ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ক্ষেত্রসমূহ

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মূলতঃ দু’টি ক্ষেত্রে কার্যকর : ধর্মীয় ক্ষেত্রে ও বৈষয়িক ক্ষেত্রে।

(ক) ধর্মীয় ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ : ধর্মীয় ক্ষেত্রে তাওহীদে ইবাদতকে বিঘ্নিত করেন যুগে যুগে দুষ্টমতি ধর্মীয় নেতাগণ। যেমন নূহের কওম, ইবরাহীমের কওম, মূসা ও ঈসার কওমের নেতারা করেছিল। আল্লাহ ইহূদী-নাছারাদের পথভ্রষ্টতার কারণ নির্দেশ করে বলেন,

اِتَّخَذُوْا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِ وَالْمَسِيْحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوْا إِلاَّ لِيَعْبُدُوْا إِلَـهًا وَاحِدًا لاَّ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُوْنَ- (الةوبة ৩১)-

‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের আলেম ও পীর-আউলিয়াদেরকে এবং মরিয়মপুত্র ঈসাকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছিল। অথচ তাদের কেবলমাত্র এক আল্লাহর দাসত্ব করতে হুকুম দেওয়া হয়েছিল। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আর তারা যে শিরক করে, তা হ’তে তিনি পবিত্র’ (তওবা ৯/৩১)

উক্ত আয়াত সম্পর্কিত ঘটনাটি নিম্নরূপ :

عَنْ عَدِيِّ بْنِ حَاتِمٍ قَالَ: أَتَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَفِي عُنُقِي صَلِيبٌ مِنْ ذَهَبٍ، فَقَالَ: يَا عَدِيُّ اطْرَحْ هَذَا الْوَثَنَ مِنْ عُنُقِكَ، فَطَرَحْتُهُ فَانْتَهَيْتُ إِلَيْهِ وَهُوَ يَقْرَأُ سُورَةَ بَرَاءَةَ فَقَرَأَ هَذِهِ الْآيَةَ (اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ وَالْمَسِيْحَ ابْنَ مَرْيَمَ) قُلْتُ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! إنَّا لَسْنَا نَعْبُدُهُمْ، فَقَالَ: أَلَيْسَ يُحَرِّمُوْنَ مَا أَحَلَّ اللهُ فَتُحَرِّمُوْنَهُ، ويُحِلُّوْنَ مَا حَرَّمَ اللهُ فَتُحِلُّونَهُ؟ قُلْتُ: بَلَى، قَالَ: فَتِلْكَ عِبَادَتُهُمْ، رواه ابن جرير في تفسيره واللفظ لحديث أبي كريب-

‘(তৎকালীন খ্যাতনামা খ্রিষ্টান ধর্মনেতা) ‘আদী বিন হাতেম হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি (৯ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে (ইসলাম কবুলের জন্য মদীনায়) আসি। এমতাবস্থায় আমার গলায় স্বর্ণের একটি ক্রুশ ঝুলানো ছিল। এটা দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে আদী! তোমার গলা থেকে ঐ মূর্তিটা ফেলে দাও। তখন আমি ওটা খুলে ফেলে দিলাম এবং তাঁর নিকটে গিয়ে বসলাম। এ সময় তিনি সূরা তওবাহর (উপরে বর্ণিত ৩১) আয়াতটি পড়ছিলেন। আমি বললাম, لَسْنَا نَعْبُدُهُمْ ‘আমরা তাদের ইবাদত করি না’। জবাবে তিনি বললেন, ‘তারা কি আল্লাহর হালালকৃত বিষয়গুলিকে হারাম করে না? অতঃপর তোমরাও সেগুলিকে হারাম গণ্য কর। তারা কি আল্লাহর হারামকৃত বিষয়গুলি হালাল করে না? অতঃপর তোমরাও তা হালাল গণ্য কর। আদী বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, فَتِلْكَ عِبَادَتُهُمْ ‘ওটাই তো ওদের ইবাদত হ’ল’।

উক্ত হাদীছের ব্যাখায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,

لَمْ يَأْمُرُوْهُمْ أَنْ يَّسْجُدُوْا لَهُمْ، وَلَكِنْ أَمَرُوْهُمْ بِمَعْصِيَةِ اللهِ، فَأَطَاعُوْهُمْ، فَسَمَّاهُمُ اللهُ بِذَلِكَ أَرْبابًا.

‘ইহূদী-নাছারা ধর্মনেতাগণ তাদেরকে সিজদা করার জন্য বলেননি। বরং তারা আল্লাহর নাফরমানীর কাজে মানুষকে হুকুম দিতেন এবং লোকেরা তা মান্য করত। ফলে আল্লাহ তাদেরকে ‘রব’ হিসাবে অভিহিত করেন’।[1]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِي مَا أَتَى عَلَى بَنِي إِسْرَائِيْلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ...رواه الترمذىُّ-

‘আমার উম্মতের উপরে এমন অবস্থা অবশ্যই আসবে, যেমন এসেছিল বনু ইস্রাঈলের উপরে, একজোড়া জুতার একটি অপরটির ন্যায়’।[2] ঐ অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য আমাদেরকে ছালাতের প্রতি রাক‘আতে সূরা ফাতিহায় প্রার্থনা করতে হয় غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ ‘(হে আল্লাহ!) আমাদেরকে সে পথে পরিচালিত করো না, যে পথে চলার কারণে লোকেরা অভিশপ্ত হয়েছে ও পথভ্রষ্ট হয়েছে’ (ফাতিহা ১/৭)

রাসূল (ছাঃ) বলেন, এখানে ‘মাগযূব’ (অভিশপ্ত) হ’ল ইহূদীরা এবং ‘যোয়াল্লীন’ (পথভ্রষ্ট) হ’ল নাছারারা’।[3] অর্থাৎ মুসলিম উম্মাহর অবস্থা বিগত ইহূদী-নাছারাদের ন্যায় হবে। তবে পার্থক্য এই যে, তারা তাদের নিকটে প্রেরিত এলাহী গ্রন্থ তাওরাত-ইঞ্জীলকে পরিবর্তন করে তা একেবারেই বিকৃত ও বিনষ্ট করে ফেলেছে। পক্ষান্তরে মুসলমানেরা সেটা করতে না পেরে বহু ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীছের ‘তাবীল’ অর্থাৎ দূরতম ব্যাখ্যা ও অপব্যাখ্যা করেছে। তাফসীরের নামে বহু বাজে গল্প রটনা করেছে। এমনকি সুযোগ মত হাদীছ তৈরী করে অথবা সেখানে কিছু যোগ-বিয়োগ করে ধর্মীয় বিধানকে নিজেদের মনমত করে নিয়েছে। ফলে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর বদলে মুসলিম জীবনের ধর্মীয় বিষয়গুলির বহু ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাযহাব ও তরীকার ধর্মনেতাদের রচিত বিধানসমূহ তাক্বলীদে শাখছীর নামে চোখ বুঁজে মান্য করা হচ্ছে। এভাবে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের পরিবর্তে মানবরচিত বিধান সমূহ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ধর্মের নামে, যার পিছনে আল্লাহর কোন অনুমতি নেই।

পৃথিবীর প্রাচীনতম শিরক হচ্ছে মৃত মানুষের পূজা। যা মূর্তি ও প্রতিমা পূজা রূপে কিংবা স্থানপূজা রূপে কাফির ও মুশরিক সমাজে চালু আছে। আজকাল সেগুলিই মুসলিম সমাজে চলছে মাযার ও কবরপূজা রূপে। চলছে ছবি ও প্রতিকৃতি পূজা। চলছে কথিত শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদির পূজা। বলা হচ্ছে পীর-আউলিয়াগণ মরেন না। তারা কবরে জীবিত থাকেন ও ভক্তের আহবান শুনেন ও তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন(নাঊযুবিল্লাহ)। বলা বাহুল্য, এভাবেই আল্লাহকৃত হারামকে হালাল করা হচ্ছে ধর্মের নামে। আর এভাবেই চলছে মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনে এক অঘোষিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’।

(খ) বৈষয়িক ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ : ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে মুসলমানদের অনেকে বিশুদ্ধভাবে ধর্মীয় বিধান মেনে চললেও বৈষয়িক জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে চলছে অনৈসলামী বিধান সমূহ, যা আল্লাহ নাযিল করেননি। যেমন অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে আইনসিদ্ধভাবেই সূদ, বেশ্যাবৃত্তি প্রভৃতি হারামকে হালাল করা হয়েছে। অথচ আল্লাহ বলেন,

أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُوْنَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُّوْقِنُوْنَ- (المائدة ৫০)-

‘তবে কি তারা জাহেলিয়াতের বিধানসমূহ কামনা করে? বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহর চাইতে সুন্দর বিধানদাতা আর কে আছে’? (মায়েদাহ ৫/৫০)

প্রথমোক্ত মতের লোকেরা শেষোক্ত লোকদের চাইতে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত। কেননা প্রথমোক্ত লোকেরা তাদের শিরক ও বিদ‘আতগুলিকে ধর্ম ভেবেই করে থাকে। ফলে তারা তওবা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু শেষোক্ত লোকেরা তাদের কাজগুলিকে অন্যায় ভেবেই করে। ফলে তাদের তওবা করার সম্ভাবনা থাকে। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন!


[1]. ইবনু জারীর হা/১৬৬৩২, ১৬৬৪১, তাফসীর জামে‘উল বায়ান (বৈরূত ছাপা : ১৯৮৭), ১০/৮০-৮১; ছহীহাহ হা/৩২৯৩; তিরমিযী হা/৩০৯৫ ‘তাফসীর’ অধ্যায় ‘সূরা তওবা’ অনুচ্ছেদ, সনদ হাসান।

[2]. তিরমিযী হা/২৬৪১; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯২; মিশকাত হা/১৭১; ছহীহাহ হা/১৩৪৮।

[3]. তিরমিযী হা/২৯৫৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৮২০২।