অন্ধকারে আলো
অবক্ষয় যুগে পাঁচজন ছূফী মুহাদ্দিছের মাধ্যমে উপমহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের পাঁচটি প্রধান কেন্দ্র পরিচালিত হয়। (১) শায়খ নিযামুদ্দীন আউলিয়া মুহাম্মদ বিন আহমাদ বিন ‘আলী (৬৩৪-৭২৫হিঃ/১২৩৬-১৩২৫খৃঃ) দিল্লীতে (২) সাইয়িদ বাহাউদ্দীন যাকারিয়া (৫৭৮-৬৬৬ হিঃ/১১৮০- ১২৬৭ খৃঃ) মুলতানে (৩) আমীর কবীর সাইয়িদ ‘আলী ইবনু শিহাব হামাদানী (৭১৪-৭৮৬হিঃ/১৩১৪-১৩৮৫খৃঃ) কাশ্মীরে (৪) মুহাদ্দিছ শারফুদ্দীন আবু তাওয়ামা বুখারী (মৃঃ ৭০০ হিঃ/১৩০০ খৃঃ) বাংলাদেশের সোনারগাঁয়ে এবং (৫) তাঁর কীর্তিমান ছাত্র ও জামাতা মাখদূমুল মুল্ক শারফুদ্দীন আহমাদ বিন ইয়াহ্ইয়া মুনীরী (৬৬১-৭৮২ হিঃ/১২৬৩-১৩৮১ খৃঃ) বিহারে ‘মুনীর’ নামক স্থানে। অবশ্য শায়খ আহমাদ সারহিন্দী ‘মুজাদ্দিদে আলফে ছানী’ (৯৭১-১০৩৪ হিঃ/১৫৬৪-১৬২৪ খৃঃ)-কেও আমরা এ কাতারে শামিল করতে পারি।
এছাড়াও দাক্ষিণাত্য, গুজরাট, মালওয়া, খান্দেশ, সিন্ধু, লাহোর, ঝাঁসি, কাল্পী, আগ্রা, লাক্ষ্ণৌ, জৌনপুর প্রভৃতি স্থানে ইলমে হাদীছের কেন্দ্র ছিল।
অবক্ষয় যুগে যে সকল মহান শাসক ইলমে হাদীছের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন, তাঁরা হ’লেন, (১) সুলতান মাহমূদ গযনবী (মৃঃ ৪২১হিঃ/১০৩০খৃঃ), যিনি হানাফী মাযহাব ত্যাগ করে ‘আহলেহাদীছ’ হন এবং ৩৯২ হিজরীতে লাহোর জয় করে গযনবী শাসন কায়েম করেন। অতঃপর ৪৪৩ হিজরীতে শী‘আদের হাতে গযনবী শাসনের অবসান ঘটে। (২) দাক্ষিণাত্যের বাহমনী শাসক সুলতান মাহমূদ শাহ (৭৮০-৭৯৯হিঃ/১৩৭৮-১৩৯৭খৃঃ), সুলতান ফীরোয শাহ, সুলতান আহমাদ শাহ যিনি ‘অলিয়ে বাহমনী’ নামে খ্যাত ছিলেন প্রমুখ হাদীছভক্ত শাসকদের যুগ চলে ৮৮৬ হিজরী মোতাবেক ১৪৮১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ১০৩ বৎসর ব্যাপী। অতঃপর (৩) পার্শ্ববর্তী গুজরাটের মুযাফফরশাহী সুলতানগণ ইলমে হাদীছের পৃষ্ঠপোষকতায় খ্যাতি লাভ করেন। যদিও মোগল বাদশাহ হুমায়ূন (৯৪১-৪২/১৫৩৪-৩৫খৃঃ) ১৩ মাস ব্যাপী গুজরাট অবরোধ করে রাখার ফলে ‘কান্যুল উম্মালের’ স্বনামধন্য সংকলক মুহাদ্দিছ ‘আলী মুত্তাকী জৌনপুরী (মৃঃ ৯৭৫হিঃ/১৫৬৭খৃঃ) ও মুহাদ্দিছ আব্দুল্লাহ সিন্ধী (মৃঃ ৯৯৩হিঃ/১৫৮৫খৃঃ)-এর ন্যায় খ্যাতনামা মুহাদ্দিছগণ গুজরাট ছেড়ে হেজায চলে যেতে বাধ্য হন। যাই হোক মুযাফফরশাহী সালত্বানাতের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান মাহমূদ বেগরহা (৮৬৩-৯১৭/১৪৫৮-১৫১১খৃঃ) ও তাঁর পরবর্তী সুলতানদের উদার পৃষ্ঠপোষকতার কারণে আরব দেশ হ’তে বহু মুহাদ্দিছ গুজরাটে আগমন করেন। ফলে ৯৮০ হিজরী মোতাবেক ১৫৭২ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ১১৪ বৎসর ব্যাপী সেখানে আহলেহাদীছ আন্দোলন যোরদার থাকে। এই সময় গুজরাটকে ‘বাব মক্কা’ বা ‘মক্কার দ্বার’ বলা হ’ত। (৪) দক্ষিণ ভারতের বাহমনী ও মুযাফফরশাহী যুগের সমসাময়িক বাংলাদেশেও আল্লাহ পাক তাঁর এক শাসক বান্দাকে ইলমে হাদীছের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে কবুল করেন। তিনি হ’লেন বাংলার সুলতান আলাউদ্দীন হুসায়েন শাহ বিন সাইয়িদ আশরাফ মাক্কী (৯০০-৯২৪হিঃ/১৪৯৩-১৫১৮খৃঃ), যাঁর সম্পর্কে ইতিপূর্বে আমরা আলোকপাত করে এসেছি।
৩. আধুনিক যুগ : ১১১৪ হিজরী হ’তে বর্তমান সময় কাল পর্যন্ত। উপরোল্লেখিত মুহাদ্দিছ ও শাসকদের উদার পৃষ্ঠপোষকতার ফলে অবক্ষয় যুগে উপমহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের দীপশিখা নিবু নিবু করে হ’লেও জ্বলছিল। অবশেষে দ্বাদশ শতাব্দী হিজরীতে এসে আল্লাহ পাকের খাছ মেহেরবাণীতে ফাতাওয়া আলমগীরীর অন্যতম সংকলক দিল্লীর বিখ্যাত মাদরাসা রহীমিয়ার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা আব্দুর রহীমের ঔরসে জন্মগ্রহণ করলেন উপমহাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনে নীরব বিপ্লব সৃষ্টিকারী বিশ্ববিখ্যাত আলেম ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ্’র অমর লেখক শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬হিঃ/১৭০৩-১৭৬২খৃঃ)। তাঁর শাণিত যুক্তি ও ক্ষুরধার লেখনী জনগণের মধ্যে নিরপেক্ষভাবে ছহীহ হাদীছ অনুসরণের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে। তাঁর পরে তদীয় স্বনামধন্য চার পুত্র শাহ আব্দুল আযীয, শাহ আব্দুল কাদের, শাহ আব্দুল গণী ও শাহ রফীউদ্দীনের শিক্ষাগুণে ও তাঁদের পরে অলিউল্লাহ পরিবারের গৌরবরত্ন মুজাহিদে মিল্লাত শাহ ইসমাঈল বিন শাহ আব্দুল গণী (১১৯৩-১২৪৬হিঃ/১৭৭৯-১৮৩১খৃঃ) পরিচালিত ‘জিহাদ আন্দোলনে’র মাধ্যমে সারা ভারতবর্ষে একটি সামাজিক বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে, যা উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বর্তমানে বসবাস রত প্রায় ৫ কোটি আহলেহাদীছ জনগণ সেই আদর্শিক জোয়ারেরই ফসল বলা চলে। এ জোয়ারে কখনও কখনও ভাটা আসলেও স্রোত কখনও থেমে যায়নি। আজও বহু ভাগ্যবান ব্যক্তি তাক্বলীদের মায়াবন্ধন ছিন্ন করে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী জীবন গড়ার শপথ নিয়ে ‘আহলেহাদীছ’ হচ্ছেন, ফালিল্লা-হিল হাম্দ। যে আহলেহাদীছদের রক্তে-মাংসে, অস্থি ও মজ্জায় বালাকোট, বাঁশের কিল্লা, পাঞ্জতার, সিত্তানা, মুল্কা, আম্বেলা, আসমাস্ত, চামারকান্দ ও আন্দামানের রক্তাক্ত স্মৃতি সমূহ, জেল-যুলুম, ফাঁসি, সম্পত্তি বাযেয়াফ্ত, যাবজ্জীবন কারাদন্ড, দ্বীপান্তর ও কালাপানির অবর্ণনীয় নির্যাতন, গাযী ও শহীদী রক্তের অমলিন ছাপ সমূহ আজও ভাস্বর হয়ে আছে।