জিহাদ ও কিতাল

আধুনিক যুগের চরমপন্থী নেতৃবৃন্দের কয়েকজন

১. সাইয়িদ আবুল আ‘লা মওদূদী (ভারত ও পরে পাকিস্তান : ১৯০৩-১৯৭৯) : প্রথম যুগের চরমপন্থী খারেজী ও শী‘আদের অনুকরণে আধুনিক যুগে কয়েকজন চিন্তাবিদের আবির্ভাব ঘটে। যাদের যুক্তিবাদী লেখনীতে প্রলুব্ধ হয়ে বিভিন্ন দেশে ইসলামের নামে চরমপন্থী দলসমূহের উদ্ভব ঘটে। বিংশ শতাব্দীতে এ দলের শীর্ষস্থানীয় হ’লেন মাওলানা মওদূদী। তাঁর পুরো লেখনীই পরিচালিত হয়েছে যেকোন উপায়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল ‘জামায়াতে ইসলামী’ও একই উদ্দেশ্যে পরিচালিত। তিনি বলেছেন, ‘দ্বীন আসলে হুকূমতের নাম। শরী‘আত ঐ হুকূমতের কানূন। আর ইবাদত হ’ল ঐ কানূন ও বিধানের আনুগত্য করার নাম’ (খুৎবাত ৩২০ পৃঃ)। তাঁর ধারণা মতে ‘ছালাত-ছিয়াম, হজ্জ-যাকাত, যিকর ও তাসবীহ সবকিছু উক্ত বড় ইবাদতের জন্য প্রস্ত্ততকারী অনুশীলনী বা ট্রেনিং কোর্স মাত্র’ (তাফহীমাত ১/৬৯)। তাঁর মতে ইসলাম কোন বণিকের দোকান নয় যে, ইচ্ছামত কিছু মাল কিনবে ও কিছু ছাড়বে। বরং ইসলামের হয় সবটুকু মানতে হবে, নয় সবটুকু ছাড়তে হবে’।[1] তাঁর মতে ‘আল্লাহর ইবাদত ও সরকারের আনুগত্য দু’টিই সমান। যদি ছালাত-ছিয়াম ইত্যাদি ইবাদত হুকূমত কায়েমের লক্ষ্য হতে বিচ্যুত হয়, তাহ’লে আল্লাহর নিকট এ সবের কোন ছওয়াব মিলবে না’ (তাফহীমাত ১/৪৯-৬৩ পৃঃ)। তিনি বলেন, তার এই দাওয়াত যারা কবুল করবে না, তাদের অবস্থা হবে নবীযুগে ইসলামী দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারী ইহূদীদের মত’ (রোয়েদাদ ২/১৯ পৃঃ)

এতে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের আক্বীদা বিগত যুগের চরমপন্থী খারেজী, শী‘আ, মু‘তাযিলা প্রভৃতি ভ্রান্ত দলসমূহের অনুরূপ। সে যুগে তারা ছাহাবীদের ‘কাফের’ বলেছিল ও তাদের রক্ত হালাল করেছিল। এ যুগে এরা অন্য মুসলমানদের ‘ইহূদী’ অর্থাৎ কাফের ভাবছে ও তাদের রক্ত হালাল গণ্য করছে। সে যুগে যেমন যেভাবে হৌক ক্ষমতা দখলই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল, এ যুগেও তেমনি ব্যালট বা বুলেট যেভাবেই হৌক ক্ষমতা দখলই তাদের মূল লক্ষ্য এবং এটাই হ’ল তাদের দৃষ্টিতে বড় ইবাদত।

বস্ত্ততঃ মাওলানা মওদূদীর রাজনৈতিক চিন্তাধারায় সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তিনটি : (১) সর্বাত্মক দ্বীন (كل  دين) -এর ধারণা। ফলে তাঁর মতে দ্বীনের কোন একটি অংশ ছাড়লেই সব দ্বীন চলে যাবে। (২) তাঁর নিকটে দ্বীন ও দুনিয়ার পার্থক্য পরিষ্কার না হওয়া এবং (৩) আল্লাহর ইবাদত ও সরকারের প্রতি আনুগত্যকে এক করে দেখা। এই দর্শনের ফলে ইসলামী সরকারের বিরোধিতা করা এবং অনৈসলামী বা অমুসলিম সরকারের আনুগত্য করা দু’টিই শিরকে পরিণত হয়। যাতে সরকার ও জনগণের মধ্যে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হবে। যেমন বর্তমানে হচ্ছে। 

২. সাইয়িদ কুতুব (মিসর : ১৯০৬-১৯৬৬) : মাওলানা মওদূদীর লেখনীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একই ভাবধারায় তিনি লেখনী পরিচালনা করেছেন। সাথে সাথে তাঁর অনুসারী দল ‘ইখওয়ানুল মুসলেমীন’কে পরিচালিত করেছেন। তিনিও খারেজীদের ন্যায় মুসলিম উম্মাহকে হয় কাফের নয় মুমিন, এভাবে ভাগ করে বলেছেন, ‘লোকেরা আসলে মুসলমান নয় যেমন তারা দাবী করে থাকে। তারা জাহেলিয়াতের জীবন যাপন করছে। ... তারা ধারণা করে যে, ইসলাম এই জাহেলিয়াতকে নিয়েই চলতে পারে। কিন্তু তাদের এই ধোঁকা খাওয়া ও অন্যকে ধোঁকা দেওয়ায় প্রকৃত অবস্থার কোনই পরিবর্তন হবে না। না এটি ইসলাম এবং না তারা মুসলমান’ (মা‘আলিম ফিত-তারীক্ব পৃঃ ১৫৮)। তিনি বলেন, ‘কালচক্রে দ্বীন এখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহতে এসে দাঁড়িয়ে গেছে। ... মানুষ প্রাচ্যে-প্রতীচ্যে সর্বত্র মসজিদের মিনার সমূহে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর ধ্বনি বারবার উচ্চারণ করে কোনরূপ বুঝ ও বাস্তবতা ছাড়াই। এরাই হ’ল সবচেয়ে বড় পাপী ও ক্বিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তির (أثقلُ إثماً وأشدُّ عذاباً يومَ القيامة) অধিকারী। কেননা তাদের কাছে হেদায়াত স্পষ্ট হওয়ার পরেও এবং তারা আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে থাকার পরেও তারা মানুষপূজার দিকে ফিরে গেছে’।[2] তিনি বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বে কোন মুসলিম রাষ্ট্র নেই বা কোন মুসলিম সমাজ নেই’।[3] তিনি মুসলমানদের সমাজকে জাহেলী সমাজ এবং তাদের মসজিদগুলিকে ‘জাহেলিয়াতের ইবাদতখানা’ (مُعَابِدُ الْجَاهِلِيَّةِ) বলে আখ্যায়িত করেছেন।[4] তিনি মাওলানা মওদূদীর ন্যায় আল্লাহর ইবাদত ও সরকারের আনুগত্যকে সমান মনে করেছেন এবং অনৈসলামী সরকারের আনুগত্য করাকে ‘ঈমানহীনতা’ গণ্য করেছেন।[5] ‘একটি বিষয়েও অন্যের অনুসরণ করলে সে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে’ বলে তিনি ধারণা করেছেন।[6] তিনি বলেন, ইসলামে জিহাদের উদ্দেশ্য হ’ল, ইসলাম বিরোধী শাসনের বুনিয়াদ সমূহ ধ্বংস করে দেয়া এবং সে স্থলে ইসলামের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কায়েম করা।[7] এভাবে বিদ্বানগণ তাঁর অন্যান্য বই ছাড়াও কেবল তাফসীর ‘ফী যিলালিল কুরআনে’ আক্বীদাগত ও অন্যান্য বিষয়ে ১৮১টি ভুল চিহ্নিত করেছেন।[8]

মাওলানা মওদূদী ও সাইয়িদ কুতুবের চিন্তাধারায় কোন পার্থক্য নেই। কবীরা গোনাহগার মুসলমানদের তারা মুসলমান হিসাবে মেনে নিতে চাননি। বরং তাদেরকে মুসলিম উম্মাহ থেকে খারিজ বলে ধারণা করেছেন। এর ফলে তাঁরা ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। সাথে সাথে পথচ্যুত করেছেন তাদের অনুসারী অসংখ্য মুসলিমকে। অথচ এর কোন বাস্তবতা এমনকি রাসূল (ছাঃ)-এর যুগেও ছিল না। তখনও মুসলমানদের মধ্যে ভাল-মন্দ, ফাসিক-মুনাফিক সবই ছিল। কিন্তু কাউকে তাঁরা কাফির এবং মুসলিম উম্মাহ থেকে খারিজ বলতেন না। সেকারণ আধুনিক বিদ্বানগণ এসব দল ও এদের অনুসারী দলসমূহকে এক কথায় ‘জামা‘আতুত তাকফীর’ (جماعة التكفير) অর্থাৎ ‘অন্যকে কাফের ধারণাকারী দল’ বলে অভিহিত করে থাকেন। অথচ এইসব চরমপন্থী আক্বীদার ফলে যিনি মারছেন ও যিনি মরছেন, উভয়ে মুসলমান। আর এটাই তো শয়তানের পাতানো ফাঁদ, যেখানে তারা পা দিয়েছেন।

অতএব সকলের কর্তব্য হবে সর্বাবস্থায় আমর বিন মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের মৌলিক দায়িত্ব পালন করা এবং মুসলিম-অমুসলিম সকলের নিকট ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা।



[1]. হাকীম আবুল হাসান ওবায়দুল্লাহ খান, ইসলামী সিয়াসাত (শ্রীনগর, কাষ্মীর : ১৯৭৮) পৃঃ ২৩; রোয়েদাদে জামা‘আতে ইসলামী (দিল্লী : জুন ১৯৮২) ১/৬ পৃঃ।

[2]. সাইয়িদ কুতুব, তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন (বৈরূত : দারুশ শুরূক্ব  ১৭তম সংস্করণ ১৪১২ হিঃ) সূরা আন‘আম ১৯ আয়াতের ব্যাখ্যা, ২/১০৫৭ পৃঃ।

[3]. ঐ, সূরা হিজরের ভূমিকা, ৪/২১২২ পৃঃ।

[4]. ঐ, ইউনুস ৮৭ আয়াতের ব্যাখ্যা ৩/১৮১৬ পৃঃ।

[5]. ঐ, নিসা ৬০ আয়াতের ব্যাখ্যা, ২/৬৯৩ পৃঃ।

[6]. ঐ, ২/৯৭২ পৃঃ।- والإسلام منهج للحياة كلها. من اتبعه كله فهو مؤمن وفي دين الله ومن اتبع غيره ولو في حكم واحد فقد رفض الإيمان واعتدى على ألوهية الله، وخرج من دين الله. مهما أعلن أنه يحترم العقيدة وأنه مسلم-                                              

[7]. ঐ, ৩/১৪৫১।- أن غاية الجهاد في الإسلام، هي هدم بنيان النظم المناقضة لمبادئه، وإقامة حكومة مؤسسة على قواعد الإسلام في مكانها واستبدالها بها-                               

[8]. মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আল-হুসাইন, ফিৎনাতুত তাকফীর ওয়াল হাকেমিয়াহ (রিয়াদ : ১৪১৬ হিঃ) পৃঃ ৯৮; গৃহীত : المورد الزلال فى التنبيه على أخطاء الظلال لعبد الله بن محمد الدويش