যোগ্য পাত্র নির্বাচন
সুলতান ইবরাহীম বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়লেন তিনি। সুলতান বুঝতে পারলেন, তাঁর দিন ফুরিয়ে এসেছে। তাঁর চিন্তা যে, একমাত্র কন্যা জাহানারার এখনও বিয়ে হয়নি। রাজকন্যা সুন্দরী, তার বিয়ের বয়স হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেকেই তাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু তার যোগ্য বর আজও খুঁজে পাননি সুলতান। একদিন সুলতান কন্যা জাহানারাকে ডেকে বললেন, মা, এবার আমি তোমার বিয়ে দেব। রাজকন্যা বললেন, কিন্তু তুমি কিভাবে বর নির্বাচন করবে বাবা?
সুলতান বললেন, আমার কোন পুত্রসন্তাই নেই। তোমার স্বামীই হবে আমার এই রাজ্যের ভাবী সুলতান। যে ভালভাবে রাজ্য শাসন করতে পারবে এবং প্রজাপালন করতে পারবে আমি তার সঙ্গেই তোমার বিয়ে দেব।
রাজকন্যা বললেন, কিন্তু তুমি কিভাবে যোগ্য বরকে নির্বাচন করবে?
সুলতান বললেন, সে ব্যবস্থা আমি করব। আগে যারা রাজকন্যার বিয়ের জন্য এসেছিল, তাদের মধ্যে তিনজনকে যোগ্য বর হিসাবে মনে মনে বাছাই করেছিলেন সুলতান। তিনি একদিন দূত পাঠিয়ে তিনজন যুবরাজকে ডেকে আনলেন রাজসভায়। তিনজন যুবরাজই ছিলেন বয়সে যুবক এবং বীর। তাদের নাম ছিল খালিদ, যুবায়ের ও ছাবিত। তিনজনই ছিল দেখতে সুদর্শন এবং আচরণ ও কথা-বার্তায় ভদ্র।
রাজকন্যা বুঝে উঠতে পারল না, সে কিভাবে এই তিনজনের মধ্য থেকে একজনকে তার স্বামী হিসাবে বাছাই করবে। তাই সে তার বাবার উপর বর নির্বাচনের ভারটা ছেড়ে দিল।
যুবরাজ তিনজন সুলতানের সামনে হাযির হ’লে সুলতান বললেন, আমি তোমাদের ডেকে পাঠিয়েছি। কারণ, আমি এবার আমার কন্যাকে পাত্রস্থ করতে চাই।
যুবরাজ তিনজন হাসিমুখে মাথা নত করল।
সুলতান বললেন, তোমরা তিনজন আমার রাজ্য শাসনের উপযুক্ত। ভবিষ্যতে তোমরা সুলতান হ’তে পার। কিন্তু তোমাদের মধ্যে একজনের হাতে আমার কন্যাকে অর্পণ করতে হবে। তাই আমি তোমাদের তিনজনের মধ্যে একজনকে নির্বাচন করার জন্য একটি পরিকল্পনা করেছি। আজ পূর্ণিমা। আজই তোমাদের এক মাসের জন্য দেশ ভ্রমণে পাঠাতে চাই। আজ হ’তে ঠিক এক মাস পরে পূর্ণিমায় তোমরা সফর শেষে ফিরে আসবে এই রাজসভায়। তোমরা প্রত্যেকেই রাজকন্যার উপযুক্ত বিবেচনা করে সবচেয়ে মূল্যবান উপহার নিয়ে আসবে। সে উপহারের গুণাগুণ বিচার করেই তোমাদের যোগ্যতা নির্ণয় করা হবে। যুবরাজ তিনজন আশান্বিত হয়ে সেদিনই দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ল।
চোখের পলকে একটি মাস অতিবাহিত হয়ে গেল। পরের মাসে আবার পূর্ণিমা এল। পূর্ণিমার দিন সন্ধ্যায় আকাশে চাঁদ উঠতেই সুলতানের প্রাসাদ দ্বারে যুবরাজদের আগমন বার্তা ঘোষণা করা হ’ল। আলোকমালা ও ফুল দিয়ে সজ্জিত করা হ’ল সমস্ত প্রাসাদ।
সুলতান প্রথমে যুবরাজ খালিদকে ডেকে বললেন, তুমি আমার কন্যার জন্য কি উপহার এনেছ? যুবরাজ খালিদ নতজানু হয়ে একটি বড় থলে থেকে অনেক বড় বড় মূল্যবান জিনিস বের করল। তারপর সুলতানকে বলল, এগুলি সবচেয়ে দামী হীরা, মুক্তা, পান্না ও চুন্নি। এগুলি বিভিন্ন দেশ ঘুরে বাছাই করে এনেছি। এগুলি দিয়ে রাজকন্যার জন্য একটি মুকুট, গলার হার, হাতের বালা আর আংটি বানাতে চাই। হাসিমুখে খুশি হয়ে মাথা নত করল রাজকন্যা জাহানারা। কিন্তু সুলতান কোন কথা বললেন না।
এবার সুলতান যুবরাজ যুবায়েরকে ডেকে বললেন, তুমি কি উপহার এনেছ? যুবায়ের বলল, ‘আমি একটি বন্দুক এনেছি। এটি এক শক্তিশালী অস্ত্র। এই অস্ত্র দিয়ে অনায়াসে এবং অব্যর্থভাবে লোক মারা যায়। এই অস্ত্র কাছে থাকলে বাইরের কোন শত্রু ভয়ে পা দেবে না আপনার রাজ্যের ত্রিসীমানায়। আপনি এর দ্বারা অনেক দেশ জয় করতেও পারেন। আপনি হয়ে উঠতে পারেন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও বিজয়ী রাজা।
যুবরাজ যুবায়েরের কথা শুনে রাজকন্যা কেঁপে উঠলেন ভয়ে। সুলতান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নীরবে। কিন্তু রাজসভায় উপস্থিত লোকদের মুখগুলি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
এবার যুবরাজ ছাবিতকে ডাকলেন সুলতান। লজ্জাবনত মুখে সুলতানের সামনে খালি হাতে এসে দাঁড়াল যুবরাজ ছাবিত। সে বলল, ক্ষমা করবেন সুলতান, আমি রাজকন্যার জন্য কোন উপহার আনতে পারিনি।
সুলতান আশ্চর্য হয়ে বললেন, সে কি? কোন উপহারই আননি?
ছাবিত বলল, আমি রাজকন্যাকে বিয়ে করতে চাই। অথচ তার জন্য কোন উপহার না আনতে পারায় সত্যিই দুঃখিত। কিন্তু এই একটি মাস আমি কাজে এমনই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, কোন উপহার যোগাড় করার ফুরসৎ পাইনি।
একথার অর্থ বুঝতে না পেরে সুলতান বললেন, কি কাজে তুমি এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলে?
ছাবিত বলল, আমি আপনার রাজসভা থেকে বেরিয়ে দেশ ভ্রমণে যাবার সময় পথে এক মুমূর্ষু পথিককে দেখতে পাই। তার গা থেকে রক্ত ঝরছিল। সর্বাঙ্গ ছিল ক্ষত-বিক্ষত। আমি তা দেখে চলে যেতে পারলাম না। তার সেবা-শুশ্রুষা করলাম। তিনি সুস্থ হয়ে উঠলে দু-একদিন পর আবার পথ চলতে শুরু করলাম। কিন্তু কিছুদূর যেতেই দেখলাম, একদল নারী ও শিশু ভয়ার্ত অবস্থায় গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে। কারণ জিজ্ঞেস করে জানলাম, একদল জলদস্যু নদী পথে এসে তাদের গ্রাম লুণ্ঠন করেছে, গ্রামের বেশির ভাগ পুরুষকে হত্যা করেছে, তাদের ধন-সম্পদ সব ছিনিয়ে নিয়ে গেছে এবং আবার আসবে বলে ভয় দেখিয়ে গেছে। আমি তাদের বুঝিয়ে গ্রামে ফেরত নিয়ে গেলাম। দেখলাম গ্রামের অল্পসংখ্যক লোক যারা বেঁচে আছে তারা জলদস্যুদের সঙ্গে লড়াই করতে চায়। কিন্তু কোন যোগ্য নেতা না থাকায় মনোবল পাচ্ছে না। আমি সে সব নিঃস্ব অসহায় ও ভীত-সন্ত্রস্ত লোকদের ফেলে চলে আসতে পারলাম না। তাদের সশস্ত্র ও সংঘবদ্ধ করে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করলাম। জোর লড়াই করে জলদস্যুদের ঘায়েল করে গ্রাম থেকে চিরদিনের মত বিতাড়ন করলাম।
তারপরও অনেক কাজ ছিল। আহতদের চিকিৎসা, বিধবা ও শিশুদের পুনর্বাসন প্রভৃতি কাজগুলি সারতে আমার বেশ কিছুদিন দেরি হয়ে গেল। কাজের চাপে আমি উপহারের কথা, রাজকন্যার কথা সব ভুলে গেলাম। হঠাৎ একদিন আকাশে চাঁদ দেখে পূর্ণিমার কথা মনে পড়ে গেল। তাই ক্ষমা চাইতে এলাম। আমাকে ক্ষমা করবেন সুলতান।
যুবরাজ ছাবিতের কথা শুনতে শুনতে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন বৃদ্ধ সুলতান। তিনি যখন চোখ তুললেন তখন দেখা গেল, চোখের পানিতে ঝাপসা হয়ে গেছে তার দৃষ্টি। রাজকন্যার চোখও পানিতে ছলছল।
সুলতান যুবরাজ ছাবিতকে তার কাছে ডাকলেন। যুবরাজের একটি হাত ধরে হাসিমুখে বললেন, এই মহান যুবরাজ রাজকন্যার জন্য উপহার না নিয়ে এলেও এ হাতে ফুটে আছে জনসেবার অনেক অমূল্য নিদর্শন। আমি তারই হাতে তুলে দেব আমার কন্যাকে। এই মহানহৃদয় পরোপকারী যুবরাজই হবে আমার রাজ্যের উপযুক্ত শাসক।
শিক্ষা : অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতা-প্রভাব দেখে নয়, চরিত্রবান পাত্র দেখে কন্যাকে বিয়ে দিতে হবে।