অকৃতজ্ঞের পরিণাম
বিশাল এক বন। সে বনের পাশেই ছিল ছোট্ট একটি গ্রাম। সে গ্রামে বাস করত এক গরীব কাঠুরে। সে বন থেকে কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করে চাল-ডাল কিনে বাড়ী ফিরত। এভাবেই দু’বেলা খেয়ে আবার কখনও উপোস থেকে তাদের দিন চলত। গরীব কাঠুরে ও তার পরিবারের লোকেরা ছিল খুবই ধার্মিক। তারা কখনও ছালাত-ছিয়াম কাযা করত না। দু’বেলা খেয়ে আবার কখনও উপোস থেকেও তারা কখনও নিজেদেরকে অসুখী মনে করত না। প্রতিদিনের ন্যায় সেদিনও কাঠুরে বনে কাঠ কাটতে গেল। কিন্তু বনের মধ্যে ঢুকে নিকটে কোথাও কাটার উপযোগী কোন কাঠ পেল না। ফলে মাইল খানেক হেঁটে বনের গভীরে গিয়ে সেখানে বেশ কাঠ পেল। তা কেটে নিয়ে গ্রামের বাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করল। কিছু দূর এগোতেই ভীষণ এক গর্জন শুনতে পেল। ভয়ে কাঠুরের বুক হিম হয়ে গেল। কারণ একটা নদী এই বনকে দ্বি-খন্ডিত করেছে। আর নদীর ওপারে রয়েছে অনেক বাঘ। অনেক সময় বাঘ নদী পার হয়ে এসে কাঠুরে ও শিকারীদের ওপর হামলা করে।
কাঠুরে শব্দটি পুনরায় শুনতে পেল। কিন্তু তার নিকট শব্দটি বড় করুণ বলে মনে হ’ল। সে লক্ষ্য করল, তার বাম পাশে গজ পনের দূরে ছোটখাট একটি ঝোপ-ঝাড়ের আড়াল থেকে শব্দটি আসছে। কাঠুরে মাথার বোঝা মাটিতে রেখে কুঠারটি সামনে বাগিয়ে এগিয়ে চলল। অতঃপর ঝোপের নিকটে পৌঁছে দেখল বিশাল একটা শিয়াল ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় পড়ে সেখানে কাতরাচ্ছে। শিয়ালটিকে দেখে কাঠুরের বড় মায়া হ’ল। সে কিছু ওষধি গাছের ছাল ও পাতা বেটে তার ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দিল এবং তার সামনে কিছু খাবার রেখে চলে আসল। পরের দিন আবার কাঠুরে বনে গেল। কিন্তু সেদিন সে শিয়ালটিকে কোথাও দেখতে পেল না।
মাস খানেক পরে একদিন সকাল বেলা কাঠুরে বনে গেল। কিন্তু এদিন বনের অনেক ভিতরে গিয়েও কাটার উপযোগী কোন কাঠ পেল না। তাই বনের গভীরে এসে যা পেল তা নিয়ে গ্রামের বাজারের দিকে এগিয়ে চলল। হঠাৎ তার সামনে বড় একটি ছোরা হাতে উপস্থিত হ’ল এক বনদস্যু।
এই বনদস্যু পাশের গ্রামে বাস করে। একদিন অসুস্থ অবস্থায় সে বনের মাঝে বেহুঁশ হয়ে পড়ে ছিল। কাঠুরে তাকে তার বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে সেবা-যত্ন করে। সুস্থ হয়ে সে কাঠুরের বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় তাদের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস চুরি করে নিয়ে যায়। ফলে গরীব কাঠুরে গ্রামের সর্দারের নিকট বিচার প্রার্থনা করে। সর্দার তাকে বলল, কাঠুরে তোমাকে অসুস্থ অবস্থায় পেয়ে সেবা করে তোমার অনেক বড় উপকার করেছে। আর তুমি উপকারীর অপকার করে ভীষণ অপরাধ করেছ। তাই তোমার শাস্তি হওয়া আবশ্যক। সর্দারের হুকুমে তার একটি হাত কেটে নেওয়া হয়। সেদিন থেকেই সে কাঠুরেকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করে এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। এদিন যেহেতু কাঠুরে বনের গভীরে এসেছে, এখানে তাকে মারলে সবাই মনে করবে কাঠুরেকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। তাই সে সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না। কাঠুরেকে বলল, কাঠুরে! তুই তোর মৃত্যুর জন্য প্রস্ত্তত হয়ে নে। তোকে আজ আমার হাতে মরতেই হবে। সে কাঠুরেকে কথাগুলি বলছে আর ছুরি বাগিয়ে সামনের দিকে এক পা দুই পা করে এগিয়ে আসছে। কাঠুরেও এক পা দুই পা করে পিছাচ্ছে। এমন বিপদের সময়ও কাঠুরে সাহস হারাল না। কাঠুরে বলল, দস্যু! আল্লাহ যদি না চান তবে তুই কেন পৃথিবীর কেউ আমাকে হত্যা করতে পারবে না। একথা শুনে সে উচ্চৈঃস্বরে ক্রূর হাসি হেসে উঠে বলল, আজ তোকে আমার হাত থেকে তোর আল্লাহও বাঁচাতে পারবে না (নাঊযুবিল্লাহ)। কাঠুরে মনে মনে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতে লাগল। পিছাতে পিছাতে কাঠুরের পিঠ একটি গাছের সাথে লেগে গেল। দস্যুও কাঠুরেকে মারার জন্য ছুরি তাক করল। এমন সময় হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে বিদ্যুৎ গতিতে একটি শিয়াল ঐ দস্যুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই সাথে আরো পাঁচ-ছ’টি শিয়াল তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কাঠুরে লক্ষ্য করল, প্রথম যে শিয়ালটি ঐ দস্যুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সেটি ঐ শিয়াল, কাঠুরে যার সেবা করেছিল। অতঃপর কাঠুরে আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল এবং মনে মনে বলল, অকৃতজ্ঞের পরিণাম আল্লাহ এমনই করেন।
শিক্ষা : আল্লাহর হাতেই সকল কিছুর ক্ষমতা। আল্লাহ কারো ক্ষতি করতে চাইলে এমন কেউ নেই যে তার উপকার করতে পারে। আবার আল্লাহ কারো উপকার করতে চাইলেও পৃথিবীর কোন শক্তি তার সামান্যতম ক্ষতি সাধন করতে পারে না (আন‘আম ১৭-১৮; তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৩০২)। কাজেই সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং বান্দার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া অপরিহার্য। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, তবে তোমাদেরকে অধিক দান করব’ (ইবরাহীম ৭)।