অধঃপতনের কারণ (سبب الانحطاط)
মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনের বহুবিধ কারণের মধ্যে সবচাইতে বড় কারণ হ’ল কুরআন ও সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। কুরআন ও হাদীছের নিরপেক্ষ অনুসরণ ও এতদুভয়ের প্রকাশ্য ও সরলার্থের উপরে আমল ও গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে লোকেরা ক্রমে দলপূজা ও ব্যক্তি পূজায় লিপ্ত হয়। আর এগুলি শুরু হয় মূলতঃ রাজনৈতিক ও দুনিয়াবী স্বার্থকে কেন্দ্র করে। আবুবকর (রাঃ)-এর আড়াই বছরের খেলাফতকাল ব্যয়িত হয় মূলতঃ ইসলামের প্রতিরক্ষার কাজে তথা ‘মুরতাদ’ বা ধর্মত্যাগীদের ঢল ঠেকানো, যাকাত অস্বীকারকারীদের ও ভন্ডনবীদের ফেৎনা, বিদেশী বৈরী শক্তির হামলা মুকাবিলা করা ইত্যাদি কাজে। ওমর (রাঃ)-এর ১০ বছরের খেলাফতকালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং মুসলিম শক্তির বিজয়াভিযান এগিয়ে চলে বাধাহীন গতিতে। মুসলমানদের জীবনযাত্রায় সচ্ছলতা ফিরে আসে। ওছমান গণী (রাঃ)-এর ১২ বছরের খেলাফতকালের প্রথমার্ধ্ব ব্যাপী এই অভিযান অব্যাহত থাকে ও মুসলিম শক্তি তৎকালীন পৃথিবীতে একক বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। কিন্তু এরি মধ্যে কিছু বিলাসী লোক দ্বীনকে দুনিয়া হাছিলের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করে। ইহুদী সন্তান আবদুল্লাহ বিন সাবা প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করে ঐসব দুনিয়াদার লোকদেরকে খেলাফতের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে থাকে। ফলে রাজনৈতিক বিশৃংখলা দেখা দেয়। যার পরিণতিতে তৃতীয় খলীফা ওছমান (রাঃ) ও পরে চতুর্থ খলীফা আলী (রাঃ) নিহত হন। চরমপন্থী খারেজীরা আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ) উভয়কে এবং মিক্বদাদ, সালমান ফারেসী ও আবু যার গেফারীসহ হাতে গণা কয়েকজন ব্যতীত সকল ছাহাবীকে ‘কাফের’ বলতে থাকে। এইভাবে নেতৃস্থানীয় ছাহাবীগণকে ‘কাফের’ বলার কারণে উম্মতের মধ্যে তাঁদের বিশাল ভাবমূর্তি ও মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। যে কেউ তাঁদের সমালোচনায় সাহসী হয়ে ওঠে। ফলে মুসলিম ঐক্য হুমকির মুখে পড়ে যায়। মদীনা ও দামেষ্ক এবং পরে কূফা ও দামেষ্ক রাজনৈতিক বিভক্তির দুই কেন্দ্রে পরিণত হয়। অতঃপর আববাসীয় আমলে বাগদাদে একক রাজধানী স্থাপিত হয়।
উপরোক্ত রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে মসজিদ, মাদরাসা সর্বত্র আক্বীদাগত বির্তক শুরু হয়ে যায়। বছরার মা‘বাদ জুহানী (মৃঃ ৮০হিঃ) তাক্বদীরকে অস্বীকার করে। জাহম বিন ছাফওয়ান সমরকন্দী (নিহত ১২৮ হিঃ) আল্লাহর গুণাবলীকে অস্বীকার করে। ওয়াছিল বিন ‘আত্বা (৮০-১৩১ হিঃ) বছরায় মু‘তাযিলা মতবাদের জন্ম দেয়। তারা যুক্তির আলোকে ছহীহ হাদীছসমূহের যাচাই শুরু করে এবং তাদের মন মত না হ’লে তাকে অস্বীকার করার দুঃসাহস দেখাতে থাকে অথবা নিজেদের মন মত করে নেওয়ার জন্য অপব্যাখ্যা ও দূরতম ব্যাখ্যা শুরু করে দেয়।
মোটকথা কুরআন ও সুন্নাহর মূল বাহক ও প্রচারক মহামান্য ছাহাবীগণের বিরুদ্ধে কুচক্রীরা মেতে ওঠে। ইহুদী-খৃষ্টান থেকে ধর্মান্তরিত নও-মুসলিম লোকেরাই মূলতঃ এই চক্রান্তে নেতৃত্ব দেয়। যাতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হাদীছ শাস্ত্রকে বাতিল প্রমাণ করা যায়। আর হাদীছকে বাতিল বা অগ্রহণযোগ্য কিংবা সন্দেহযুক্ত প্রমাণ করতে পারলেই কুচক্রীদের উদ্দেশ্য সফল হবে। কেননা হাদীছের স্তম্ভের উপরেই ইসলামের সুউচ্চ প্রাসাদ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।