মাসায়েলে কুরবাণী ও আক্বীক্বা

 আক্বীক্বা (العقيقة) অধ্যায়

সংজ্ঞা:

شعر المولود من بطن امه او الذبيحة التى تُذْبَحُ عن المولود يوم سُبُوْعِهِ عند حلق شعره-

‘নবজাত শিশুর মাথার চুল অথবা সপ্তম দিনে নবজাতকের চুল ফেলার সময় যবহকৃত বকরীকে আক্বীক্বা বলা হয়’।[1]

আক্বীক্বার প্রচলন

(১) বুরায়দা (রাঃ) বলেন, জাহেলী যুগে আমাদের কারও সন্তান ভূমিষ্ট হ’লে তার পক্ষ হ’তে একটা বকরী যবহ করা হ’ত এবং তার রক্ত শিশুর মাথায় মাখিয়ে দেওয়া হ’ত। অতঃপর ‘ইসলাম’ আসার পর আমরা শিশু জন্মের সপ্তম দিনে বকরী যবহ করি এবং শিশুর মাথা মুন্ডন করে সেখানে ‘যাফরান’ মাখিয়ে দেই’ (আবুদাঊদ)। রাযীন -এর বর্ণনায় এসেছে যে, ঐদিন আমরা শিশুর নাম রাখি’।[2]

(২) হযরত আলী (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে এসেছে যে, হাসান -এর আক্বীক্বার দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কন্যা ফাতেমাকে বলেন, হাসানের মাথার চুলের ওযনে রূপা ছাদাক্বা কর। তখন আমরা তা ওযন করি এবং তা এক দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) বা তার কিছু কম হয়’।[3]

µ উল্লে­খ্য যে, ‘চুলের ওযনে স্বর্ণ অথবা রৌপ্য দেওয়ার ও সপ্তম দিনে খাৎনা দেওয়ার’ বিষয়ে বায়হাক্বী ও ত্বাবারাণী বর্ণিত হাদীছ ‘যঈফ’।[4]

হুকুম

আক্বীক্বা করা সুন্নাত। ছাহাবী, তাবেঈ ও ফক্বীহ বিদ্বানগণের প্রায় সকলে এতে একমত। হাসান বাছরী ও দাঊদ যাহেরী একে ওয়াজিব বলেন। তবে আহলুর রায় (হানাফী) গণ একে সুন্নাত বলেন না। কেননা এটি জাহেলী যুগে রেওয়াজ ছিল। কেউ বলেন, এটি তাদের কাছে ইচ্ছাধীন বিষয়।[5] নিঃসন্দেহে এটি প্রাক-ইসলামী যুগে চালু ছিল। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ও ধরন পৃথক ছিল। ইসলাম আসার পর আক্বীক্বার রেওয়াজ ঠিক রাখা হয়। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ও ধরনে পার্থক্য হয়। জাহেলী যুগে আশুরার ছিয়াম চালু ছিল। ইসলামী যুগেও তা অব্যাহত রাখা হয়। অতএব প্রাক-ইসলামী যুগে আক্বীক্বা ছিল বিধায় ইসলামী যুগে সেটা করা যাবে না, এমন কথা ঠিক নয়।

গুরুতব :

(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَعَ الْغُلاَمِ عَقِيْقَةٌ فَأَهْرِيْقُوْا عنه دَمًا وأَمِيْطُوا عَنْهُ الْأَذَى رواه البخارىُّ ‘সন্তানের সাথে আক্বীক্বা জড়িত। অতএব তোমরা তার পক্ষ থেকে রক্ত প্রবাহিত কর এবং তার থেকে কষ্ট দূর করে দাও (অর্থাৎ তার জন্য একটি আক্বীক্বার পশু যবহ কর এবং তার মাথার চুল ফেলে দাও)।[6]

(২) তিনি বলেন, كُلُّ غُلاَمٍ رَهِيْنَةٌ اومُرْتَهَنٌ بعقيقَتِهِ تُذْبَحُ عنه يومَ السابع و يُسَمَّى وَ يُحْلَقُ رَأْسُهُ رواه الخمسة   ‘প্রত্যেক শিশু তার আক্বীক্বার সাথে বন্ধক থাকে। অতএব জন্মের সপ্তম দিনে তার পক্ষ থেকে পশু যবহ করতে হয়, নাম রাখতে হয় ও তার মাথা মুন্ডন করতে হয়’।[7]

µ ইমাম খাত্ত্বাবী বলেন, ‘আক্বীক্বার সাথে শিশু বন্ধক থাকে’-একথার ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, যদি বাচ্চা আক্বীক্বা ছাড়াই শৈশবে মারা যায়, তা’হলে সে তার পিতা-মাতার জন্য ক্বিয়ামতের দিন শাফা‘আত করবে না’। কেউ বলেছেন, আক্বীক্বা যে অবশ্য করণীয় এবং অপরিহার্য বিষয়, সেটা বুঝানোর জন্যই এখানে ‘বন্ধক’ (مرتهن বা  رهينة ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা পরিশোধ না করা পর্যন্ত বন্ধকদাতার নিকট বন্ধক গ্রহিতা আবদ্ধ থাকে’।[8] ছাহেবে মিরক্বাত মোল্লা আলী ক্বারী বলেন, এর অর্থ এটা হ’তে পারে যে, আক্বীক্বা বন্ধকী বস্ত্তর ন্যায়। যতক্ষণ তা ছাড়ানো না যায়, ততক্ষণ তা থেকে উপকার গ্রহণ করা যায় না। সন্তান পিতা-মাতার জন্য আল্লাহর বিশেষ নে‘মত। অতএব এজন্য শুকরিয়া আদায় করা তাদের উপর অবশ্য কর্তব্য’।[9]

(৩) সাত দিনের পূর্বে শিশু মারা গেলে তার জন্য আক্বীক্বার কর্তব্য শেষ হয়ে যায়।[10]

আক্বীক্বার পশু:

(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ছাগ হৌক বা ছাগী হৌক, ছেলের পক্ষ থেকে দু’টি ও মেয়ের পক্ষ থেকে একটি আক্বীক্বা দিতে হয়’।[11] পুত্র সন্তানের জন্য দু’টি দেওয়াই উত্তম। তবে একটা দিলেও চলবে।[12] ছাগল দু’টিই কুরবানীর পশুর ন্যায় ‘মুসিন্নাহ’ অর্থাৎ দুধে দাঁত ভেঙ্গে নতুন দাঁতওয়ালা হ’তে হবে এবং কাছাকাছি সমান স্বাস্থ্যের অধিকারী হ’তে হবে। এমন নয় যে, একটি মুসিন্নাহ হবে, অন্যটি মুসিন্নাহ নয়।[13] একটি খাসী ও অন্যটি বকরী হওয়ায় কোন দোষ নেই।

(২) ত্বাবারাণীতে উট, গরু বা ছাগল দিয়ে আক্বীক্বা করা সম্পর্কে যে হাদীছ এসেছে, তা ‘মওযূ’ অর্থাৎ জাল।[14] তাছাড়া এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে কোন আমল নেই।

(৩) পিতার সম্মতিক্রমে অথবা তাঁর অবর্তমানে দাদা, চাচা, নানা, মামু যেকোন অভিভাবক আক্বীক্বা দিতে পারেন। হাসান ও হোসায়েন -এর পক্ষে তাদের নানা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আক্বীক্বা দিয়েছিলেন।[15]

(৪) সাত দিনের পরে ১৪ ও ২১ দিনে আক্বীক্বা দেওয়ার ব্যাপারে বায়হাক্বী, ত্বাবারাণী ও হাকেমে বুরায়দা ও আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছকে শায়খ আলবানী ‘যঈফ’ বলেছেন।[16]

(৫) শাফেঈ বিদ্বানগণের মতে সাত দিনে আক্বীক্বার বিষয়টি সীমা নির্দেশ মূলক নয় বরং এখতিয়ার মূলক (للاختيار لا للتعيين )। ইমাম শাফেঈ বলেন, সাত দিনে আক্বীক্বার অর্থ হ’ল, ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ সাত দিনের পরে আক্বীক্বা করবে না। যদি কোন কারণে বিলম্ব হয়, এমনকি সন্তান বালেগ হয়ে যায়, তাহ’লে তার পক্ষে তার অভিভাবকের আক্বীক্বার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় সে নিজের আক্বীক্বা নিজে করতে পারবে।[17]

µ উল্লেখ্য যে, নবুঅত লাভের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের আক্বীক্বা নিজে করেছিলেন বলে বায়হাক্বীতে আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি ‘মুনকার’ বা যঈফ[18] বরং এটাই প্রমাণিত যে, তাঁর জন্মের সপ্তম দিনে তাঁর দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিব তাঁর আক্বীক্বা করেন ও ‘মুহাম্মাদ’ নাম রাখেন।[19]

আক্বীক্বার দো‘আ:

আল­া-হুম্মা মিনকা ওয়া লাকা, আক্বীক্বাতা ফুলান। বিসমিল্ল­া-হি ওয়াল্ল­া-হু আকবর। এ সময় ‘ফুলান’-এর স্থলে বাচ্চার নাম বলা যাবে।[20] মনে মনে নবজাতকের আক্বীক্বার নিয়ত করে মুখে কেবল ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবর’ বললেও চলবে।

শিশুর নামকরণ

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় নাম হ’ল ‘আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান’।[21]

অমুসলিমদের সাথে সামঞ্জস্যশীল ও শিরক-বিদ‘আতযুক্ত নাম বা ডাকনাম রাখা যাবে না। তাছাড়া অনারবদের জন্য আরবী ভাষায় নাম রাখা আবশ্যক। কেননা অনারব দেশে এটাই মুসলিম ও অমুসলিমের নামের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে। আজকাল এ পার্থক্য ঘুচিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। তাই নাম রাখার আগে অবশ্যই সচেতন ও যোগ্য আলেমের কাছে পরামর্শ নিতে হবে।

µ উল্লেখ্য যে, শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পরপরই নাম রাখা যায়। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন ফজরের পরে সবাইকে বলেন, গত রাতে আমার একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করেছে। আমি তাকে আমার পিতার নামানুসারে ‘ইবরাহীম’ নাম রেখেছি’।[22] এভাবে তিনি আবু ত্বালহার পুত্র আব্দুল্লাহ ও আসওয়াদপুত্র মুনযির-এর নাম তাদের জন্মের পরেই রেখেছিলেন’।[23] তবে আক্বীক্বা সপ্তম দিনেই হবে।

নামকরণ বিষয়ে জ্ঞাতব্য:

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মন্দ নাম পরিবর্তন করে দিতেন।[24] এমনকি কোন গ্রাম বা মহল্লার অপসন্দনীয় নামও তিনি পরিবর্তন করে দিতেন। যেমন চলার পথে একটি গ্রামের নাম তিনি শুনেন ‘ওফরাহ’ (عُفْرَة ) অর্থ ‘ধূসর মাটি’। তিনি সেটা পরিবর্তন করে রাখেন ‘খুযরাহ’ (خُضْرَة ) অর্থ ‘সবুজ-শ্যামল’।[25] তাঁর কাছে আগন্তুক কোন ব্যক্তির নাম অপসন্দনীয় মনে হ’লে তিনি তা পাল্টে দিয়ে ভাল নাম রেখে দিতেন।[26]

‘আল্লাহর দাস’ বা ‘করুণাময়ের দাস’ একথাটা যেন সন্তানের মনে সারা জীবন সর্বাবস্থায় জাগরুক থাকে, সেজন্যই ‘আব্দুল্লাহ’ ও ‘আব্দুর রহমান’ নাম দু’টিকে সর্বোত্তম বলা হয়েছে। অতএব আল্লাহ বা তাঁর গুণবাচক নামের সাথে ‘আব্দ’ সংযোগে নাম রাখাই উত্তম। এমন নাম রাখা কখনোই উচিত নয়, যা আল্লাহর স্মরণ থেকে সন্তানকে গাফেল করে দেয়। কেননা ভাল ও মন্দ উভয় নামের প্রভাব সন্তানের উপর পড়ে থাকে। যেমন ‘হায্ন’ (কর্কশ) নামের জনৈক ব্যক্তি রসূলের দরবারে এলে তিনি তার নাম পাল্টিয়ে ‘সাহ্ল’ (নম্র) রাখেন। কিন্তু লোকটি বলল, আমার বাপের রাখা নাম আমি কখনোই ছাড়ব না। পরবর্তীতে লোকটির পৌত্র খ্যাতনামা তাবেঈ সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (রহঃ) বলেন, দেখা গেছে যে, আমাদের বংশে চিরকাল রুক্ষতা বিদ্যমান ছিল’।[27]

অনেকে সার্টিফিকেটের দোহাই দিয়ে নিজেদের অপসন্দনীয় নামসমূহ পরিবর্তন করেন না। সারা জীবন ঐ মন্দ নাম বহন করে তারা কবরে চলে যান। অথচ ক্বিয়ামতের দিন বান্দাকে তার পিতার নামসহ ডাকা হবে। যেমন অঙ্গীকার ও বিশ্বাস ভঙ্গকারী (غادر ) ব্যক্তিদের ডেকে সেদিন বলা হবে, এটি ‘অমুকের সন্তান অমুকের বিশ্বাসঘাতকতা’ (هذه غَدْرَةُ فُلاَنِ بْنِ فُلاَنٍ )।[28] অঙ্গীকার ভঙ্গকারী ও বিশ্বাসঘাতকদের যখন তাদের পিতার নামসহ ডাকা হবে, তখন ঈমানদার ও সৎকর্মশীল বান্দাদের অবশ্যই তাদের স্ব স্ব পিতার নামসহ ডাকা হবে, এটা পরিস্কার বুঝা যায়। যেমন অন্য হাদীছে এসেছে, ‘তোমাদেরকে তোমাদের পিতার নামসহ ক্বিয়ামতের দিন ডাকা হবে। অতএব তোমরা তোমাদের নামগুলি সুন্দর রাখো’।[29] আলবানী হাদীছটির সনদ ‘যঈফ’ বলেছেন। কিন্তু বক্তব্য ছহীহ হাদীছের অনুকূলে। এক্ষণে পিতার নাম যদি ‘পচা’ হয়, আর ছেলের নাম যদি ‘দুখে’ হয়, তাহলে হাশরের ময়দানে কোটি মানুষের সামনে ‘দুখে ইবনে পচা’ ‘পক্কু ইবনে ছক্কু’ বা ‘কালা ইবনে ধলা’ কিংবা ‘ফেলনা বিনতে পাপ্পু’ বলে ডাকলে বাপ-বেটার বা বাপ-বেটির শুনতে কেমন লাগবে? অতএব মৃত্যুর আগেই এবিষয়ে সাবধান হওয়া ভাল।

প্রচলিত কিছু ভুল নামের নমুনা:

আব্দুন্নবী, আব্দুর রাসূল, গোলাম নবী, গোলাম রসূল, গোলাম মুহাম্মাদ, গোলাম আহমাদ, গোলাম মুছতফা, গোলাম মুরতযা, নূর মুহাম্মাদ, নূর আহমাদ, মাদার বখ্শ, পীর বখ্শ, রূহুল আমীন, সুলতানুল আওলিয়া প্রভৃতি। এতদ্ব্যতীত (১) অহংকার মূলক নাম, যেমন খায়রুল বাশার, শাহজাহান, শাহ আলম, শাহানশাহ প্রভৃতি; (২) নবীগণের উপাধি, যেমন আবুল বাশার, নবীউল্লাহ, খলীলুল্লাহ, কালীমুল্লাহ, রূহুল্লাহ, মুহাম্মাদ আবুল কাসেম; (৩) কুরআনের আয়াতসমূহ, যেমন আলিফ লাম মীম, ত্বোয়াহা, ইয়াসীন, হা-মীম, লেতুনযেরা; (৪) অনর্থক নাম, যেমন লায়লুন নাহার, ক্বামারুন নাহার, আলিফ লায়লা ইত্যাদি। (৫) কুখ্যাত যালেমদের নাম, যেমন নমরূদ, ফেরাঊন, হামান, শাদ্দাদ, ক্বারূণ, মীরজাফর প্রমুখ। (৬) এতদ্ব্যতীত শী‘আদের অনুকরণে নামের আগে বা পিছে আলী, হাসান বা হোসায়েন নাম যোগ করা। (৭) এছাড়াও ঝন্টু, মন্টু, পিন্টু, মিন্টু, হাবলু, জিবলু, বেল্টু, শিপলু, ইতি, মিতি, খেন্তী, বিন্তী, মলী, ডলী ইত্যাদি অর্থহীন নামসমূহ।

(৭) নবজাতকের জন্মের পরপরই তার ডান কানে আযান ও বাম কানে এক্বামত শুনানোর হাদীছ ‘মওযূ’ বা জাল।[30] (ক) কেবল আযান শুনানোর বিষয়ে আবুদাঊদ ও তিরমিযী বর্ণিত হাদীছ সম্পর্কে শায়খ আলবানী ‘হাসান’ বলেছেন।[31] তবে সর্বশেষ তাহক্বীক্বে তিনি এটাকে ‘যঈফ’ বলেছেন।[32] (খ) ইমাম তিরমিযী বলেন, নবজাতকের কানে আযান শুনানোর উপরে আমল জারি আছে (والعمل عليه )।[33] (গ) সাবেক সঊদী মুফতী শায়খ ছালেহ আল-উছায়মীন বলেন, এতে কোন অসুবিধা নেই (لابأس به )। যদিও এর সনদে কিছু বিতর্ক (مقال ) রয়েছে’। (ঘ) হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) শিশুর কানে আযানের তাৎপর্য বর্ণনা করে বলেন, দুনিয়াতে আগমনের সাথে সাথে তার কানে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বড়ত্বের ও শ্রেষ্ঠত্বের বাণী শুনানো হয়। যেমন দুনিয়া থেকে বিদায়কালে তাকে তাওহীদের কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর তালক্বীন করানো হয়।  আযান  বাচ্চার  মনে  দূরবর্তী  ও  স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে এবং শয়তানকে বিতাড়িত করে’।[34]

আক্বীক্বার গোশত বন্টন:

(ক) আক্বীক্বার গোশত কুরবানীর গোশতের ন্যায় তিন ভাগ করে একভাগ ফকীর-মিসকীনকে ছাদাক্বা দিবে ও একভাগ বাপ-মা ও পরিবার খাবে এবং একভাগ আত্নীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে হাদিয়া হিসাবে বন্টন করবে।[35] চামড়া বিক্রি করে তা কুরবানীর পশুর চামড়ার ন্যায় ছাদাক্বা করে দিবে।[36]

আক্বীক্বার অন্যান্য মাসায়েল:

(ক) আক্বীক্বা একটি ইবাদত। এর জন্য জাঁকজমকপূর্ণ কোন অনুষ্ঠান করা যাবে না। এ উপলক্ষে আত্নীয়-বন্ধুদের কাছ থেকে উপঢৌকন নেওয়ারও কোন দলীল পাওয়া যায় না।

(খ) আক্বীক্বা ও কুরবানী দু’টি পৃথক ইবাদত। একই পশুতে কুরবানী ও আক্বীক্বা দু’টি একসাথে করার কোন দলীল নেই।

(গ) আক্বীক্বা ও কুরবানী একই দিনে হ’লে সম্ভব হ’লে দু’টিই করবে। নইলে কেবল আক্বীক্বা করবে। কেননা আক্বীক্বা জীবনে একবার হয় এবং তা সপ্তম দিনেই করতে হয়। কিন্তু কুরবানী প্রতি বছর করা যায়।

(ঘ) শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর হাদীছপন্থী কোন দ্বীনদার আলেমের কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁর নিকট থেকে শিশুর ‘তাহনীক’ করানো ও শিশুর জন্য দো‘আ করানো ভাল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এটা করতেন।[37] ‘তাহনীক’ অর্থ খেজুর বা মিষ্টি জাতীয় কিছু চিবিয়ে বাচ্চার মুখে দেওয়া। হিজরতের পর মদীনায় জন্মগ্রহণকারী প্রথম মুহাজির সন্তান আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়েরকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দিয়ে ‘তাহনীক’ করেছিলেন। এভাবে তিনিই ছিলেন প্রথম সৌভাগ্যবান শিশু যার পেটে প্রথম রাসূলের পবিত্র মুখের লালা প্রবেশ করে। পরবর্তী জীবনে তিনি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। আনছারগণ তাদের নবজাতক সন্তানদের রাসূলের কাছে এনে ‘তাহনীক’ করাতেন। আবু ত্বালহা (রাঃ) তার সদ্যজাত পুত্রকে এনে রাসূলের কোলে দিলে তিনি খেজুর তলব করেন। অতঃপর তিনি তা চিবিয়ে বাচ্চার গালে দেন ও নাম রাখেন ‘আব্দুল্লাহ’।[38] ‘তাহনীক’ করার পর শিশুর কল্যাণের জন্য দো‘আ করবেন- ‘বা-রাকাল্লা-হু আলায়েক’ ‘আল্লাহ তোমার উপরে অনুগ্রহ বর্ষণ করুন’।[39]

(ঙ) শিশু অবস্থায় প্রয়োজন বোধে মেয়েদের কান ফুটানো জায়েয আছে। কেননা জাহেলী যুগে এটা করা হ’ত। কিন্তু ইসলামী যুগে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এটাতে কোন আপত্তি করেন নি। তবে ছেলেদের ক্ষেত্রে এটা করা মাকরূহ।[40]



[1]. আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব।

[2]. মিশকাত হা/৪১৫৮ ‘যবহ ও শিকার’ অধ্যায়, ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ।

[3]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৪১৫৪; আহমাদ, ইরওয়া হা/১১৭৫।

[4]. আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৮৩, ৩৮৫ পৃঃ।

[5]. ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ৩/৫৮৬; নায়ল ৬/২৬০ পৃঃ

[6]. বুখারী, মিশকাত হা/৪১৪৯ ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ।

[7]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, আহমাদ; ইরওয়া হা/১১৬৫।

[8]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৬/২৬০ পৃঃ ‘আক্বীক্বা’ অধ্যায়।

[9]. মিরক্বাত শরহ মিশকাত (দিল্লী ছাপা, তারিখ বিহীন) ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ ৮/১৫৬ পৃঃ।

[10]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৬১ পৃঃ।

[11]. নাসাঈ, তিরমিযী, আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৪১৫২, ৪১৫৬; ইরওয়া হা/১১৬৬।

[12]. আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৪১৫৫; নায়লুল আওত্বার ৬/২৬২,২৬৪ পৃঃ।

[13]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৬২ পৃঃ; আওনুল মা‘বূদ হা/২৮১৭-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

[14]. আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/১১৬৮।

[15]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/৪১৫৫।

[16]. ইরওয়াউল গালীল হা/১১৭০।

[17]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৬১ পৃঃ।

[18]. নায়লুল আওত্বার ৬/২৬৪ পৃঃ।

[19]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত (বৈরুতঃ ১৯৮৫) ১/১১৩ পৃঃ; সুলায়মান মানছূরপুরী, রাহমাতুল লিল আলামীন (দিল্ল­ী, ১৯৮০) ১/৪১ পৃঃ।

[20]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, আবু ইয়া‘লা, বায়হাক্বী ৯/৩০৪ পৃঃ; নায়ল ৬/২৬২ পৃঃ।

[21]. মুসলিম, মিশকাত, হা/৪৭৫২‘শিষ্টাচার’ অধ্যায় ‘নামসমূহ’ অনুচ্ছেদ; ইরওয়া হা/১১৭৬।

[22]. মুসলিম, হা/২৩১৫ ‘ফাযায়েল’ অধ্যায় হা/৬২।

[23]. মুগনী ১১/১২৫; আওনুল মা‘বূদ হা/২৮২১-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৭৫৯ ‘নামসমূহ অনুচ্ছেদ।

[24]. তিরমিযী, মিশকাত হা/৪৭৭৪; ছহীহাহ হা/২০৭।

[25]. ত্বাবারাণী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২০৮।

[26]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/২০৯।

[27]. বুখারী হা/৬১৯০, ৬১৯৩ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায় ১০৭ অনুচ্ছেদ।

[28]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৭২৫ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায় ১ অনুচ্ছেদ।

[29]. আহমাদ, আবদাঊদ, মিশকাত হা/৪৭৬৮ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায় ‘নামসমূহ’ অনুচ্ছেদ।

[30]. ইরওয়াউল গালীল হা/১১৭৪।

[31]. ছহীহ তিরমিযী হা/১২২৪; ইরওয়াউল গালীল হা/১১৭৩।

[32]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৬১২১; হেদায়াতুর রুওয়াত শরহ মিশকাত হা/৪০৮৫, ৪/১৩৮ পৃঃ।

[33]. তিরমিযী হা/১৫৬৯; আলবানী, ছহীহ তিরমিযী হা/১২২৪; ‘কুরবানী’ অধ্যায়, ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ নং ১৫; তুহফা হা/১৫৫৩।

[34]. ইবনুল ক্বাইয়িম, তুহফাতুল মওলূদ পৃঃ ২৫-২৬।

[35]. বায়হাক্বী ৯/৩০২ পৃঃ।

[36]. ইবনে রুশদ কুরতুবী, বেদায়াতুল মুজতাহিদ (রাবাত্ব, মরক্কো: ১৪১৯ হিঃ) ১/৪৬৭ পৃঃ।

[37]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪১৫১ ‘আক্বীক্বা’ অনুচ্ছেদ।

[38]. ইবনু কুদামা, আল-মুগনী ৩/৫৯০ পৃঃ।

[39]. মিরক্বাত (দিল্লী ছাপা : তারিখ বিহীন) ৮/১৫৫ পৃঃ।

[40]. ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রোঃ দারুল ফাৎহ ১৪১২/১৯৯২) পৃঃ ২/৩৪।