কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ হুঁশিয়ারী
(১) দাওয়াত দাতা যখন সাহায্যের স্বরূপ বুঝতে পারবেন, তখন দাওয়াতী কাজ আঞ্জাম দেওয়া, অন্যায়, দুর্নীতি, অপরাধ ইত্যাদি উৎখাতে জোর তৎপরতা চালানোর ব্যাপারে এবং মানুষকে সৎপথে আনার অবিরাম চেষ্টায় কোনরূপ শিথিলতা দেখানো তার জন্য মোটেও ঠিক হবে না। কেননা শয়তানের কাজই হ’ল মানুষকে খোঁচান। সে তাকে বুঝায়- দেখ, তোমার কাজ তো প্রচার করা। ফলাফল তো আর তোমার হাতে নয়। সেটা তো আল্লাহর হাতে। তাহ’লে ওদের পথে না আসার জন্য তুমি কেন এত চিন্তা করছ? যে জিনিস তোমার আয়ত্তে নেই তার জন্য ক্লেশ ভোগ কর কেন? দু’একবার যা প্রচার করেছ তা-ই যথেষ্ট, আর দরকার নেই।
আবার সে এই বলেও কুমন্ত্রণা দেয় যে, এই লোকগুলির মধ্যে ভাল কিছু নেই। তুমি তাদের দু’তিনবার তো দাওয়াত দিয়েছ । এতেই যথেষ্ট হয়েছে। তাতে যদি ওরা পথে না আসে তাহ’লে তুমি তো নিরুপায়। সব সময় জোঁকের মত ওদের পেছনে লেগে থাকা কী দরকার? তাতে তোমার শক্তি ক্ষয় হবে। এসব না করে রবং অন্য কিছুতে মন দাও। তাতে তোমারও ভাল হবে, আবার সময়টাও কাজে লাগবে। এরপর থেকে দাওয়াত দাতা একটু একটু করে পিছু হটতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত দাওয়াত দেওয়া ছেড়ে দেয়। সে লোকদের সংশ্রব ত্যাগ করে এবং তাদের অবস্থা নিয়ে মাথা ঘামানো বাদ দেয়। একজন দাওয়াত দাতার এহেন অবস্থায় উপনীত হওয়া মোটেই কাম্য নয়।
সাহায্য ও বিজয়ের প্রকৃত অর্থ অনুভব করতে পারলে তার বরং আরও মনোবল বেড়ে যাবে। সে নিজের লক্ষ্য অর্জনে সব্যসাচীর ন্যায় তৎপরতা চালাবে। তাতে হয় দ্বীনের স্পষ্ট বিজয় অর্জিত হবে, নয় খোদ দাওয়াত দাতা বিজয়ী হবে। দাওয়াত দাতা বেদনার্ত ও আনন্দিত অবশ্যই হবে। কিন্তু এ বেদনা ও আনন্দকে অবশ্যই ইতিবাচক ও কার্যকরী হ’তে হবে। তার বেদনা যেন তাকে হতাশ না করে, বরং স্বীয় সম্প্রদায়কে দুনিয়া-আখিরাতের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে, জাতিকে সৎপথ প্রদর্শন করতে এবং মানুষকে আল্লাহর গোলাম বানাতে সদা তৎপর ও আগ্রহী করে তোলে।
(২) প্রত্যেক দাওয়াত দাতাকে নিজের জন্য একটি কর্মনীতি অবশ্যই এঁকে নিতে হবে। সে ঐ কর্মনীতি মেনে চলবে এবং কিছু লক্ষ্য স্থির করে তা বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। এ জন্য আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহ থেকে সাহায্য নেবে। যে সমাজে সে বাস করে তার চাহিদা ও প্রয়োজন অনুসারে এবং যে যুগে তার আগমন সেই যুগের বাস্তবতার প্রতি খেয়াল রেখে সে লক্ষ্য স্থির করবে।
কোন কোন দাওয়াত দাতাকে দেখা যায়, কিছুকাল দাওয়াতী কাজ পরিচালনার পর লক্ষ্য কতটুকু অর্জিত হ’ল তা পিছনে ফিরে দেখে। তারপর যখন দেখে আংশিক বা যৎসামান্য লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে এবং নির্ধারিত লক্ষ্যের বিশাল অংশ পড়ে রয়েছে তখন তার মনে হয়, তার কর্মনীতি ব্যর্থ হয়েছে, মিশন সফল হচ্ছে না এবং সে দাওয়াতী কাজে লাভবান হ’তে পারেনি বরং লোকসানের বোঝা উঠিয়েছে। তারপর সে নিরাশ হয়ে পড়ে এবং দাওয়াতী কাজ বন্ধ করে দেয়।
এটি একটি ভয়াবহ পদক্ষেপ। যেখানে কোন কোন নবীর হাতে একজন লোকও হেদায়াতের পথে আসেনি, তা সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের দাওয়াতী কাজের সফলতা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেননি এবং থেমেও থাকেননি। সেখানে যে ব্যক্তি কোন নবী না হওয়ার পরও তার লক্ষ্য কিছুটা অর্জিত হয়েছে সে কেন সংশয়ের ঘোরে পতিত হবে? দু’একজন লোকের হেদায়াত লাভই কি কম? লক্ষ্য করুন আলী (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছিলেন, فَوَاللهِ لَأنْ يَّهْدِىَ اللهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِدً خَيْرٌ لَّكَ مِنْ حُمُرِ النَّعَمِ- ‘আল্লাহর শপথ! তোমার চেষ্টায় আল্লাহ একজন লোককেও হেদায়াত দান করলে তা হবে তোমার জন্য অনেক লাল উট থেকেও শ্রেষ্ঠ’।[1] এ হাদীছ মাত্র একজন লোকের হেদায়াত লাভও প্রচারকের জন্য মহাবিজয় নির্দেশ করে।
(৩) বিজয়ের যত প্রকার আছে তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হ’ল, নিজের মনের উপর বিজয়। আসলে দাওয়াত দাতা নিজের মন ও প্রবৃত্তির উপর বিজয় লাভ করার আগ পর্যন্ত অন্য কোন বিজয় অর্জন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أَوَلَمَّا أَصَابَتْكُمْ مُّصِيْبَةٌ قَدْ أَصَبْتُمْ مِّثْلَيْهَا قُلْتُمْ أَنَّى هَـذَا قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِكُمْ ‘তোমাদের উপর যখন এমন বিপদ চেপে বসল, যার দ্বিগুণ বিপদ ইতিপূর্বে তোমাদের উপর চেপেছে তখন তোমরা বললে, বিপদ কোথা থেকে এলো? আপনি বলুন, ‘এ তোমাদের নিজেদেরই পক্ষ থেকে এসেছে’ (আলে ইমরান ৩/১৬৫)। তিনি আরো বলেন, إِنَّ اللّهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنْفُسِهِمْ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন জাতির চলমান অবস্থার পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন নিজেরা করে’ (রা‘দ ১৩/১১)।
এজাতীয় আয়াত পবিত্র কুরআনে আরও আছে। এতদপ্রেক্ষিততে বলা যায়, যখন সাহায্য ও বিজয় বিলম্বিত হবে তখন আমরা তার কারণ অনুসদ্ধান করব প্রথমে নিজেদের মধ্যে, তারপর অন্যত্র। কেননা বিপদ বুঝেই সাবধানতা। বিপদ যদি নিজেরা ঘটাই তাহ’লে সেটা বন্ধ না করে অন্যদের পক্ষ থেকে আগত বিপদের মোকাবেলা করা কখনো সম্ভব নয়।