আকার কি নিরাকার সেই রববানা, আহমাদ ‘আহাদ’ হ’লে তবে যায় জানা। মীমের ঐ পর্দাটিরে উঠিয়ে দেখরে মন, দেখবি সেথায় বিরাজ করে আহাদ নিরঞ্জন।’

[26] . মুসলিম, মিশকাত হা/২০৫২ ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ।

[27] . আল-ইনছাফ, পৃঃ ৩২।

[28] .আহমাদ, মিশকাত (কিতাবুর রিক্বাক্ব), ‘রিয়া’ অধ্যায় হা/৫৩১৮।