কাফির গণ্য করার মূলনীতি সমূহ
কাউকে কাফের বলতে গেলে যেসব মূলনীতি জানা আবশ্যক তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি নিম্নে প্রদত্ত হ’ল।-
(১) এটি একটি শারঈ হুকুম। যা কুরআন ও সুন্নাহ্র ভিত্তিতেই সাব্যস্ত হবে। অন্য কোন ভিত্তিতে নয়।
(২) কাফের সাব্যস্ত হবে ব্যক্তির অবস্থা ভেদে। কেননা অনেকে ঈমান ও কুফরের পার্থক্য বুঝে না। ফলে প্রত্যেক বিদ‘আতী ও পাপী এমনকি একজন কবরপূজারীকেও কাফের সাব্যস্ত করা যায় না তার অজ্ঞতা ও মূর্খতার কারণে।
(৩) কারু কথা, কাজ বা বিশ্বাসের ভিত্তিতেই কেবল তাকে কাফের বলা যাবে না, যতক্ষণ না তার কাছে দলীল স্পষ্ট করা হবে এবং সন্দেহ দূর করা হবে। এমনকি যদি কেউ অজ্ঞতাবশে কাউকে সিজদা করে, তবে তাকে কাফের বলা যাবে না। যেমন হযরত মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) শাম (সিরিয়া) থেকে ফিরে এসে রাসূল (ছাঃ)-কে সিজদা করেন। কেননা তিনি সেখানে নেতাদের সিজদা করতে দেখেছেন, তাই এসে রাসূলকে সিজদা করেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে নিষেধ করে দেন।[1] অতএব অজ্ঞতাবশে ইসলামের কোন বিধানকে অস্বীকার করলে তাকে ‘কাফের’ বলা যাবে না। যতক্ষণ না তাকে ভালভাবে বুঝানো হয়।
(৪) মুমিন কোন ক্ষেত্রে ঈমান বিরোধী কাজ করলেই তিনি ঈমানের গন্ডী থেকে বের হয়ে যান না বা ‘মুরতাদ’ হয়ে যান না। যেমন মক্কা অভিযানের গোপন তথ্য ফাঁস করে জনৈক মহিলার মাধ্যমে মক্কার নেতাদের কাছে পত্র প্রেরণ করা ও তা হাতেনাতে ধরা পড়ার মত হত্যাযোগ্য পাপ করা সত্ত্বেও রাসূল (ছাঃ) বদরী ছাহাবী হাতেব বিন আবী বালতা‘আহ (রাঃ)-কে ‘কাফের’ সাব্যস্ত করেননি ও তাকে হত্যা করেননি। বরং তাকে ক্ষমা করে দেন তার কৈফিয়ত শ্রবণ করার পর।[2]
(৫) ইসলামের মূল বিষয়গুলি অস্বীকার করলে কাফের হবে, আর শাখাগুলি অস্বীকার করলে কাফের হবে না, এমনটি নয়। বরং শরী‘আতের প্রতিটি বিষয়ই পালনীয়। ছাহাবায়ে কেরাম আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর কোন নির্দেশকেই অগ্রাহ্য করতেন না বরং প্রতিটি নির্দেশকেই সমভাবে গুরুত্ব ও মর্যাদা দিতেন।
(৬) একই ব্যক্তির মধ্যে ঈমান ও কুফর, তাওহীদ ও শিরক, তাক্বওয়া ও পাপাচার, সরলতা ও কপটতা দু’টিই একত্রিত হতে পারে।
আর এটাই হ’ল বাস্তব। তা না হ’লে তওবা ও ইস্তিগফারের কোন প্রয়োজন থাকত না। আর আহলে সুন্নাতের নিকট এটি একটি বড় মূলনীতি। যা খারেজী, মুরজিয়া, মু‘তাযিলা, ক্বাদারিয়া ও অন্যান্য ভ্রান্ত ফের্কা সমূহের বিপরীত।
বস্ত্ততঃ তাদের পথভ্রষ্টতার বড় কারণ এখানেই যে, তারা ঈমানকে এক ও অবিভাজ্য মনে করে। মুরজিয়ারা মনে করে যখন ঈমানের একাংশ থাকবে, তখন তার সবটাই থাকবে। পক্ষান্তরে খারেজীরা মনে করে যখন ঈমানের একাংশ চলে যাবে, তখন সবটাই চলে যাবে। আর একারণেই তারা কবীরা গোনাহগার মুমিনকে ‘কাফের’ ও ‘চিরস্থায়ী জাহান্নামী’ বলে এবং তার রক্তকে হালাল জ্ঞান করে। যেমন আজকাল চরমপন্থীরা মনে করে থাকে।
অথচ ‘কুরআন সৃষ্ট’ এই কুফরী মতবাদের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) তাঁর উপর নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতনকারী খলীফা মু‘তাছিম বিল্লাহ (২১৮-২২৭ হিঃ)-কে ‘কাফের’ বলেননি। বরং তার ইস্তিগফারের জন্য দো‘আ করেছেন একারণে যে, খলীফা ও তাঁর সাথীদের নিকট প্রকৃত বিষয়ের স্পষ্ট জ্ঞান ছিল না।[3]
সে যুগে খলীফা মু‘তাছিমের ইসলাম সম্পর্কে যে জ্ঞান ছিল, আজকের যুগে মুসলিম সরকার ও রাজনীতিকদের মধ্যে তার শতভাগের একভাগও আছে কি? অথচ তাদেরকে কাফের সাব্যস্ত করে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় যারা, তারা আল্লাহ্র কাছে কি কৈফিয়ত দিবে?[1]. ইবনু মাজাহ হা/১৮৫৩; ছহীহাহ হা/১২০৩।
[2]. বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/৬২১৬।
[3]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া (রিয়াদ : ১৪০৪ হিঃ) ২৩/৩৪৮-৪৯; আবু ইয়া‘লা, তাবাক্বাতুল হানাবিলাহ (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ, তাবি) ১/১৬৩-৬৭, ২৪০ পৃঃ।