ফায়েদা
ফায়েদা : (ক) মিশকাতুল মাছাবীহ-এর আরবী ভাষ্যগ্রন্থ মিরক্বাতুল মাফাতীহ-এর স্বনামধন্য লেখক মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (মৃঃ ১০১৪ হিঃ) مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ -এর ব্যাখ্যায় বলেন, فَلاَ شَكَّ وَلاَ رَيْبَ أَنَّهُمْ هُمْ أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ، وَقِيلَ: ... فَإِنَّ ذَلِكَ يُعْرَفُ بِالْإِجْمَاعِ، فَمَا أَجْمَعَ عَلَيْهِ عُلَمَاءُ الْإِسْلاَمِ فَهُوَ حَقٌّ وَمَا عَدَاهُ فَهُوَ بَاطِلٌ ‘নিঃসন্দেহে তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত। বলা হয়েছে যে, ... সেটা চেনা যাবে ইজমা-এর মাধ্যমে। অতএব যে বিষয়ের উপরে ওলামায়ে ইসলামের ইজমা বা ঐক্যমত হয়েছে, সেটাই হক। আর যা তার বাইরে তা বাতিল’।[1]
উপরোক্ত বক্তব্য অবশ্যই ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। কেননা বিদ‘আতী আলেমরাও নিজেদেরকে ওলামায়ে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবী করেন এবং নিজেদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বলেন। বরং সকল যুগে এদের সংখ্যাই বেশী। অথচ বিদ‘আতীরা কখনোই আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত নন।
অতঃপর ছাহেবে মিরক্বাত বলেন,
وَالْفِرْقَةُ النَّاجِيَةُ هُمْ أَهْلُ السُّنَّةِ الْبَيْضَاءِ الْمُحَمَّدِيَّةِ وَالطَّرِيقَةِ النَّقِيَّةِ الْأَحْمَدِيَّةِ، وَلَهَا ظَاهِرٌ سُمِّيَ بِالشَّرِيعَةِ شِرْعَةً لِلْعَامَّةِ، وَبَاطِنٌ سُمِّيَ بِالطَّرِيقَةِ مِنْهَاجًا لِلْخَاصَّةِ وَخُلاَصَةٌ خُصَّتْ بِاسْمِ الْحَقِيقَةِ مِعْرَاجًا لِأَخَصِّ الْخَاصَّةِ، فَالْأَوَّلُ نَصِيبُ الْأَبْدَانِ مِنَ الْخِدْمَةِ، وَالثَّانِي نَصِيبُ الْقُلُوبِ مِنَ الْعِلْمِ وَالْمَعْرِفَةِ، وَالثَّالِثُ نَصِيبُ الْأَرْوَاحِ مِنَ الْمُشَاهَدَةِ وَالرُّؤْيَةِ. قَالَ الْقُشَيْرِيُّ: وَالشَّرِيعَةُ أَمْرٌ بِالْتِزَامِ الْعُبُودِيَّةِ وَالْحَقِيقَةُ مُشَاهَدَةُ الرُّبُوبِيَّةِ، فَكُلُّ شَرِيعَةٍ غَيْرُ مُؤَيَّدَةٍ بِالْحَقِيقَةِ فَغَيْرُ مَقْبُولٍ، وَكُلُّ حَقِيقَةٍ غَيْرُ مُقَيَّدَةٍ بِالشَّرِيعَةِ فَغَيْرُ مَحْصُولٍ. فَالشَّرِيعَةُ قِيَامٌ بِمَا أُمِرَ وَالْحَقِيقَةُ شُهُودٌ لِمَا قُضِيَ وَقُدِّرَ وَأُخْفِيَ وَأُظْهِرَ - (مرقاة ১/২৪৮)-
‘ফের্কায়ে নাজিয়াহ হ’ল আহলে সুন্নাত দল। যারা স্বচ্ছ মুহাম্মাদী সুন্নাত ও পরিচ্ছন্ন আহমাদী তরীকার অনুসারী। যার একটি বাহ্যিক দিক আছে। যার নাম ‘শরী‘আত’। যা সাধারণ মানুষের জন্য প্রদত্ত বিধান। তার একটি বাতেনী দিক আছে, যার নাম ‘তরীকত’, যা খাছ লোকদের জন্য প্রদত্ত পন্থা। আর একটি সারবস্ত্ত রয়েছে যার নাম ‘হাকীকত’। যা হ’ল খাছ লোকদের মধ্যকার খাছ ব্যক্তিগণের জন্য মি‘রাজ সদৃশ। এক্ষণে প্রথমটি হ’ল দেহের অংশ, যা তার ক্রিয়াকর্মের দ্বারা অর্জিত হয়। দ্বিতীয়টি হ’ল কলবের অংশ, যা ইলম ও মা‘রেফাত তথা জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে অর্জিত হয়। তৃতীয়টি হ’ল রূহের অংশ, যা মুশাহাদাহ বা চাক্ষুষ দর্শনের মাধ্যমে অর্জিত হয়। কুশায়রী বলেন, শরী‘আত হ’ল উবূদিয়াত অর্থাৎ আল্লাহর দাসত্বকে কবুল করে নেওয়ার বিষয়। হাকীকত হ’ল রুবূবিয়াতকে দর্শনের বিষয়। এক্ষণে প্রত্যেক শরী‘আত যা হাকীকত দ্বারা শক্তিকৃত নয়, তা গ্রহণযোগ্য নয়। অনুরূপভাবে প্রত্যেক হাকীকত যা শরী‘আতের বিধানযুক্ত নয়, তা ফলবলহীন। অতএব শরী‘আত হ’ল আদিষ্ট বিষয় পালন করার নাম এবং হাকীকত হ’ল ক্বাযা ও ক্বদর তথা তাকদীরে নির্ধারিত গোপন ও প্রকাশ্য বিষয় সমূহ চাক্ষুষ দর্শনের নাম’।[2]
উপরোক্ত বক্তব্যগুলি স্রেফ ধারণা নির্ভর ও কাল্পনিক ব্যাখ্যা মাত্র, যা কোন দলীলের উপর ভিত্তিশীল নয়। কেননা হাদীছে জিব্রীলে ইহসান-এর ব্যাখ্যায় অত্যন্ত সহজ ও সুন্দরভাবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ ‘তুমি আল্লাহর ইবাদত কর এমনভাবে যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পাও, তাহলে এমন বিশ্বাস নিয়ে ইবাদত কর যে তিনি তোমাকে দেখছেন’।[3] এর দ্বারা রাসূল (ছাঃ) একথা বুঝাতে চেয়েছেন যে, তোমরা গভীর মনোযোগ দিয়ে ও পূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে ইবাদতে রত হও যে আল্লাহ তোমার সবকিছু দেখছেন ও শুনছেন। অতএব ভীত-সন্ত্রস্ত ও শ্রদ্ধাভরা আকুতি নিয়ে হে মুছল্লী! তুমি ছালাতে মনোনিবেশ কর। এই মনোনিবেশ সাধারণ-অসাধারণ সকল মুছল্লীর মধ্যে যাতে সমানভাবে সৃষ্টি হয়, সেদিকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যদিও সবার জন্য সর্বাবস্থায় তা সম্ভব হয় না। আর এর ফলেই আল্লাহর নিকটে মুছল্লীদের স্তরভেদ সৃষ্টি হয়।
কিন্তু ইহসান-এর এই স্তর হাছিল করার জন্য ছালাত ব্যতীত পৃথক কোন মা‘রেফতী তরীকা বা পদ্ধতি রাসূল (ছাঃ) চালু করে যাননি। যা ছাহাবী ও তাবেঈগণের স্বর্ণযুগের পর ভ্রষ্টতার যুগে কথিত ছূফী ও পীর-আউলিয়াদের মাধ্যমে সমাজে চালু হয়েছে এবং যা বর্তমানে কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দীয়া ও মুজদ্দেদিয়া নামে প্রধান চারটি তরীকায় বিভক্ত। অতঃপর তা আরও বিভক্ত হয়ে উপমহাদেশে অন্যূন দু’শো তরীকার সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে মাযহাবের নামে, তরীকার নামে, দেহতত্ত্বের নামে উপমহাদেশের বিশেষ করে হানাফী সমাজ অসংখ্য ভাগে বিভক্ত ও ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। প্রত্যেক মুরীদ তার তরীকার পীর নিয়েই সন্তুষ্ট। আর এইসব তরীকার পীরের সংখ্যা শুধু বাংলাদেশেই ১৯৮১ সালের সরকারী হিসাব মতে ২,৯৮,০০০। যা বর্তমানে আরও বেড়েছে। এইসব পীরগণ আল্লাহ ও বান্দার মাঝে অসীলা হিসাবে পূজিত হচ্ছেন। এমনকি তদের নামে কুমীর, কচ্ছপ, কবুতর, গজাল মাছ ইত্যাদিও পূজিত হচ্ছে। মৃত্যুর পরে তাদের কবরের উপরে নির্মিত কারুকার্যখচিত সমাধিসৌধে কুরআনের বিশেষ একটি আয়াত লিখে ভক্তদের ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে এভাবে যে, আউলিয়াগণ মরেন না। আয়াতটি হ’ল, أَلاَ إِنَّ أَوْلِيْاء اللهِ لاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُوْنَ- ‘মনে রেখ যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (ইউনুস ১০/৬২)। আল্লাহ স্বীয় রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে বলছেন, إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ ‘নিশ্চয়ই তুমি মৃত্যুবরণ করবে এবং তারাও (অর্থাৎ পূর্বের নবীরাও) মৃত্যুবরণ করেছে’ (যুমার ৩৯/৩০)। অন্যদিকে সকল মৃত ব্যক্তির জন্য সাধারণ রীতি হিসাবে আল্লাহ বলেন, وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ ‘আর তাদের সম্মুখে বারযাখ অর্থাৎ পর্দা থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত’ (মুমিনূন ২৩/১০০)। ফলে বারযাখী জগতের লোকেরা পার্থিব জগতের কারু কোন ক্ষতি বা উপকার করতে পারেন না। যেমন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মৃত্যুর পর হযরত ওমর, ওছমান, আলী ও হুসায়েন (রাঃ)-এর কোন উপকার করতে পারেন নি বা তাদের হত্যাকারীদের ঠেকাতে পারেন নি।
এক্ষণে আল্লাহর বন্ধু কারা? সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন, اللهُ وَلِيُّ الَّذِيْنَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ ‘আল্লাহ হ’লেন বিশ্বাসীদের অলী বা অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার হ’তে আলোর পথে নিয়ে যান। আর যারা অবিশ্বাসী, শয়তান তাদের অলী বা অভিভাবক। সে তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। ওরা হ’ল জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২৫৭)। এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, প্রকৃত মুমিন যারা, তারাই আল্লাহর অলী। যারা নিজেরা অন্ধকার ছেড়ে আলোর পথে আসে এবং অন্যকে আলোর পথে ডাকে। অর্থাৎ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পথে আহবান করে। আল্লাহ তার বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলেন, نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَدَّعُوْنَ ‘আমরা তোমাদের অভিভাবক তোমাদের পার্থিব জীবনে এবং আখেরাতে। সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা কিছু তোমাদের মন চাইবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা কিছু তোমরা দাবী করবে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩১)। তিনি সাবধান করে বলেন,أَفَحَسِبَ الَّذِيْنَ كَفَرُوا أَنْ يَتَّخِذُوا عِبَادِي مِنْ دُوْنِي أَوْلِيَاءَ إِنَّا أَعْتَدْنَا جَهَنَّمَ لِلْكَافِرِيْنَ نُزُلاً ‘অবিশ্বাসীরা কি ভেবেছে তারা আমাকে বাদ দিয়ে আমার বান্দাদের অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করবে? আমরা অবিশ্বাসীদের আপ্যায়নের জন্য জাহান্নাম প্রস্ত্তত করে রেখেছি’ (কাহফ ১৮/১০২)।
অতএব মৃতব্যক্তি কখনোই জীবিত নন। তিনি কারু ‘অলি’ বা অভিভাবক নন। তিনি তার নিজের বা অন্যের কোন ক্ষতি বা উপকার করতে পারেন না। তিনি কাউকে দেখতে পান না বা কারু কথা শুনতে পান না। যারা এটাতে বিশ্বাসী, তারা শিরকে ডুবে আছে। তারা কখনোই আল্লাহর অলী নয়। বরং নিঃসন্দেহে শয়তানের অলী। এরা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অন্যকে পথভ্রষ্ট করে। এরা মহাপাপী। খালেছ তওবা ব্যতীত এদের পাপের কোন ক্ষমা নেই।
বিগত যুগের কোন কোন ছূফী তো নিজেকেই ‘আল্লাহ’ বলেছেন। যেমন মেহমানের ডাকে ঘরে অবস্থানকারী আবু ইয়াযীদ বিসত্বামী ওরফে বায়েযীদ বোস্তামী (১৮৮-২৬১/৮০৪-৮৭৫ খৃঃ) বলেন, لَيْسَ فِي الْبَيْتِ أَحَدٌ إِلاَّ اللهُ ‘ঘরের মধ্যে কেউ নেই আল্লাহ ব্যতীত’।[4] একই আক্বীদার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে চালু হয়েছে, ‘যত কল্লা তত আল্লাহ’। অর্থাৎ সৃষ্টি সবাই স্রষ্টার অংশ। এরা আহমাদ ও আহাদ-এর মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পান না একটা মীম-এর পর্দা ব্যতীত। এসব পীরদের কবর মহাসমারোহে পূজিত হচ্ছে তাদের ভক্তদের মাধ্যমে। মৃত পীরকে খুশী করার জন্য এরা তাদের জান-মাল উৎসর্গ করছে। তার অসীলাতেই তারা পরকালে মুক্তি কামনা করছে (ইউনুস ১০/১৮; যুমার ৩৯/৩)। ওদিকে আবার ছালাত-ছিয়াম-হজ্জ-ওমরাহ সবই পালন করছে। এটাই যদি হয় বাস্তবতা, তাহ’লে জাহেলী আরবের মূর্তিপূজারীদের সাথে উপমহাদেশের এইসব কবরপূজারীদের আক্বীদার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
ওদিকে রাজনৈতিক নেতারা কিছু ইট ও রড-সিমেন্ট দিয়ে একটা স্তম্ভ খাড়া করে বা প্রতিকৃতি বানিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন করছেন। যেকোন উপলক্ষ্যে সেখানে গিয়ে নীরবতা পালন করছেন বা নেতার কবরে গিয়ে ফুল দিচ্ছেন ও ‘ফাতেহা’ পাঠ করছেন। ভাবখানা এই, যেন কবরস্থ নেতা বা নেতার ছবি ও প্রতিকৃতি সবই শুনছেন ও দেখছেন। অথচ এসবের পিছনে কোন যুক্তিও নেই, ধর্মও নেই, স্রেফ মূর্তিপূজারীদের অনুকরণ ব্যতীত। তাদের বানানো এইসব সৌধ, মিনার ও স্তম্ভগুলি এখন মসজিদের চাইতে পবিত্র স্থান বলে পূজিত হচ্ছে। অথচ যত লোক যতদিন যাবত এসবে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে, তত লোকের তত পরিমাণ পাপের বোঝা ক্বিয়ামতের দিন ঐ লোকদের উপরে চাপানো হবে, যারা এগুলি প্রতিষ্ঠা করেছে। যেমন আল্লাহ বলেন, لِيَحْمِلُوا أَوْزَارَهُمْ كَامِلَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمِنْ أَوْزَارِ الَّذِينَ يُضِلُّونَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ أَلاَ سَاءَ مَا يَزِرُونَ ‘ফলে ক্বিয়ামত দিবসে তারা পূর্ণমাত্রায় তাদের পাপভার বহন করবে এবং তাদেরও পাপভার বহন করবে যাদেরকে ওরা অজ্ঞতাবশে পথভ্রষ্ট করেছে। দেখো, তারা যা বহন করে, তা কতই না নিকৃষ্ট’ (নাহল ১৬/২৫)। পৃথিবীতে কাবীল প্রথমে মানুষ খুন করায় পরবর্তীতে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ অন্যায়ভাবে খুন হবে, সকলের পাপের একটি অংশ কাবীলের আমলনামায় লিপিবদ্ধ হবে।[5]
যদি সুন্নী বিদ্বানগণ শরী‘আত, তরীকত, হাকীকত, মা‘রেফাত এভাবে ইসলামকে বিভক্ত করে জনগণের সামনে পেশ না করতেন, তাহ’লে এর সুযোগ নিয়ে ইবলীস পৃথক পৃথক তরীকা ও খানকাহ খুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারত না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যা করেননি, তা থেকে সুধারণা বশেও কোন কাজ করলে শয়তান ঐ সুযোগে মুমিনের যে কতবড় সর্বনাশ করে, কবরপূজারী এইসব পথভ্রষ্ট তথাকথিত সুন্নী মুসলমানেরা তার বড় প্রমাণ। অতএব ছাহেবে মিরক্বাত বর্ণিত ‘ওলামায়ে ইসলাম’-এর সঠিক অর্থ হবে- علماء أهل السنة الصحيحة ‘ছহীহ সুন্নাহর অনুসারী আলেমগণ’। নিঃসন্দেহে তারা ‘আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম’ ব্যতীত আর কেউ নন।
(খ) একইভাবে বঙ্গানুবাদ মেশকাত শরীফের সম্মানিত অনুবাদক ‘ছাহাবীগণ এবং হাদীছ ও ফিক্বহের ইমামগণ আহলে সুন্নাতের আক্বীদার অনুসারী ছিলেন’ বলার পরে একই বাক্যে বলেছেন, ‘দুনিয়ার সমস্ত ছূফী ওলীগণও এই আকীদাই পোষণ করিয়া গিয়াছেন’।[6] অথচ ছূফী-ওলী এই পরিভাষাগুলি সৃষ্টি হয়েছে স্বর্ণযুগ গত হয়ে যাবার পরে ভ্রষ্টতার যুগে। যার মূল নিহিত রয়েছে ইরানের অনৈসলামী যুগের অদ্বৈতবাদী কুফরী দর্শনের মধ্যে। যাদের দৃষ্টিতে স্রষ্টা ও সৃষ্টি এক ও অদ্বৈত সত্তা এবং সৃষ্টি স্রষ্টার অংশ মাত্র। ইসলাম এই দর্শনের ঘোর প্রতিবাদ করে বলেছে যে, ‘আল্লাহ এক। তিনি মুখাপেক্ষীহীন। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তিনি কারু জন্মিত নন। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই’ (ইখলাছ ১১২/১-৪)। মাননীয় অনুবাদকের কথিত ছূফী-ওলীদের মর্যাদা নিঃসন্দেহে ছাহাবীগণের উপরে নয় বা তাদের সম মানের নয়। অথচ আহলেসুন্নাত ওয়াল জামা‘আত কেবল ছাহাবীগণের আক্বীদা ও আমলের অনুসারী, অন্যদের নয়।
অতঃপর মাননীয় অনুবাদক লিখেছেন, হাদীছে ফের্কা বলিতে আকীদা ও বিশ্বাসগত দলকেই বুঝাইয়াছে। কারণ আকীদা বা বিশ্বাসই হইল ইছলামের মূল। সুতরাং হানাফী, শাফেঈ প্রভৃতি ইহার অন্তর্গত নহে। ইহাদের সকলের আকীদাই এক। ইহারা সকলেই আহলুছ ছুন্নাতে ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত। ইহাদের এখতেলাফ শুধু ওজু, নামাজ প্রভৃতি খুঁটিনাটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ’।[7]
কথাটি যত হালকাভাবে বলা হয়েছে, বিষয়টি তত হালকা নয়। কেননা খুঁটিনাটি ইখতেলাফ অতক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য, যতক্ষণ সেখানে ছহীহ হাদীছের সমাধান না পাওয়া যায়। পেয়ে গেলে সেটাই মেনে নিতে হবে। আর তখন কোন ইখতেলাফ থাকবে না। কিন্তু সেটা পাওয়ার পরেও যদি যিদ করা হয়, তখন সেটা তাক্বলীদ হয়ে যাবে। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রদত্ত বিধান বাদ দিয়ে অন্যের বিধান মান্য করা হবে। যা ‘শিরক ফির-রিসালাত’-এর পর্যায়ভুক্ত এবং যা নিষিদ্ধ। এই নিষিদ্ধ কাজের পরিণামেই মুসলিম উম্মাহ তাদের ‘খেলাফত’ হারিয়েছে। আজও সমাজে সর্বত্র ধর্মীয় হানাহানি মূলতঃ এই তাক্বলীদী যিদ ও মাযহাবী হঠকারিতার কারণেই বিদ্যমান রয়েছে।
অতএব যুক্তির নিরিখে মাননীয় অনুবাদকের উপরোক্ত বক্তব্য অনেকটা সঠিক হ’লেও বাস্তবতা বহুলাংশে ভিন্ন। কেননা (ক) উপমহাদেশের কবরপূজারী মুসলমানেরা অধিকাংশ হানাফী মাযহাবভুক্ত। অথচ কবরপূজা পরিষ্কারভাবে শিরক। এতদ্ব্যতীত আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কেও তাদের অনেকের আক্বীদা ভ্রান্তিপূর্ণ। যেমন (খ) অধিকাংশ হানাফী আলেম বলেন, ‘আল্লাহ নিরাকার। তিনি সর্বত্র বিরাজমান’। অথচ এগুলি আহলে সুন্নাতের আক্বীদা বহির্ভূত। কেননা সঠিক আক্বীদা হ’ল এই যে, আল্লাহর নিজস্ব আকার আছে, যা তাঁর উপযুক্ত এবং যা কারু সাথে তুলনীয় নয় (শূরা ৪২/১১)। তাঁর সত্তা সপ্তাকাশের উপরে আরশে সমুন্নীত (ত্বোয়াহা ২০/৫-৬)। তাঁর ইল্ম ও কুদরত তথা জ্ঞান ও শক্তি সর্বত্র বিরাজিত (বাক্বারাহ ২/২৫৫)।
(গ) অনেক হানাফী ওলামা-মাশায়েখ বলেন, মুহাম্মাদ (ছাঃ) মানুষ নবী ছিলেন না, তিনি ছিলেন নূরের নবী। তারা বলেন, আল্লাহর নূরে মুহাম্মাদ পয়দা, মুহাম্মাদের নূরে সারা জাহান পয়দা’। অথচ মুহাম্মাদ (ছাঃ) নূরের তৈরী ছিলেন না। তিনি ছিলেন অন্যান্য মানুষের ন্যায় মাটির মানুষ (কাহফ ১৮/১১০)। তিনি সাধারণ মানুষের ন্যায় খানা-পিনা করতেন। বিয়ে-শাদী করেছিলেন। সন্তানের পিতা হয়েছিলেন। অথচ ‘নূর’ হলে তিনি এসব হতে মুক্ত থাকতেন। (ঘ) অধিকাংশ হানাফী আলেমের নিকটে চার মাযহাব মান্য করা ফরয এবং মাযহাবী তাক্বলীদ করা ফরয। আর চার ইমামের পরে ইজতিহাদের দুয়ার বন্ধ। (ঙ) অনেকের নিকটে পীর ধরা ফরয। যার কোন পীর নেই, শয়তান তার পীর’। অথচ এগুলি আহলে সুন্নাতের আক্বীদাভুক্ত নয়। অতএব ‘শুধু ওজু, নামাজ প্রভৃতি খুঁটিনাটি বিষয়ের মধ্যে এখতেলাফ সীমাবদ্ধ’ বলে আত্মতুষ্টি লাভের কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া ওযূ ও ছালাত কখনোই খুঁটিনাটি বিষয় নয়। বরং ছালাত হ’ল সর্বপ্রধান ইবাদত, ক্বিয়ামতের দিন যার প্রথম হিসাব নেওয়া হবে। ছালাতের হিসাব সুষ্ঠু হ’লে বাকী সবকিছুর হিসাব সুষ্ঠু হবে। নইলে সব বরবাদ হবে।[8]
অতএব আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী বিবাদীয় সকল বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যেতে হবে। আর সুন্নাহ হ’তে হবে ছহীহ সুন্নাহ। কোন যঈফ বা জাল হাদীছ নয়। সুতরাং তারাই হবে সত্যিকারের আহলে সুন্নাত, যারা নিজেদের মনগড়া শিরকী ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ থেকে খালেছভাবে তওবা করে সর্বাবস্থায় ছহীহ হাদীছমুখী হবে। নইলে মুখে ‘সুন্নী’ বলে কাজের বেলায় শিরক ও বিদ‘আতের বাজার গরম করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিদর্শন নয়।
অতএব افةراق الأمة বা উম্মতের বিভক্তি রোধের একটাই পথ খোলা রয়েছে। আর তা হ’ল, الرجوع إلي الكةاب والسنة الصحيحةঅর্থাৎ তাক্বলীদী গোঁড়ামী পরিহার করে নিরপেক্ষ ও খোলা মন নিয়ে সর্বাবস্থায় পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দিকে ফিরে যাওয়া এবং খোলাফায়ে রাশেদীন, ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আতের বুঝ হাছিল করা। কারু কোন বিষয় জানা না থাকলে বিজ্ঞ ও মুত্তাক্বী আলেমের নিকট থেকে তিনি জেনে নিবেন দলীলের ভিত্তিতে, রায়-এর ভিত্তিতে নয়। মনে রাখা আবশ্যক যে, দ্বীন সম্পূর্ণ হয়েছে রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায়। অতএব রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগে যা দ্বীন ছিল না, এ যুগে তা দ্বীন নয়। যতই তার গায়ে দ্বীনের লেবাস পরানো হৌক না কেন।[1]. মোল্লা আলী ক্বারী, মিরক্বাত শরহ মিশকাত (দিল্লী : তাবি) ১/২৪৮ পৃঃ।
[2]. মিরক্বাত ১/২৪৮ পৃঃ।
[3]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২।
[4]. আব্দুর রহমান, আন-নাক্বশাবান্দিায়া (রিয়ায : দার ত্বাইয়িবাহ, ১৪০৯/১৯৮৮), পৃঃ ৭৭।
[5]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২১১ ‘ইলম’ অধ্যায়।
[6]. নূর মোহাম্মদ আ‘জমী, বঙ্গানুবাদ মেশকাত শরীফ (ঢাকা : এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ১৯৮৬), হা/১৬৩ (৩১)-এর ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য, ১/১৮১ পৃঃ।
[7]. পূর্বোক্ত, ১/১৮২ পৃঃ।
[8]. ত্বাবারাণী আওসাত্ব, ছহীহাহ হা/১৩৫৮; আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১৩৩০।