জিহাদ ও কিতাল

২য় ভাগ

সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রকৃতি

(ক) মুসলিম হৌক অমুসলিম হৌক প্রতিষ্ঠিত কোন সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ইসলামের নীতি নয়। তবে ইসলাম বিরোধী হুকুম মানতে কোন মুসলিম নাগরিক বাধ্য নয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِى مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ ‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির প্রতি কোন আনুগত্য নেই।[1]  অতএব সর্বাবস্থায় তাওহীদের কালেমাকে সমুন্নত রাখা ও ইসলামী স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করা মুসলমানের উপর ফরয দায়িত্ব। এমতক্ষেত্রে সরকারের নিকটে কুরআন ও হাদীছের বক্তব্য তুলে ধরাই হ’ল বড় জিহাদ। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, أَفْضَلُ الْجِهَادِ كَلِمَةُ حَقٍّ عِنْدَ سُلْطَانٍ جَائِرٍ ‘শ্রেষ্ঠ জিহাদ হ’ল অত্যাচারী শাসকের নিকটে হক কথা বলা।[2]

সরকারের নিকট বক্তব্য তুলে ধরার সর্বোত্তম পন্থা হ’ল, সরকার প্রধান বা তাঁর প্রতিনিধির সাথে নিরিবিলি সাক্ষাতে কথা বলা ও উপদেশ দেওয়া। এজন্য সরকারকে উদার ও সহনশীল হ’তে হবে। অহংকারী ও হঠকারী হওয়া চলবে না। হরতাল-ধর্মঘট, মারদাঙ্গা মিছিল ইত্যাদি গণতন্ত্রে সমর্থনযোগ্য হ’লেও ইসলাম এগুলি সমর্থন করে না। অতএব এগুলি কখনোই কোন উত্তম প্রক্রিয়া নয়। এতে সরকার ও জনগণ মুখোমুখি হয়। যাতে হিতে বিপরীত হবে এবং অহেতুক নির্যাতন ও রক্তপাত হবে। যা এখন গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারী ও বিরোধী দল অর্থই হ’ল পরস্পর সহিংস দু’টো দল। যা সমাজকে বিভক্ত করে ও রাষ্ট্রকে পঙ্গু ও গতিহীন করে দেয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَرَادَ أَنْ يَنْصَحَ لِسُلْطَانٍ بِأَمْرٍ فَلاَ يُبْدِ لَهُ عَلاَنِيَةً وَلَكِنْ لِيَأْخُذْ بِيَدِهِ فَيَخْلُوَ بِهِ فَإِنْ قَبِلَ مِنْهُ فَذَاكَ وَإِلاَّ كَانَ قَدْ أَدَّى الَّذِى عَلَيْهِ لَهُ ‘যে ব্যক্তি শাসককে উপদেশ দিতে চায়, সে যেন তা প্রকাশ্যে না দেয়। বরং তার কাছে নির্জন স্থানে দেয়। এক্ষণে তিনি সেটি গ্রহণ করলে তো ভালই। না করলে ঐ ব্যক্তি তার দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করল’।[3] সরকারের কাছে বক্তব্য পেশ করার এই ভদ্র পন্থাই হ’ল ইসলামী পন্থা। এতে উভয়পক্ষ পরস্পরের প্রতি সহনশীল ও সহানুভূতিশীল থাকে। দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। এর বাইরে প্রচলিত হরতাল-ধর্মঘটের পন্থা একটা জংলী পন্থা বৈ কিছুই নয়।

অমুসলিম রাষ্ট্রে মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষণের সকল প্রকার ইসলামী প্রচেষ্টাই হ’ল ‘জিহাদ’। যখন তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয় এবং তাওহীদের ঝান্ডাকে সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে হয়। কিন্তু যদি বিনা প্রচেষ্টায় অনৈসলামী আইন মেনে নেওয়া হয় এবং তার উপর কোন মুসলমান সন্তুষ্ট থাকে, তাহ’লে সে অবশ্যই কবীরা গোনাহগার হবে। সাধ্যমত চেষ্টা সত্ত্বেও বাধ্য হ’লে আল্লাহর নিকটে ক্ষমা চাইতে হবে এবং শাসকের হেদায়াতের জন্য দো‘আ করতে হবে।

(খ) শাসক মুসলিম ফাসেক হলে সে অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّهُ يُسْتَعْمَلُ عَلَيْكُمْ أُمَرَاءُ فَتَعْرِفُونَ وَتُنْكِرُونَ فَمَنْ أَنْكَرَ فَقَدْ بَرِئَ وَمَنْ كَرِهَ فَقَدْ سَلِمَ وَلَكِنْ مَنْ رَضِىَ وَتَابَعَ، قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ أَفَلاَ نُقَاتِلُهُمْ؟ قَالَ لاَ مَا صَلَّوْا، لاَ مَا صَلَّوْا- ‘তোমাদের উপর অনেক শাসক নিযুক্ত হবে। যাদের কোন কাজ তোমরা পসন্দ করবে এবং কোন কাজ অপসন্দ করবে। এক্ষণে যে ব্যক্তি উক্ত অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করবে, সে দায়িত্বমুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি তা অপসন্দ করবে, সে (মুনাফেকী থেকে) নিরাপদ থাকবে। কিন্তু যে ব্যক্তি তাতে সন্তুষ্ট থাকবে ও তার অনুসরণ করবে। এ সময় ছাহাবীগণ বললেন, আমরা কি ঐ শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? রাসূল (ছাঃ) বললেন, না। যতক্ষণ তারা ছালাত আদায় করে। না, যতক্ষণ তারা ছালাত আদায় করে’।[4]

অন্য হাদীছে এসেছে وَأَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ قَالَ إِلاَّ أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِنَ اللهِ فِيهِ بُرْهَانٌ ‘আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রমাণ ভিত্তিক সুস্পষ্ট কুফরী না দেখা পর্যন্ত মুসলিম শাসকদের আনুগত্যমুক্ত হওয়া যাবে না’।[5]



[1]. শারহুস সুন্নাহ, মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৯৬, ৩৬৬৪ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।

[2]. আবুদাঊদ হা/৪৩৪৪, তিরমিযী; মিশকাত হা/৩৭০৫।

[3]. আহমাদ হা/১৫৩৬৯; হাকেম; আলবানী, যিলালুল জান্নাহ হা/১০৯৮, সনদ ছহীহ।

[4]. মুসলিম হা/১৮৫৪, শারহুস সুন্নাহ হা/২৪৫৯, মিশকাত হা/৩৬৭১।

[5]. বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/৩৬৬৬।