ইবরাহীমী চেতনা বনাম প্রচলিত চেতনা
হযরত ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর যুগে দু’ধরনের মানুষ ছিল। তারকাপূজারী ও মূর্তিপূজারী। তারকা অথবা মূর্তির অসীলায় মানুষ আল্লাহর নৈকট্য কামনা করত এবং এসব অসীলাকে খুশী করার জন্য কুরবানী করত। এর প্রতিবাদ স্বরূপ ইবরাহীম (আঃ) সরাসরি আল্লাহর নামে ও আল্লাহর উদ্দেশ্যে তাঁরই হুকুমে স্বীয় প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রকে কুরবানী দেন। পুত্রের বিনিময়ে আল্লাহর হুকুমে দুম্বা কুরবানী হয় এবং তা পরবর্তীদের জন্য নিয়ম হিসাবে চালু হয় (ছাফফাত ৩৭/১০৮)।
ইতিপূর্বে ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় মূতিপূজারী কওমকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,
قَالَ اَتَعْبُدُوْنَ مَا تَنْحِتُوْنَ- وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُوْنَ- قَالُوا ابْنُوْا لَهُ بُنْيَانًا فَأَلْقُوْهُ فِى الْجَحِيْمِ- فَأَرَادُوْا بِهِ كَيْدًا فَجَعَلْنَاهُمُ الْأَسْفَلِيْنَ- (الصافات ৯৫-৯৮)-
‘আপনারা নিজ হাতে মূর্তি তৈরি করেন, আবার তারই পূজা করেন?’ ‘অথচ আল্লাহ আপনাদের ও আপনাদের সকল কর্মকে সৃষ্টি করেছেন’। লা-জওয়াব নেতারা ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল, ‘এর জন্য একটা দেওয়াল নির্মাণ কর। অতঃপর ওকে সেই অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ কর’। ‘এভাবে তারা তার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র অাঁটলো। কিন্তু আমরা তাদের পরাভূত করে দিলাম’ (ছাফফাত ৯৫-৯৮)। পরবর্তীকালে ইবরাহীম (আঃ)-এর অনুসারীরা তাওহীদের মর্ম ভুলে যায় এবং জাহেলী যুগের আরবরা আল্লাহকে স্বীকার করা সত্ত্বেও তাদের ধারণা মতে বিভিন্ন মৃত সৎ লোকের অসীলায় পরকালে মুক্তি পাওয়ার আশায় তাদের মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয় এবং এইসব অসীলাকে খুশী করার জন্য মূর্তির উদ্দেশ্যে কুরবানী করতে থাকে। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের প্রাক্কালে কা‘বাগৃহ ৩৬০টি মূর্তিতে ভরে যায়। যার বিরুদ্ধে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেন ও কা‘বাগৃহ সহ সমগ্র আরব জাহানকে মূর্তিমুক্ত করেন। অথচ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মতগণ জাহেলী আরবের মুশরিকদের ন্যায় আজ বিভিন্ন পীরের দরগায় গিয়ে গরু-খাসি-মুরগী কুরবানী দিচ্ছে। অন্যদিকে রাজনীতির নামে একদল মুসলমান নিজেদের তৈরি কথিত শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ, শিখা চিরন্তন ইত্যাদি বানিয়ে সেখানে পুষ্পার্ঘ নিবেদন করছে। অতঃপর সেখানে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করছে। অথচ সেখানে কোন লাশও নেই কবরও নেই। এ দৃশ্য ইবরাহীম (আঃ)-এর যুগে প্রচলিত শিরক-এর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। জীবন্ত মানুষ ক্ষুধায় মরে। তার প্রতি কেউ দয়া করে না। অথচ মৃতের কবরে মানুষ লাখ টাকা ঢালে, যার কিছুরই প্রয়োজন নেই। সেখানে গিয়ে কাঁদে, যার কোনই ক্ষমতা নেই। সেখানে গিয়ে শ্রদ্ধা দেখায়, যে দেখতেও পায় না, শুনতেও পায় না, অনুভবও করে না। অথচ মানুষ সেখানেই জমা হয়। এর চেয়ে মূর্খতা আর কী হ’তে পারে?
জানা আবশ্যক যে, ঈদুল আযহার কুরবানীর আনন্দ মূলতঃ শিরক মুক্তির আনন্দ, তাওহীদের ঝান্ডাকে আপোষহীনভাবে উন্নীত করার আনন্দ। অথচ আমরা ইবরাহীম (আঃ)-এর সেই নির্ভেজাল তাওহীদী চেতনা হারিয়ে ফেলেছি। অন্যদিকে একদল লোক কুরবানীকে স্রেফ গোশতখুরীর উৎসবে পরিণত করেছে। প্রচলিত এই চেতনা ইবরাহীমী চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাই অনতিবিলম্বে শিরকী চেতনা হ’তে তওবা করে তাওহীদী চেতনা প্রতিষ্ঠিত করা অপরিহার্য। নইলে কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য ‘তাক্বওয়া’ বা একনিষ্ঠ আল্লাহভীতি কখনোই অর্জিত হবে না। আর প্রকৃত আল্লাহভীতিই জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির চাবিকাঠি। ইবরাহীমী ঈমান যদি আবার জাগ্রত হয়, তবে আধুনিক জাহেলিয়াতের গাঢ় তমিশ্রা ভেদ করে পুনরায় মানবতার বিজয় নিশান উড্ডীন হবে। সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে আসবে। উর্দূ কবি বলেন,
আগার হো যায়ে ফের হাম মেঁ ইবরাহীম কা ঈমাঁ পয়দা
আ-গ মেঁ হো সেকতা হায় ফের আন্দা-যে গুলিস্তাঁ পয়দা।
অর্থঃ যদি আমাদের মাঝে ফের ইবরাহীমের ঈমান পয়দা হয়, তাহ’লে অগ্নির মাঝে ফের ফুলবাগের নমুনা সৃষ্টি হ’তে পারে’।
ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন
ঐ খুনের খুঁটিতে কল্যাণকেতু লক্ষ্য ঐ তোরণ
আজি আল্লাহর নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন।
ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন\
গৃহীতঃ কাজী নজরুল ইসলাম -এর ‘কুরবানী’ কবিতা হ’তে।