ছাহাবীগণের ভূমিকা (موقف الصحابة)
ছাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের শিষ্য তাবেঈনে এযাম সর্বদা হাদীছের পাহারাদার হিসাবে দৃঢ় হিমাদ্রির ন্যায় ভূমিকা পালন করে গেছেন। হাদীছের নামে মিথ্যা বর্ণনা, হাদীছের অপব্যাখ্যা, দূরতম ব্যাখ্যা ইত্যাদি থেকে তাঁরা ছিলেন বহু যোজন দূরে। এসব বিষয় ছিল তাঁদের স্বপ্নেরও বাইরে। এ কারণে তাঁরা জনগণের মধ্যে ‘আহলুল হাদীছ’ ‘আহলুস সুন্নাহ’ ইত্যাদি নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁদের বিরোধীরা ‘আহলুল বিদ‘আ’ তথা বিদ‘আতী নামে অভিহিত হতে থাকে (মুক্বাদ্দামা মুসলিম পৃ. ১৫)।
উল্লেখ্য যে, রাজনৈতিক গোলযোগের ফলে ছাহাবীগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হ’লেও তাঁদের মধ্যে আক্বীদাগত কোন বিভক্তি দেখা দেয়নি। তাঁরা পরস্পরকে ‘কাফির’ বলেননি বা কারুর রক্ত হালাল বলেননি। তাঁদের মধ্যে যা কিছু বিরোধ ছিল, তা ছিল স্রেফ ইজতিহাদী মতবিরোধ। যাঁর ইজতিহাদ সঠিক ছিল, তিনি দ্বিগুণ ছওয়াব পাবেন এবং যাঁর ইজতিহাদ বেঠিক ছিল, তিনি একগুণ ছওয়াব পাবেন।
বছরায় থাকাকালীন সময়ে একদা ছাহাবী ইমরান বিন হুছাইন (রাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে হাদীছ শুনাচ্ছিলেন। তখন একজন লোক এসে বলল, হে আবু নাজীদ! আপনি আমাদেরকে কুরআন শুনান। ইমরান বিন হুছাইন (রাঃ) তখন লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা কি ছালাত আদায় কর না? তোমরা কি যাকাত আদায় কর না? তাহ’লে তা কার দেওয়া পদ্ধতিতে আদায় কর? লোকটি বলল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে এসব বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছেন। অতঃপর লোকটি নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল :أَحْيَيْتَنِي أَحْيَاكَ اللهُ ‘আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবি করুন!’[1]
উমাইয়া বিন খালিদ একবার সকল মাসআলা কুরআন থেকে বের করার চেষ্টা করেন। তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা মুক্বীম অবস্থায় ও ভীতির অবস্থায় ছালাত আদায়ের বিষয় কুরআনে পাই। কিন্তু সফরে ছালাত আদায়ের বিষয় তো কুরআনে পাই না। তখন ইবনু ওমর (রাঃ) তাকে বললেন, يَا ابْنَ أَخِي، إِنَّ اللهَ بَعَثَ إِلَيْنَا مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلاَ نَعْلَمُ شَيْئًا، فَإِنَّمَا نَفْعَلُ كَمَا رَأَيْنَا مُحَمَّدًا يَفْعَلُ- ‘হে ভাতিজা! মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে আল্লাহ আমাদের নিকট পাঠিয়েছিলেন, যখন আমরা কিছুই জানতাম না। নিশ্চয়ই আমরা করে থাকি, যেমনভাবে আমরা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে করতে দেখেছি’।[2]
তবে এই ধরনের প্রশ্ন তৎকালীন মুসলিম সমাজে ব্যাপকতা লাভ করেনি। বরং ব্যক্তি পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল। আর মূলতঃ ইরাকের বছরাতেই এটি সীমাবদ্ধ ছিল। সেকারণ বছরার অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাবেঈ বিদ্বান আইয়ূব সাখতিয়ানী (৬৮-১৩১ হিঃ) নিজ শহরের লোকদের চূড়ান্তভাবে বলে দেন যে,إِذَا حَدَّثْتَ الرَّجُلَ بِالسُّنَّةِ فَقَالَ: دَعْنَا مِنْ هَذَا وَحَدِّثْنَا مِنَ الْقُرْآنِ فَاعْلَمْ أَنَّهُ ضَآلٌّ وَمُضِلٌّ- ‘যখন তুমি কোন ব্যক্তিকে হাদীছ শুনাবে, তখন সে যদি বলে যে, ছাড় এসব, আমাদেরকে কুরআন শুনাও, তখন তুমি জেনো যে, ঐ লোকটি নিজে পথভ্রষ্ট এবং অন্যকে পথভ্রষ্টকারী’।[3]
ব্যক্তি পর্যায়ে হাদীছ বিরোধী উক্ত মনোভাব সীমাবদ্ধ থাকলেও দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ দিকে এসে বেশ কিছু লোককে পাওয়া যায়, যারা পুরা হাদীছ শাস্ত্রকেই অস্বীকার করে অথবা ‘খবরে ওয়াহেদ’ পর্যায়ের হাদীছসমূহকে অস্বীকার করে। যদিও মুসলিম উম্মাহর সার্বিক সামাজিক জীবনে এর ব্যাপক প্রভাব তখনও পড়েনি, আজও পড়েনি। ফালিল্লা-হিল হাম্দ। তবে হাদীছ বিরোধী ষড়যন্ত্র প্রকাশ্যে ও পরোক্ষে সর্বদা অব্যাহত ছিল, আজও আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এই লোকেরা এখন আর বাইরের কেউ নয়, বরং ঘরের। ইসলামের বড় বড় বিদ্বান হিসাবে যারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত। এক্ষণে বিগত ও বর্তমান যুগের প্রকাশ্য ও পরোক্ষ হাদীছ বিরোধীদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় আমরা তুলে ধরার প্রয়াস পাব। যাতে সাধারণ মুসলমানগণ এদের ধোঁকায় না পড়েন।[1]. মুস্তাদরাকে হাকেম ১/১০৯-১০ পৃঃ।
[2]. মুস্তাদরাকে হাকেম ১/২৫৮ পৃঃ।
[3]. ছালাহুদ্দীন মকবূল আহমাদ, যাওয়াবে‘ ফী ওয়াজহিস সুন্নাহ (রিয়াদ : দার আলমিল কুতুব) তাবি, পৃঃ ৪৬।