একজন পরোপকারী অফিস প্রধান
আব্দুল হালীমের স্ত্রী রাবেয়া একজন বিদুষী, পতিপরায়ণা এবং অন্যান্য সদগুণে গুণান্বিতা নারী। আব্দুল হালীমও একজন চরিত্রবান যুবক। সে যে অফিসে কাজ করে সে অফিসের অন্যান্য ব্যক্তি ও কর্মচারীরাও সৎ এবং মানবদরদী। কর্তব্যে তাকে কোন দিন অবহেলা করতে দেখা যায় না। এজন্য অফিস প্রধান তার প্রতি অতি প্রসন্ন।
আব্দুল হালীমের বিবাহিত জীবনের ছ’বছর পর তাদের ঘরে ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে। ফলে তাদের নিরাশার জীবনে আশার সঞ্চার হয়।
সদা প্রফুল্ল এবং কাজে একনিষ্ঠ আব্দুল হালীমকে সন্তান লাভের পর আর পূর্বের মতো দেখা যায় না। তার হাসিমুখে বিষাদের ছায়া বিরাজমান। সে যেন বড় রকমের কোন এক দুর্বিষহ যন্ত্রণায় ভুগছে। সে সত্যি সত্যি একটি যন্ত্রণার শিকার। তার সন্তানটি হার্টে একটি ছিদ্র নিয়ে জন্মেছে। ফলে সে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে না। হার্ট অপারেশন ছাড়া এর কোন বিকল্প নেই। আর এ কাজে অন্ততঃ ৩/৪ লাখ টাকা প্রয়োজন। এ অপারেশন দেশেও হবে না। এতো টাকা আব্দুল হালীমের নেই এবং এতো টাকার সম্পদও নেই। তাই তার মুখমন্ডলে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ।
স্ত্রী রাবেয়া এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, এতো টাকা সংগ্রহ করা তাদের সামর্থ্যের বাইরে। তাই চিকিৎসার অভাবে তাদের বহুদিনের প্রত্যাশিত ধনকে ধুকে ধুকে তার চোখের সামনে মৃত্যুবরণ করতে হবে ভেবে সে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেয়।
আব্দুল হালীমের বোন তাসনীম ভাইয়ের বাসায় থেকে লেখাপড়া করে। ভাইয়ের আশা বোন উচ্চশিক্ষিতা হ’লে তাকে একজন ভাল পাত্রের হাতে তুলে দিবে। তাসনীম শিশুটির অবস্থা প্রত্যহ প্রত্যক্ষ করছে। তাই সে একদিন ভাবীকে ডেকে বলল, ‘ভাবী, আমি আর পড়াশুনা করব না। বাড়ী চলে যাব’। হঠাৎ করে ভাবী তার এরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ‘আমি তোমাদের আর খরচ বাড়াতে চাই না। তোমরা আমার জন্য যে খরচ কর, তা বাঁচিয়ে শিশুটির চিকিৎসা করে তাকে সুস্থ করে তোল’।
ভাবী তাকে তার এ সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করতে বলে এবং বলে, ‘তুমি এ সিদ্ধান্ত তোমার ভাইকে কখনো বলো না। তাহলে তিনি দারুণ কষ্ট পাবেন। আমরা নিশ্চিত ধরে নিয়েছি, আমরা তাকে সুস্থ করে তুলতে পারব না। তার মৃত্যু অবধারিত। কারণ চিকিৎসার অত টাকা আমরা কোথায় পাব’?
রাবেয়ার শাশুড়ীর নামে কিছু সম্পত্তি আছে। নাতির চিকিৎসার জন্য তিনি তা বিক্রি করে দিতে চান। কিন্তু আব্দুল হালীম তাতে সম্মত নয়। কারণ সে সম্পত্তির উৎপন্ন ফসলে মাতা-পিতার কোনমতে দিন কাটে। তাছাড়া সে সম্পত্তি বিক্রি করেও চিকিৎসার পুরো খরচ জোগাড় হবে না।
একদিন অফিসের প্রধান কর্মকর্তা আব্দুল হালীমকে তাঁর কক্ষে ডেকে নিয়ে তার এ মানসিক পরিবর্তনের কারণ জিজ্ঞেস করেন। আব্দুল হালীম অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার সন্তানের বিষয়টি তাঁকে অবহিত করেন। তার বস তাকে বলেন, ‘আমরা সকলে মিলে তোমার সন্তানের চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্য করব এবং প্রয়োজনে ভিক্ষা চাইব। একটি নিষ্পাপ শিশুকে বাঁচিয়ে তুলতে পারি কিনা চেষ্টা করে দেখব। আব্দুল হালীম এতে আপত্তি করে। সে বলে, ‘আমার জন্য আপনি অন্যের কাছে হাত পাতবেন, এটা হ’তে পারে না। আমি আমার স্বার্থে আপনাকে এভাবে মানুষের কাছে ছোট হ’তে দিতে পারি না’।
প্রধান কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি যদি তোমার এ বিপদে আমার সামর্থ্য অনুযায়ী তোমার পাশে না দাঁড়াই, তাহ’লে এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। অতএব আমি তোমার কোন আপত্তি মানতে রাযী নই। একাজ আমার দায়িত্ব বলে মনে করি’।
একদিন বিকেলে অফিসের প্রধান কবীর ছাহেব আব্দুল হালীমের বাসায় এসে আব্দুল হালীমের সন্তানকে দেখলেন। তিনি শিশুর ফটোর একটি নেগেটিভ কপি নিয়ে চলে গেলেন। তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় শিশুটির ছবি ছাপিয়ে তার অসুখের বিবরণ দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে তুলতে সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে আবেদন জানালেন। এতে কাজ হ’ল।
আব্দুল হালীম শিশুর চিকিৎসার জন্য স্ত্রীসহ বিদেশ যাত্রা করতে বিমানবন্দরে উপস্থিত হ’লে তাদের বিদায় জানাতে আসলেন অফিসের প্রধান কবীর ছাহেব, সহকর্মী আবিদ হাসান এবং অন্যান্য দাতা ব্যক্তিরা। সবাই আল্লাহর কাছে শিশুটির আরোগ্য কামনা করে তাদের বিদায় জানালেন।
শিক্ষা : অসহায়-দুঃস্থ মানুষকে সাধ্যমত সহযোগিতা করা আমাদের প্রত্যেকেরই ইমানী ও নৈতিক দায়িত্ব।