নাজী ফের্কার বৈশিষ্ট্য
১. তাঁরা সংস্কারক হবেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, بَدَأَ الإِسْلاَمُ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ، قِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَنِ الْغُرَبَاءُ قَالَ: الَّذِيْنَ يُصْلِحُوْنَ مَا أَفْسَدَ النَّاسُ- ‘ইসলাম নিঃসঙ্গভাবে যাত্রা শুরু করেছিল। সত্বর সেই অবস্থায় ফিরে যাবে। অতএব সুসংবাদ হ’ল সেই অল্পসংখ্যক লোকদের জন্য। যারা আমার পরে লোকেরা (ইসলামের) যে বিষয়গুলি ধ্বংস করে, সেগুলিকে পুনঃ সংস্কার করে’।[1]
২. আক্বীদার ক্ষেত্রে তারা সর্বদা মধ্যপন্থী হবেন এবং কখনোই চরমপন্থী বা শৈথিল্যবাদী হবেন না।
আল্লাহ বলেন, وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا- ‘এভাবে আমরা তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত করেছি। যেন তোমরা মানবজাতির উপরে সাক্ষী হ’তে পার এবং রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হ’তে পারেন’ (বাক্বারাহ ২/১৪৩)।
তারা কবীরা গোনাহগার মুমিনকে কাফের ও তার রক্তকে হালাল বলেন না বা তাকে পূর্ণ মুমিন বলেন না। আমলে ও আচরণে সর্বদা মধ্যপন্থী থেকে তারা আল্লাহর নৈকট্য তালাশ করেন। তারা নবীগণের তরীকা অনুযায়ী মানুষের আক্বীদা ও আমলের সংশোধনের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক সংস্কার সাধনে রত থাকেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধীদের তারা ভালবাসেন না এবং আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর ভালোবাসার ঊর্ধ্বে তারা অন্য কারু ভালোবাসাকে হৃদয়ে স্থান দেন না।[2] তারা কেবল আল্লাহর জন্য মানুষকে ভালবাসেন ও আল্লাহর জন্যই মানুষের সাথে বিদ্বেষ করেন।[3]
৩. আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে তারা সর্বদা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রকাশ্য অর্থের অনুসারী হবেন এবং ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আত ব্যাখ্যা করবেন।
এক্ষেত্রে তারা রায়পন্থীদের কোন ধারণা ও কল্পনার অনুসারী হবেন না। যেমন (১) আল্লাহ বলেন, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ‘তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (শূরা ৪২/১১)। এর সরলার্থ হ’ল, আল্লাহর নিজস্ব আকার আছে। কিন্তু তা কারু সাথে তুলনীয় নয়। তাঁর কান আছে ও চোখ আছে। কিন্তু তা কারু সাথে তুলনীয় নয়। তিনি নিরাকার কোন শূন্য সত্তা নন। আল্লাহ বলেন, بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ ‘বরং তাঁর দু’টি হাত প্রসারিত’ (মায়েদাহ ৫/৬৪)। তিনি বলেন, خَلَقْتُ بِيَدَيَّ ‘আমি আমার দু’হাত দিয়ে (মানুষকে) সৃষ্টি করেছি’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৫)। এগুলির অর্থ যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, সেভাবেই বুঝতে হবে। ভ্রান্ত ফের্কা জাহমিয়া ও অতি যুক্তিবাদী মু‘তাযিলা এবং তাদের অনুসারীদের মতে আল্লাহ সকল প্রকার গুণাবলী হ’তে মুক্ত। তারা ‘আল্লাহর হাত’ অর্থ করেন তাঁর কুদরত ও নে‘মত, ‘চেহারা’ অর্থ করেন তাঁর সত্তা বা ছওয়াব ইত্যাদি। অথচ সঠিক আক্বীদা এই যে, আল্লাহ অবশ্যই নাম ও গুণযুক্ত সত্তা। তবে তা কারু সাথে তুলনীয় নয়। তিনি শোনেন ও দেখেন। কিন্তু সেটা কিভাবে, তা জানা যাবে না। কেননা তাঁর সত্তা ও গুণাবলী বান্দার সত্তা ও গুণাবলীর সাথে তুলনীয় নয়। ভিডিও ক্যামেরা মানুষের কথা ও ছবি ধারণ করে। তার কান ও চোখ আছে। কিন্তু তা অন্যের সাথে তুলনীয় নয়। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সমূহে আল্লাহর হাত, আঙ্গুল, পায়ের নলা, চেহারা, চক্ষু, কথা বলা, আরশে অবস্থান, নিম্ন আকাশে অবতরণ, ক্বিয়ামতের দিন মুমিনদের দর্শন দান ইত্যাদি অনেক বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তার ধরন মানুষের অজানা। আবার এসবের অর্থ বুঝার জন্য আল্লাহর উপর ন্যস্ত করাও যাবে না। অতএব এসবই প্রকাশ্য অর্থে বিশ্বাস করতে হবে কোনরূপ পরিবর্তন, শূন্যকরণ, প্রকৃতি নির্ধারণ, তুলনাকরণ বা আল্লাহর উপরে ন্যস্তকরণ (من غير تحريف وتعطيل وتكييف وتمثيل وتفويض) ছাড়াই।
(২) আল্লাহ বলেন, الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى ‘দয়াময় (আল্লাহ) আরশের উপর সমুন্নীত’ (ত্বোয়াহা ২০/৫)। এখানে اسْتَوَى -এর অর্থ আমাদের জানা। কিন্তু কিভাবে আল্লাহ আরশে অবস্থান করেন, সেটা আমাদের অজানা। এক্ষেত্রে কেবল প্রকাশ্য অর্থে বিশ্বাস করতে হবে। কোনরূপ দূরতম ব্যাখ্যা বা কল্পনা করা যাবে না। ইমাম মালেক (রহঃ)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, اَلْإِسْتِوَاءُ مَعْلُوْمٌ وَالْكَيْفُ مَجْهُولٌ وَالْإِيْمَانُ بِهِ وَاجِبٌ وَالسُّؤَالُ عَنْهُ بِدْعَةٌ ‘আরশের উপর সমুন্নীত কথাটির অর্থ সুবিদিত। কিন্তু কিভাবে সমুন্নীত সেটা অবিদিত। অতএব এর উপর ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদ‘আত’।[4]
(৩) আল্লাহ বলেন, وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ ‘তিনি তোমাদের সাথে আছেন, যেখানেই তোমরা থাক না কেন’ (হাদীদ ৫৭/৪)। তিনি বলেন, وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ ‘আমরা তার গর্দানের প্রধান শিরার চাইতেও নিকটবর্তী থাকি’ (ক্বাফ ৫০/১৬)। তিনি মূসা ও হারূণকে বলেন, إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَى ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সাথে আছি। আমি সবকিছু দেখছি ও শুনছি’ (ত্বোয়াহা ২০/৪৬)। তিনি সাথে আছেন, কথাটি পরিষ্কার। এর অর্থ বুঝার জন্য আল্লাহর উপরে ন্যস্ত করার প্রয়োজন নেই। কেননা আরবরা যা বুঝে, সেই ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে। কিন্তু কিভাবে তিনি বান্দার সঙ্গে থাকেন, সে বিষয়ে এরূপ কাল্পনিক কথা বলা যাবে না যে, তাঁর আরশ বান্দার কলবে থাকে বা বান্দা আল্লাহর সত্তার অংশ কিংবা আত্মায় আত্মায় মিলিত হয়ে পরমাত্মায় লীন হয়ে ফানা ফিল্লাহ হয়ে যাবে, তিনি নিরাকার ও নির্গূণ সত্তা, তিনি সর্বত্র বিরাজমান ইত্যাদি। কেননা তিনি আরশে থাকেন, যা সাত আসমানের উপরে সমুন্নীত, যা বিভিন্ন আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। অতএব এর অর্থ হ’ল এই যে, আল্লাহ স্বীয় ইলমের মাধ্যমে বান্দার সাথে থাকেন। তাঁর জ্ঞান ও শক্তি সর্বত্র বিরাজমান। তিনি সবকিছুর উপরে ক্ষমতাশালী। তিনি বান্দার সব কথা শোনেন ও দেখেন। তিনি বান্দার হেফাযত করেন ও তাকে সাহায্য করেন।
ফলাফল : উপরোক্ত বিশ্বাসের ফলাফল এই হবে যে, মানুষ যখন জানবে, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি সর্বদা আরশে অবস্থান করেন, তখন বান্দা সর্বদা কেবল তাঁরই মুখাপেক্ষী থাকবে। কেবল তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। বান্দা যখন জানবে যে, আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নামসমূহ রয়েছে (আ‘রাফ ৭/১৮০), তখন সেইসব গুণবাচক নামেই বান্দা আল্লাহকে ডাকবে ও তাঁর সাহায্য চেয়ে নিশ্চিন্ত হবে। উদাহরণ স্বরূপ সে যখন জানবে যে, আল্লাহ একমাত্র রূযীদাতা, তখন সে রূযী নিয়ে চিন্তিত হবে না। যখন সে জানবে যে, আল্লাহ তার সব কথা শুনছেন ও সব কাজ দেখছেন, তখন সে অন্যায় কাজে ভীত হবে এবং নেকীর কাজে উৎসাহী হবে। যখন সে জানবে যে, আল্লাহ হায়াত ও মউতের মালিক, তিনি সন্তানদাতা, রোগ ও আরোগ্যদাতা এবং তিনিই বিপদহন্তা, তখন সে এসব বিষয় নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তায় ভুগবে না। যখন মানুষ জানবে যে, আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান, তখন সে পাপ করে হতাশ হবে না। বরং অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে ভালো হওয়ার চেষ্টা করবে। এভাবে মানুষ যখন আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে জানবে, তখন সে সঠিকভাবে তার জীবনকে গড়ে তুলবে। নইলে যে কোন সময়ে তার পদস্খলন ঘটবে। আত্মগ্লানিতে সে ভেঙ্গে পড়বে। বস্ত্ততঃ অধিকাংশ বাতিল ফের্কার জন্ম হয়েছে তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানের অভাবে। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন- আমীন!
৪. তারা জামা‘আতবদ্ধভাবে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করেন এবং কখনোই উদ্ধত ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী হন না।
আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَرْصُوصٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালবাসেন ঐসব লোকদের, যারা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে সারিবদ্ধভাবে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায়’ (ছফ ৬১/৪)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَرَادَ بُحْبُوحَةَ الْجَنَّةِ فَلْيَلْزَمِ الْجَمَاعَةَ ‘যে ব্যক্তি জান্নাতের মধ্যস্থলে থাকতে চায়, সে যেন জামা‘আতকে অপরিহার্য করে নেয়’।[5]
হযরত উমামাহ (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের ভাষণে আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে,
اِتَّقُوا اللهَ رَبَّكُمْ وَصَلُّوْا خَمْسَكُمْ وَصُوْمُوْا شَهْرَكُمْ وَأَدُّوْا زَكَاةَ أَمْوَالِكُمْ وَأَطِيْعُوْا ذَا أَمْرِكُمْ تَدْخُلُوْا جَنَّةَ رَبِّكُمْ-
(১) ‘তোমরা তোমাদের প্রভু আল্লাহকে ভয় কর (২) পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় কর (৩) রামাযান মাসের ছিয়াম পালন কর (৪) তোমাদের সম্পদের যাকাত প্রদান কর এবং (৫) আমীরের আনুগত্য কর; তোমাদের প্রভুর জান্নাতে প্রবেশ কর’।[6] অত্র হাদীছে আমীরের আনুগত্যকে ছালাত, ছিয়াম, যাকাত ইত্যাদি ফরয ইবাদতের সাথে যুক্ত করে বলা হয়েছে এবং একে জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম মাধ্যম হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
ইসলামী সংগঠনের স্তম্ভ হল ৪টি : আমীর, মামূর, বায়‘আত ও এত্বা‘আত।[7] বায়‘আত হ’ল আমীরের নিকট আল্লাহর নামে আল্লাহর বিধান মানার অঙ্গীকার গ্রহণের নাম। যা ব্যতীত ইসলামী সংগঠন হয় না। আল্লাহ বলেন, وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولاً ‘তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে’ (ইসরা ১৭/৩৪)। বস্ত্ততঃ বায়‘আতবিহীন আনুগত্য সাধারণ সমর্থনের ন্যায়। জামা‘আতবদ্ধ জীবনে যার কোন দায়বদ্ধতা নেই। অতঃপর চতুর্থটি অর্থাৎ আনুগত্য না থাকলে বাকীগুলি মূল্যহীন হবে। কেননা অঙ্গীকার ও আনুগত্যহীন সংগঠন ইসলামে কাম্য নয়।
আল্লাহ বলেন, تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لاَ يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ ‘আখেরাতের ঐ গৃহ আমরা নির্ধারিত করেছি তাদের জন্য যারা পৃথিবীতে উদ্ধত হয় না ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম রয়েছে কেবল মুত্তাকীদের জন্য’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।
৫. তারা কুফর ও কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ও শক্তিশালী থাকেন এবং নিজেদের মধ্যে সর্বদা রহমদিল ও আল্লাহর প্রতি বিনীত থাকেন।
আল্লাহ বলেন, مُحَمَّدٌ رَسُوْلُ اللهِ وَالَّذِيْنَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُوْنَ فَضْلاً مِنَ اللهِ وَرِضْوَانًا سِيْمَاهُمْ فِيْ وُجُوْهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُوْدِ، ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং যারা তার সাথী, তারা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ও নিজেদের মধ্যে সহমর্মী। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে সর্বদা রুকূকারী ও সিজদাকারী দেখতে পাবে। তাদের কপালে সিজদার চিহ্ন থাকবে’ (ফাৎহ ৪৮/২৯)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ ‘তুমি জান্নাতের সুসংবাদ দাও বিনীতদের জন্য’ (হজ্জ ২২/৩৪)।
তিনি আরও বলেন,وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِينَ مِنْ دُونِهِمْ لاَ تَعْلَمُونَهُمُ اللهُ يَعْلَمُهُمْ ‘তোমরা অবিশ্বাসীদের মুকাবিলায় যথাসাধ্য শক্তি ও সদা প্রস্ত্তত অশ্ববাহিনী প্রস্ত্তত রাখো। যদ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদের ভীত করবে এবং এছাড়াও অন্যদের, যাদেরকে তোমরা জানোনা। কিন্তু আল্লাহ জানেন’ (আনফাল ৮/৬০)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الْمُؤْمِنُ الْقَوِىُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ ‘শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চাইতে উত্তম ও আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় দুর্বল মুমিনের চাইতে’।[8] আর এটি কেবল দৈহিক শক্তি নয়। বরং মানসিক ও সাংগঠনিক শক্তিই বড় শক্তি। সেই সাথে থাকবে যুগোপযোগী বৈষয়িক শক্তি।
৬. তাঁরা যেকোন মূল্যে সুন্নাতকে অাঁকড়ে থাকেন ও বিদ‘আত হ’তে দূরে থাকেন।
হযরত ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ ‘তোমরা আমার ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে ধারণ কর। তোমরা সেগুলি কঠিনভাবে অাঁকড়ে ধর এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধর। আর তোমরা ধর্মের নামে নতুন সৃষ্টি করা হ’তে বিরত থাক। কেননা প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।[9]
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ مِنْ وَرَائِكُمْ زَمَانَ صَبْرٍ لِلْمُتَمَسِّكِ فِيْهِ أَجْرُ خَمْسِيْنَ شَهِيْدًا مِّنْكُمْ ‘তোমাদের পরে এমন একটা কঠিন সময় আসছে, যখন সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে ধারণকারী ব্যক্তি তোমাদের মধ্যকার পঞ্চাশ জন শহীদের সমান নেকী পাবে’।[10]
৭. তারা সর্বাবস্থায় সমবেতভাবে হাবলুল্লাহকে ধারণ করে থাকেন এবং কখনোই সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হন না। কেউ তাদেরকে ছেড়ে গেলে সে অবস্থায় তারা আল্লাহর উপর ভরসা করেন ও তাঁর গায়েবী মদদ কামনা করেন।
আল্লাহ বলেন, وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيعًا وَّلاَ تَفَرَّقُوا ‘তোমরা সকলে সমবেতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করো এবং তোমরা বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)।
হযরত নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, الْجَمَاعَةُ رَحْمَةٌ وَالْفُرْقَةُ عَذَابٌ ‘জামা‘আতবদ্ধ জীবন হ’ল রহমত এবং বিচ্ছিন্ন জীবন হ’ল আযাব’।[11] তিনি বলেন, يَدُ اللهِ عَلَى الْجَمَاعَةِ وَإِنَّ الشَّيْطَانَ مَعَ مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ، ‘জামা‘আতের উপর আল্লাহর হাত থাকে। আর শয়তান তার সাথে থাকে যে জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়।[12]
‘হাবলুল্লাহ’ হ’ল কুরআন ও তার ব্যাখ্যা হাদীছ। যতক্ষণ কোন সংগঠনে এদু’টির সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকবে এবং তা যথার্থভাবে অনুসৃত হবে, ততক্ষণ উক্ত সংগঠনের সাথে জামা‘আতবদ্ধ থাকা ফরয। যেমন হযরত উম্মুল হুছায়েন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنْ أُمِّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ مُجَدَّعٌ أَسْوَدُ يَقُودُكُمْ بِكِتَابِ اللهِ تَعَالَى فَاسْمَعُوا لَهُ وَأَطِيعُوا ‘যদি তোমাদের উপর একজন নাক-কান কাটা কৃষ্ণকায় গোলামকেও আমীর নিযুক্ত করা হয়, যদি তিনি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালিত করেন, তাহ’লে তোমরা তার কথা শোন ও তার আনুগত্য কর’।[13] হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ أَطَاعَنِي فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ عَصَى اللهَ وَمَنْ يُطِعْ الْأَمِيرَ فَقَدْ أَطَاعَنِي وَمَنْ يَعْصِ الْأَمِيرَ فَقَدْ عَصَانِي وَإِنَّمَا الْإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ وَيُتَّقَى بِهِ فَإِنْ أَمَرَ بِتَقْوَى اللهِ وَعَدَلَ فَإِنَّ لَهُ بِذَلِكَ أَجْرًا وَإِنْ قَالَ بِغَيْرِهِ فَإِنَّ عَلَيْهِ مِنْهُ. ‘যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্যতা করল সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য করল, সে আমার আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি আমীরের অবাধ্যতা করল, সে আমার অবাধ্যতা করল। আমীর হলেন ঢাল স্বরূপ। যার পিছনে থেকে লড়াই করা হয় ও যার মাধ্যমে আত্মরক্ষা করা হয়। যদি তিনি আল্লাহভীতির আদেশ দেন ও ন্যায় বিচার করেন, তাহ’লে এর বিনিময়ে তার জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার। আর যদি বিপরীত কিছু বলেন, তাহ’লে তার পাপ তার উপরেই বর্তাবে’।[14] তিনি বলেন, ‘তোমরা সাধ্যমত আমীরের কথা শোন ও মান্য কর’। ‘যদি আমীরের কোন বিষয় অপসন্দনীয় মনে কর, তাহ’লে তাতে ছবর কর। কেননা যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে এক বিঘত বেরিয়ে গেল ও মৃত্যু বরণ করল, সে জাহেলিয়াতের উপর মৃত্যু বরণ করল’।[15]
এই আমীর নাজী ফের্কার আমীর হ’তে পারেন কিংবা দেশের শাসক হ’তে পারেন। সাংগঠনিক আমীর ইসলামী ‘হুদূদ’ বা দন্ডবিধি জারি করতে পারেন না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আমীর সেটা করেন। উভয় অবস্থায় বায়‘আত ও আনুগত্য অপরিহার্য। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِى عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল, অথচ তার গর্দানে আমীরের প্রতি আনুগত্যের বায়‘আত নেই, সে জাহেলী মৃত্যু বরণ করল’।[16] এটি কেবল খেলাফতে রাশেদাহ পর্যন্ত সীমায়িত নয়। বরং সকল যুগে রাষ্ট্রীয় বায়‘আত ও সাংগঠনিক বায়‘আত দু’টিই হ’তে পারে। কারণ বায়‘আত বা আনুগত্যের অঙ্গীকার না থাকলে রাষ্ট্র বা সংগঠনের প্রতি কোনরূপ দায়বদ্ধতা থাকে না। আর বায়‘আতবিহীন আনুগত্য সাধারণ সমর্থনের ন্যায়, যা তেমন কোন গুরুত্ব বহন করে না। এই বায়‘আত না থাকলে বা ভঙ্গ করলে কেউ কাফির হবে না বটে, কিন্তু সামাজিক বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে। যাকে এখানে ‘জাহেলিয়াত’ বলা হয়েছে (মিরক্বাত)। যা আল্লাহর কাম্য নয়।
লোকেরা ছেড়ে গেলেও এবং পরিস্থিতি বিরূপ হলেও যারা হাবলুল্লাহকে মযবুতভাবে ধারণ করে থাকেন। এমতাবস্থায় তারা আল্লাহর গায়েবী মদদ পেয়ে থাকেন।
যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلاَئِكَةُ أَلاَّ تَخَافُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ ‘যারা বলে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। অতঃপর উক্ত কথার উপর দৃঢ় থাকে, তাদের উপর ফেরেশতাগণ অবতীর্ণ হয় এই বলে যে, তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তান্বিত হয়ো না। তোমরা জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর, যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩০)।
নাজী ফের্কা থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং হক-বাতিল না বুঝে কোন দলে যোগ দেয়া বা নতুন দল গড়ার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ خَرَجَ مِنَ الطَّاعَةِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ فَمَاتَ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً وَمَنْ قَاتَلَ تَحْتَ رَايَةٍ عُمِّيَّةٍ يَغْضَبُ لِعَصَبَةٍ أَوْ يَدْعُو إِلَى عَصَبَةٍ أَوْ يَنْصُرُ عَصَبَةً فَقُتِلَ فَقِتْلَةٌ جَاهِلِيَّةٌ ‘যে ব্যক্তি আনুগত্য হ’তে বেরিয়ে যায় ও জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, অতঃপর মারা যায়, সে জাহেলিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করে। আর যে ব্যক্তি এমন পতাকাতলে যুদ্ধ করে, যার হক ও বাতিল হওয়া সম্পর্কে তার স্পষ্ট জ্ঞান নেই। বরং সে দলীয় প্রেরণায় ক্রুদ্ধ হয়, দলীয় প্রেরণায় লোকদের আহবান করে ও দলীয় প্রেরণায় মানুষকে সাহায্য করে, অতঃপর নিহত হয়। এমতাবস্থায় সে জাহেলিয়াতের উপর নিহত হয়।... [17]
যারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয় ও অন্যকে পথভ্রষ্ট করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَلَيَحْمِلُنَّ أَثْقَالَهُمْ وَأَثْقَالاً مَعَ أَثْقَالِهِمْ وَلَيُسْأَلُنَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَمَّا كَانُوا يَفْتَرُونَ ‘তারা নিজেদের পাপভার বহন করবে এবং নিজেদের বোঝার সাথে অন্যদের পাপের বোঝা। আর তারা যেসব মিথ্যা উদ্ভাবন করে সে বিষয়ে কিয়ামত দিবসে অবশ্যই তাদের প্রশ্ন করা হবে’ (আনকাবূত ২৯/১৩)।[1]. আহমাদ হা/১৬৭৩৬; মিশকাত হা/১৫৯, ১৭০; ছহীহাহ হা/১২৭৩।
[2]. মুজাদালাহ ৫৮/২২; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৭; বুখারী হা/৬৬৩২।
[3]. ত্বাবারাণী কাবীর, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৯৯৮; মিশকাত হা/৫০১৪।
[4]. শাহরাস্তানী, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল ১/৯৩ পৃঃ।
[5]. তিরমিযী হা/২১৬৫।
[6]. তিরমিযী হা/৬১৬, আহমাদ হা/২২২১৫; মিশকাত হা/৫৭১; ছহীহাহ হা/৮৬৭।
[7]. দ্রঃ সূরা তওবা ১১১ আয়াত যা মক্কায় বায়‘আতে কুবরা উপলক্ষে নাযিল হয়েছিল (ইবনু কাছীর, তাফসীর উক্ত আয়াত; ইক্বামতে দ্বীন পৃঃ ১৪-১৬; সূরা ফাৎহ ৪৮/১০, ১৮ আয়াত)।
[8]. মুসলিম হা/২৬৬৪; মিশকাত হা/৫২৯৮।
[9]. আহমাদ, আবুদাঊদ প্রভৃতি; মিশকাত হা/১৬৫।
[10]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/১০২৪০; ছহীহুল জামে‘ হা/২২৩৪।
[11]. আহমাদ হা/১৮৪৭২; ছহীহাহ হা/৬৬৭।
[12]. নাসাঈ হা/৪০২০; তিরমিযী হা/২১৬৬; মিশকাত হা/১৭৩।
[13]. মুসলিম হা/১৮৩৮, মিশকাত হা/৩৬৬২ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।
[14]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৬১ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।
[15]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৬৭-৬৮।
[16]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৭৪।
[17]. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৬৯, ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।