ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ

অমুসলিমদের প্রতি ইসলামের নীতি

(১) হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, একটি ইহূদী বালক রাসূল (ছাঃ)-এর সেবা করত। সে তাঁর ওযূর পানি এনে দিত ও জুতা গুছিয়ে দিত। একসময় সে পীড়িত হ’ল। রাসূল (ছাঃ) তার বাড়ীতে তাকে দেখতে গেলেন ও মাথার কাছে বসলেন। অতঃপর ছেলেটিকে বললেন, তুমি ইসলাম কবুল কর’। ছেলেটি তার বাপের দিকে তাকাল। বাপ তাকে বলল, أَطِعْ أَبَا الْقَاسِمِ ‘তুমি আবুল ক্বাসেম-এর কথা মেনে নাও। তখন ছেলেটি কালেমা শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম কবুল করল। অতঃপর মারা গেল। এরপর রাসূল (ছাঃ) বের হবার সময় বললেন الْحَمْدُ للهِ الَّذِى أَنْقَذَهُ بِىْ مِنَ النَّارِ ‘আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা। যিনি তাকে আমার মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলেন’।[1]

এখানে শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, নিজের বাড়ীর কাজের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও রাসূল (ছাঃ) কখনো তাকে বা তার ইহূদী পরিবারকে ইসলাম কবুলের জন্য চাপ দেননি। 

(২) ওমর ফারূক (রাঃ) স্বীয় খেলাফতকালে একবার তার খ্রিষ্টান গোলাম উসাক্বকে ইসলামের দাওয়াত দেন। কিন্তু সে অস্বীকার করে। তখন তিনি لاَ إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ (‘দ্বীনের ব্যাপারে কোন যবরদস্তি নেই’) আয়াতাংশটি পাঠ করেন। অতঃপর বলেন, ‘হে উসাক্ব! তুমি ইসলাম কবুল করলে মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমি তোমার নিকট থেকে সাহায্য নিতাম’।[2]

(৩) ওমর ফারূক (রাঃ) স্বীয় খেলাফতকালে ১৫ হিজরীতে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয় উপলক্ষ্যে ফিলিস্তীন সফরে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে তিনি ওযূর পানি তলব করেন। তখন রাস্তার পাশের এক বাড়ী থেকে তাঁকে পানি এনে দেওয়া হয়। তিনি ওযূ শেষে বললেন, কোথা থেকে এ পানি আনলে? কোন কুয়ার পানি বা বৃষ্টির পানি আমি এত সুমিষ্ট পাইনি। রাবী বললেন, এই বৃদ্ধা খ্রিষ্টান মহিলার বাড়ী থেকে এনেছি। তখন ওমর (রাঃ) তার কাছে গেলেন ও বললেন, হে বৃদ্ধা! اَسْلِمِى تَسْلَمِى ‘ইসলাম কবুল কর। (জাহান্নাম থেকে) বেঁচে যাবে’। আল্লাহ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন। তখন বৃদ্ধা তার মাথা আলগা করে দেখালো কাশফুলের মত ধবধবে সাদা একরাশ চুল। অতঃপর বলল, وَأَنَا اَمُوْتُ الْآنَ ‘আমি এখন মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গেছি’। একথা শুনে ওমর (রাঃ) বললেন, اَللَّهُمَّ اشْهَدْ ‘হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক’ (যে, আমি তাকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি)। কুরতুবী বর্ধিতভাবে লিখেছেন, অতঃপর তিনি لاَ إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ আয়াতাংশটি পাঠ করলেন।[3]

এখানে শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, সে সময়কার খ্রিষ্টান বিশ্ব যে ওমরের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল এবং যখন ফিলিস্তীনের খ্রিষ্টান নেতারা তাঁকে অভ্যর্থনার জন্য প্রস্ত্তত, সে অবস্থায় তিনি একজন খ্রিষ্টান বৃদ্ধার প্রতিও ইসলাম কবুলের জন্য চাপ দেননি।

এরূপ অসংখ্য নযীর ইসলামী খেলাফতের পরতে পরতে রয়েছে। অথচ ইসলাম হ’ল মানবজাতির জন্য আল্লাহর মনোনীত সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ দ্বীন (আলে ইমরান ৩/১৯, মায়েদাহ ৫/৩)। আর ইসলাম কবুল না করলে মানুষকে অবশ্যই পরকালে জাহান্নামী হ’তে হবে।[4] এরপরেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ), খোলাফায়ে রাশেদীন ও ছাহাবায়ে কেরাম মানুষকে কেবল ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু কারু প্রতি চাপ প্রয়োগ করেননি।

এতে প্রমাণিত হয় যে, ইসলামেই মাত্র অন্য ধর্মের লোকেরা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালনের সুযোগ পায়। অথচ কথিত ধর্মনিরপেক্ষ ও কম্যুনিষ্ট দেশগুলিতে ইসলামের প্রকৃত স্বাধীনতা নেই। সেখানে মুসলমানদের গরু কুরবানী করতে বা মাইকে আযান দিতে, এমনকি একের অধিক সন্তান নিতেও নিষেধ করা হয়। মিথ্যা অজুহাতে মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। মুসলমান নারী-পুরুষকে হত্যা করা হয় ও নিষ্ঠুরতম নির্যাতন করা হয়। অতএব ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ অর্থ সব ধর্মের স্বাধীনতা নয় বা অসাম্প্রদায়িকতা নয়, বরং এর প্রকৃত অর্থ হ’ল ইসলামকে প্রতিহত করা।


[1]. আবুদাঊদ হা/৩০৯৫; আহমাদ হা/১৩৩৯৯; বুখারী হা/১৩৫৬;  মিশকাত হা/১৫৭৪; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আলে ইমরান ১৯ আয়াত।

[2]. তাফসীর ইবনু আবী হাতেম হা/২৬৫৪; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ২৫৬ আয়াত।

[3]. বায়হাক্বী ‘তাহারৎ’ অধ্যায় ১/৩২ পৃঃ; দারাকুৎনী হা/৬০-৬১; কুরতুবী, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ২৫৬ আয়াত; আল-বিদায়াহ ৭/৫৬।

[4]. মুসলিম হা/১৫৩; মিশকাত হা/১০।