ইসলামী আন্দোলনে বিজয়ের স্বরূপ

বিজয়ের প্রত্যাশায় ছাড় প্রদান

আমরা লক্ষ্য করেছি যে, বর্তমানে অনেক দাঈ এবং ইসলামী দল দ্বীন বিজয়ে আল্লাহর সাহায্য বিলম্বিত হ’তে দেখে বেশ উদ্বিগ্ন। একদিকে আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের প্রত্যাশা ও চূড়ান্ত সংগ্রাম; অন্যদিকে প্রচুর শ্রম ব্যয় ও যথেষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যখন লক্ষ্য অর্জিত হয় না, তখন প্রচারের আংশিক ফল লাভের প্রত্যাশায় তারা বেশ কিছু ছাড় দিয়ে বসে। এসব ছাড়ের প্রকৃতি ও মাত্রা বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে, যা কখনও কম কখনও বেশী হয়।

এ গ্রন্থে আমরা যে নীতি-পদ্ধতি অবলম্বন করেছি, তার আলোকে বিজয়ের প্রত্যাশায় ছাড় দেওয়া সম্পর্কে কুরআনুল কারীম থেকে অনুসন্ধান করতে চেষ্টা করেছি। আমরা তিনটি ঘটনা অবগত হ’তে পেরেছি, যেখানে কুরআন তার প্রতিবিধান করেছে এবং আমাদের জন্য এমন এক কর্মপন্থা এঁকে দিয়েছে, যাকে আশ্রয় করে পদস্খলন কিংবা বিচ্যুতি ছাড়া আমরা অনায়াসে চলতে পারব। এখানে প্রতিটি বিষয় ও তার প্রতিবিধানের ফর্মুলা প্রথমে উল্লেখ করব এবং সব শেষে এ বিষয়ে আমরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি তার সারমর্ম তুলে ধরব।-

১ম বিষয় : সূরা কাফিরূনের শানে নুযুল :

ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করল যে, তারা তাঁকে সম্পদ দিবে, যা পেয়ে তিনি মক্কার ধনাঢ্য ব্যক্তিকে পরিণত হবেন, যে নারী তাঁর পসন্দ হয় তার সাথেই তাঁকে বিবাহ দিবে এবং তাঁর পিছনে সমর্থন যোগাবে। বিনিময় হ’ল তিনি তাদের প্রভুদের গালমন্দ করবেন না বা খারাপ কিছু বলবেন না। আর যদি তিনি তা একান্তই না পারেন তবে বিকল্প একটি প্রস্তাব আমরা পেশ করছি। তাতে আমাদের উভয়ের মঙ্গল রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, সেটা কি? তারা বলল, ‘আপনি এক বছর আমাদের উপাস্য দেবতা লাত ও উয্যার ইবাদত করবেন, আমরা এক বছর আপনার মা‘বূদ আল্লাহর ইবাদত করব’। তিনি উত্তরে বললেন, ‘অপেক্ষা কর, দেখি আমার প্রভুর পক্ষ থেকে কি বিধান আসে। তখন ‘লাওহে মাহফূয’ থেকে সূরা কাফিরূন অবতীর্ণ হল, قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُوْنَ، لاَ أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَ ‘(হে নবী ! ) আপনি বলুন, ওহে কাফিররা, তোমরা যার ইবাদত কর আমি তার ইবাদত করি না’ ...(কাফিরূন)। আল্লাহ আরও অবতীর্ণ করলেন,

قُلْ أَفَغَيْرَ اللَّهِ تَأْمُرُونِّيْ أَعْبُدُ أَيُّهَا الْجَاهِلُوْنَ،..... بَلِ اللَّهَ فَاعْبُدْ وَكُن مِّنْ الشَّاكِرِيْنَ-

‘(হে রাসূল) আপনি (মুশরিকদের) বলুন, তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত করতে আমাকে আদেশ করছ, হে মূর্খরা? ....আপনি বরং আল্লাহরই ইবাদত করুন এবং কৃতজ্ঞদের মাঝে থাকুন’ (যুমার ৬৪-৬৬; তাফসীরে ত্বাবারী ৩০/৩৩১)

ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) আরও বলেন, ইয়াকূবের সনদে বাখতারীর আযাদ কৃত গোলাম সাঈদ বিন মিনা হ’তে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ওয়ালীদ বিন মুগীরা, আছ বিন ওয়ায়েল, আসওয়াদ বিন মুত্ত্বালিব ও উমাইয়া বিন খালফ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে দেখা করে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আসুন, আমরা আপনার মা‘বূদের ইবাদত করি, আর আপনি আমাদের মা‘বূদের ইবাদত করুন। এভাবে আমাদের সব কাজে আপনাকে অংশীদার করে নেই। ফলত: যে দ্বীন নিয়ে আপনি আবির্ভূত হয়েছেন তা যদি আমাদের দ্বীন থেকে শ্রেষ্ঠ হয় তাহ’লে আমরা তাতে আপনার সাথে শরীক হ’তে পারব এবং তা থেকে আমাদের অংশ নিতে পারব। আবার আমাদের দ্বীন যদি আপনার দ্বীন থেকে শ্রেষ্ঠ হয় তাহ’লে আপনি আমাদের সাথে শরীক হয়ে আপনার অংশ গ্রহণ করতে পারবেন’। তখন আল্লাহ তা‘আলা সূরা কাফিরূন নাযিল করলেন।[1]

শানে নুযূলের এই ঘটনাগুলিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে তাদের খাতিরে কিছু ছাড় দিতে অনুরোধ করেছিল। বিনিময়ে তারাও কিছু ছাড় দিতে চেয়েছিল। এমনি করে তারা দু’পক্ষ এক বিন্দুতে মিলিত হ’তে  পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিল।

কেউ হয়ত বলতে পারেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যদি তাদের সঙ্গে ঐক্যমত হ’তেন এবং তাদের নিকট আগে আল্লাহর ইবাদতের দাবী করতেন, তাহ’লে তারা ইবাদত করতে গিয়ে ইসলামকে ভালমত জানত ও বুঝত। ফলে তারা আর ইসলাম বিমুখ হ’ত না। এতে ইসলামের একটি বড় অর্জন তথা বিজয় নিশ্চিত হ’ত। দূর হ’ত সেই অত্যাচার-নির্যাতন, যার মুখোমুখি মুসলমানরা প্রতিনিয়ত হচ্ছিল। ঐ ব্যক্তির কথার উত্তরে বলা যায়, আল্লাহ এরূপ ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَ، وَلاَ أَنتُمْ عَابِدُوْنَ مَا أَعْبُدُ- ‘আমি তোমাদের উপাস্য মা‘বূদদের ইবাদতকারী নই। আর তোমরাও আমার মা‘বূদের ইবাদতকারী নও  (কাফিরূন ১০/২-৩)। অবশেষে তিনি বলেছেন, لَكُمْ دِيْنُكُمْ وَلِيَ دِيْنِ ‘তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন, আমার জন্য আমার দ্বীন’ (কাফিরূন ১০৯/৬)

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বিষয়টি একান্তই দ্বীনের মূলীভূত। এখানে দর কষাকষির কোন অবকাশ নেই এবং বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়ারও কোন সুযোগ নেই। এটি আক্বীদাগত বিষয়। বরং বলা চলে, এটাই আক্বীদাগত মূল ভিত্তি। আর আক্বীদার বিষয়ে কখনো কোন ছাড় নেই। এ রকম বলার হেতু এই যে, কিছু নির্দিষ্ট মুশরিককে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর  রাসূলের মাধ্যমে এখানে সম্বোধন করেছেন, যাদের সম্বন্ধে তাঁর জানা আছে যে, তারা কস্মিনকালেও ঈমান আনবে না। তাই আল্লাহ তাঁর নবীকে বলে দিতে আদেশ করেছেন যে, ওদের আশা  ও মনষ্কামনায় গুড়েবালি। এ ধরণের সমঝোতা কোন কালেই হবে না, না আপনার পক্ষ থেকে, না ওদের পক্ষ থেকে। এভাবে নবী করীম (ছাঃ)-কেও আল্লাহ হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তাদের ঈমানদার হওয়া ও চিরস্থায়ী সাফল্য লাভের যে বাসনা আপনি লালন করেন, তা কখনো পূরণ হবে না। বাস্তবে তাদের এ রকমই ঘটেছিল। তারা সফল ও কৃতকার্য না হয়েই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। তারা কেউ কেউ বদরে তরবারীর আঘাতে ধরাশায়ী হয়েছে এবং কেউ কেউ তার আগেই কাফির হিসাবে মারা গিয়েছে।*

বস্ত্ততঃ এই ঘটনায় ইসলামের বর্তমান ও ভবিষ্যতের শত্রুদের বহুবিধ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র মুকাবেলার একটি সুস্পষ্ট কর্মপদ্ধতি অঙ্কিত হয়েছে।

২য় ঘটনা: সূরা আন‘আমের ৫২নং আয়াতের শানে নুযূল :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  وَلاَ تَطْرُدِ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ ‘যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করে তাদেরকে আপনি তাড়িয়ে দিবেন না’ (আন‘আম ৬/৫২)। অত্র আয়াতের শানে নুযূল প্রসঙ্গে ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ)-এর বরাতে বর্ণনা করেছেন যে, কয়েকজন কুরাইশ নেতা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিল। তাঁর নিকটে তখন ছুহাইব, আম্মার, বেলাল,  খাববাব প্রমুখ হতদরিদ্র মুসলমানগণ উপবিষ্ট ছিলেন। তখন তারা বলল, হে মুুহাম্মাদ! তুমি তোমার কওমকে ফেলে কিভাবে এদের নিয়ে সন্তুষ্ট আছ? আমাদের মধ্য হ’তে কি আল্লাহ তা‘আলা কেবল এদেরই অনুগৃহীত করেছেন, আমরা কি এদের তল্পিবাহক হব? তুমি এদের তাড়িয়ে দাও, তোমার নিকটে এদের বসতে দিও না। তাহ‘লে হয়ত আমরা তোমার অনুসরণ করতে পারি। তখন আল্লাহ উক্ত আয়াত নাযিল করেন।

অন্য বর্ণনায় ইমাম ত্বাবারী (রহঃ) তাবেঈ মুজাহিদের বরাতে বলেছেন, বেলাল ও ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মজলিসে বরাবর বসতেন। কুরাইশরা তাদের প্রতি নাক সিটকিয়ে বলে, এরা দু’জন সহ এদের মত ছোট লোকেরা যদি না থাকত তাহ’লে আমরা মুহাম্মাদের নিকটে বসতাম। তখন উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়।[2]

অন্য বর্ণনায় খাববাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, কুরাইশরা নবী করীম (ছাঃ)-কে বলেছিল, ‘আমরা আপনার নিকট এমন বৈঠক ও আসন পসন্দ করি, যাতে সমগ্র আরব আমাদের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে পারে। কেননা আপনার নিকট আরবের বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধি দল আসা যাওয়া করে। এসব চাকর-বাকরদের সঙ্গে তারা আমাদেরকে দেখুক এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। তাই আমরা যখন আসব তখন আপনি ওদের উঠিয়ে দিবেন। আমরা চলে গেলে চাইলে ওদের নিয়ে বসবেন। তখন উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়।[3]

এসব বর্ণনাগুলিকে নিম্নোক্ত হাদীছটি জোরাল করে, যা মুসলিম শরীফে সংকলিত হয়েছে। আবুবকর ইবনু শায়বা (রাঃ)-এর বরাতে সা‘দ ইবনু আবি ওয়াক্কাছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা ছয়জন লোক নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। মুশরিকরা তা দেখে তাঁকে বলল, ‘আপনি এদেরকে আপনার দরবার থেকে তাড়িয়ে দিন। এরা আমাদের উপর বাহাদুরী করবে তা হ’তে পারে না’। উক্ত ছয়জনের একজন আমি। অপর ক’জন হ’লেন ইবনু মাস‘ঊদ, হুযাইল গোত্রীয় একজন ও বেলাল। আর দু’জনের নাম আমি ভুলে গেছি। এ কথায় হয়ত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মনে কোন ভাবোদয় হয়েছিল। তাই আল্লাহ আয়াত নাযিল করলেন।[4]

আয়াতের শানে নুযূল পর্যালোচনা ও আমলে নিলে এমন অনেক ভুল পরিকল্পনার অবসান ঘটত, যেগুলি করতে অনেক প্রচারক ও ইসলামী দল অগ্রসর হয়ে থাকে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তারা নিজেদের দ্বীনকে অত্যন্ত ভালবাসেন এবং দ্বীনকে বিজয়ী করার তীব্র আকাঙ্খার অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁŠছাতে এসব পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। কিন্তু লক্ষ্য যতই মহৎ হোক না কেন তা সাধনের উপায় মোটেও মহৎ নয়।

যেমন- ইসলামী দলগুলির মধ্যে কোন একটি দল অমুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে পাওয়া যাচ্ছে, যারা আল্লাহর দ্বীনের প্রতি আহবান ও ইসলামের বাণী প্রচার-প্রসারে সচেষ্ট আছে। কিন্তু ঐ রাষ্ট্র তাদের বলছে, তোমাদের স্বীকৃতি দেওয়া ও দাওয়াতী কার্যক্রমের কিছু সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে আমরা তোমাদের সাথে সমঝোতা করতে প্রস্ত্তত আছি। তবে শর্ত হ’ল, তোমাদের দলের অমুক অমুক ব্যক্তিকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে এবং অমুক অমুককে দলেই রাখতে পারবে না।  কেননা যে দলে এই লোকগুলি আছে তাদের আমরা স্বীকৃতি দিতে পারি না। অথচ দল ঐ লোকগুলির মধ্যে কোন ভুলভ্রান্তি পায়নি। এমনকি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উক্ত দাবী তোলার পূর্বে তারা এ সম্পর্কে কোন চিন্তাও করেনি। আসলে তাদের তো কোন দোষ নেই। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের ছোট ও অপসন্দ করার মানসে তাদের চাচ্ছে না।

সুধী পাঠক! এমতাবস্থায় কি আপনাদের মনে হয় ঐ দল রাষ্ট্রের উত্থাপিত আপোষ ফর্মূলা একেবারে পায়ে ঠেলে বলতে পারবে, وَمَا نَقَمُوْا مِنْهُمْ إِلَّا أَنْ يُؤْمِنُوْا بِاللَّهِ الْعَزِيْزِ الْحَمِيْد-ِ ‘আসলে কিছুই না, আমাদের নেতা ও ভাইদের একমাত্র অপরাধ হ’ল, তারা পরাক্রমশালী প্রশংসাময় আল্লাহতে বিশ্বাসী’ (বুরূজ ৮৫/৮)। নাকি তারা দর কষাকষি শুরু করবে, যা তথাকথিত ‘সুবিধা’ নামে আখ্যায়িত? দাওয়াতের সুবিধা লাভ ও সম্ভাব্য নানা অর্জন নিশ্চিত করার নামে ঐ ভাইদের যদি দল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং ক্ষণিকের জন্য তা বৈধ ধরা হয়, তাহ’লে পরিণামই বা কি দাঁড়াবে? কিছু কিছু দলের বাস্তবতা থেকে আমাদের ধারণা, বর্তমান কালের লোকেরা এরূপ দরাদরিতে  পড়ে যাবে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাক্কী যুগেই এরূপ দর কষাকষির মূল্লোচ্ছেদ করে দিয়েছেন এবং আমাদের জন্য এমন এক নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা এক বাক্যে পালনীয়। তাতে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ নেই। আল্লাহ বলেন,

مَا عَلَيْكَ مِنْ حِسَابِهِمْ مِّنْ شَيْءٍ وَمَا مِنْ حِسَابِكَ عَلَيْهِم مِّن شَيْءٍ فَتَطْرُدَهُمْ فَتَكُوْنَ مِنَ الظَّالِمِيْن-

‘তাদের হিসাব দেওয়ার নূন্যতম দায়িত্ব আপনার উপর নেই এবং আপনার হিসাব দেওয়ার নূন্যতম দায়িত্বও তাদের উপর নেই। তাহ’লে আপনি কেন তাদের তাড়িয়ে দিবেন? এরূপ করলে আপনি যালিমদের শ্রেণীভুক্ত হয়ে যাবেন’ (আন‘আম ৬/৫২)

কী ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারী! যিনি মানবকুল শ্রেষ্ঠ এবং রাসূলদের নেতা তিনি যদি কোন ছাহাবীকে তাড়ানোর কাজ করতেন তাহ’লে দাওয়াতের ও ইসলামের স্বার্থেই কেবল করতেন, অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। যদিও এরূপ ঘটা তাঁর পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ   অচিন্তনীয়। তবুও যদি তিনি এটা করতেন তবে যালিমদের শ্রেণীভুক্ত হয়ে পড়তেন। এরূপ দাবী ও দরাদরির সময় আমাদের করণীয় নীতি কী হবে তাও আল্লাহ বলে দিয়েছেন। যখন আমাদের সামনে বিপক্ষরা এরূপ স্বার্থ ও সুবিধার টোপ ফেলবে তখন আমাদের বলতে হবে- وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّكُمْ فَمَنْ شَاء فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاء فَلْيَكْفُرْ ‘আপনি বলুন, সত্য তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আসে। অতএব যার ইচ্ছা সে মুমিন হোক, আর যার ইচ্ছা সে কাফির থাকুক’ (কাহ্ফ ১৮/২৯)। অতএব এটাই  আমাদের  দায়িত্ব, এটাই আমাদের যিম্মাদারী। আমরা হক কথা বলব, তাতে লোকে ঈমান আনে আনুক, আর কাফের থাকে থাকুক আমাদের কিছুই আসে যায় না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

أَفَلَمْ يَيْأَسِ الَّذِينَ آمَنُواْ أَن لَّوْ يَشَاءُ اللّهُ لَهَدَى النَّاسَ جَمِيْعًا ‘তবে কি যারা ঈমান এনেছে তাদের প্রত্যয় হয়নি যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে অবশ্যই সকল মানবকে সৎ পথে পরিচালিত করতে পারতেন?’ (রা‘দ ১৩/৩১)। মূল কথা হ’ল সমস্যা যখন মূলনীতির সঙ্গে জড়িত হয় তখন নীতির প্রশ্নে কোন আপোষরফা ও ছাড় প্রদানের অবকাশ থাকে না।

৩য় ঘটনা: সূরা ‘আল-ফাত্হ’ এর বিষয়-বস্ত্ত :

ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলকা‘দাহ মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন হুদায়বিয়া থেকে মদীনা ফিরে যাচ্ছিলেন তখন সূরা আল-ফাত্হ নাযিল হয়। এর আগে মক্কার মুশরিকরা তাঁর মসজিদুল হারামে যাওয়ার পথ রোধ করেছিল। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ওমরাহ পালন করা। কিন্তু মুশরিকদের বাধার মুখে তা স্থগিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে উভয় পক্ষ একটি সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিল। শর্ত করা হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ বছর ফিরে যাবেন এবং আগামী বছর ওমরাহ করতে আসবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদল ছাহাবীর অমত ও অসন্তুষ্টি সত্ত্বে প্রতিপক্ষের কথা মেনে নিয়েছিলেন। অসন্তুষ্ট ছাহাবীদের একজন ছিলেন ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)। হুদায়বিয়ার সন্ধির ঘটনা অনেক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। এই ঘটনা বেশ লম্বা। সংক্ষেপে আমাদের আলোচ্য অংশের সাথে সংশ্লিষ্ট অংশটুকু তুলে ধরা হ’ল-

ছহীহ বুখারীতে এসেছে, নবী করীম (ছাঃ) সন্ধির জন্য তাঁর লেখককে ডাকলেন এবং বললেন লেখ, ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’। তখন (অপরপক্ষের সন্ধি প্রস্ত্ততকারী) সুহাইল বলল, আল্লাহ শপথ ‘রহমান’ শব্দ কী তা আমি জানি না। তুমি বরং আগে যেমন লিখতে তেমনিভাবে ‘বিসমিকা আল্লাহু-হুম্মা’ লেখ। তখন মুসলিম লেখক বললেন, আল্লাহর কসম, আমরা ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’ ছাড়া লিখব না। কিন্তু নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘বিসমিকা আল্লা-হুম্মা’ই লেখা তারপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, লেখ ‘এতদশর্তে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সন্ধি করছেন’। এ কথা  শোনা মাত্রই সুহাইল বলে উঠল, ‘আমরা যদি তোমাকে আল্লাহর রাসূলই জানতাম তাহ’লে ওমরাহ করতে বাধা দেব কেন? আর যুদ্ধই বা করব কেন? তুমি বরং লেখ, ‘আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ’। এতে নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল, যদিও তোমরা আমাকে মিথ্যা মনে করছ। ঠিক আছে- ‘আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ’ই লেখা হোক’।[5]

সন্ধির শর্তাবলীতে আরও ছিল আগামী বছর আসলে আমরা মক্কা হ’তে বের হয়ে যাব, তারপর তুমি তোমার সাথীদের নিয়ে সেখানে প্রবেশ করবে। নবী করীম (ছাঃ)-এর কোন ছাহাবী (মক্কা থেকে) অভিভাবকের বিনা অনুমতিতে তাঁর নিকট গমন করলে তিনি তাকে ফেরৎ পাঠাবেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে যারা আছেন তাদের কেউ মক্কায় কুরাইশদের আশ্রয়ে এলে তাকে ফেরত পাঠানো হবে না’।[6]

এ ছিল সন্ধির কিছু অংশ। এ কারণেই ওমর (রাঃ)-এর কানে যখন রাসূলের সন্ধি স্থাপনের দৃঢ় সংকল্পের কথা পেঁŠছল, তখন তিনি খুব রেগে গিয়েছিলেন এবং রাসূলের নিকটে কৈফিয়ত তলবের সুরে বলেছিলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি মুসলিম নই? ওরা কি মুশরিক নয়? তিনি বললেন, ‘অবশ্যই’। ওমর (রাঃ) বললেন, তাহ’লে আমরা কেন আমাদের দ্বীনের ক্ষেত্রে এমন অপমান মেনে নেব? উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আমি কখনই তাঁর আদেশের বিরোধিতা করব না। আর তিনি আমাকে শেষ করে দিবেন না।[7]

এই সন্ধিকে ওমর (রাঃ) দ্বীনের মধ্যে অপমানজনক বলে গণ্য করেছিলেন এবং প্রথম দৃষ্টিতে কিছু শর্ত মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর ছিল। অথচ সেই সন্ধিকেই আল্লাহ তা‘আলা তার সকল শর্তসহই ‘স্পষ্ট বিজয়’ বলে উল্লেখ করেছেন।

ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেন, তোমরা তো মক্কা বিজয়কে বিজয় বলে গণ্য করে থাক, কিন্তু আমরা হুদায়বিয়ার সন্ধিকেই বিজয় গণ্য করে থাকি। বারা ইবনু আযিব (রাঃ) বলেন, তোমরা তো মক্কা বিজয়কে বিজয় বলে মনে কর। অবশ্য সেটিও একটি বিজয়, কিন্তু আমরা হুদায়বিয়াতে সংঘটিত বাই‘আতুর রিযওয়ানকেই বিজয় মনে করি।[8] মুসনাদে আহমাদে আছে নবী করীম (ছাঃ) বলেন,

نَزَلَ عَلَّى الْباَرِحَةَ سُوْرَةٌ أَحَبُّ إلَّى مِنَ الدُّنْياَ وَماَ فِيْهَا إنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُبِيْنًا-

‘আজ রাতে আমার উপর একটি সূরা নাযিল হয়েছে, যা আমার নিকট দুনিয়া ও দুনিয়াস্থ সমস্ত কিছুর তুলনায় প্রিয়তর’ তাহ’ল ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে স্পষ্ট বিজয় দান করেছি’।[9] আহমাদের আরেক বর্ণনায় এসেছে, আনাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) হুদায়বিয়া থেকে ফেরার পথে নাযিল হয়- لِيَغْفِرَ لَكَ اللهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَماَ تَأَخَّرَ، ‘আল্লাহ আপনার জীবনের পূর্বাপর সকল গুনাহ মাফ করার জন্য (আপনাকে স্পষ্ট বিজয় দান করেছে)’ (ফাতাহ ৪৮/২)। নবী করীম (ছাঃ) তখন বলেন, আজ রাতে আমার উপর এমন একটি আয়াত নাযিল হয়েছে, যা আমার নিকট ধরাপৃষ্ঠের সমুদয় জিনিস থেকেও প্রিয়। তারপর তিনি সূরাটি পড়ে শুনান।[10]

আমরা এ ঘটনায় দেখতে পাচ্ছি যে, কয়েকটি ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কার কাফির কুরাইশদের মতে মত দিয়েছিলেন। যেমন-

১. ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’-এর স্থলে ‘বিসমিকা আল্লা-হুম্মা’ লেখায়।

২. ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’-এর স্থলে ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’ লেখায়।

৩. পরবর্তী বছর মক্কায় প্রবেশ পিছিয়ে দেওয়া।

৪. মুশরিকদের কেউ তার অভিভাবকের বিনা অনুমতিতে মুসলমান হয়ে মদীনায় গেলে তাকে তাদের নিকট ফেরত পাঠানোর শর্তে। যদিও মুসলামনদের কেউ মুশরিক হয়ে মক্কায় এলে তারা তাকে ফেরত দেবে না। বরং ছাহাবীদের কেউ কেউ যখন সন্ধির কিছু শর্ত নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন, তখন রাসূল (ছাঃ) তাদের বলেছিলেন, ‘তারা আমার নিকট যে কাজের কথাই বলবে তাতে যদি আল্লাহর  মর্যাদা ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয় তবে আমি তা-ই মঞ্জুর করব’।[11]

মুশরিকদের দেয়া যে সব শর্ত রাসূলুল্লাহ (ছঃ) মেনে নিয়েছিলেন আমরা যদি তা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করি তাহ’লে দেখতে পাব, এগুলি না ইসলামের আক্বীদার সাথে জড়িত, না তার বুনিয়াদী নীতির সাথে জড়িত। এই ঘটনা এবং সূরা কাফিরূন ও সূরা আন‘আমে বর্ণিত ঘটনার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এই সন্ধিতে না বাতিলের স্বীকৃতি আছে, না তাকে সম্মতি দেয়া হয়েছে। আর তা হবেই বা কী করে- যেখানে আল্লাহ একে ‘স্পষ্ট বিজয়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সন্ধির চারটি দাবীকে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায় নিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

‘বিস্মিকা আল্লা-হুমা’ লেখায় শারঈ কোন বাধা নেই। কেননা কোন মুসলিম যদি ‘রহমান’ ও ‘রহীম’ নাম দু’টি ব্যাখ্যাসূত্রে ‘বিসমিকা আল্লা-হুম্মা’ না পড়ে তাহ’লে সে পাপী হবে না।

আর ‘মু হাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’ নিয়ে কথা হ’ল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তো প্রকৃতই আব্দুল্লাহর পুত্র ছিলেন। তাই তিনি একথা মেনে নিয়েছিলেন। সেই সাথে মানব স্মৃতিতে কোন বৈরি সন্দেহের অবকাশ যাতে না জন্মাতে পারে সেজন্য তিনি বলে দিয়েছিলেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল, যদিও তোমরা আমাকে মিথ্যা বলছ। এভাবে কথার গোল দূর হয়ে যাওয়ায় বিষয়টির বৈধতা নিয়ে সমস্যা থাকছে না।

এছাড়া তাদের এ বছরে ফিরে গিয়ে পরবর্তী বছরে আগমনের কথা সুযোগ-সুবিধার সাথে জড়িত একটি বিষয়। সুবিধা অনুপাতে এ ধরনের শর্ত গ্রহণযোগ্য। ঐ বছর ওমরাহ না করে পরবর্তী বছর ওমরাহ করার কথা মেনে নেয়ায় নির্বিঘ্ন সন্ধিটা হ’তে পেরেছিল। এদিকে ওমরাহ করতে না পারায় ছাহাবীগণ ছিলেন আবেগতাড়িত ও ক্ষুদ্ধ। এত ক্ষুদ্ধ আবেগে সাড়া না দেয়ায় ভালই হয়েছে। তাদের আবেগে সাড়া দিয়ে এবছরেই যেকোন মূল্যে ওমরাহ করতে হবে মর্মে মেনে নিলে বরং ক্ষতি হ’ত। আর আবেগতাড়িত মুহূর্তে সে ক্ষতি অনুমান করা সম্ভব হয় না।

মুসলিম হয়ে আগমনকারীকে মুশরিকদের নিকট হস্তান্তরের ভেতর তাদেরই মুছীবত রয়েছে। যেমন আবু জান্দাল (রাঃ)-এর বেলায় হয়েছিল। খোদ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আবু জান্দাল! ধৈর্য ধর ও পুণ্য লাভের নিয়ত কর। আল্লাহ তোমাকে ও তোমার সাথে জড়িত অসহায়দের মুক্তির একটা সুরাহা অবশ্যই করে দিবেন।[12] আবু বছিরকেও আল্লাহ তা‘আলা উপায় করে দিয়েছিলেন। তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধির পর মুসলমান হয়ে মদীনায় এলে কাফেররা তাকে সন্ধি মোতাবেক ফিরিয়ে নিতে আসে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন দুঃখ করে বলেছিলেন, وَيْلُ أُمَّةٍ مِسْعَرِ حَرْبٍ، لَوْ كَانَ مَعَهُ أَحَدٌ- ‘যে জাতি যুদ্ধ উষ্কে দেয় তার জন্য বড়ই পরিতাপ! হায় তার (আবু বছিরের) সাথে যদি কেউ হ’ত’।[13] কিন্তু এই দু’জনকে ফেরৎ দানের মাধ্যমেই মুসলমানদের বিরাট বিজয়ের সূচনা হয়েছিল।

উপরোক্ত ঘটনাগুলি ও তৎসংক্রান্ত কুরআনের মীমাংসা আলোচনার পর আমাদের শিরোনাম ‘বিজয়ের প্রত্যাশায় ছাড় প্রদান’-এর একটু জরীপ করে দেখা যাক। ‘ছাড় দেয়া’ কথাটির অর্থ গ্রহণে অনেক দাঈ ও ইসলামী দল তালগোল পাকিয়ে ফেলে। প্রত্যেকেই স্ব স্ব সুবিধামত ছাড় প্রদান করেন এবং তার সপক্ষে দলীল দেন। সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে করেন না। আমরা এক্ষেত্রে চরম ও নরম মধ্যম অবস্থানে থাকতে চাই। আমরা আগেও বলেছি যে, এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সার্বিক দিক-নির্দেশক মৌলিক অধ্যয়ন। ছাড় দেয়া সংক্রান্ত বিষয়টি এমনভাবে অধ্যয়ন করতে হবে যাতে তার মাঝে সব রকম দলীল জমা হয় এবং এ সংক্রান্ত নানা সমস্যা ও তাদের গতি-প্রকৃতি, হাল-অবস্থা তুলে ধরা হয়। এভাবে অগ্রসর হ’লে বিষয়টির মীমাংসা ও জটখোলায় সহযোগিতা মিলবে।

ছাড় প্রদানের বিষয়ে পূর্বে যা আলোচিত হয়েছে তাতে আমাদের সামনে মূলতঃ দু’টি দিক প্রতিভাত হয়েছে।

এক: নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলিতে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করতে কোন ছাড় প্রদানের অবকাশ নেই। যথা- (১) ইসলামের মৌলিক আক্বীদা সংক্রান্ত কোন বিষয়ে। (২) যে সকল বিষয় ইসলামের বুনিয়াদ বা ভিত্তি বলে স্বীকৃত তার যেকোন বিষয়ে (৩) কুরআন, সুন্নাহ এবং ছাহাবীদের ইজমা দ্বারা অকাট্যভাবে নির্ণীত ইসলামের আইন ও বিধি-বিধানের যে কোনটিতে।

দুই: শরী‘আতের সামষ্টিক ও সাধারণ বিধির আলোকে সমঝোতা করা বা ছাড় প্রদানের অবকাশ রয়েছে। যথা:

(১) ইজতিহাদ বা গবেষণার মাধ্যমে যে সব সমস্যা সমাধানযোগ্য সে ক্ষেত্রে (২) ইসলাম প্রচারের কৌশল, মাধ্যম ও পর্যায়ের ক্ষেত্রে। (৩) শারঈ রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে।

উল্লেখ্য, শরী‘আতের সামষ্টিক ও সাধারণ বিধির মধ্যে তিনটি দিক রয়েছে-

(ক) دَرْءُ الْمَفَاسِدِ وَحَلْبُ الْمَصاَلِحِ ‘বিশৃঙ্খলা দূরীকরণ ও কল্যাণ আনয়ন’। সুতরাং তা যদি না আসে তাহ’লে আপোষরফা অর্থহীন।

(খ) سَدُّ الذََّرَائِعُ ‘অপরাধের দ্বার ও ফাঁক-ফোকর বন্ধ করা’। দেখতে হবে যে, প্রতিপক্ষকে ছাড় দিলে অন্যায়, অপরাধ, দুর্নীতি বন্ধ হবে, না বাড়বে। যদি বন্ধ হয় তাহ’লে ছাড় দিয়ে আপোষ করা যাবে।

(গ) اَلْمَصَالِحُ الْمُرْسَلَةُ وَالْإِسْتِحْسَانُ وَغَيْرُِهَا- ‘মাছালিহি মুরসালা’ ও ‘ইস্তিহ্সান’ অর্থাৎ ‘অন্তর্নিহি কল্যাণের আলোকে সিদ্ধান্ত’সহ অন্যান্য প্রসিদ্ধ নীতিমালা। এধরনের বিধি-বিধান মেনে ছাড় প্রদান ও সমঝোতার ঝুঁকি কেবল তারাই নিতে পারেন, যারা জ্ঞানবৃদ্ধ পন্ডিত, অভিজ্ঞ। যাঁদের মধ্যে ইজতিহাদের যোগ্যতা আছে। পরিশেষ বলব, আমাদের সমস্ত কামনা ও আগ্রহ আল্লাহর দ্বীনকে ঘিরে। আমাদের লক্ষ্য  হবে অন্যান্য দ্বীন বা জীবন দর্শন ও জীবন ব্যবস্থার উপর আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করা। এজন্য কোনক্রমেই শারঈ কর্মনীতির বাইরে আমাদের যাওয়া চলবে না। কেননা লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে অবৈধ পন্থা কখনই বৈধ হয়ে যায় না।



[1]. তাফসীরে ত্বাবারী ৩০/৩৩১ পৃঃ।

[2]. তাফসীরে ত্বাবারী ৭/২০২ পৃঃ।

[3]. তাফসীরে ত্বাবারী ৭/২০১ পৃ: সূরা আন‘আম ৫২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা।

[4]. মুসলিম হা/২৪১৩; তাফসীরে ইবনু কাছীর ৩/৮০ পৃঃ।

[5]. বুখারী হা/২৭৩১ ও ২৭৩২।

[6]. আহমাদ ৪/৩৩০ পৃ:; ইবনু কাছীর ৪/১৯৬ পৃ:।

[7]. আহমাদ ৪/৩৩০ পৃ ; ইবনু কাছীর ৪/১৯৬ পৃ:।

[8]. বুখারী হা/৩৮৩৮।

[9]. ফাতহ ১; ইবনু কাছীর ৪/১৮২ পৃ:।

[10]. আহমাদ, ইবনু কাছীর ৪/১৮২ পৃ:।

[11]. বুখারী হা/২৭৩১, ২৭৩২।

* আবু বছির (রাঃ) ফেরৎ যাওয়ার পথে তাঁর সঙ্গী দু’জন থেকে কৌশল করে মুক্তি লাভ করেন এবং লোহিত তীরবর্তী ‘ঈছ’ নামক স্থানে ডেরা স্থাপন করেন। এ সংবাদ পেয়ে মক্কার নির্যাতিত মুসলমানরা ঈছে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে মুসলমানদের একটি বড়-সড় জমায়েত হয়ে গেলে তাঁরা সুযোগ পেলেই ঐ পথে আগত কুরাইশ কাফেলা আক্রমণ শুরু করে। এতে কুরাইশরা যারপর নাই বিচলিত হয়ে ওঠে। তাদের জনবল, অর্থবল ক্ষয় হ’তে দেখে শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট সন্ধি থেকে মুসলমানদের ফেরৎ দানের শর্ত প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে আবু বছির (রাঃ) ও তাঁর সঙ্গীগণ মদীনায় ফিরে আসার সুযোগ পান (সীরাত গ্রন্থ সমূহ দ্রঃ)- অনুবাদক}

[12]. আহমাদ ৪/৩২৫; ইবনু কাছীর ৪/১৯৭।

[13]. বুখারী হা/২৭৩১; মিখকাত হা/৪০৪২।