বুদ্ধিমান বিচারক
আলজেরিয়ার এক বাদশাহর নাম বাওয়াকাস। তিনি স্থির করলেন, তাঁর দেশের বিচারকদের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন। তিনি শুনেছেন রাজধানীর বাইরে একজন বিজ্ঞ ন্যায়বিচারক আছেন। যিনি ন্যায়বিচার করতে কোন দ্বিধা করেন না। কোন দুষ্কৃতিকারীর কূটকৌশল কিংবা কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রভাব তাকে ন্যায়বিচার থেকে বিরত রাখতে পারে না। এ সংবাদের সত্যতা যাচাই করতে বাদশাহ ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে একটি ঘোড়ায় চড়ে সেদিকে রওনা হ’লেন। তাকে দেখে চেনার উপায় নেই যে, তিনি দেশের বাদশাহ। পথিমধ্যে এক খোঁড়া লোককে হাত তুলতে দেখে ঘোড়া থামালেন। লোকটি ভিক্ষা চাচ্ছে। তাকে কিছু টাকা দিয়ে বাদশাহ ঘোড়ায় চড়তে যাবেন ঠিক তখনি ঘটল বিপত্তি।
ভিক্ষুক বাদশাহর কাপড় টেনে ধরল। বাদশাহ তাজ্জব বনে গেলেন। তিনি বললেন, আর কি চাও তুমি? তোমাকে কি ভিক্ষা দেইনি? সে বলল, জি হ্যাঁ দিয়েছেন। কিন্তু আমার আরেকটি উপকার করুন! আমাকে ঘোড়ায় তুলে মাইল খানেক পথ এগিয়ে দিন। এমনিতে হাঁটতে পারি না, গাড়ি-ঘোড়ার নীচে পড়ে কখন যে চ্যাপ্টা হয়ে যাই তার ঠিক নেই! বাদশাহ বড়ই দয়ালু। তিনি ভিক্ষুককে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিলেন। মাইল খানেক যাবার পর ঘোড়া থামালেন। কিন্তু ভিক্ষুকের নামার কোন লক্ষণ না দেখে বললেন, নেমে পড়ো। ভিক্ষুক বলল, নামব কেন? এটাতো আমারই ঘোড়া। বদ মতলব ছেড়ে দাও, ব্যবসায়ী ভাই! নিজ ইচ্ছায় ঘোড়া না দিলে কোর্টে চলো। বাদশাহকে নিয়ে ভিক্ষুক কোর্টে হাযির হল।
দু’জনের যবানবন্দী শুনলেন বিচারক। রায় দিলেন ভিক্ষুকের পক্ষে। বাদশাহ হ’লেন ঘোড়া চোর। অগত্যা বাদশাহ ঘোড়াটি নিয়ে এলেন সেই ন্যায়বিচারকের দরবারে। অসংখ্য বিচারপ্রার্থী ও দর্শক-শ্রোতায় আদালত ঠাসা। তখন চলছিল অন্য একটি বিচার। একজন বুদ্ধিজীবি ও একজন কৃষককে দেখা গেল কাঠগড়ায় দন্ডায়মান। দু’জনই এক সুন্দরী মহিলার স্বামী বলে দাবী করছে। কৃষক বলল, ঐ মহিলা আমার বিবাহিতা স্ত্রী। বুদ্ধিজীবি বললেন, না সে আমার স্ত্রী। সুন্দরী মহিলাটি বোবা ও অশিক্ষিত। বিচারক পড়লেন ভীষণ সমস্যায়। তিনি কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, এই মহিলা আজ আমার কাছে থাকবে, আগামীকাল এর ফায়ছালা হবে। তারা চলে গেল।
কাঠগড়ায় উঠলো আরও দু’জন বিচারপ্রার্থী। একজন কসাই অন্যজন তেল বিক্রেতা। কসাইয়ের গায়ে ছিল রক্তমাখা পোশাক আর তেল বিক্রেতার গায়ে তেল চিটচিটে কাপড়। কসাইয়ের হাতে একটা টাকার থলে, আর তেল বিক্রেতা কসাইয়ের হাত শক্ত করে ধরে আছে। কসাই বলল, মাননীয় বিচারক! আমি এই লোকটির কাছ থেকে কিছু তেল কিনেছি, টাকা দেয়ার জন্য যেইনা এই থলেটি বের করেছি, অমনি এই তেল বিক্রেতা থলে সমেত টাকা ছিনতাই করার জন্য আমার হাত চেপে ধরেছে। তেল বিক্রেতা বলল, সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা মহামান্য বিচারক। আমার কাছ থেকে এ কসাই তেল নেয়ার জন্য এলে আমি তাকে এক টিন তেল দেই। সে একটা স্বর্ণমুদ্রা বের করে দেয়। তার ভাংতি চাইলে ভাংতি দেওয়ার জন্য এই থলে বের করে খুলি। তখন সে আমার হাত থেকে টাকার থলেটি নিয়ে দৌড় দেয়। ভাগ্যক্রমে আমি তাকে ধরতে পেরেছি। এর বিচার করুন। বিজ্ঞ বিচারক একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, টাকার থলে আমার কাছে রেখে যাও। আগামীকাল রায় হবে।
এবার বিচারক ব্যবসায়ী ও ভিক্ষুকের অভিযোগ শুনতে চাইলেন। যা কিছু ঘটেছে ব্যবসায়ী তার সবই বিচারককে বলল। ভিক্ষুক বলল, আমি খোঁড়া মানুষ। ঘোড়ায় চড়ে এদিক-সেদিক চলাফেরা করি। এই ব্যবসায়ী আমার ঘোড়া ছিনতাই করার মতলবে আমাকে পথিমধ্যে থামিয়ে দেয়। ঘোড়ায় চড়ে এখন উল্টো ওটা নিজের বলে দাবী করছে। একটু চিন্তা করে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বিচারক বললেন, ঘোড়া আমার কাছে রেখে চলে যাও, কাল বিচার হবে।
চাঞ্চল্যকর এই মামলা তিনটির রায় শুনার জন্য পরদিন অসংখ্য লোক আদালতের সামনে ভিড় জমাল। যখন বিচারক হাতুড়ি পেটালেন, তখন উৎসুক লোকের ফিসফিস শব্দ থেমে গেল। যথারীতি ডাক পড়ল সেই মহিলার স্বামী দাবীদার বুদ্ধিজীবি এবং কৃষকের। বিচারক রায় ঘোষণা করলেন। মহিলার প্রকৃত স্বামী হচ্ছে বুদ্ধিজীবি। প্রতারক কৃষককে ৫০ ঘা বেত মারার হুকুম দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে রায় কার্যকর করা হ’ল। এবার এল কসাই আর তেল বিক্রেতার পালা। দু’জনেই কাঠগড়ায় হাযির। বিচারক আদেশ দিলেন টাকার থলেটি কসাইকে দেয়া হোক। আর ছিনতাইয়ের চেষ্টা করায় তেল বিক্রেতাকে মারা হোক ৫০টি বেত্রাঘাত। সবশেষে ডাক পড়ল ব্যবসায়ী ও ভিক্ষুকের। বিচারক ব্যবসায়ীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি কি আর বিশটি ঘোড়ার মধ্য থেকে তোমারটি আলাদা করতে পারবে? ব্যবসায়ী বলল, জি হ্যাঁ পারব। একই কথা বিচারক ভিক্ষুককে জিজ্ঞেস করলে সে আরও অধিক জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই পারব। ব্যবসায়ীকে সাথে নিয়ে বিচারক ঘোড়ার আস্তাবলে ঢুকলেন। সত্যি সত্যি ব্যবসায়ী ঘোড়া শনাক্ত করল।
এবার ভিক্ষুকের পালা। সেও ২০টি ঘোড়ার মধ্যে ঐ নির্দিষ্ট ঘোড়াটি চিনে ফেলল এবং হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল। বিচারক এজলাসে এসে বসলেন। রায় শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে জনতা। দৃপ্তকণ্ঠে রায় দিলেন বিচারক, ঘোড়া এই ব্যবসায়ীকে দেয়া হোক এবং ভিক্ষুককে ৫০ ঘা বেত মারা হোক। যথারীতি তাই হ’ল।
সেদিনের মত বিচার শেষ হ’ল। আদালত মুলতবি করা হ’ল। বিচারক বাসায় রওয়ানা হ’লেন। ব্যবসায়ীকে পিছু পিছু অনুসরণ করতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? আপনি কি আমার বিচারে সন্তুষ্ট হ’তে পারেননি? ব্যবসায়ী বলল, আমি খুবই সন্তুষ্ট হয়েছি। কিন্তু দয়া করে একটু বলবেন কি, কেমন করে বুঝতে পারলেন যে, ঐ বুদ্ধিজীবিই মহিলার স্বামী, কৃষক নয়? টাকাগুলো কসাইয়ের, তেল বিক্রেতার নয়? ঘোড়াটি আমার, ভিক্ষুকের নয়? বিচারক বললেন, আমি মহিলাকে কলমে কালি ঢুকাতে দিয়েছিলাম। মহিলা তৎক্ষণাৎ কলমটি পরিষ্কার করে দক্ষ হাতে দ্রুত কালি ভরে দিল। অবশ্যই একাজে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। কৃষকের স্ত্রী হ’লে তা সম্ভব হ’ত না।
আমি টাকাগুলো শনাক্ত করেছি এভাবে যে, একটি পাত্রে পানি ভর্তি করে তাতে টাকা ভিজিয়ে রেখে সতর্কভাবে খেয়াল করছিলাম, পানির উপর তেলের আস্তরণ পড়ে কি-না। তেল বিক্রেতার টাকা হ’লে হাতে নাড়া-চাড়ার কারণে কিছু তেল টাকায় লেগে থাকত। আর টাকা পানিতে ভিজিয়ে রাখায় তেল পানিতে ভেসে উঠত। কিন্তু তা হয়নি। অতএব কসাই সত্য বলেছিল। কিন্তু ঘোড়ার পাল থেকে ঘোড়া শনাক্তকরণ ছিল জটিল কাজ। আপনারা দু’জনই দক্ষ। ঘোড়া চিনতে পেরেছিলেন বটে, কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি ঘোড়া কাকে চেনে। আপনি ঘোড়ার কাছে যাওয়া মাত্রই ঘোড়াটি মাথা ঘুরিয়ে আপনার দিকে এলো। কিন্তু ভিক্ষুক ঘোড়াটি স্পর্শ করার সাথে সাথে পা উঠাল। সুতরাং বুঝতে পারলাম, ঘোড়ার মালিক কে হ’তে পারে।
ব্যবসায়ী এবার নিজের আসল পরিচয় প্রকাশ করলেন। আমি আসলে ব্যবসায়ী নই, আলজেরিয়ার বাদশাহ বাওয়াকাস। দুর্নীতি আর আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কথা শুনে আমার কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। আরো শুনেছি, দেশে সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা নেই। তাই দেশের প্রকৃত অবস্থা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ছদ্মবেশে বের হয়েছি। কে বলে দেশে সুষ্ঠু বিচার উঠে গেছে?
আপনার মত একজন মহান ন্যায়বিচারককে আমি স্বচক্ষে দেখলাম। আজ আপনি কি চান? যা খুশি চাইতে পারেন। আপনাকে পুরস্কৃত করব। আবেগে আপ্লুত হয়ে বিচারক বললেন, আমার কোন পুরস্কারের প্রয়োজন নেই জাঁহাপনা, কেবল দো‘আ করবেন। কিছুদিন পর বাদশাহ বাওয়াকাস প্রধান বিচারপতি হিসাবে তাকে নিয়োগ দান করলেন। বিচারব্যবস্থা আরো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হ’ল। দেশে প্রতিষ্ঠিত হ’ল আইনের শাসন। ফিরে এলো শান্তি-খৃঙ্খলা।
শিক্ষা : ন্যায়বিচারের জন্য দূরদৃষ্টি ও বিচক্ষণতা অত্যন্ত যরূরী। একজন সৎ ও বিচক্ষণ বিচারপতির মাধ্যমে সমাজের শত অপরাধ দূরীভূত হয় এবং সমাজে শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হয়।