জীবন দর্শন

শিক্ষা দর্শন[1]

সুষ্ঠু পন্থায় মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ সাধনই হ’ল প্রকৃত অর্থে ‘শিক্ষাদর্শন’।

‘পড়! তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন’। ‘সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিন্ড থেকে’। ‘পড়! আর তোমার পালনকর্তা হ’লেন সর্বাধিক দয়ালু’। ‘যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন’। ‘শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না’ (আলাক্ব ৯৬/১-৫)। মানব জাতির জন্য শেষনবী (ছাঃ)-এর মাধ্যমে পাঠানো সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর আসমানী তারবার্তা এটি। ইসলামের প্রথম নির্দেশ হ’ল ‘পড়’। যা অন্য কোন ধর্মে নেই। কার নামে পড়বে? কি পড়বে? কিসের মাধ্যমে শিখবে? শিক্ষার বিষয়বস্ত্ত কি হবে? চারটি বিষয়ের জওয়াব রয়েছে উক্ত পাঁচটি আয়াতে। এর মধ্যেই রয়েছে ইসলামের ‘শিক্ষাদর্শন’। আর তা হ’ল আত্মিক ও জৈবিক চাহিদার সর্বোত্তম পরিচর্যার মাধ্যমে মানবতার সর্বোচ্চ উন্নয়ন সাধন। আর এটাই হ’ল ‘বিশ্ব মানবতার শিক্ষাদর্শন’। কেননা ইসলাম এসেছে মানব জাতির কল্যাণে। তার সকল নির্দেশনা বিশ্ব সমাজের উদ্দেশ্যে বিধৃত। মনে রাখা আবশ্যক যে, ইসলাম এসেছিল অমুসলিমদের কাছে। তারাই এ শিক্ষাদর্শন কবুল করেছিল ও জগতে বরেণ্য হয়েছিল। তাই ইসলামী শিক্ষাদর্শনই মানব জাতির জন্য প্রকৃত শিক্ষাদর্শন। আয়াত পাঁচটির গুরুত্ব বিবেচনায় এর পর থেকে ‘অহি’ নাযিল হওয়া কিছু দিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। যাকে ‘অহি-র বিরতি কাল’ বলা হয়।

উক্ত দর্শনে বলা হয়েছে যে, মানুষ পড়বে তার প্রভুর নামে, যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি হ’লেন সবচেয়ে দয়ালু। তাঁর উপরে কেউ নেই। অর্থাৎ মানব শিশু প্রথমেই জানবে যে সে আল্লাহর সৃষ্টি। সে প্রকৃতির সৃষ্টি নয় বা আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়নি, কিংবা বানর-হনুমানের বিবর্তিত কোন লেজখসা দ্বিপদ প্রাণী নয়। দ্বিতীয় প্রশ্ন : সে কি পড়বে? জওয়াব : সে পড়বে এমন কিছু যা তাকে তার সৃষ্টিকর্তার সন্ধান দিবে ও যাকে সে ইবাদত করবে। অতঃপর সে তার বিধান সমূহ জানবে, যা তার আত্মা ও দেহ উভয়ের চাহিদা মিটাবে। যে দেহ আলাক্ব থেকে সৃষ্ট। তৃতীয় প্রশ্ন : কিসের মাধ্যমে শিখবে? জওয়াব : সে কলমের মাধ্যমে শিখবে। এর মধ্যে যবান ও অন্যান্য মাধ্যমসমূহ শামিল রয়েছে। চতুর্থ প্রশ্ন : শিক্ষার বিষয়বস্ত্ত কি হবে? জওয়াব : মানুষ যা জানে না তাই শিখবে। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, মানুষ জন্মগত ভাবেই অজ্ঞ। সে তার ভবিষ্যৎ ভাল-মন্দ কিছুই জানে না। তাই আল্লাহ তাকে অহি-র মাধ্যমে চূড়ান্ত সত্যের জ্ঞান প্রেরণ করেছেন। যা তার আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক জীবন পরিচালনার জন্য যথেষ্ট হবে। বাকী তার জৈবিক প্রয়োজনে আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টিরাজির অজানা রহস্য জানার জন্য এবং সেখান থেকে কল্যাণ আহরণের জন্য সে সর্বদা জ্ঞান-সাধনায় লিপ্ত থাকবে। আর নতুন নতুন আবিষ্কারে বিষ্ময়াভিভূত হয়ে সে আল্লাহর প্রতি সমর্পিত চিত্তে বলে উঠবে- ‘রববানা মা খালাক্বতা হা-যা বাত্বিলান সুবহা-নাকা ফাক্বিনা আযা-বান্নার’ ‘হে আমাদের পালনকর্তা! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করোনি। তুমি মহা পবিত্র। তুমি আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাও’ (আলে ইমরান ৩/১৯১)। এতে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, মানুষ জ্ঞান-গবেষণায় এবং শিক্ষা ও কর্মে যত বড়ই হৌক না কেন তাকে আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যেই থাকতে হবে। তাকে অবশ্যই তার সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে যেতে হবে এবং তাকে অবশ্যই সেখানে তার সারা জীবনের কর্মকান্ডের হিসাব দিতে হবে। অতএব যেন তাকে সেখানে গিয়ে জাহান্নামের অধিবাসী না হ’তে হয়, দুনিয়াতে সে লক্ষ্যে তাকে শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং আল্লাহর দাসত্বের মধ্যে তার সকল কর্মতৎপরতা নিয়োজিত রাখতে হবে।

এবারে পঞ্চম একটি মৌলিক প্রশ্ন : আল্লাহ মানুষকে কি উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন? জওয়াব: ‘আমি জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছি কেবলমাত্র আমার দাসত্ব করার জন্য’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)। এই বিশ্বাস মানুষকে বহুমুখী আনুগত্যের বিশৃংখল জীবন থেকে মুক্তি দেয় এবং একমুখী আনুগত্যের সুশৃংখল জীবনের প্রশান্তি দান করে।

অত্র আয়াতে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থায় আল্লাহর দাসত্ব শিখানো হবে, শয়তানের দাসত্ব নয়। আর এটাই হ’ল ‘তাওহীদে ইবাদত’ যা না থাকলে কেউ ‘মুসলিম’ হ’তে পারে না। এক্ষণে ষষ্ঠ ও শেষ প্রশ্ন : আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও তাঁর বিধান সমূহ কোথায় পাব, যা জেনে নিয়ে পথ চলতে হবে? জওয়াব: তা পাওয়া যাবে পবিত্র কুরআনে। যা তিনি স্বীয় করুণা বশে মানবজাতির জন্য সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ হেদায়াতগ্রন্থ হিসাবে প্রেরণ করেছেন। যেমন তিনি বলেন, ‘আর-রহমান’! ‘আল্লামাল কুরআন’। ‘পরম করুণাময়’। ‘তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন’ (রহমান ৫৫/১-২)। অর্থাৎ সৃষ্টিকুলের প্রতি ও বিশেষ করে মানবজাতির প্রতি আল্লাহর দয়াগুণের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হ’ল তাদের জন্য ‘কুরআন’ প্রেরণ। কুরআন নাযিল করাই হ’ল বান্দার প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ। কেন? কেননা এর মধ্যেই রয়েছে মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতের সকল কল্যাণের চাবিকাঠি। কুরআনের বিধান সমূহের আনুগত্য করার অর্থই হ’ল আল্লাহর দাসত্ব করা। আর সেগুলি অমান্য করার অর্থ হ’ল আল্লাহর অবাধ্যতা করা ও শয়তানের দাসত্ব করা। আল্লাহর দাসত্বের অধীনে মানুষের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে। কিন্তু আল্লাহর অবাধ্যতায় মানুষ শয়তানের গোলামী করে। আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি এই দাওয়াত নিয়ে যে, তোমরা কেবলমাত্র আল্লাহর দাসত্ব কর এবং তাগূত (শয়তান) হ’তে বিরত থাক’ (নাহ্ল ১৬/৩৬)। অতএব মানুষকে বস্ত্তবাদী ও ভোগবাদী না করে আল্লাহ ও আখেরাতমুখী করাই হ’ল প্রকৃত অর্থে মানবীয় শিক্ষাদর্শন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সে লক্ষ্যেই ঢেলে সাজাতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন- আমীন!



[1]. আত-তাহরীক ১২তম বর্ষ ১১তম সংখ্যা আগস্ট ২০০৯।