অ্যানেসথেসিয়া দর্শন[1]
অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করলে মানুষ সাময়িকভাবে অচেতন হয়। যদি এই ঔষধ স্থানিক হয়, তাহ’লে রোগী নিজে তার দেহের কাটাছেঁড়ার সবকিছু দেখতে পায়। কিন্তু ঔষধের প্রভাবে সে ব্যথাতুর হয় না বা কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। চেতনানাশক ঔষধ তৈরী হয় ফ্যাক্টরীতে, প্রয়োগ করেন চিকিৎসক এবং ব্যবহৃত হয় রোগীর উপর। রোগীই এর ভাল-মন্দ সবকিছু ভোগ করেন। দেশের জাতীয় জীবনে এমনিতরো চেতনানাশক ঔষধ তৈরী হচ্ছে হর-হামেশা। যা ব্যবহৃত হচ্ছে নিরীহ জনগণের উপর। ভোটের মওসুমে নেতারা সব পাক্কা মুসলমানী পোষাকে হাযির হন। কবরে ফাতিহা পাঠ করে নির্বাচনী সফর শুরু করেন। ‘কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী কোন আইন করা হবেনা’ বলে তারস্বরে ভাষণ দেন ও নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেন। ব্যস এটাতেই বাজিমাত। সরল-সিধা ভোটারগণ এতেই খুশীতে বেহুঁশ। এটাই হ’ল প্রথম চেতনানাশক ঔষধ। যা দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে ঘুম পাড়ানো হয়। এর মাধ্যমে জননেতারা আগামী পাঁচ বছরের জন্য জনগণের উপর শাসন-শোষণ, দলীয়করণ, হামলা-মামলা ও যুলুম করার অবাধ লাইসেন্স পেয়ে যান।
দ্বিতীয় চেতনা নাশক সস্তা ট্যাবলেট হ’ল জঙ্গীবাদ। নেতাদের মুখে ফেনা উঠে যাচ্ছে জঙ্গীবাদ জঙ্গীবাদ করে। ফলে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে এবং বিদেশে জনশক্তি রফতানীতেও ধ্বস নেমেছে। তারা শয়নে-স্বপনে-জাগরণে সর্বদা চারদিকে কেবল জঙ্গী দেখেন। নিরীহ গোবেচারী মহিলাদের ধরে এনেও তাদের এখন জঙ্গী হিসাবে দেখানো হচ্ছে। অথচ দলীয় ক্যাডাররা প্রকাশ্য দিনমানে রাজপথে প্রতিপক্ষ জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধিকে পিটিয়ে হত্যা করে লাশের উপর দাঁড়িয়ে নাচানাচি করলেও ওটা জঙ্গীপনা নয়। যাত্রীবাহী বাসে ওঠে গান পাউডার ছড়িয়ে তাতে আগুন দিয়ে প্রকাশ্য দিনের বেলায় ডজন খানেক তাযা মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করলেও ওরা চরমপন্থী নয়। বাস-ট্যাক্সি ও ট্রেনে ভাংচুর, লুটপাট ও আগুনে পুড়িয়ে শেষ করে দিলেও ওরা সন্ত্রাসী নয়। কারণ ওরা যে গণতন্ত্রী। অথচ হাযার বছরের ইতিহাস সাক্ষ্য যে, বাংলাদেশের মানুষ কখনোই জঙ্গী, সন্ত্রাসী বা চরমপন্থী নয়। তারা সর্বদা সহনশীল ও শান্তিপ্রিয়। তাদেরকে জঙ্গী বানানোর চেতনানাশক ট্যাবলেট তৈরী হয়েছে বিদেশের কোন গোপন ফ্যাক্টরীতে। বাস্তবায়ন হচ্ছে আমাদের দেশে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ইসলামই যেন এখন সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। ছাত্রীদের ইসলামী হেজাবের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সরকারী পরিপত্র জারি হয়েছে। ইসলামী শিক্ষার বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চালানো হচ্ছে। ইসলামী জালসা বা ওয়ায মাহফিল করতেও সরকারের অনুমতি লাগে। ‘কোনরূপ রাজনৈতিক কথা বলা হবে না’- মর্মে মুচলেকা দিয়েই তবে ইসলামী জালসার অনুমতি নিতে হচ্ছে। অথচ বাক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবই লেখা আছে দেশের সংবিধানে। হ্যাঁ, এগুলি প্রযোজ্য হয় কেবলমাত্র ইসলামের বিরুদ্ধে ও ইসলামী নেতাদের চরিত্র হননের ক্ষেত্রে। অথচ সচেতন দেশপ্রেমিক মাত্রই বুঝেন যে, এ দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ আমদানীর মূল হোতা হ’ল পাশ্চাত্যের লুটেরা পরাশক্তি ও তাদের দোসররা। যারা তাদের কথিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে ইরাক ও আফগানিস্তান ধ্বংস করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের তেল লুট করা তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিক টার্গেট। ঐসব দেশের তেল-গ্যাস লুট করার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে এবার তারা এ দেশের তেল-গ্যাস লুন্ঠন করতে এগিয়ে আসছে। সরকারকে বাধ্য করা হবে তাদের লক্ষ্য পূরণের জন্য। নইলে সরকারের পতন ঘটাবে তারা তাদের এজেন্টদের দিয়ে। তারা সমুদ্রসীমার নিয়ন্ত্রণ নেবে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বাধীন করে ইন্দোনেশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা পূর্ব তিমূরের ন্যায় খৃষ্টান অধ্যুষিত একটি বাফার স্টেট বানাবে। তাই তাদের প্রয়োজন এদেশকে জঙ্গী রাষ্ট্র অপবাদ দিয়ে সন্ত্রাস দমনের নামে এখানে এসে ঘাঁটি গাড়া। কোন স্বাধীনচেতা ও দেশপ্রেমিক নেতা ও সরকার তারা কখনোই চাইবে না। সে যুগে বৃটিশ বিরোধী জিহাদ আন্দোলন, সিপাহী আন্দোলন, ফকীর বিদ্রোহ, মুহাম্মাদী আন্দোলন প্রভৃতিকে তারা সন্ত্রাসী আন্দোলন বলেছিল। এযুগে তেমনি পাশ্চাত্যের যুলুম ও শোষণ বিরোধী ইসলামী আন্দোলনকে তারা জঙ্গী আন্দোলন বলে। অথচ যালেমের বিরুদ্ধে মযলূমের প্রতিরোধ আন্দোলন থাকবেই। বৃটিশ ও হিন্দু জমিদারদের যুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠার কারণেই উপমহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের যুলুমের প্রতিবাদেই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। ইসলামী আক্বীদা ও তাহযীব-তমদ্দুনের বিরুদ্ধে যখনই ষড়যন্ত্র হয়েছে, তখনই তার বিরুদ্ধে ইসলামী জনতা রুখে দাঁড়িয়েছে। আর সেটাকেই লুফে নিয়ে পাশ্চাত্য শক্তিবলয় নাম দিয়েছে টেরোরিজম বা সন্ত্রাসবাদ। জনৈক লেখক তাই যথার্থভাবেই বলেছেন, টেরোরিজম বাই দ্য ওয়েস্টার্ণ, অফ দ্য ওয়েস্টার্ণ, ফর দ্য ওয়েস্টার্ণ। টার্গেট কেবল ইসলাম ও মুসলমান’। অতএব দেশপ্রেমিক সরকার ও জনগণ সাবধান!
চেতনানাশক তৃতীয় ট্যাবলেট হ’ল নারীর ক্ষমতায়ন। দেশের অর্ধেক জনশক্তি নারীজাতিকে কর্মহীন রেখে কখনোই দেশ সামনে এগোতে পারে না, একথা নেতাদের মুখে মুখে। অথচ নারীরা যদি গৃহের দায়িত্ব না নিতেন, তাহ’লে পুরুষের পক্ষে বাইরে যাওয়া আদৌ সম্ভব ছিল না। পুরুষ বাইরে ৮ ঘণ্টা চাকুরী করে হাঁপিয়ে ওঠে। অথচ নারী তার গৃহে ২৪ ঘণ্টা কর্তব্য পালন করেন। তার হিসাব কেউ করে কি? নারীর অকপট সহযোগিতা ও অকৃত্রিম ভালোবাসা ব্যতীত একজন পুরুষ তার ঘরে, বাইরে ও কর্মজীবনে ব্যর্থ, এ বাস্তব সত্য কেউ অস্বীকার করতে পারেন কি? যে পুরুষ তার স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে পারে না, সে পুরুষ অপদার্থ ও পৌরুষহীন। এরাই ঘরের শোভা নারী জাতিকে পরপুরুষের সাথে কর্মস্থলে আনতে চায়। যা নারীর স্বভাবধর্মের বিরোধী। সংসার ও সন্তান পালনই নারীর প্রধান দায়িত্ব। বাকী সবই অতিরিক্ত। পর্দা ও পরিবেশ নিরংকুশ ও নিরাপদ হ’লে সুযোগমত নারী ইচ্ছা করলে বাড়তি দায়িত্ব পালন করবে, নইলে নয়।
চেতনানাশক চতুর্থ ট্যাবলেটটি হ’ল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। সেই সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে সারা বিশ্ব থেকে বিতাড়িত বস্তাপচা সমাজতন্ত্রবাদ। এইসব মতবাদের কথা যারা বলেন, তারা সম্ভবতঃ এগুলির সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য কিছুই বুঝেন না। এগুলিকে বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তাহ’লে তারা তাদের পিতা-মাতাদের জিজ্ঞেস করুন, তাদের মধ্যে এইসব চেতনা ছিল কি-না? স্বয়ং শেখ মুজিব, এম.এ.জি. ওসমানী, জিয়াউর রহমান, মেজর জলিল প্রমুখ বরেণ্য নেতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এই চেতনা ছিল কি? তাদের কোন ভাষণ বা লেখনী উক্ত মর্মে কেউ শুনাতে বা দেখাতে পারবেন কি? বরং উল্টাটাই সত্য। তার প্রমাণ ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিলে প্রচারিত প্রবাসী সরকারের প্রচারপত্র। যেখানে ‘আল্লাহু আকবর’ দিয়ে বক্তব্য শুরু করা হয়েছে এবং শেষে বলা হয়েছে ‘সর্ব শক্তিমান আল্লাহর উপরে বিশ্বাস রেখে ন্যায়ের সংগ্রামে অবিচল থাকুন’... (মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ৩য় খন্ড ২২ পৃঃ)। এতে প্রমাণিত হয় যে, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে আল্লাহর নামে ও তার উপর বিশ্বাস রেখে। পুরা নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের লিখিত দালিলিক ইতিহাসের কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের নামগন্ধও নেই। অথচ ’৭২-এর সংবিধানে তা যোগ করা হ’ল প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সংবিধান থেকে এনে। এতে তো পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কাদের স্বার্থে এইসব বানোয়াট থিয়োরীর আমদানী করা হয়েছে।
এক্ষণে জনগণ যদি সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হয়, তাহ’লে জনগণের আক্বীদা-বিশ্বাসের বাইরের কোন মতবাদ এদেশে চলবে কি? নিজেদের বানানো কি বাইরের চাপানো, তা জনগণ দেখবে না। জনগণ যখনই বুঝবে যে, বৃটিশ ও পাকিস্তানীদের মত তাদের নির্বাচিত শাসকরাও যালেম এবং তারাও ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তখন আর কোন কিছুরই তোয়াক্কা কেউ করবে না। জনগণের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে রাশিয়া, আমেরিকা ও পুরো ইউরোপীয় শক্তি আজ লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে, এটা দেখেও কি কারু হুঁশ হবে না। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ অর্থ যদি পরধর্ম সহিষ্ণুতা হয়, তা হ’লে ইসলামেই একমাত্র সে শিক্ষা রয়েছে। সেই শিক্ষার কারণেই বাংলাদেশে কোন ধর্মীয় দাঙ্গা হয় না। অথচ প্রতিবেশী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের রক্তে প্রতিনিয়ত হোলি খেলা হয়।
অতএব সকলের উদ্দেশ্যে আমাদের আবেদন, ইসলাম আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ দ্বীন, যা মানবজাতির কল্যাণে নাযিল হয়েছে। এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আল্লাহ বরদাশত করবেন না। ইতিপূর্বে ‘আদ, ছামূদ, নমরূদ, ফেরাঊন সবাই ধ্বংস হয়েছে আল্লাহর গযবে। আমরাও সেই গযবের শিকার হব প্রধানতঃ সমাজ নেতাদের দুষ্কর্মের কারণে। অতএব তওবা করে ফিরে আসুন আল্লাহর পথে। তাহ’লেই আমরা সফলকাম হব (নূর ২৪/৩১)। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন! আমীন!!
سبحانك اللهم وبحمدك أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك وأتوب إليك اللهم اغفرلى ولوالدى وللمؤمنين يوم يقوم الحساب
[1]. আত-তাহরীক ১৪তম বর্ষ ২য় সংখ্যা নভেম্বর ২০১০।