সূরা মায়েদাহ ৪৪ আয়াতের ব্যাখ্যা
যেসব মুসলিম সরকার ইসলামী বিধান অনুযায়ী দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেনা বা যেসব আদালত তদনুযায়ী বিচার-ফায়ছালা করেনা, তাদেরকে ‘কাফের’ আখ্যায়িত করে তাদের হত্যা করার পক্ষে নিম্নের আয়াতটিকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْكَافِرُوْنَ ‘যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার বা শাসন করেনা, তারা কাফের’ (মায়েদাহ ৫/৪৪)। এর পরে ৪৫ আয়াতে রয়েছে ‘তারা যালেম’ (فَأُوْلَئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ) এবং ৪৭ আয়াতে রয়েছে, ‘তারা ফাসেক’ (فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُوْنَ)। একই অপরাধের তিন রকম পরিণতি : কাফের, যালেম ও ফাসেক।
এখানে ‘কাফের’ অর্থ ইসলাম থেকে খারিজ প্রকৃত ‘কাফের’ বা ‘মুরতাদ’ নয়। বরং এর অর্থ আল্লাহর বিধানের অবাধ্যতাকারী কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি। কিন্তু চরমপন্থীরা এ আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করে মুসলিম সরকারকে প্রকৃত ‘কাফের’ আখ্যায়িত করে এবং তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নামতে তরুণদের প্ররোচিত করে।
বিগত যুগে এই আয়াতের অপব্যাখ্যা করে চরমপন্থী ভ্রান্ত ফের্কা খারেজীরা চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রাঃ)-কে ‘কাফের’ আখ্যায়িত করে তাঁকে হত্যা করেছিল। আজও ঐ ভ্রান্ত আক্বীদার অনুসারীরা বিভিন্ন দেশের মুসলিম বা অমুসলিম সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। যা বিশ্বব্যাপী ইসলামের শান্তিময় ভাবমূর্তিকে বিনষ্ট করছে। সম্ভবতঃ একারণেই রাসূল (ছাঃ) খারেজীদেরকে ‘জাহান্নামের কুকুর’ (الْخَوَارِجُ كِلاَبُ النَّارِ) বলেছেন।[1] মানাবী বলেন, এর কারণ হ’ল তারা ইবাদতে অগ্রগামী। কিন্তু অন্তরসমূহ বক্রতায় পূর্ণ। এরা মুসলমানদের কোন বড় পাপ করতে দেখলে তাকে ‘কাফের’ বলে ও তার রক্ত হালাল জ্ঞান করে। যেহেতু এরা আল্লাহর বান্দাদের প্রতি কুকুরের মত আগ্রাসী হয়, তাই তাদের কৃতকর্মের দরুণ জাহান্নামে প্রবেশকালে তারা কুকুরের মত আকৃতি লাভ করবে’।[2] হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) এদেরকে ‘আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি’ (شِرَارُ خَلْقِ اللهِ) মনে করতেন। কেননা তারা কাফিরদের উদ্দেশ্যে বর্ণিত আয়াতগুলিকে মুসলিমদের উপরে প্রয়োগ করে থাকে’।[3] বস্ত্ততঃ উক্ত আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা সেটাই, যা ছাহাবায়ে কেরাম করেছেন। যেমন-
(১) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, مَنْ جَحَدَ مَا أَنْزَلَ اللهُ فَقَدْ كَفَرَ وَمَنْ أَقَرَّ بِهِ وَلَمْ يَحْكُمْ فَهُوَ ظَالِمٌ فَاسِقٌ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে অস্বীকার করল সে কুফরী করল। আর যে ব্যক্তি তা স্বীকার করল, কিন্তু সে অনুযায়ী বিচার করল না সে যালিম ও ফাসিক।[4] অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, لَيْسَ بِالْكُفْرِ الَّذِي يَذْهَبُونَ إِلَيْهِ إِنَّهُ لَيْسَ كُفْرًا يَنْقِلُ عَنِ الْمِلَّةِ، وَهُوَ كُفْرٌ دُوْنَ كُفْرٍ وَظُلْمٌ دُوْنَ ظُلْمٍ، وَفِسْقٌ دُوْنَ فِسْقٍ ‘তোমরা এ কুফরী দ্বারা যে অর্থ বুঝাতে চাচ্ছ, সেটা নয়। কেননা এটি ঐ কুফরী নয়, যা কোন মুসলমানকে ইসলামের গন্ডী থেকে বের করে দেয়। বরং এর দ্বারা বড় কুফরের নিম্নের কুফর, বড় যুলুমের নিম্নের যুলুম ও বড় ফিসকের নিম্নের ফিসক বুঝানো হয়েছে।[5]
(২) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) ও হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, هِيَ عَامَّةٌ فِي كُلِّ مَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ مِنَ الْمُسْلِمِينَ وَالْيَهُودِ وَالْكُفَّارِ أَيْ مُعْتَقِدًا ذَلِكَ وَمُسْتَحِلاًّ لَهُ- فَأَمَّا مَنْ فَعَلَ ذَلِكَ وَهُوَ مُعْتَقِدٌ أَنَّهُ رَاكِبُ مُحَرَّمٍ فَهُوَ مِنْ فُسَّاقِ الْمُسْلِمِينَ، وَأَمْرُهُ إِلَى اللهِ تَعَالَى إِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ، وَإِنْ شَاءَ غَفَرَ لَهُ এটা মুসলিম, ইহূদী, কাফের সকল প্রকার লোকের জন্য সাধারণ হুকুম যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার-ফায়ছালা করে না। অর্থাৎ যারা বিশ্বাসগতভাবে (আল্লাহর বিধানকে) প্রত্যাখ্যান করে এবং অন্য বিধান দ্বারা বিচার ও শাসন করাকে হালাল বা বৈধ মনে করে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি উক্ত কাজ করে, অথচ বিশ্বাস করে যে সে হারাম কাজ করছে, সে ব্যক্তি মুসলিম ফাসেকদের অন্তর্ভুক্ত হবে। তার বিষয়টি আল্লাহর উপর ন্যস্ত। তিনি চাইলে তাকে শাস্তি দিবেন, চাইলে তাকে ক্ষমা করবেন’ (কুরতুবী, মায়েদাহ ৪৪/আয়াতের তাফসীর)।
(৩) তাবেঈ বিদ্বান ইকরিমা, মুজাহিদ, আত্বা ও তাঊসসহ বিগত ও পরবর্তী যুগের আহলে সুন্নাত বিদ্বানগণের সকলে কাছাকাছি একই ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।[6] এটাই হল ছাহাবী ও তাবেঈগণের ব্যাখ্যা। যারা হলেন আল্লাহর কিতাব এবং ইসলাম ও কুফর সম্পর্কে উম্মতের সেরা বিদ্বান ও সেরা বিজ্ঞ ব্যক্তি।
পরবর্তীরা এ ব্যাপারে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদল চরমপন্থী। যারা কবীরা গোনাহগার মুমিনকে কাফের বলে ও তাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামী গণ্য করে এবং তার রক্ত হালাল মনে করে। এরা হ’ল প্রথম যুগের ভ্রান্ত ফের্কা ‘খারেজী’ ও পরবর্তী যুগে তাদের অনুসারী হঠকারী লোকেরা। আরেক দল এ ব্যাপারে চরম শৈথিল্যবাদ প্রদর্শন করে এবং কেবল হৃদয়ে বিশ্বাস অথবা মুখে স্বীকৃতিকেই পূর্ণ মুমিন হওয়ার জন্য যথেষ্ট মনে করে। বস্ত্ততঃ এই দলের লোকসংখ্যাই সর্বদা বেশী। এরা পূর্ববর্তী ভ্রান্ত ফের্কা ‘মুর্জিয়া’ দলের অনুসারী। দু’টি দলই বাড়াবাড়ির দুই প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে।
আল্লাহ রহম করেছেন আহলেহাদীছগণের উপরে, যারা সকল বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত এবং সর্বদা মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকেন। তারা কবীরা গোনাহগার মুমিনকে কাফের বা পূর্ণ মুমিন বলেন না। বরং তাকে ফাসেক বা গোনাহগার মুমিন বলেন ও তাকে তওবা করে পূর্ণ মুমিন হওয়ার সুযোগ দেন। রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহ যে ৭৩ ফের্কায় বিভক্ত হবে, তাদের মধ্যে ৭২ ফের্কাই জাহান্নামী হবে এবং মাত্র একটি ফের্কা শুরুতেই জান্নাতী হবে। তারা হ’লেন ভাগ্যবান সেইসব মুমিন, যারা রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণের তরীকার উপর দৃঢ় থাকবেন।[7]
ইমাম আহমাদ, ইমাম বুখারী, তদীয় উস্তাদ আলী ইবনুল মাদীনী, ইয়াযীদ বিন হারূণ, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারকসহ মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠ বিদ্বানমন্ডলীর ঐক্যমতে তারা হ’লেন ‘আহলুল হাদীছ’ এবং তারাই হ’লেন ফির্কা নাজিয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল।[8] আল্লাহ আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন-আমীন!
উল্লেখ্য যে, ‘আহলেহাদীছ’ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম, যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। কালেমা পাঠকারী সকলে ‘মুসলিম’ হলেও সকলে ‘আহলেহাদীছ’ নয়। কারণ সকলের মধ্যে আহলেহাদীছের মধ্যপন্থী বৈশিষ্ট্য নেই এবং নিঃশর্তভাবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী জীবন পরিচালনার প্রতিজ্ঞা নেই।
(৪) আববাসীয় খলীফা মামূন (১৯৮-২১৮ হিঃ)-এর দরবারে জনৈক ‘খারেজী’ এলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, কোন্ বস্ত্ত তোমাদেরকে আমাদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে? জবাবে সে বলল, আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত। তিনি বললেন, সেটি কোন আয়াত? সে বলল, সূরা মায়েদাহ ৪৪ আয়াত। খলীফা বললেন, তুমি কি জানো এটি আল্লাহর নাযিলকৃত? সে বলল, জানি। খলীফা বললেন, এ বিষয়ে তোমার প্রমাণ কি? সে বলল, উম্মতের ঐক্যমত (ইজমা)। তখন খলীফা তাকে বললেন, তুমি যেমন আয়াত নাযিলের ব্যাপারে ইজমার উপরে খুশী হয়েছ, তেমনি উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায়ও উম্মতের ইজমার উপরে সন্তুষ্ট হও’। সে বলল, আপনি সঠিক কথা বলেছেন। অতঃপর সে খলীফাকে সালাম দিয়ে বিদায় হ’ল’।[9]
(৫) সঊদী আরবের সাবেক প্রধান মুফতী শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসন বা বিচার করেনা, সে ব্যক্তি চারটি বিষয় থেকে মুক্ত নয় : (১) তার বিশ্বাস মতে মানুষের মনগড়া আইন আল্লাহর আইনের চাইতে উত্তম। অথবা (২) সেটি শারঈ বিধানের ন্যায়। অথবা (৩) শারঈ বিধান উত্তম, তবে এটাও জায়েয। এরূপ বিশ্বাস থাকলে সে কাফির এবং মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজ হয়ে যাবে। কিন্তু (৪) যদি সে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর বিধান ব্যতীত অন্য কোন বিধান বৈধ নয়। তবে সে অলসতা বা উদাসীনতা বশে বা পরিস্থিতির চাপে এটা করে, তাহ’লে সেটা ছোট কুফরী হবে ও সে কবীরা গোনাহগার হবে। কিন্তু মুসলিম মিল্লাত থেকে খারিজ হবে না’।[10]
যেমন হাবশার (ইথিওপিয়া) বাদশাহ নাজাশী ইসলাম কবুল করেছিলেন এবং সে মর্মে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রেরিত দূতের নিকট তিনি বায়‘আত নিয়েছিলেন ও পত্র প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু দেশের নাগরিকগণ খ্রিষ্টান হওয়ায় তিনি নিজ দেশে ইসলামী বিধান চালু করতে পারেননি। এজন্য তিনি দায়ী ছিলেন না। বরং পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছিল। সেকারণ ৯ম হিজরীতে তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে রাসূল (ছাঃ) ছাহাবীগণকে নিয়ে তার গায়েবানা জানাযা পড়েন।[11] কারণ অমুসলিম দেশে তাঁর জানাযা হয়নি।[12]
(৬) শায়খ নাছেরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, কুফর, যুলুম, ফিসক সবগুলিই বড় ও ছোট দু’প্রকারের। যদি কেউ আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার-ফায়ছালা না করে, সূদী লেন-দেন, যেনা-ব্যভিচার বা অনুরূপ স্পষ্ট হারামগুলিকে হালাল জ্ঞান করে, সে বড় কাফের, যালেম ও ফাসেক হবে। আর বৈধ জ্ঞান না করে পাপ করলে সে ছোট কাফের, যালেম ও ফাসেক হবে ও মহাপাপী হবে’।[13] যা তওবা ব্যতীত মাফ হবে না।[1]. ইবনু মাজাহ হা/১৭৩, সনদ ছহীহ।
[2]. মানাবী, ফায়যুল ক্বাদীর শরহ ছহীহুল জামে‘ আছ-ছাগীর (বৈরূত : ১ম সংস্করণ ১৪১৫/১৯৯৪) ৩/৫০৯ পৃঃ।
[3]. ফাৎহুল বারী ৮৮ অধ্যায় ৬ অনুচ্ছেদ-এর তরজুমাতুল বাব, হা/৬৯৩০-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[4]. ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর, উক্ত আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য; তাহকীক দ্রষ্টব্য : খালেদ আল-আম্বারী, উছূলুত তাকফীর পৃঃ ৬৪; ৭৫-৭৬ টীকাসমূহ।
[5]. হাকেম হা/৩২১৯, ২/৩১৩, সনদ ছহীহ; তিরমিযী হা/২৬৩৫।
[6]. সালাফ ও খালাফের ৩৯ জন বিদ্বানের ফৎওয়া দ্রষ্টব্য; উছূলুত তাকফীর ৬৪-৭৪ পৃঃ।
[7]. তিরমিযী হা/২৬৪১, ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯২; মিশকাত হা/১৭১-১৭২।
[8]. খতীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ ও অন্যান্য; আলবানী, ছহীহাহ হা/২৭০-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[9]. খত্বীব, তারীখু বাগদাদ ১০/১৮৬; যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১০/২৮০।
[10]. খালেদ আল-আম্বারী, উছূলুত তাকফীর (রিয়াদ : ৩য় সংস্করণ, ১৪১৭ হিঃ) ৭১-৭২।
[11]. আর-রাহীকুল মাখতূম ৩৫২ পৃঃ; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৬৫২ ‘জানায়েয’ অধ্যায়।
[12]. আবুদাঊদ হা/৩২০৪ ‘জানায়েয’ অধ্যায় ৬২ অনুচ্ছেদ।
[13]. উছূলুত তাকফীর, ৭৪ পৃঃ।