কাফের বলার দলীল হিসাবে আরও কয়েকটি আয়াত
সূরা মায়েদাহ ৪৪ আয়াতটি ছাড়াও আরও কয়েকটি আয়াতকে মুসলমানকে ‘কাফের’ বলার পক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করা হয়। যেমন- সূরা নিসা ৬৫, তওবা ৩১, শূরা ২১ ও আন‘আম ১২১ প্রভৃতি।
(১) নিসা ৬৫। আল্লাহ বলেন, فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا (‘অতএব তোমার পালনকর্তার শপথ! তারা কখনো মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়ে তোমাকে ফায়ছালা দানকারী হিসাবে মেনে নিবে। অতঃপর তোমার দেওয়া ফায়ছালার ব্যাপারে তাদের অন্তরে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ না রাখবে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নিবে’)।
সাইয়িদ কুতুব অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন ‘তাগূতের অনুসারী ঐসব লোকেরা ‘ঈমানের গন্ডী থেকে বেরিয়ে যাবে। মুখে তারা যতই দাবী করুক না কেন’।[1] অথচ ‘তারা মুমিন হতে পারবে না’ (لاَ يُؤْمِنُوْنَ) -এর প্রকৃত অর্থ হবে, ‘তারা পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না’ (لاَ يَسْتَكْمِلُوْنَ الْإِيْمَانَ)। কারণ উক্ত আয়াত নাযিল হয়েছিল দু’জন মুহাজির ও আনছার ছাহাবীর পরস্পরের জমিতে পানি সেচ নিয়ে ঝগড়া মিমাংসার উদ্দেশ্যে।[2] দু’জনই ছিলেন বদরী ছাহাবী এবং দু’জনই ছিলেন স্ব স্ব জীবদ্দশায় ক্ষমাপ্রাপ্ত ও জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত। অতএব তাদের কাউকে মুনাফিক বা কাফির বলার উপায় নেই। কিন্তু চরমপন্থী খারেজী ও শী‘আপন্থী মুফাসসিরগণ তাদের ‘কাফের’ বলায় প্রশান্তি বোধ করে থাকেন। তারা আয়াতের প্রকাশ্য অর্থ নিয়েছেন ও সকল কবীরা গোনাহগারকে ‘কাফের’ সাব্যস্ত করেছেন। অথচ তারা আরবীয় বাকরীতি এবং হাদীছের প্রতি লক্ষ্য করেননি। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ، وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ، وَاللهِ لاَ يُؤْمِنُ. قِيلَ وَمَنْ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ الَّذِى لاَ يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَايِقَهُ. ‘আল্লাহর কসম! ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় (৩ বার), যার প্রতিবেশী তার অনিষ্টকারিতা হতে নিরাপদ নয়’।[3] তিনি বলেন, وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لاَ يُؤْمِنُ عَبْدٌ حَتَّى يُحِبَّ لِجَارِهِ أَوْ قَالَ لأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ. ‘তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য সেটা ভালবাসবে যা সে তার নিজের জন্য ভালবাসে’।[4] এসব হাদীছের অর্থ ঐ ব্যক্তি ঈমানহীন কাফের নয়, বরং পূর্ণ মুমিন নয়। একইভাবে কবীরা গোনাহগার মুমিন ‘কাফের’ হবে না বরং সে ‘পূর্ণ মুমিন’ হবে না।
(২) তওবা ৩১। আল্লাহ বলেন, اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلاَّ لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ (‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের আলেম-ওলামা ও পোপ-পাদ্রীদের এবং মারিয়াম পুত্র মসীহ ঈসাকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছে। অথচ তাদের প্রতি কেবল এই আদেশ করা হয়েছিল যে, তারা শুধুমাত্র এক উপাস্যের ইবাদত করবে। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আর তারা যাদেরকে শরীক সাব্যস্ত করে, তিনি সে সব থেকে পবিত্র’)।
অত্র আয়াতের তাফসীরে সাইয়িদ কুতুব বলেছেন, ‘এরা মুশরিক এবং তা ঐ শিরক, যা তাদেরকে মুমিনদের গন্ডী থেকে বের করে কাফিরদের গন্ডীতে প্রবেশ করাবে’।[5] অথচ এর ব্যাখ্যায় প্রায় সকল মুফাসসির বলেছেন যে, তারা তাদেরকে প্রকৃত ‘রব’ ভাবত না। বরং তাদের অন্যায় আদেশ-নিষেধসমূহ মান্য করত। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) ও যাহহাক বলেন,أَنَّهُمْ لَمْ يَأمُرُوْهُمْ أَنْ يَّسْجُدُوْا لَهُمْ وَلَكِنْ أَمَرُوْهُمْ بِمَعْصِيَةِ اللهِ فَأَطَاعُوْهُمْ فَسَمَّاهُمُ اللهُ بِذَالِكَ أَرْبَابًا- ‘ইহূদী-নাছারাদের সমাজ ও ধর্মনেতাগণ তাদেরকে সিজদা করার জন্য বলেননি। বরং তারা আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কাজে লোকদের হুকুম দিতেন এবং তারা তা মান্য করত। আর সেজন্যই আল্লাহ পাক ঐসব আলেম, সমাজনেতা ও দরবেশগণকে ‘রব’ হিসাবে অভিহিত করেছেন’।[6] হযরত হুযায়ফা (রাঃ)ও অনুরূপ বলেন (কুরতুবী)।
ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, যদি কেউ আক্বীদাগত ভাবে হারামকে হালাল করায় বিশ্বাসী হয়, তবে সে কাফের হবে। কিন্তু যদি আক্বীদাগতভাবে এতে বিশ্বাসী না হয়। কিন্তু গোনাহের আনুগত্য করে, তবে সে কবীরা গোনাহগার হবে। এমনকি হারামকে হালালকারী ব্যক্তি যদি মুজতাহিদ হয় এবং তার কাছে উক্ত বিষয়ে সত্য অস্পষ্ট থাকে এবং সে আল্লাহকে সাধ্যমত ভয় করে, তবে সে ব্যক্তি তার গোনাহের জন্য আল্লাহর নিকট পাকড়াও হবে না’। তিনি বলেন, কুরআন ও হাদীছে বহু গোনাহের ক্ষেত্রে এরূপ কুফর ও শিরকের শব্দ বর্ণিত হয়েছে’।[7] বস্ত্ততঃ এটাই হল সঠিক ব্যাখ্যা। যা আহলেসুন্নাত বিদ্বানগণের নিকটে গৃহীত।
(৩) শূরা ২১। আল্লাহ বলেন, أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّيْنِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللهُ وَلَوْلاَ كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ وَإِنَّ الظَّالِمِيْنَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ ‘তাদের কি এমন কিছু শরীক আছে যারা তাদের জন্য দ্বীনের কিছু বিধান প্রবর্তন করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? ক্বিয়ামতের দিন তাদের বিষয়ে ফায়ছালার সিদ্ধান্ত না থাকলে এখুনি তাদের নিষ্পত্তি হয়ে যেত। নিশ্চয়ই যালেমদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (শূরা ৪২/২১)।
উক্ত আয়াতে একথা বর্ণিত হয়েছে যে, আইন প্রণয়নের অধিকার কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। যার কোন শরীক নেই। এক্ষণে যদি কেউ তাতে ভাগ বসায় এবং নিজেরা আইন রচনা করে, তাহ’লে সে মুশরিক হবে। শিরকের উক্ত প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ করেছেন খারেজী আক্বীদার অনুসারী মুফাসসিরগণ। ফলে যেসব মুসলিম সরকার কোন একটি আইনও রচনা করেছে, যা আল্লাহর আইনের অনুকূলে নয়, তাদেরকে তারা মুশরিক ও মুরতাদ ধারণা করেছেন এবং তাদেরকে হত্যা করা সিদ্ধ মনে করেছেন। অথচ পূর্বের আয়াতগুলির ন্যায় এ আয়াতের অর্থ তারা প্রকৃত মুশরিক নয়, বরং কবীরা গোনাহগার। কেননা এর প্রকৃত অর্থ আল্লাহর ইবাদতে শরীক করা নয়। বরং জিন ও ইনসানরূপী শয়তানরা হালাল ও হারামের যেসব বিধান রচনা করে, সে সবের অনুসরণ করা। কোন সরকার এগুলি করলে এবং আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে সেটাকে উত্তম, সমান অথবা সিদ্ধ মনে করলে ঐ সরকার স্পষ্ট কুফরীতে লিপ্ত হবে। কিন্তু তা মনে না করলে সে কবীরা গোনাহগার হবে। ইবনু জারীর, ইবনু কাছীরসহ আহলে সুন্নাতের সকল বিদ্বান এরূপ তাফসীর করেছেন।
(৪) আন‘আম ১২১। আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِيْنَ لَيُوْحُوْنَ إِلَى أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوْكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوْهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُوْنَ ‘যে সব পশু যবেহকালে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি, তা তোমরা ভক্ষণ করো না। নিশ্চয়ই সেটি ফাসেকী কাজ। শয়তানেরা তাদের বন্ধুদের মনে কুমন্ত্রণা প্রবেশ করিয়ে দেয়, যাতে তারা তোমাদের সাথে বিতর্ক করে। এক্ষণে যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তাহ’লে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হয়ে যাবে’ (আন‘আম ৬/১২১)।
এখানেও পূর্বের ন্যায় প্রকাশ্য অর্থে মুশরিক ও কাফির অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন সাইয়েদ কুতুব বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ছোট একটি প্রশাখাগত বিষয়েও মানুষের রচিত আইনের অনুসরণ করবে, ঐ ব্যক্তি নিঃসন্দেহে ‘মুশরিক’ হবে। যদিও সে আসলে ‘মুসলমান’। অতঃপর তার কাজ তাকে ইসলাম থেকে শিরকের দিকে বের করে নিয়ে গেছে। যদিও সে মুখে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর সাক্ষ্য দান অব্যাহত রাখে। কেননা ইতিমধ্যেই সে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের সাথে মিলিত হয়েছে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যের আনুগত্য করেছে’।[8][1]. তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন, ২/৮৯৫।-
فما يمكن أن يجتمع الإيمان، وعدم تحكيم شريعة الله، أو عدم الرضى بحكم هذه الشريعة. والذين يزعمون لأنفسهم أو لغيرهم أنهم «مؤمنون» ثم هم لا يحكمون شريعة الله في حياتهم، أو لا يرضون حكمها إذا طبق عليهم.. إنما يدعون دعوى كاذبة وإنما يصطدمون بهذا النص القاطع: «وَما أُولئِكَ بِالْمُؤْمِنِينَ» . فليس الأمر في هذا هو أمر عدم تحكيم شريعة الله من الحكام فحسب بل إنه كذلك عدم الرضى بحكم الله من المحكومين، يخرجهم من دائرة الإيمان، مهما ادعوه باللسان-
[2]. বুখারী হা/২৩৫৯; মুসলিম হা/২৩৫৭ ও অন্যান্য।
[3]. বুখারী হা/৬০১৬; মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৬২ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, ১৫ অনুচ্ছেদ।
[4]. বুখারী, মুসলিম হা/৪৫; মিশকাত হা/৪৯৬১।
[5]. তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন ৩/১৬৪২।-
فقد حكم الله سبحانه- عليهم بالشرك في هذه الآية- وبالكفر في آية تالية في السياق- لمجرد أنهم تلقوا منهم الشرائع فأطاعوها واتبعوها.. فهذا وحده- دون الاعتقاد والشعائر- يكفي لاعتبار من يفعله مشركاً بالله، الشرك الذي يخرجه من عداد المؤمنين ويدخله في عداد الكافرين-
[6]. তাফসীর ইবনু জারীর (বৈরূত ছাপা : ১৯৮৬), ১০/৮০-৮১ পৃঃ।
[7]. ইবনু তায়মিয়াহ, আল-ঈমান (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৩য় সংস্করণ ১৪০৮/১৯৮৮) পৃঃ ৬৭, ৬৯।
[8]. তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন, আন‘আম ১২১ আয়াতের তাফসীর, ৩/১১৯৮ পৃঃ।-
من أطاع بشراً في شريعة من عند نفسه، ولو في جزئية صغيرة ، فإنما هو مشرك. وإن كان في الأصل مسلما ثم فعلها فإنما خرج بها من الإسلام إلى الشرك أيضاً. مهما بقي بعد ذلك يقول: أشهد أن لا إله إلا الله بلسانه. بينما هو يتلقى من غير الله، ويطيع غير الله-