নিকট অতীতের কয়েকজন স্মরণীয় মুজাহিদ
(১) সীমান্তের ‘আসমাস্ত’ কেন্দ্রের ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুজাহিদ পাবনা হেমায়েতপুরের গাযী মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ সালাফী, যিনি ‘রাহাতুল্লাহ’ ছদ্মনামে উক্ত কেন্দ্রে অবস্থান করতেন। গত ১৯৭২ সালের ৬ই জানুয়ারী পাবনায় নিজ বাড়ীতে মৃত্যুবরণ করেন। (২) মালদহের কারবোনার গাযী মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব সালাফী ওরফে ‘মূসা কমান্ডার’ গত ১৯৮৯ সালে ঠাকুরগাঁও যেলার রাণীশংকৈলের দিহোট গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। যিনি আমীর রহমাতুল্লাহর (১৯২১-১৯৪৯খৃঃ) নির্দেশক্রমে ইংরেজ বড়লাটকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে আসমাস্ত কেন্দ্র হ’তে দিল্লী যাওয়ার পথে পাঞ্জাবের রাজধানী অমৃতসরে পৌঁছে যখন শুনলেন যে, এখানকার স্বর্ণমন্দিরের পুরোহিত শিখগুরু ঈশ্বর সিং পবিত্র কুরআনের উপরে পা রেখে বক্তৃতা করে, তখন তিনি ও তাঁর চারজন সাথী যশোরের গাযী আব্দুর রশীদ, ঢাকার গাযী আলীমুদ্দীন ও অপর দু’জন অবাংগালী মুজাহিদ সর্বপ্রথম এই শয়তানটাকে খতম করার সিদ্ধান্ত নেন এবং পরিকল্পনা মোতাবেক গাযী মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব নিজেই ছদ্মবেশে গিয়ে ঈশ্বর সিংয়ের মাথা কেটে আনেন বলে শ্রুতি আছে। নিজের জীবনের এই সোনালী স্মৃতি রোমন্থনের সময় গাযী ছাহেব নাকি প্রায়ই বলতেন, ‘আমার আমলনামায় কিছুই নেই ঈশ্বর সিংয়ের খুন ছাড়া’।
অমৃতসর হ’তে দিল্লী আসার পর তাঁরা শুনলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বিদ্রূপকারী ‘রংগীলা রসূল’ বইয়ের গুমনাম লেখক-এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক স্বামী শ্রদ্ধানন্দ (১৮৫৫-১৯২৬খৃঃ) দিল্লী আসছেন। আবার প্রতিজ্ঞা নিলেন যশোরের গাযী আব্দুর রশীদ। দুর্দান্ত সাহস নিয়ে একাই শ্রদ্ধানন্দের কক্ষে ঢুকে সেখানেই তাকে শেষ করে দিয়ে খুশী মনে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। শ্রদ্ধানন্দের আরদালী তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। দিল্লীর মুসলমানেরা ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে বললেন আমরা আব্দুর রশীদকে তার ওযনে সোনা দিয়ে খরিদ করে নিব, ওকে মুক্তি দিন। ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, ‘ওকে শুধু এটুকু বলতে বলুন যে, মারের কথা আমার মনে নেই’। কিন্তু না, জান্নাত পাগল আব্দুর রশীদ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিলেন,
ميرﮮــــــــﮧــــﮟـــــﯽـــــﯽ نـﮩـــﮟـــﮯــــــــــــــــــــــــــــــــــــﮯـــــــــــﮯـــﮯ ، كبهي اسے ميںــــﮢـلا نـﮩـــﮟ سكتا-
‘আমার আমলনামায় কোন নেকী নেই কেবলমাত্র রাসূলকে বিদ্রূপকারী এই দুশমনটার খুন ছাড়া। আমি এই খুনকে কখনো অস্বীকার করতে পারি না’। সুব্হা-নাল্লাহ...। ফাঁসি হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে দু’জন অবাংগালী মুজাহিদ পুলিশের কাছ থেকে তাঁর লাশ ছিনিয়ে এনে ছদর বাযারের মুসলমানদের সহায়তায় দিল্লীর শাহী গোরস্থানে দাফন করেন। মুজাহিদদের এই ক্রমবর্ধমান তৎপরতায় বাধ্য হয়ে ইংরেজ সরকার আমীর রহমাতুল্লাহর সঙ্গে সন্ধি করেন ও তাঁদের নিকটে জিহাদ ফান্ডের দশ হাযার টাকা সহ বন্দী পাবনার গাযী আবুল কাসেম ওরফে কাসেম ও নীলফামারী জলঢাকার কচুয়া গ্রামের গাযী মাওলানা মুজাহিদকে বিনাশর্তে মুক্তি দেন। যে গাযী মাওলানা মুজাহিদ হ’লেন রাজশাহী নওহাটার জনাব মকবুল চেয়ারম্যানের আপন পিতামহ (দাদা)।
(৩) ‘আসমাস্ত’ কেন্দ্রের ‘বড়ী জামা‘আতের যিম্মাদার’ কমান্ডার রাজশাহী বাগমারার গাযী মাওলানা আনোয়ারুদ্দীন যিনি ‘আব্দুল হাই’ ছদ্মনামে কেন্দ্রে থাকতেন ও পরবর্তীতে ‘আব্দুল হাই আনোয়ারী’ নামে নিজদেশে পরিচিত হন, তিনি তো মাত্র গত ১৯৯০ সালের ২৩শে ডিসেম্বর তারিখে নিজ গ্রাম শেরকোলে শেষ নিঃশাস ত্যাগ করলেন। (ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহে রা-জে‘ঊন)। (৪) রাজশাহী কাকনহাটের নিকটবর্তী পাঁচগাছিয়ার গাযী আব্দুল জাববার, যিনি নিজের ও অন্যের দেওয়া চাঁদা সহ মোট ৬০,০০০/= টাকা নিয়ে জিহাদের উদ্দেশ্যে সীমান্তে পাড়ি দিয়েছিলেন, আর দেশে ফেরেননি। ‘আসমাস্ত’ কেন্দ্রেই তিনি মৃত্যু বরণ করেন। (৫) রাজশাহীর বাগমারার তাহেরুদ্দীন গাযী, যিনি আমীর নে‘মাতুল্লাহ শহীদ হওয়ার পর তাঁর পুত্র বরকতুল্লাহকে আসমাস্ত কেন্দ্রে নাবালক অবস্থায় দেখাশুনা করতেন। (৬) রাজশাহী গোদাগাড়ীর খাজিরাগাতি গ্রামের গাযী মাওলানা আব্দুস সোবহান সপরিবারে জিহাদে চলে গিয়েছিলেন এবং দীর্ঘ নয় বৎসর আসমাস্ত কেন্দ্রে অবস্থান করে দেশে ফিরে এসে মারা যান। (৭) বগুড়া সোন্দাবাড়ী কেন্দ্রের শহীদ ফক্বীর মাহমূদ-এর নাম অনেকেই জানেন। সোন্দাবাড়ী মাদরাসার পার্শ্বে অবস্থিত ‘মুজাহিদ কবরস্থান’ আজও তাঁদের বিগত ত্যাগ ও কুরবাণীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে নয়জন মুজাহিদের কবর রয়েছে। (৮) বগুড়ার কাঁটাবাড়িয়ার বেলাল গাযী ছিলেন স্বয়ং ‘আসমাস্ত’ মুজাহিদ কেন্দ্রে আমীর নে‘মাতুল্লাহর (১৯১৫-১৯২১খৃঃ) দেহরক্ষী। যিনি মাত্র কিছুদিন পূর্বে মারা গেলেন।[1] (৯) সাতক্ষীরার স্বনামধন্য গাযী মাখদূম হোসাইন ওরফে ‘মার্জ্জুম হোসেন’ ব্যবহৃত ১২০০ গ্রাম ওযনের তামার ‘বদনা’ এখনো জিহাদের স্মৃতি নিয়ে আমাদের সামনে মওজুদ আছে। বৃটিশ ফরমানের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ওয়াহ্হাবী ধরপাকড়ের হিড়িকের মধ্যেও গাযী মাখদূম হোসায়েন দুর্বার সাহস নিয়ে শিয়ালকোটের এক মসজিদে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করে ছালাত আদায় করেছিলেন। ফলে সাথে সাথেই তিনি গ্রেফতার হয়ে যান। উল্লেখ্য যে, সেযুগে ছালাতে রাফ‘উল ইয়াদায়েন ছিল ‘ওয়াহ্হবী’ ধরার জন্য একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ। অতঃপর যথারীতি বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। কিন্তু অলৌকিকভাবে ফাঁসির দড়ি তিন তিনবার ছিড়ে গেলে ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট ভয় পেয়ে তাঁকে ছেড়ে দেন। গাযী মাখদূম হোসায়েন তাঁর একমাত্র সম্বল তামার বদনাটি নিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় ঘুরতে ঘুরতে একসময় নিজ গ্রাম সাতক্ষীরার ভালুকা চাঁদপুর এসে পৌঁছেন ও পার্শ্ববর্তী এলাকা সমূহে আহলেহাদীছ আন্দোলনের দাওয়াত দিতে থাকেন। আজ সাতক্ষীরার গুণাকরকাটিতে পীরের যে আস্তানা হয়েছে, ওখানকার সমস্ত লোক এক সময় এই গাযী মাখদূম হোসায়েনের ওয়ায শুনে ও কেরামতে মুগ্ধ হয়ে তাঁরই নিকটে ‘আহলেহাদীছ’ হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সাতক্ষীরার আলীপুর গ্রামের মক্তবের শিক্ষক ‘পীর’ নামধারী জনৈক আব্দুল আযীযের প্ররোচনায় তারা পুনরায় ‘হানাফী’ হয়ে যায়। তবে যে বাড়ীতে ওয়ায হয়েছিল তারা সহ এখনো সেখানে মুষ্টিমেয় সংখ্যক আহলেহাদীছ আছেন ও তাদের একটি জামে মসজিদও রয়েছে।[2]
(১০) গাইবান্ধা যেলার সাঘাটা উপযেলার ঝাড়াবর্ষা গ্রামের তিনজন শহীদ ভাই সমীরুদ্দীন, যমীরুদ্দীন ও জামা‘আতুল্লাহর শোকে অভিভূত হয়ে তাঁদের ভাতিজা আব্দুল বারী কাযী যে শোকগাথা রচনা করেন, তাও আজ আমাদের সামনে রয়েছে। যাঁরা তাঁদের মোট ৮০ বিঘা সম্পত্তির মধ্যে একে একে ৪২ বিঘা সম্পত্তি বিক্রি করে জিহাদের ফান্ডে দান করেছিলেন। (১১) একই উপযেলার বারকোনা গ্রামের মাওলানা ওয়াসে‘উর রহমান মাত্র সাত দিনের পুত্র সন্তান ইবরাহীম সরকারকে রেখে বালাকোট জিহাদে যোগদান করে শহীদ হয়ে যান। (১২) ময়মনসিংহের মাওলানা আতাউল্লাহ বালাকোট জিহাদে অংশগ্রহণ শেষে গাইবান্ধার সাঘাটা উপযেলার চিনিরপটল গ্রামে এসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (১৩) একই উপযেলার ধনারুহা গ্রামের আদি বাসিন্দা গাযী আব্দুল হালীম, আব্দুল হাকীম ও ফহীমুদ্দীন মন্ডল বালাকোট জিহাদ থেকে ফিরে এসেও বৃটিশের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পাননি। অবশেষে গাযী আব্দুল হালীম ঘর ছেড়ে রংপুর হারাগাছের সেরুডাঙ্গা জংগলে ৩/৪ বৎসর নির্জন বাসের পর সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহে রা-জে‘ঊন)। (১৪) ১৭ বৎসর বয়সে জিহাদে অংশগ্রহণকারী এবং সীমান্ত হ’তে বাংলাদেশে হিজরতকারী গাইবান্ধা শহরের হক্কানী পরিবারের প্রাণপুরুষ আলহাজ্জ এফাজুদ্দীন আহমাদ হক্কানী, যিনি ১৯৮৩ সালের ১২ই নভেম্বর তারিখে ১৩৩ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন এবং আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাঁর ব্যবহৃত তরবারী, জিহাদের পোষাক ও ব্যাজ, জিহাদী প্রেরণার উৎস হিসাবে।[3]
(১৫) চাঁপাই নবাবগঞ্জের নারায়ণপুরের কীর্তিমান সন্তান সম্ভবতঃ মাওলানা এনায়েত আলীর (১২০৭-৭৪হিঃ/১৭৯২-১৮৫৮খৃঃ) খলীফা রফী মোল্লার পুত্র ও খলীফা মৌঃ আমীরুদ্দীন তাবলীগের জামা‘আত নিয়ে কানসাট এলাকার তেররশিয়া দুর্লভপুর গ্রামে গেলে এবং সেখানকার একটি বিদ‘আতী প্রথার প্রতিবাদ করলে স্থানীয় বিদ‘আতী মুসলমানেরা তাঁকে ‘ওয়াহ্হাবী’ বলে ইংরেজের হাতে ধরিয়ে দেয়। বিচারে তাঁর ফাঁসির আদেশ হ’লে শহীদ হওয়ার আনন্দে তিনি ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে ওঠেন। ইংরেজ বিচারক এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যুদন্ড রদ করে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দেন ও তাঁর সমস্ত সম্পত্তি বাযেয়াফ্ত করা হয়। মূলতঃ এটি ছিল আহলেহাদীছদেরকে জিহাদ ও শাহাদাতের ব্যাপারে নিরুৎসাহ করার একটি শয়তানী পলিসি মাত্র। ১১ বৎসর আন্দামানের কালাপানিতে বন্দীজীবন কাটিয়ে অবশেষে মুক্তি পেয়ে তিনি ১৮৮৩ সালে দেশে ফেরেন। তাঁর আনীত কালাপানি বন্দীদশার স্মৃতিবাহী ৭ ইঞ্চি লম্বা ঝিনুক, প্রায় ১ ফুট দৈর্ঘ্যের শামুক, ১০ ইঞ্চি লম্বা ও ৯ ইঞ্চি ব্যাসের কড়ি আজও বিহারের ছাহেবগঞ্জের আগলই নারায়ণপুরের গিয়াছুদ্দীন মাস্টারের নিকটে এবং বড় বাক্সটা চাঁপাই নবাবগঞ্জের রহনপুরের আনারপুর গ্রামের বাহারুল্লাহ মোল্লার নিকটে রক্ষিত আছে, আমাদের জন্য জিহাদ ও কুরবানীর অমলিন স্মৃতি হিসাবে। আল্লাহু-ম্মাগ্ফির লাহুম অরহাম্হুম অ‘আ-ফেহিম অ‘ফু ‘আনহুম। -আমীন!
যুলুম ও নির্যাতনের আগুনে পোড়া নিখাদ তাওহীদবাদী জামা‘আতে আহলেহাদীছ তাই চিরকালীন জিহাদী উত্তরাধিকারের নাম। যে কোন মূল্যের বিনিময়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারকে অক্ষুণ্ণ রাখার চিরন্তন শহীদী কাফেলার নাম।
আল্লাহ বলেন,
وَلاَ تَهِنُوْا وَلاَ تَحْزَنُوْا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ -(آل عمران 139)-
‘তোমরা হীনবল হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না, ঈমানদার হ’লে তোমরাই বিজয়ী’ (আলে ইমরান ৩/১৩৯)।
উল্লেখ্য যে, জিহাদ আন্দোলনে বাংলাদেশের লোকেরাই অধিকহারে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং আল্লাহর রহমতে বর্তমান পৃথিবীতে আহলেহাদীছ জনসংখ্যা বাংলাদেশেই সর্বাধিক এবং বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চাইতে বৃহত্তর রাজশাহীতেই তাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। ফালিল্লা-হিল হাম্দ হাম্দান কাছীরান ত্বাইয়েবাম মুবা-রাকান ফীহ্।