ফিরক্বা নাজিয়াহ

নাজী ফের্কা হলেন ছাহাবীগণ ও তাঁদের যথার্থ অনুসারীগণ

পূর্বোক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, নাজী ফের্কা হ’ল মাত্র একটি :

ছাহাবায়ে কেরাম ও তাদের যথার্থ অনুসারীগণ। আল্লাহ বলেন, وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ‘ঈমান আনয়নে অগ্রবর্তী মুহাজির ও আনছারগণ এবং যারা নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসারী হয়েছে, আল্লাহ তাদের উপর খুশী হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর উপর খুশী হয়েছে’ (তওবা ৯/১০০)।

হযরত ইমরান বিন হুছায়েন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, خَيْرُ أُمَّتِى قَرْنِى ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ‘আমার উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হ’ল আমার যুগের লোক (অর্থাৎ ছাহাবীগণের যুগ)। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক (অর্থাৎ তাবেঈগণের যুগ)। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক (অর্থাৎ তাবে তাবেঈগণের যুগ)’।[1]

অতঃপর তাদের পরবর্তী সকল যুগে ‘আহলেহাদীছ’গণ। যারা ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আতের ব্যাখ্যা করেন ও সার্বিক জীবনে তার অনুসারী থাকেন। ক্বিয়ামতের প্রাক্কাল অবধি এই দলের অস্তিত্ব থাকবে। যেমন হযরত ছওবান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

لاَ تَزَالُ طَائِـفَةٌ مِنْ أُمَّتِى ظَاهِرِيْنَ عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِىَ أَمْرُ اللهِ وَ هُمْ كَذَالِكَ ، رواه مسلم-

‘চিরদিন আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল হক-এর উপরে বিজয়ী থাকবে। পরিত্যাগকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে, অথচ তারা ঐভাবে থাকবে’।[2]

অন্য বর্ণনায় এসেছে لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَالَفَهُمْ ‘তাদের বিরোধিতাকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না’।[3] ইমরান বিন হুছায়েন (রাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ عَلَى مَنْ نَاوَأَهُمْ حَتَّى يُقَاتِلَ آخِرُهُمُ الْمَسِيحَ الدَّجَّالَ ‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা হক-এর উপর লড়াই করবে। তারা তাদের শত্রুদের উপর বিজয়ী থাকবে। তাদের শেষ দলটি দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে’।[4]

উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, إِنْ لَّمْ يَكُوْنُوْا أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ فَلاَ أَدْرِىْ مَنْ هُمْ؟ ‘তারা যদি ‘আহলেহাদীছ’ না হয়, তাহ’লে আমি জানি না তারা কারা’?[5]

বিদ‘আতীদের বিপরীতে তারা সর্বদা ‘আহলুল হাদীছ’ নামে পরিচিত হবেন। ছাহাবায়ে কেরাম ‘আহলুল হাদীছ’ নামে পরিচিত ছিলেন। ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) মুসলিম যুবকদের ‘মারহাবা’ জানিয়ে বলতেন فَإِنَّكُمْ خُلُوْفُنَا وَأَهْلُ الْحَدِيْثِ بَعْدَنَا ‘তোমরাই আমাদের পরবর্তী বংশধর ও তোমরাই আমাদের পরবর্তী আহলুল হাদীছ’।[6] খ্যাতনামা তাবেঈ ইমাম শা‘বী (২২-১০৪ হিঃ) ছাহাবায়ে কেরামের জামা‘আতকে ‘আহলুল হাদীছ’ বলতেন।[7] আলী ইবনুল মাদীনী বলেন, তারা হলেন আহলুল হাদীছ’।[8] আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সকল প্রসিদ্ধ ইমাম, বিশেষ করে চার ইমামের প্রত্যেকে ছহীহ হাদীছকে তাদের মাযহাব হিসাবে ঘোষণা করে বলেছেন, إِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهبُنَا ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমাদের মাযহাব’।[9] অতএব সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন, ছহীহ হাদীছ এবং ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী জীবন পরিচালনাকারী ব্যক্তিই মাত্র ‘আহলুল হাদীছ’ বলে অভিহিত হবেন। অন্য কেউ নয়।

আহলেহাদীছের উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য সমূহের কারণে তাদের প্রশংসায়      (১) ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, أَهْلُ الْحَدِيْثِ فِي كُلِّ زَمَانٍ كَالسَّحَابَةِ فِي زَمَانِهِمْ প্রত্যেক যামানায় আহলেহাদীছগণ হলেন সেই যামানার জন্য মেঘ সদৃশ।’ (২) তিনি বলতেন, إِذَا رَأَيْتُ صَاحِبَ حَدِيْثٍ فَكَأَنِّيْ رَأَيْتُ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَياًّ ‘আমি যখন কোন আহলুল হাদীছকে দেখি, তখন যেন আমি রাসূল (ছাঃ)-এর কোন ছাহাবীকে জীবন্ত দেখি’।[10]

(৩) ইমাম আবুদাঊদ (রহঃ) বলেন, لَوْلاَ هَذِهِ الْعِصَابَةُ لاَنْدَرَسَ الْإِسْلاَمُ يِعْنِىْ أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ- ‘আহলেহাদীছ জামা‘আত যদি দুনিয়ায় না থাকত, তাহ’লে ইসলাম দুনিয়া থেকে মিটে যেত’।[11]

(৪) ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, أَهْلُ الْحَدِيْثِ فِىْ أَهْلِ الْإِسْلاَمِ كَأَهْلِ الْإِسْلاَمِ فِىْ أَهْلِ الْمِلَلِ ‘মুসলিম উম্মাহর মধ্যে আহলেহাদীছের মর্যাদা অনুরূপ, যেমন সকল জাতির মধ্যে মুসলমানদের মর্যাদা’।[12]

উল্লেখ্য যে, যারা উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য সমূহ থেকে বিচ্যুত হয়, তারা আহলুল হাদীছ বা আহলুস সুন্নাহ নয়। মুখে যত দাবীই তারা করুক না কেন। যেমন কুরায়েশরা নিজেদেরকে ‘আহলুল্লাহ’ (আল্লাহওয়ালা) বলে দাবী করলেও তারা তা ছিলনা। বরং প্রকৃত আহলুল্লাহ ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর সাথী মুসলমানগণ। যদিও মক্কার মুশরিক নেতারা রাসূল (ছাঃ)-কে ‘ছাবেঈ’ (ধর্মত্যাগী) ও ‘জামা‘আত বিভক্তকারী’ বলত।[13] যুগে যুগে বাতিলপন্থীরা এভাবেই হকপন্থীদের গালি দিবে।

পৃথিবীর সকল প্রান্তের সকল ‘আহলেহাদীছ’ একই ফেরক্বা নাজিয়াহর অন্তর্ভুক্ত। সাংগঠনিক শৃংখলার স্বার্থে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ‘আমীর’ থাকতে পারেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তারা সবাই একই ফের্কাভুক্ত। লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতির ঐক্য থাকলে বর্তমান বিশ্বে একই ইমারতের অধীনে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ পরিচালিত হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়। ইতিমধ্যেই কিছু বিদ‘আতী দল যার নমুনা কায়েম করেছে।


[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬০০০-০১ ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ।

[2]. ছহীহ মুসলিম ‘ইমারত’ অধ্যায়-৩৩, অনুচ্ছেদ-৫৩, হা/১৯২০; অত্র হাদীছের ব্যাখ্যা দ্রঃ ঐ, দেউবন্দ ছাপা শরহ নববী ২/১৪৩ পৃঃ; বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৭১ ‘ইল্ম’ অধ্যায় ও হা/৭৩১১-এর ভাষ্য ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অধ্যায়; আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭০-এর ব্যাখ্যা।

[3]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬২৭৬; আবুদাঊদ হা/৪২৫২।

[4]. আবুদাঊদ হা/২৪৮৪; মিশকাত হা/৩৮১৯ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[5]. তিরমিযী হা/২১৯২; মিশকাত হা/৬২৮৩-এর ব্যাখ্যা; ফাৎহুল বারী ১৩/৩০৬ পৃঃ, হা/৭৩১১-এর ব্যাখ্যা; খতীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ১৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭০।

[6]. খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ১২; হাকেম ১/৮৮ পৃঃ; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৮০।

[7]. যাহাবী, তাযকেরাতুল হুফফায (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ১/৮৩ পৃঃ।

[8]. তিরমিযী হা/২১৯২; ছহীহুল জামে‘ হা/৭০২; মিশকাত হা/৬২৮৩।

[9]. শা‘রানী, কিতাবুল মীযান (দিল্লী : ১২৮৬ হিঃ) ১/৭৩ পৃঃ।

[10]. কিতাবুল মীযান ১/৬৫-৬৬; খতীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ২৬।

[11]. শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ২৯।

[12]. ইবনু তায়মিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ (বৈরূতঃ দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ২/১৭৯ পৃঃ।

[13]. সীরাতে ইবনে হিশাম ১/২৬৭; আহমাদ হা/১৬০৬৯।