প্রত্যেক বস্ত্ত তার মূলের দিকেই ফিরে যায়
আরবের কোন এক পাহাড়ী অঞ্চলে একদল দস্যু একটি পাহাড়ের শীর্ষদেশে বসবাস করত। কোন কাফেলা ঐ পথে যাত্রা করলেই তারা তাদের উপর চড়াও হ’ত। লুট করে নিত তাদের সমুদয় সম্পদ। আক্রমণ করত পথচারীদের উপর। এদের ভয়ে শহরের জনসাধারণ সর্বদা তটস্থ থাকত। কারণ তারা পর্বতশৃঙ্গে নিরাপদ আশ্রয় বানিয়েছিল। আর এজন্যই রাজার সেনাবাহিনীও এদের সঙ্গে পেরে উঠছিল না। ঐ অঞ্চলীয় রাষ্ট্র প্রশাসন দস্যুদের কবল থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য পরামর্শ করল। কেউ কেউ বলল, দস্যুদল এভাবে যদি আর কিছুকাল অবস্থান করে তবে এদের সঙ্গে যুদ্ধ করাও অসম্ভব হয়ে পড়বে।
কবি বলেন,
‘যে বৃক্ষ সবেমাত্র গেড়েছে শিকড়
উপড়াতে পারবে কেহ দিয়ে স্বল্প জোর।
ঐ অবস্থায় রাখে যদি আর কিছুকাল
জন্মেও পারবে না তুলতে, হবে বিফল।
অল্প পানির গতি বন্ধ কর থোড়া চীযে
পূর্ণ জোরে চললে হস্তিও ভেসে যাবে নিজে’।
অতঃপর পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের অনুসন্ধান করার জন্য একজন গুপ্তচর ঠিক করা হ’ল। যে সব সময় তাদের দিকে নযর রাখত। একদা দস্যুদল কোন এক কাফেলার উপর আক্রমণ করতে গেলে তাদের আস্তানা সম্পূর্ণ খালি হয়ে যায়। এ সংবাদ অবহিত হয়ে যুদ্ধে পারদর্শী কয়েকজন বীরপুরুষকে তথায় পাঠানো হয়। তারা পাহাড়ের বিভিন্ন গুহায় আত্মগোপন করে ওঁৎ পেতে থাকে। গভীর রাতে দস্যুদল লুট করে মালামাল নিয়ে ফিরে এসে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে। আর এ নিন্দ্রাই হয় তাদের কাল।
যখন রাত্রি আরো গভীর হ’ল। দস্যুদলও ঘুমে বিভোর। তখন বীর সিপাহীগণ তাদের গুপ্তঘাঁটি আক্রমণ করল এবং এক এক করে সকল দস্যুর হস্ত কাঁধে বেঁধে ফেলল। সকাল বেলা তাদের সবাইকে রাজদরবারে উপস্থিত করা হ’ল। রাজা বিনাদ্বিধায় তাদের মৃত্যুদন্ডের নির্দেশ দিলেন।
দেখা গেল তাদের মধ্যে একজন সুন্দর যুবক রয়েছে, যে কেবলমাত্র নব যৌবনে পদার্পণ করেছে। তার গন্ডদেশ কানন কেবলমাত্র নতুন সবুজ মেলায় ভরে উঠেছে। জনৈক মন্ত্রী উক্ত যুবকের জন্য সুফারিশ করে বললেন, হে সম্রাট! এই সুন্দর ছেলেটি তার জীবন কানন হ’তে এখনও কোনরূপ ফল ভোগ করেনি। তার নব যৌবন হ’তে উপকৃত হয়নি। সম্রাটের উন্নত স্বভাব ও দানশীলতায় আমি আশাবাদী, অনুগ্রহ করে তার খুন মাফ করে দিয়ে অধমের উপর অনুকম্পা করবেন। বাদশাহ মন্ত্রীর কথা শুনে বিমুখ হ’লেন এবং তাঁর রায়ের অনুকূল না হওয়ায় বললেন,
‘কু-জাত লভেনা কভু সুজনের শিক্ষা
গোলের উপর গোল যেন অযোগ্যের দীক্ষা’।
এদের বংশ-বুনিয়াদ নির্মূল করাই উত্তম। কেননা অগ্নি নির্বাপিত করে আংটা রাখা, সাপ মেরে উহার বাচ্চা পালন করার ন্যায়, যা জ্ঞানীদের কাজ নয়।
‘মেঘে যদি দেয় ঢেলে হায়াতের পানি
ঝাউ গাছে ফুল কভু পাবে নাকো জানি।
দুষ্টের সাথে কাল কর না ক্ষেপণ
নলখাগড়া হ’তে চিনি পাবে না কখন’।
মন্ত্রী বাদশার এসব কথা শ্রবণ করলেন। সুন্দর অভিমতের জন্য বাদশাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন এবং বললেন, বাদশাহ যা বলেছেন সম্পূর্ণ সত্য। তবে ছেলেটি এখনও ছোট। যদি সে ঐসব দস্যুদের শিক্ষা পেত তবে তাদের আচরণ গ্রহণ করতো এবং তাদের অন্তর্ভুক্ত হ’ত। অধম বান্দার অভিলাষ এই যে, সে সৎ লোকদের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। চরিত্রবান হবে। কারণ দস্যুদের সীমালঙ্ঘন ও বিদ্রোহী আচরণ এখনো হয়ত তার অন্তরে প্রোথিত হয়নি। হাদীছে বর্ণিত আছে, ‘প্রতিটি সন্তান ইসলামী ফিৎরাতের উপর জন্ম লাভ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী-নাছারা বা অগ্নিপূজক বানায়’। মন্ত্রী তার উক্তির পিছনে এই সব যুক্তি পেশ করলেন।
‘নূহ (আঃ) পুত্র যখন বদের সঙ্গী হ’ল
নবুঅতী বংশ তাঁর ধ্বংস হয়ে গেল।
গুহাবাসীদের কুকুর দেখ মাত্র কয়েকটি দিন
পুণ্যবানদের অনুসরণে হইল মানবাধীন’।
মন্ত্রী একথা বলার পর বাদশাহর নিকটজনদের মধ্য হ’তে আরো কিছু লোক মন্ত্রীর সাথে সুফারিশে শরীক হ’লেন। তখন বাদশা এই বলে তার খুন মাফ করে দিলেন যে, ক্ষমা করে দিলাম, কিন্তু ভাল মনে করলাম না।
‘জান না কি বলেছিল মহিলাটি বীর রোস্তমকে
নিরুপায় নিকৃষ্ট জান না কভু শত্রুকে।
বহু দেখেছি অল্প পানির স্বল্প স্রোতের টানে
প্রবল হ’লে উট বোঝা ভেসে গেছে বানে’।
অতঃপর মন্ত্রী তার দলবলসহ ছেলেটিকে মহাআনন্দ ও পুরস্কারের সাথে বের করে নিয়ে এলেন। তার শিক্ষার জন্য একজন উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ করা হ’ল। সুন্দর বক্তব্য, প্রশ্নের জবাব, বাদশাহর খেদমতে আদব ইত্যাদি বিষয় তাকে বিশেষভাবে শিক্ষা দেয়া হ’ল। সকলের দৃষ্টিতে ছেলেটি আদরের পাত্রে পরিণত হ’ল। একদা মন্ত্রী বাদশাহর খেদমতে তার সৎ চরিত্র বিষয়ে বলতে গিয়ে বললেন, জাঁহাপনা! জ্ঞানীদের প্রশিক্ষণ তার মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং তার জন্মগত পুরাতন অজ্ঞতা বিদূরিত হয়েছে। বাদশাহ এটা শুনে মুচকি হেসে বললেন,
‘সিংহ শাবক পরিশেষে সিংহ হয়ে যায়
যদিও মানুষের সাথে বুযরগী সে পায়’।
দু’বৎসর এভাবেই কেটে গেল। ইতিমধ্যেই মহল্লার একদল দুর্বৃত্ত তার সাথে মিলিত হয়ে বন্ধুত্বের বন্ধন এঁটে নিল। তাদের প্ররোচনায় ছেলেটি বাপ-চাচাদের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে সংকল্পবদ্ধ হ’ল। একদা সুযোগ বুঝে মন্ত্রী ও তার দুই পুত্রকে হত্যা করল এবং বহু সম্পদ লুটে নিয়ে সেই পুরাতন পর্বত গুহায় গিয়ে পিতার স্থলাভিষিক্ত হ’ল। এ সংবাদ পেয়ে বাদশাহ পরিতাপের সাথে দাঁত দিয়ে আঙ্গুল কামড়াতে কামড়াতে বললেন,
‘কাঁচা লোহায় পাকা অস্ত্র বানায়না কেউ কভু
অমানুষকে শিক্ষা দিলেই হয়না মানব তবু
পাক বৃষ্টির পানিতে ভাই নাইকো কোন নাশ
ফুল বাগানে ফুল ফোটে আর পতিত যমীনে ঘাস’।
..................
‘কু-লোকের ভাল করা জানিবে কেমন
সু-লোকের মন্দ করার পরিণাম যেমন’।
শিক্ষা : ইল্লত যায় না ধুলে, আর খাছলত যায় না মলে।