হাদীছের প্রামাণিকতা

আধুনিক যুগে হাদীছ অস্বীকারকারীগণ (منكرو السنة حديثًا)

ইসলামের প্রথম শতাব্দীতে মাথা চাড়া দেওয়া হাদীছ বিরোধী দলগুলির অপতৎপরতা পরবর্তীতে স্থান বিশেষে ধিকি ধিকি ভাবে টিকে থাকলেও মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণের অব্যাহত প্রতিরোধের মুখে তা ব্যাপকতা লাভ করতে পারেনি। এমনকি আববাসীয় খলীফা মামূন, মু‘তাছিম ও ওয়াছিক্ব বিল্লাহর (১৯৮-২৩২ হিঃ/৮১৩-৪৭ খৃঃ) সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও যুক্তিবাদের নামে ভ্রান্ত মু‘তাযিলা মতবাদ বৃহত্তর মুসলিম জনসাধারণের গ্রহণযোগ্যতা লাভে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। যদিও ঐসময় আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের উপরে নেমে আসে ভূমিকম্পসদৃশ বিপদ-মুছীবত ও যুলুম-অত্যাচারসমূহ। এভাবে শত রাজনৈতিক নির্যাতন ও জেল-যুলুম সহ্য করেও তাঁদের দৃঢ় প্রতিরোধ সাধারণ জনগণের হৃদয় জয় করে। যা হাদীছ শাস্ত্রের পবিত্রতা ও উচ্চ মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সহায়ক হয়।

কিন্তু পঞ্চম শতাব্দী হিজরী থেকে সপ্তম শতাব্দী হিজরী পর্যন্ত (৪৮০-৬৯১হিঃ/১০৯৫-১২৯১খৃঃ=২০২/১৯৬ বছর) ফিলিস্তীন উদ্ধারের নামে খ্রিষ্টান ইউরোপের নেতৃত্বে পরিচালিত প্রায় দু’শো বছর ব্যাপী সংঘটিত ‘ক্রুসেড’ যুদ্ধে পরাজিত ও ব্যর্থ খ্রিষ্টান নেতারা মুসলিম বিশ্বকে করায়ত্ত করার জন্য ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। তারা সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের নীলনকশা অংকন করে এবং এজন্য বিশেষ কিছু শিক্ষিত লোক নিয়োগ করে। যারা আরবী ও ইসলামী সাহিত্য বিষয়ে গবেষণা ও অনুবাদে আত্মনিয়োগ করেন। অন্যদিকে আর্থিকভাবে দুর্বল মুসলিম দেশগুলিতে সমাজ কল্যাণের নামে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে  মানবপ্রেমিক সেজে তারা সামনে আসে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে ইসলামী গবেষণা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে তারা বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করতে থাকে।  যা মুসলমানেরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে করতে সক্ষম হয়নি। মূল্যবান স্কলারশিপ দিয়ে মুসলিম দেশসমূহের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাগুলিকে তারা গবেষণার নামে নিজেদের দেশে নিয়ে যায় এবং উচ্চতর ডিগ্রী ও লোভনীয় সুযোগ-সুবিধার ফাঁদে ফেলে তাদেরকে মানসিক গোলামে পরিণত করে। তারা ইসলামকে প্রাচীন ভেবে তাকে আধুনিক করার সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। কেউ কেউ তাদের ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাসকে ইসলামী লেবাস পরিধান করাতে সচেষ্ট হন। এভাবে তাদের নানামুখী ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান দিক ছিল এই যে, ‘আমাদের জন্য কুরআনই যথেষ্ট হাদীছের কোন প্রয়োজন নেই’। কেননা হাদীছ হ’ল ‘যান্নী’ বা ধারণা নির্ভর। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে এগুলি লিপিবদ্ধ আকারে রেখে যাননি। সেকারণ এতে অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। বিশেষ করে একক রাবীর বর্ণিত হাদীছসমূহকে, যাকে ‘খবরে ওয়াহেদ’ বলা হয়।

অতঃপর ঐসব লোকগুলি ‘সংস্কার’-এর নাম নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তাদের গুরু ‘প্রাচ্যবিদ’ (Orientalist) নামে খ্যাত ইউরোপীয় খ্রিষ্টান পন্ডিতদের অনুকরণে কাজ করতে থাকেন। মুক্তবুদ্ধির নামে তারা কথিত মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার বিরুদ্ধে তরুণদের উত্তেজিত ও আকৃষ্ট করতে থাকেন। এইভাবে ইসলামের প্রকৃত ইতিহাস এবং ছাহাবী ও তাবেঈগণের ঈমানী দৃঢ়তা সম্পর্কে অজ্ঞ লোকেরাই ইসলাম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরূপে মুসলিম সমাজে আবির্ভূত হন ও তাদের দেওয়া ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যায় সমাজে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। মুসলমান নামধারী এইসব কলমী মুনাফিকরাই ইসলামের স্থায়ী ক্ষতি সাধনে সক্ষম হয়, যা সশস্ত্র ‘ক্রুসেড’ যুদ্ধের মাধ্যমে করা সম্ভব হয়নি।

এইসব মুক্তবুদ্ধি ইসলামী চিন্তাবিদগণ কয়েকভাবে বিভক্ত। কেউ পুরো হাদীছ শাস্ত্রের বিরুদ্ধে ‘সন্দেহবাদ’ আরোপ করেছেন। কেউ শুধুমাত্র ‘খবরে ওয়াহেদ’ জাতীয় হাদীছগুলিতে সন্দেহ সৃষ্টি করেছেন। কেউ  হাদীছ বাদ দিয়ে কেবলমাত্র কুরআনের অনুসারী হওয়ার দাবী করেছেন। কেউ নিজের স্বার্থের কিছু হাদীছকে স্বীকার করেছেন, বাকীগুলিকে অস্বীকার বা অপব্যাখ্যা করেছেন। অনেকে হাদীছ শাস্ত্রকে সরাসরি অস্বীকার করেননি, তবে যুক্তির নামে এমন সব অপযুক্তির অবতারণা করেছেন, যা হাদীছ অস্বীকারকারীদের চেয়েও অধিক ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে এবং যা লোকদের নিকটে হাদীছের উচ্চ মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে।

পাশ্চাত্যে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন গোল্ডযিহের (১৮৫০-১৯২১), জোসেফ শাখত, মার্গোলিয়থ, গ্যাষ্টন ওয়াট, টমাস আর্ণল্ড, কার্ল ব্রোকেলম্যান, আর.এ. নিকলসন, এ.জে. আরবেরী, আলফ্রেড হিউম, হ্যামিল্টন এ.আর. গীব, মন্টগোমারী ওয়াট, এস.এম. যুইমার, এ.জে. ভিনসিক, হেনরী ল্যামেন্স (১৮৬৮-১৯৫১) প্রমুখ।

পক্ষান্তরে প্রাচ্যে এই আন্দোলনের উৎস ভূমি হ’ল প্রধানতঃ দু’টি। ১. মিসরে মুফতী মুহাম্মাদ আব্দুহু (১৮৪৯-১৯০৫) ও তাঁর অনুসারীবৃন্দ ২. ভারতে স্যার সৈয়দ আহমাদ খান (১৮১৭-১৮৯৮) ও তাঁর অনুসারীবৃন্দ।