পীরভক্তি
জনৈক পীর পীরগিরিতে যদিও সফলকাম হয়েছিলেন, তথাপি তাঁর ছেলেকে ঐ বিদ্যায় পারদর্শী না করে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে ইচ্ছুক হলেন। এসএসসি পাশের পর ছেলেকে কলেজে ভর্তি করে দিলেন এবং তাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। অতঃপর কিছুদিন পর তিনি মারা গেলেন।
ছেলের নাম আব্দুল্লাহ। ছেলের আইএ ফাইনাল পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এলো। পিতার আর্থিক অবস্থা মোটেও ভাল ছিল না। পীরগিরি করেই তিনি সংসার চালাতেন। পিতার মৃত্যুতে ছেলে আর্থিক দিক দিয়ে চরম ক্ষতির মধ্যে পড়ল। কিন্তু পড়াশুনা ত্যাগ করল না। পরীক্ষার ফী বাবদ শ্বশুরের নিকট থেকে টাকা পাবার প্রত্যাশায় সে একদিন শ্বশুর বাড়ীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। মাঝ পথে তার পিতার অনেক মুরীদ রয়েছে। ক্বাসেম গোলদার নামে এক বুড়ো অবস্থাপন্ন মুরীদের বাড়ীতে ঠিক দুপুরে আব্দুল্লাহ ক্লান্ত-ঘর্মাক্ত হয়ে উঠল। উদ্দেশ্য এখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে পুনরায় যাত্রা করা।
বুড়ো ক্বাসেম গোলদার আব্দুল্লাহকে দেখতে পেয়েই ব্যস্ত হয়ে তার কদমবুসি করার জন্য অগ্রসর হ’ল। পথ চলতে চলতে হঠাৎ সাপ দেখে মানুষ যেভাবে আঁতকে উঠে এক পাশে সরে দাঁড়ায়, ঠিক তেমনিভাবে আব্দুল্লাহ সরে দাঁড়াল। ক্বাসেম গোলদারের মনে হ’ল, অল্পের জন্য জান্নাতের দুয়ারের চাবি তার হাতের কাছ থেকে সরে গেল। সে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলল, ‘আমাদেরকে কি পায়ে ঠেললেন হুযূর?’ আব্দুল্লাহ জবাব দিল, ‘আপনি আমার মুরুববী, তাই আমারই উচিত আপনার কদমবুসি করা’। শুনে ক্বাসেম গোলদার তওবা তওবা বলতে লাগল এবং বলল, ‘আমাদেরকে আর গোনাহগার করবেন না হুযূর। আপনি যে বংশে জন্মেছেন, সে বংশের একজন বালকের পদধূলি পেলেও আমাদের জান্নাতের পথ খোলাসা হয়ে যায়’।
প্রসংগ পাল্টানোর জন্য আব্দুল্লাহ বলল, ‘দেখুন! আমি খুবই ক্লান্ত। আগে আমার একটু বিশ্রামের দরকার’। তখন বুড়ো ক্বাসেম গোলদার পানি নিয়ে আনো, পাখা আনো ইত্যাদি বলে হাকডাক শুরু করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ওযূর পানি এলো, পাখাও আনা হ’ল। ওযূর পর একটি সুন্দর ঘরে আব্দুল্লাহকে বসিয়ে পাখা দিয়ে বাতাস করতে লোক নিয়োজিত হ’ল। উপস্থিত মোরগের গোশত দিয়ে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা হ’ল। কিন্তু রাতের জন্য একটি খাসী জবাই করা হ’ল এবং গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরও দাওয়াত করা হ’ল। গ্রামবাসী সকলে আব্দুল্লাহর পিতার মুরীদ। পিতার অবর্তমানে আব্দুল্লাহ্ই তার স্থলাভিষিক্ত। অন্ততঃ মুরীদগণ আব্দুল্লাহ্কে মনে মনে সেই আসনে বসিয়েছে।
রাতের খাওয়া-দাওয়া বেশ সুন্দরভাবেই সম্পন্ন হ’ল। ক্বাসেম গোলদার আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনায় বসল। আব্দুল্লাহকে লক্ষ্য করে ক্বাসেম বলল, হুযূর আপনাদের পূর্বপুরুষ সুদূর আরব থেকে মাছের পীঠে চড়ে এদেশে এসেছিলেন। তাই তাকে ‘মাহী সওয়ার’ বলা হ’ত। তাঁর কেরামতির কথা লোকের মুখে মুখে। নদীতে নৌকা ডুবে গেলে তিনি বৈঠকখানায় বসে থেকে তা টেনে তুলতেন। ফলে তার আস্তীন ভিজে যেত। হাতে কিছু খাবার নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ‘আও আও’ করলে লক্ষ লক্ষ কবুতর এসে জমা হ’ত। তিনি সেগুলিকে ঐভাবে খাওয়াতেন। আব্দুল্লাহ অতি মনোযোগ সহকারে বৃদ্ধ ভক্তের কথাগুলি শুনছিল।
এক সময় ক্বাসেম বলল, হুযূর! আপনাদের বংশে সবাই কামেল পীর হয়েই জন্মায়। এক পীর নিজ হাতে একটি কাঁঠাল গাছ রোপণ করে সেবা-যত্নে সেটি বড় করেছেন। গাছে প্রথমবার মাত্র একটি কাঁঠালই ধরেছে। পীর মনে মনে স্থির করেছেন, কাঁঠালটি তিনি খাবেন। তার অনুপস্থিতির সুযোগে তার এক নাবালক ছেলে কাঁঠালটি খেয়ে ফেলে। বাড়ী এসেই তিনি কাঁঠালের খোঁজে যান। দেখেন, গাছে কাঁঠাল নেই। তিনি খুব রাগান্বিত হয়ে যান। ফলে কেউ বলে না, কাঁঠাল কে খেয়েছে। ঐ নাবালক ছেলের বিমাতার কাছ থেকে পীর জানতে পারলেন, কাঁঠালটি কে খেয়েছে। পীর ছেলেকে ডাকলেন। ছেলে এলে পিতা বললেন, ‘তুমি কাঁঠাল খেয়েছ কেন?’ ছেলে কিছুমাত্র ইতস্ততঃ না করে জবাব দিল, ‘কেন, আববা, গাছের কাঁঠাল তো গাছেই আছে’। পিতা তখন পুনরায় গাছের কাছে গিয়ে বিস্মিত নয়নে দেখলেন, সত্যিই তো কাঁঠাল গাছেই রয়েছে। পিতার বুঝতে বাকী রইল না। তিনি অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন, ‘কিয়া, এক ঘরমে দো পীর? যাও বাছা শুয়ে রও’। বাছা সেই যে শুইল। আর উঠল না।
আব্দুল্লাহ তার পিতার মুরীদের পীরদের কেরামতির অতিরঞ্জিত গল্প শুনে একেবারে তাজ্জব বনে গেল। আর একটা ভাবনা তার মনকে আলোড়িত করতে থাকল যে, পুত্রের পীরগিরিতে পিতার হিংসার কাহিনী তারা কিভাবে ব্যক্ত করতে পারে! আর এহেন পীরকে তারা মাথায় নিয়ে জান্নাতের পথ খোলাসা করতে চায়!
শিক্ষা : তথাকথিত পীররা মিথ্যা কেরামতির দোহাই দিয়ে মুরীদদের ঈমান হরণ করে। অতএব এদের থেকে সাবধান।