হাদীছের প্রামাণিকতা

‘হাদীছ’ সম্পর্কে মাওলানা মওদূদীর আক্বীদা

(عقيدة المودودي في الحديث)

হাদীছ ও হাদীছ শাস্ত্রবিদগণ সম্পর্কে মাওলানা মওদূদীর আক্বীদা লিখিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘মাসলাকে এ‘তেদাল’ (مسلك اعتدال) নামক নিবন্ধে, যার বঙ্গানুবাদ ‘সুষম মতবাদ’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত প্রবন্ধে তিনি হাদীছকে ‘যান্নী’ (ظنى) বা ‘ধারণা নির্ভর’ বলে অগ্রহণযোগ্য সাব্যস্ত করতে চেয়েছেন। যদিও এ ব্যাপারে তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছেন। তবুও অনেক ঘুরিয়ে তিনি যে কথাটি বুঝাতে চেয়েছেন তা এই যে, হাদীছের উপরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপনের কোন নিশ্চিত ভিত্তি নেই। কেননা বর্ণনাকারী একজন মানুষ হিসাবে ভুলের ঊর্ধ্বে ছিলেন না। অতএব এ ক্ষেত্রে নিশ্চিত সত্যে উপনীত হওয়ার একমাত্র পথ হ’ল ফক্বীহদের মর্ম অনুধাবন (تفقہ) ও তাঁদের বিশেষ রুচিবোধ (خاص ذوق)। মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণকে তিনি সাংবাদিক (أخبارى) দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী বলে মনে করেন, যারা কেবল সংবাদের সত্যাসত্য যাচাই করেন, কিন্তু এর তাৎপর্য (فقہ) অনুধাবন করেন না। যেমন তিনি বলেন,

محدثين رحمهم الله كى خدمات مسلم... كلام اس ميں نہيں بلكہ صرف اس امر ميں ہے كہ كليةً ان  پر اعتماد كرنا كہاں تك درست ہے، بہر حال تہے تو انسان ہى... پہر آپ كيسے كہ سكتے ہيں كہ جس كو وہ صحيح قرار ديتے ہيں وہ حقيقت ميں بہى صحيح ہے؟ ... مزيد برآں ظن غالب ان كو جس بنا پر حاصل ہوتا تہا وه بلحاظ روايت تہا نہ كہ بلحاظ درايت- ان كا نقطہ نظر زياده تر أخبارى ہوتا تہا ، فقہ ان كا اصل موضوع نہ تہا ... يہ ماننا پڑيگا كہ احاديث كے متعلق جو كچھ بہى تحقيقات انہوں نے كى ہے اس ميں دو طرح كى كمزورياں موجود ہيں، ايك بلحاظ اسناد اور دوسرے بلحاظ تفقہ-

‘মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণের খিদমত সর্বস্বীকৃত।.... এতে কোন কথা নেই। কথা কেবল এ বিষয়ে যে, পুরোপুরিভাবে তাঁদের উপরে ভরসা করা কতটুকু সঠিক হবে। হাযার হৌক তাঁরা তো ছিলেন মানুষই। ...অতএব কিভাবে আপনি একথা বলতে পারেন যে, তাঁরা যে হাদীছকে ‘ছহীহ’ সাব্যস্ত করেছেন, আসলেই সেটা ছহীহ। ...অধিকন্তু যার কারণে তাদের মধ্যে হাদীছের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সর্বোচ্চ ধারণার সৃষ্টি হয়, সেটি হ’ল রেওয়ায়াতের (বর্ণনার) দৃষ্টিকোণ, দিরায়াতের (যুক্তি গ্রাহ্যতার) দৃষ্টিকোণ নয়। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বেশীর বেশী সাংবাদিকের দৃষ্টিভঙ্গি, ফিক্বহ বা তাৎপর্য অনুধাবন তাদের বিয়ষবস্ত্ত ছিল না। ...অতএব একথা মানতেই হবে যে, হাদীছসমূহে যেসব গবেষণা তাঁরা করেছেন, তাতে দু’টি দিকে তাঁদের দুর্বলতা ছিল। ১- সনদের দিক দিয়ে ২- মর্ম অনুধাবনের দিক দিয়ে।[1]

প্রিয় পাঠক! নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কত সুন্দরভাবে তিনি ফিক্বহকে হাদীছের উপরে স্থান দিতে চেয়েছেন। অথচ কে না জানে যে, হাদীছের তাৎপর্য অনুধাবনের ক্ষেত্রে স্থান-কাল পাত্র ভেদে মুজতাহিদ ফক্বীহগণের মধ্যে সকল যুগে মতভেদ হয়েছে। কিন্তু হাদীছের ভাষায় কোন পরিবর্তন হয়নি, হবেও না ইনশাআল্লাহ। অতএব হাদীছের বর্ণনার বিশুদ্ধতা যাচাই করাই হ’ল মুখ্য। আর বর্ণনার সত্যাসত্য যাচাইয়ের জন্য বর্ণনাকারীকে যাচাই করা সর্বাধিক প্রয়োজন। মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণ তাই সনদ যাচাইয়ের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। আর একারণেই তাবেঈ বিদ্বান আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১১৮-১৮১হিঃ) বলেছেন, اَلْإِسْنَادُ عِنْدِيْ مِنَ الدِّيْنِ، لَوْلاَ الْإِسْنَادُ لَقَالَ مَنْ شَاءَ مَا شَاءَ ‘আমার নিকটে সনদ হ’ল দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। যদি সনদ যাচাই না হ’ত, তাহ’লে যে যা খুশি তাই বলত’ (মুক্বাদ্দামা মুসলিম পৃঃ ১৫)। মুহাদ্দিছগণ সনদ যাচাইয়ের সাথে সাথে হাদীছের ‘দিরায়াত’ বা যুক্তিগ্রাহ্যতা সূক্ষ্মভাবে যাচাই করেছেন। উছূলে হাদীছের ছাত্রগণ তা ভালভাবেই জানেন। অতএব মাওলানার উপরোক্ত মন্তব্য হাদীছ বিরোধীদের উত্থাপিত মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগেরই প্রতিধ্বনি মাত্র। যদিও মাওলানা হাদীছ অস্বীকারকারী ছিলেন না।

তিনি বলেন, ‘উপরোক্ত আলোচনায় একথা বুঝা গেছে যে, হাদীছকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যানকারী ব্যক্তিগণ যেমন ভুলের উপরে আছে, তেমনি ঐ ব্যক্তিগণও ভুল থেকে নিরাপদ নন, যারা হাদীছের কেবল রেওয়ায়াতের উপরে ভরসা করে  থাকেন। সঠিক রাস্তা ঐ দু’টির মাঝখানে রয়েছে। আর সেটি হ’ল ঐ রাস্তা, যা মুজতাহিদগণ অবলম্বন করেছেন। ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর ফিক্বহে আপনি এমন বহু মাসআলা দেখবেন, যা মুরসাল, মু‘যাল ও মুনক্বাতি‘ (ইত্যাদি ‘যঈফ’) হাদীছসমূহের উপরে ভিত্তিশীল। অথবা যেখানে শক্তিশালী সনদের হাদীছ বাদ দিয়ে দুর্বল সনদের হাদীছ গ্রহণ করা  হয়েছে। অথবা যেখানে হাদীছ কিছু বলছে, ইমাম আবু হানীফা কিংবা তাঁর শিষ্যগণ কিছু বলছেন। ইমাম মালেকের অবস্থাও অনুরূপ’।[2]

একটু পরে গিয়ে মাওলানা হাদীছের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের দ্বিতীয় মানদন্ড (دوسري كسوٹى) নির্ধারণ করেছেন ফক্বীহদের বিশেষ রুচিকে (خاص ذوق)। যার মাধ্যমে তাঁরা হাদীছ পরখ করেন এবং তাতে হৃদয়ে প্রশান্তি (اطمينان) লাভ করলে হাদীছটি গ্রহণ করেন। যদিও মুহাদ্দিছগণের দৃষ্টিতে তা ত্রুটিপূর্ণ (مرجوح) হয়’।[3]

যেমন তিনি বলেন,

يہ دوسرى كسوٹى كونسى ہے؟ہم اس سے پہلے اشارةً اس كا ذكر كئى مرتبہ كر چكے ہيں- جس شخص كو الله تفقہ كى نعمت سے سرفراز فرماتا ہے اس كے اندر قرآن اور سيرت رسول ﷺ كے غائر مطالعہ سے ايك خاص ذوق پيدا ہو جاتا ہے جس كى كيفيّت بالكل ايسى ہے جيسے ايك پُرانے جوہرى كى بصيرت... اس مقام پر پہونچ جانے كے بعد انسان اسناد كا زياده محتاج نہيں رہتا- وه اسناد كا مدد ضرور ليتا ہے مگر اس كے فيصلے كا مدار اس پر نہيں ہوتا-

‘এই দ্বিতীয় মানদন্ড কোনটি? ইতিপূর্বে আমরা কয়েকবার এ বিষয়ে ইঙ্গিতে উল্লেখ করেছি। আল্লাহ যাকে মর্ম অনুধাবনের অনুগ্রহে সিক্ত করেন, তার মধ্যে কুরআন ও রাসূল-চরিত গভীরভাবে অধ্যয়নের ফলে এক বিশেষ রুচিবোধ (خاص ذوق) সৃষ্টি হয়। যার প্রকৃতি ঠিক ঐরূপ, যেরূপ একজন পুরানো স্বর্ণকারের দূরদৃষ্টি।... এই স্থানে পৌঁছে যাবার পর মানুষ সনদের প্রতি বেশী মুখাপেক্ষী থাকেনা। সে সনদ থেকে অবশ্যই সাহায্য নেয়। কিন্তু সিদ্ধান্তের ভিত্তি তার উপরে থাকেনা’।[4]

চটকদার যুক্তির মাধ্যমে মাওলানা নিজেদের রায়-কে হাদীছের উপরে স্থান দিতে চেয়েছেন। যা ভ্রান্ত ফের্কা মু‘তাযিলাদের অনুকরণ বৈ কিছুই নয়।

কিন্তু প্রশ্ন হ’ল, ব্যক্তিগত রুচিই যদি ছহীহ-যঈফ বাছাইয়ের ও হাদীছ কবুল করা বা না করার মানদন্ড হয়, তাহ’লে তো হাদীছের কোন অস্তিত্বই থাকবে না। কেননা ব্যক্তিগত রুচি তো সবার এক নয়। তাছাড়া একথার অর্থ তাহ’লে কি  হবে যে, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) যঈফ হাদীছকে রায়-এর উপরে অগ্রাধিকার দিতেন? ছাহাবা, তাবেঈন ও উম্মতের সেরা বিদ্বানমন্ডলী ছহীহ হাদীছ পাওয়ার সাথে সাথে ইতিপূর্বেকার আমল ছেড়ে দিয়ে ছহীহ হাদীছের অনুসারী হয়েছেন কেন? এবং কেনই বা তাঁদের ‘রায়’ পরিত্যাগ করে ছহীহ হাদীছের অনুসারী হওয়ার জন্য স্ব স্ব অনুরক্তদের নির্দেশ দিয়ে গেলেন?

বস্ত্ততঃ মাওলানার উক্ত বক্তব্য একেবারেই কল্পনাপ্রসূত এবং বাস্তবতার সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেছেন যে, إِيَّاكُمْ وَالْقَوْلِ فِيْ دِيْنِ اللهِ بِالرَّأْيِ وَعَلَيْكُمْ بِاتِّبَاعِ السُّنَةِ فَمَنْ خَرَجَ عَنْهَا ضَلَّ- ‘তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে ‘রায়’ অনুযায়ী কোন কথা বল না । তোমাদের কর্তব্য হ’ল সুন্নাহর অনুসরণ করা। যে ব্যক্তি সুন্নাহ থেকে বেরিয়ে গেল, সে পথভ্রষ্ট হ’ল’।[5] আর প্রথম ছহীহ হাদীছের সংকলন ‘মুওয়াত্ত্বা’র স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ত্ব ইমাম মালেক (৯৫-১৭৯ হিঃ)-এর বিরুদ্ধে এরূপ কথা বলা রীতিমত তোহমত বৈকি! এইসব মহামতি ইমামগণ কখনোই জেনেশুনে হাদীছের বিরুদ্ধে নিজেদের ‘রায়’-কে অগ্রাধিকার দেননি। বরং এ বিষয়ে তাঁদের সকলের বক্তব্য প্রায় একইরূপ ছিল যে, ছহীহ হাদীছই আমাদের মাযহাব।[6]

মাওলানার উক্ত প্রবন্ধ মাসিক ‘তারজুমানুল কুরআন’ মে ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হ’লে আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে প্রমাণ চেয়ে পত্র লিখলে তিনি জবাবে লিখেন যে,  اس وقت ميرے پيش نظر مطلوبہ نظير نہيں ہے اور ويسے بہى نظيريں پيش كرنے سے بحث كا سلسلہ دراز ہوتا ہے ‘এ মুহূর্তে আমার সম্মুখে অনুরূপ কোন প্রমাণ নেই। তবে এসব প্রমাণ পেশ করতে গেলে আলোচনা দীর্ঘায়িত হয়ে যায়’।[7]

মাওলানা তাঁর আলোচনায় ছহীহ হাদীছের উপরে মুজতাহিদগণের রায় ও তাঁদের ব্যক্তিগত রুচিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাকেই সঠিক পথ বলে মন্তব্য করেছেন। অথচ আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের চিরন্তন নীতি হ’ল, হাদীছ মওজুদ থাকতে ক্বিয়াস বৈধ নয়’ (আর-রিসালাহ পৃঃ ৫৯৯) এবংإِذَا وَرَدَ الْأَثَرُ بَطَلَ النَّظَرُ ‘যখনই হাদীছ পাওয়া যাবে, তখনই যুক্তি বাতিল হবে’।[8] তাছাড়া ফক্বীহগণের পরস্পরের মতভেদে ফিক্বহের কিতাবসমূহ ভরপুর। এমনকি ইমাম গাযযালী (রহঃ)-এর হিসাব মতে খোদ আবু হানীফা (রহঃ)-এর সমস্ত ফৎওয়ার দুই-তৃতীয়াংশের বিরোধিতা করেছেন তাঁর দুই প্রধান শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ (রাহেমাহুমাল্লাহ)’।[9]

যে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) নিজের ব্যাপারে তাঁর প্রধান শিষ্য আবু ইউসুফকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, لاَ تَرْوِ عَنِّى شَيْئًا فَإِنِّىْ وَاللهِ لاَ أَدْرِيْ مُخْطِئٌ أَنَا أَمْ مُصِيْبٌ ‘তুমি আমার পক্ষ থেকে কোন মাসআলা বর্ণনা কর না। কেননা আল্লাহর কসম! আমি জানি না আমি নিজ সিদ্ধান্তে বেঠিক না সঠিক’ (খত্বীব ১৩/৪০২), সেক্ষেত্রে মাওলানা মওদূদী কিভাবে বলতে পারেন যে, মুজতাহিদগণের রায় ও তাঁদের ব্যক্তিগত রুচিই হ’ল নিশ্চিত জ্ঞানলাভের সঠিক উপায়। তিনি কি তাহ’লে মুসলিম উম্মাহকে কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট পথ থেকে বের করে ইসলামী চিন্তাবিদগণের পরস্পর বিরোধী চিন্তাধারার ধূম্রজালে আবদ্ধ করতে চান? এটা নিঃসন্দেহে ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের অনুসৃত পথ হ’তে বিচ্যুতি। যে পথে ভ্রান্তি আছে, সত্য নেই। অশান্তি আছে, প্রশান্তি নেই।

উল্লেখ্য যে, কুরআন ও হাদীছের চিরস্থায়ী নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ গ্রহণ করেছেন (হিজর ১৫/৯, ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৬-১৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لَقَدْ جِئْتُكُمْ بِهَا بَيْضَاءَ نَقِيَّةً ‘আমি তোমাদের নিকটে এসেছি স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন দ্বীন নিয়ে’।[10] যার রাত্রি হ’ল দিবসের ন্যায় আলোকিত। এই আলোকিত দ্বীনকে সন্দেহবাদের অন্ধকারে ঢেকে দেবার অপপ্রয়াস থেকে প্রত্যেক মুমিনকে অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে।

দুর্ভাগ্য এই যে, যুক্তিবাদের ধাঁধানো চোখে আমরা অনেক সময় অন্ধকার দেখি। ফলে সহজ চিন্তার স্নিগ্ধ আলোকে আমরা অহি-র বিধানের প্রকাশ্য রাস্তা খুঁজে পেতে অনেক সময় ব্যর্থ হই। যে জন্য মাওলানা মওদূদীর ন্যায় ইসলামের একজন সিপাহসালারের অতি যুক্তিবাদী চক্ষু এমনকি ছহীহ বুখারীর হাদীছসমূহের বিশুদ্ধতাও খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন তিনি বলেন,

كوئي شريف آدمى يہ نہيں كہ سكتا كہ حديث كا جو مجموعہ ہم تك پہونچا ہے  وه قطعى طور پر صحيح ہے- مثلاً بخارى، جسكے بارے ميں اصح الكتب بعد كتاب الله كها جاتا ہے، حديث ميں كوئي بڑے سے بڑا غلو كرنيوالا بہى يہ نہيں كہ سكتا كہ اس ميں جو چھ سات ہزار احاديث درج ہيں وه سارى كى سارى صحيح ہے-

‘কোন শরীফ লোক এ কথা বলতে পারে না যে, হাদীছের যে সমষ্টি আমাদের নিকটে পৌঁছেছে, তার সবটা অকাট্যভাবেই ছহীহ। যেমন বুখারী, যাকে আল্লাহর কেতাবের পরে সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ কিতাব বলা হয়, হাদীছের অতি বড় ভক্তও একথা বলতে পারে না যে, এর মধ্যে যে ছয়-সাত হাযার হাদীছ সংকলিত আছে, তার সবটাই ছহীহ’।[11] কি তাচ্ছিল্যভরা ভয়ংকর মন্তব্য! অথচ এ প্রসঙ্গে ভারতগুরু শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (রহঃ) বলেন,

أَمَّا الصَّحِيْحَانِ فَقَدِ اتَّفَقَ الْمُحَدِّثُوْنَ عَلَى أَنَّ جَمِيْعَ مَا فِيْهِمَا مِنَ الْمُتَّصِلِ الْمَرْفُوعِ صَحِيْحٌ بِالْقَطْعِ، وَأَنَّهُمَا مُتَوَاتِرَانِ إِلَى مُصَنِّفَيْهِمَا، وَأَنَّهُ كُلُّ مَنْ يُهَوِّنُ أَمْرَهُمَا فَهُوَ مُبْتَدِعٌ مُتَّبِعُ غَيْرِ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ- (حجة الله البالغة 1/134)-

‘ছহীহায়েন অর্থাৎ ছহীহ বুখারী ও মুসলিম সম্পর্কে হাদীছ বিশারদ পন্ডিতগণ একমত হয়েছেন যে, এ দু’য়ের মধ্যে মুত্তাছিল মারফূ‘ যত হাদীছ রয়েছে, সবই অকাট্যভাবে ছহীহ। যে ব্যক্তি ঐ দুই গ্রন্থ সম্পর্কে হীন ধারণা পোষণ করবে, সে বিদ‘আতী এবং মুসলিম উম্মাহর বিরোধী তরীকার অনুসারী’।[12]

অথচ হাদীছের সনদ এবং বর্ণনাগত ও তাৎপর্যগত বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের ব্যাপারে ইমাম বুখারী (রহঃ) -এর কঠোর শর্তাবলী এবং ফিক্বহ বিষয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ দূরদর্শিতা কিংবদন্তীর ন্যায় প্রসিদ্ধ। হক্ব ও বাতিলের পার্থক্যকারী ওমর ফারূক (রাঃ) বলেন,وَالَّذِيْ نَفْسُ عُمَرَ بِيَدِهِ مَا قَبَضَ اللهُ تَعَالَى رُوْحَ نَبِيِّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلاَ رَفَعَ الْوَحْيَ عَنْهُ حَتَّى أَغْنَي أُمَّتَهُ كُلَّهُمْ عَنِ الرَّأْيِ- ‘যাঁর হাতে ওমরের জীবন তাঁর কসম করে বলছি, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর নবীর রূহ কবয করেননি এবং ‘অহি’ উঠিয়ে নেননি, যতক্ষণ না তাঁর উম্মত সকল প্রকার ‘রায়’ (তথা যুক্তিবাদ) হ’তে মুক্ত হ’তে পেরেছে’।[13] অতএব মুজতাহিদগণের ‘রায়’ নয়, বরং মুহাদ্দিছগণের গৃহীত ছহীহ হাদীছই হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী মানদন্ড।


[1]. সাইয়িদ আবুল আ‘লা মওদূদী, তাফহীমাত (দিল্লী: মারকাযী মাকতাবা ইসলামী, ১৯৭৯) ১/৩৫৬ পৃঃ।

[2]. তাফহীমাত ১/৩৬০ পৃঃ।

[3]. ঐ, ১/৩৬১।

[4]. ঐ, ১/৩৬১-৬২।

[5]. আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানী (৮৯৮-৯৭৩হিঃ), মীযানুল কুবরা (দিল্লী ছাপাঃ ১২৮ হিঃ) ১/৬৩ পৃঃ।

[6]. ঐ, ১/৭৩।

[7]. তাফহীমাত ১/৩৬৬।

[8]. আলবানী, আল-হাদীছু হুজ্জিয়াতুন বিনাফসিহী, পৃঃ ২৭।

[9]. দ্রঃ ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ (ডক্টরেট থিসিস) পৃঃ ১৮০; গৃহীত শারহু বেক্বায়াহ-এর মুক্বাদ্দামাহ (দিল্লী ছাপা ১৩২৭ হিঃ) পৃঃ ২৮ শেষ লাইন; ঐ দেউবন্দ ছাপা, তাবি, পৃঃ ৮)।                  

[10]. আহমাদ, বায়হাক্বী, মিশকাত হা/১৭৭ ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।

[11]. যাওয়াবে‘ পৃঃ ১৪৫, গৃহীত : সাপ্তাহিক আল-ই‘তিছাম লাহোর, ২৭ মে ও ৩ জুন ১৯৫৫।

[12]. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ (কায়রোঃ দারুত তুরাছ, ১৩৫৫ হিঃ) ১/১৩৪ পৃঃ।

[13]. মীযান ১/৬২।