সাড়ে তিন হাত মাটি
সুদীর্ঘ পথেরও শেষ আছে, আছে এই মোহনীয় বসুন্ধরার। শুধু শেষ নেই বনু আদমের আশা-আকাঙ্খা, চাওয়া-পাওয়া ও লোভ-লালসার। তারই আলোকে এই ছোট্ট গল্প।-
এক গ্রামে রিয়াযুদ্দীন নামে জনৈক ধনী ব্যক্তি বাস করতেন। তার দুই ছেলে। বড় ছেলে আরমান ওকালতি পাশ করে শহরেই থাকে। ছোট ছেলে আনোয়ার গ্রামে বাস করে। আনোয়ার পেশায় কৃষক। গ্রামের মাদরাসা থেকে সে অষ্টম শ্রেণী পাশ করেছে। সে গভীর অনুরাগী। গ্রামেই সে বিয়ে করেছে। হঠাৎ ব্রেইন স্ট্রোক করে ইন্তেকাল করেন রিয়াযুদ্দীন। বাবার দাফন-কাফন শেষে দু’ভাই একত্রে বসে আলোচনা করছে।
বড় ভাই বলছেন, শোন আনোয়ার, বাবা মৃত্যুর সময় সম্পত্তি আমাদের দু’ভাইয়ের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। গ্রামের জমিজমা সব তোমার। আর শহরেরগুলি আমার। আর বাবা যেহেতু জমি বণ্টন করে দিয়েছেন, সেহেতু আর কোন প্রশ্নই ওঠে না।
আরমান ছিল ছোটবেলা থেকেই লোভী প্রকৃতির। আর মিথ্যা বলায় পারঙ্গম। ছালাত-ছিয়াম সহ ধর্মীয় কার্যাদি পালনে ছিল তার চরম অনীহা। তবুও মাঝে-মধ্যে শুক্রবারে মসজিদে গেলেও বলত, এই দিনে সব লোক যায় তাই আমিও যাই। আরমানের গ্রামের বাড়ীতে জমি তেমন ছিল না। শহরেই সব। ব্যাংক ব্যালেন্স সহ বেশ কয়েকটি বাসা।
আরমান ছাহেবের দুই ছেলে হেলাল আর বেলালকে প্রয়োজনমত লেখাপড়া শিখিয়ে তার ব্যবসার দায়িত্ব দিয়েছেন।
আরমান ছাহেব বৃদ্ধ বয়সে উপনীত। আগেই সম্পত্তি দু’ছেলের মাঝে ভাগ করে দিয়েছেন। শরীরে তেমন জোর নেই বললেই চলে। সব সময় ঘরে তাসবীহ-তাহলীল করে সময় কাটান। মাঝে মাঝে ওয়ায-মাহফিলে যান এবং অনেক পাপ-পুণ্যের কথা শুনেন। মনে মনে ভাবেন কিছু অর্থ-সম্পদ দিয়ে ইয়াতীমখানা, মাদরাসা, মসজিদ তৈরী করে দিবেন। কিন্তু আশা সেখানেই শেষ। অর্থ-সম্পদতো ছেলেদের হাতে।
আর ইদানীং ছেলেরা কাজে এতটা ব্যস্ত যে, পিতার খোঁজ-খবর নেয়ারও সময় নেই। আরমান ছাহেব শুধু অন্ধকার ঘরে বসে পাপ-পুণ্যের হিসাব কষেই সময় কাটান।
একদিন দুই ছেলের জোরালো কণ্ঠের আওয়ায পিতার কানে প্রবেশ করে। তাদের মাঝে দ্বন্দ্ব পিতাকে নিয়েই। সারমর্ম হ’ল-
হেলাল বলছে, দেখ বেলাল। বাবার শরীর খারাপ। কখন মারা যায় বলা যায় না। কবর দেয়ার কথা তো ভাবতে হবে। উত্তরায় তোর যে খালি জায়গা পড়ে আছে, সেখানে দেওয়া যায় বলে ভাবছি। কথার মাঝে বাধা দিয়ে বেলাল বলে, না, এটা সম্ভব নয়। গতকাল ইঞ্জিনিয়ারের সাথে কথা হয়েছে, ওখানে একটা ফ্ল্যাট তুলব। বরং বিশ্বাসপাড়ায় তোর জায়গা আছে, সে জায়গায় দাফনের চিন্তা করা যায়। না না, ওখানে আমার ভিন্ন পরিকল্পনা আছে। দু’ভাইয়ের মাঝে তর্ক ঝগড়ায় রূপ নিল। পরিশেষে তারা বলল, আমাদের আর কি দোষ বল, বাবা যদি গ্রামের সব জমি চাচাকে লিখে না দিত, তবে সেখানে বাবার কবরের ব্যবস্থা করা যেত।
আরমান ছাহেব ছেলেদের কথা শুনছেন আর নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। জীবনের এতটা বছর অতিক্রম করেছেন লোভ-লালসা আর অর্থের মোহে। কখনও পরকালের কথা ভাবেননি। অথচ ছোট ভাইকে ঠকিয়ে এত সম্পদ দখল করার পরও সাড়ে তিন হাত জায়গা তার ভাগ্যে জুটছে না। হায়রে নিয়তি, হায়রে জীবন, হায়রে সাড়ে তিন হাত জমি। আজ সবাই আমার পর।
শিক্ষা : অন্যকে ঠকানোর পরিণতি কখনো ভাল হয় না।