আল্লাহ যা করেন, বান্দার মঙ্গলের জন্য করেন
প্রাচীন কালে পারস্যে এক বদমেযাযী রাজা ছিলেন। একদিন চেরী কাটতে গিয়ে তাঁর হাতের আঙ্গুলের ডগা কেটে গেল। প্রচুর রক্তক্ষরণে রাজা শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। উযীরে আ‘যম সংবাদ পেয়ে রাজাকে দেখতে গেলেন। উযীরে আ‘যম ছিলেন খুবই ধর্মপরায়ণ। রাজার এ অবস্থা দেখে তিনি বললেন, ‘ইন্না লিল্লা-হ; আল্লাহ যা করেন বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন’। এতে রাজা উযীরের প্রতি খুবই অসন্তুষ্ট হ’লেন। ভাবলেন, ভীষণ ব্যথা ও প্রচুর রক্তক্ষরণে আমি শয্যাশায়ী, আর সে বলে ‘আল্লাহ যা করেন বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন’। বেটাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। কিন্তু রাজ্যের অধিকাংশ প্রজা উযীরের ধর্মপরায়ণতায় মুগ্ধ ছিল। তাই সরাসরি তাঁকে শাস্তি দিলে ব্যাপারটা অন্যদিকে মোড় নিতে পারে ভেবে রাজা মনে মনে অন্য ফন্দি অাঁটলেন।
রাজা সুস্থ হয়ে মন্ত্রী পরিষদের সাথে পরামর্শ করে একদিন শিকারে বের হ’লেন। সাথে উযীরে আ‘যমকেও নিলেন। গভীর অরণ্যে প্রবেশ করে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী উযীরে আ‘যমকে এক অন্ধকার কূপে ফেলে দিয়ে তাঁরা শিকারে মনোনিবেশ করলেন। অতঃপর রাজা এক মায়া হরিণের মায়ায় পড়ে হরিণটি শিকার করার জন্য ঘোড়া নিয়ে ছুটলেন। রাজার ঘোড়া এমন দ্রুত দৌড়াচ্ছিল যে, সাথীরা তাঁকে অনুসরণ করতে পারছিল না। দৌড়াতে দৌড়াতে রাজা রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করে অন্য রাজ্যে ঢুকে পড়লেন। এদিকে ঐ রাজ্যের রাজার খুবই প্রিয় একটি ঘোড়া ছিল। কয়েকদিন আগে জনৈক চোর ঘোড়াটি চুরি করে পারসিক এই রাজার নিকট বহুমূল্যে বিক্রি করেছিল। আর সেই ঘোড়াটি নিয়েই পারস্যের রাজা শিকারে বের হয়েছিলেন। এদিকে ঐ রাজার সৈন্যবাহিনীও ঘোড়ায় সওয়ার রাজাকে চিনতে পেরে তাকে বনদী করে কয়েদখানায় প্রেরণ করে।
ঐ দেশের রাজা ছিল প্রতিমা পূজারী। সেদেশের প্রথা ছিল প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে সুদর্শন, সুঠামদেহী, নিখুঁত একজন লোককে তাদের দেবতার নামে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বলি’ দেয়া। অধিকাংশ সময় সে লোক সরবরাহ করা হ’ত কয়েদখানা হ’তে। আর এ সময়টি ছিল তাদের সেই বলি অনুষ্ঠানের সময়। তাই সুদর্শন, সুঠামদেহী কয়েদী রাজাকে মনোনীত করা হ’ল ‘বলি’ দেয়ার জন্য। নির্দিষ্ট সময়ে কয়েদী রাজাকে বলির মঞ্চে হাযির করা হ’লে সেদেশের রাজা কয়েদীর সারা শরীর অনুসন্ধান করতে লাগলেন কোন খুঁত আছে কি-না তা দেখার জন্য। অতঃপর কয়েদীর হাতের আঙ্গুল কাটার দাগ দেখতে পেয়ে রাজা বললেন, এটা বলি দেয়ার উপযু্ক্ত নয়। অন্য একজনকে খুঁজে আন।
এমন সময় কয়েদী (পারস্যের রাজা) বললেন, উযীরের কথাই সত্যি হ’ল, ‘আল্লাহ যা করেন বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন’। এ কথা শুনে ঐ দেশের রাজা জিজ্ঞেস করল, কি বললে তুমি? একথার মর্মার্থ কি? তখন পারস্যের রাজা তাঁর পরিচয়সহ সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। কয়েদীর পরিচয় ও ঘটনা শুনে সে দেশের রাজা লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে বললেন, ‘আপনার উযীর ঠিকই বলেছে’। অতঃপর সসম্মানে পারস্যের রাজাকে মুক্তি দেয়া হ’ল এবং ঘোড়াটিও তাঁকে উপহার দেয়া হ’ল।
মুক্তি পেয়ে পারস্যের রাজা রাজ্যে ফিরে এসে প্রথমেই উযীরে আ‘যমের খোঁজে সেই অন্ধকার কূপের নিকট গিয়ে দেখলেন, উযীর এখনও বেঁচে আছে এবং পাশেই বসবাস করছে। রাজা উযীরে আ‘যমকে আবেগে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি তোমাকে ভুল বুঝে তোমার প্রতি অন্যায় করেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও ভাই। তুমি সত্যিই বলেছিলে, আল্লাহ যা করেন বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন’। যদি আমার আঙ্গুলে কাটার দাগ না থাকত তবে আজ আমি মৃত্যুর রাজ্যে চলে যেতাম’। তখন উযীরে আ‘যম বললেন, আপনার দেয়া শাস্তিকে আমি হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছিলাম এজন্য যে, আমি বিশ্বাস করি ‘আল্লাহ যা করেন বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন’। ভেবে দেখুন, আপনি যদি আমাকে কূপের মধ্যে না ফেলতেন তবে আমি কিছুতেই আপনার পিছু ছাড়তাম না। ফলে সে দেশের সৈন্যবাহিনীর হাতে আপনার সাথে আমিও বন্দী হ’তাম এবং আমাকেই তাদের প্রথানুযায়ী ‘বলি’ দেয়া হ’ত। কারণ আমার শরীরে কোন খুঁত নেই।
শিক্ষা : সকল বিপদ-আপদ ও বালা-মুছীবতে আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে ধৈর্যের সাথে বিপদ-মুছীবতকে হাসিমুখে বরণ করে নিতে হবে এবং সর্বদা বিশ্বাস রাখতে হবে যে, ‘আল্লাহ যা করেন বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন’।