আক্বীদা ইসলামিয়াহ
العقيدة
১- আহলেহাদীছগণ (১) আল্লাহর উপরে (২) তাঁর ফিরিশতাগণের উপরে (৩) আল্লাহ প্রেরিত কিতাব সমূহের উপরে (৪) রাসূলগণের উপরে (৫) বিচার দিবসের উপরে এবং (৬) তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপরে ঈমান পোষণ করেন।
ব্যাখ্যা: (১) আল্লাহর উপর ঈমান : পারিভাষিক অর্থে আহলেহাদীছের নিকটে ‘ঈমান’ হ’ল হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের সমন্বিত নাম। যা আনুগত্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ও গোনাহে হরাসপ্রাপ্ত হয়। বিশ্বাস ও স্বীকৃতি হ’ল মূল এবং কর্ম হ’ল শাখা।[1] যেটা না থাকলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যায় না।
খারেজীগণ তিনটি বিষয়কেই ঈমানের মূল হিসাবে গণ্য করেন। সেকারণ কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি তাদের মতে কাফের ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী এবং তাদের রক্ত হালাল। মুরজিয়াগণ বিশ্বাস ও স্বীকৃতিকেই ‘ঈমান’ বলেন। ‘কর্ম’ ঈমানের অংশ নয়। সেকারণ কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি তাদের নিকট পূর্ণ ঈমানদার। আমলহীন শৈথিল্যবাদী মুসলমানগণের অধিকাংশ নামে-বেনামে এই দলভূক্ত। পক্ষান্তরে খারেজী আক্বীদার অনুসারীরা চরমপন্থী হয়ে থাকেন। উক্ত দুই কট্টর ও শৈথিল্যবাদী আক্বীদার মধ্যপন্থী হ’ল আহলেহাদীছের আক্বীদা। এই আক্বীদার অনুসারীগণ কবীরা গোনাহগার ব্যক্তিকে কাফের বলেন না। বরং ফাসেক বা ত্রুটিপূর্ণ ঈমানদার বলেন। তারা কবীরা গোনাহকে ঘৃণা করেন ও তা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করেন এবং পূর্ণ ঈমানদার হওয়ার জন্য সৎকর্ম সম্পাদনকে আবশ্যিক গণ্য করেন।
মুরজিয়াদের বারোটি উপদলের মধ্যে কার্রামিয়াগণ বিশ্বাস ও আমল ছাড়াই কেবল মুখে ‘স্বীকৃতি’ ঈমানের জন্য যথেষ্ট মনে করেন। সাধারণ মুরজিয়াগণ ‘বিশ্বাস ও স্বীকৃতি’কেই ঈমান বলে থাকেন। ইমাম আবু হানীফা ও কিছু সংখ্যক ফক্বীহ ‘আমল’কে ঈমানের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেননি রবং ‘ঈমানের বাস্তব পদ্ধতি’ (شرائع الإيمان) বলে মনে করেন।
আহলেহাদীছগণ আল্লাহর উপরে ঈমান রাখেন ‘রব’ হিসাবে, একক ‘ইলাহ’ হিসাবে, তাঁর অনন্য নাম ও গুণাবলী সহকারে, যা মাখলূকের নাম ও গুণাবলীর সাথে তুলনীয় নয়। এই নির্ভেজাল একত্ববাদকেই বলা হয় ‘তাওহীদ’, যাকে তিনভাগে ব্যাখ্যা করা চলে। যথা : (১) তাওহীদে রবূবিয়াত (ةوحيد الربوبية) : সৃষ্টি ও পালনে আল্লাহর একত্ব (২) তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত (توحيد الأسماء والصفات) : নাম ও গুণাবলীর একত্ব (৩) তাওহীদে ইবাদাত ও উলূহিয়াত (ةوحيد العبادة أو الألوهية) : ইবাদত বা উপাসনায় একত্ব।
(১) তাওহীদে রবূবিয়াত (ةوحيد الربوبية) : এর অর্থ হ’ল আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রূযীদাতা, রোগ ও আরোগ্যদাতা, জীবন ও মরণদাতা প্রভৃতি হিসাবে বিশ্বাস করা। কিছু সংখ্যক নাস্তিক ও প্রকৃতিবাদী ছাড়া দুনিয়ার প্রায় সকল মানুষ সকল যুগে আল্লাহকে ‘রব’ হিসাবে বিশ্বাস করে এসেছে। মুশরিক আরবরাও এ বিশ্বাস রাখত। যেমন আল্লাহ পাক নিজেই কালামে পাকে এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছেন (লোকমান ৩১/২১)। এমনকি তারা তাদের সন্তানদের নাম আব্দুল্লাহ, আব্দুল মুত্ত্বালিব ইত্যাদি রাখত। তাই শুধুমাত্র তাওহীদে রবূবিয়াতের উপর ঈমান আনলেই কেউ মুমিন হ’তে পারে না এবং আখেরাতে মুক্তি পেতে পারে না, যতক্ষণ না তাওহীদে ইবাদতের উপর ঈমান পোষণ করে।
(২) তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত (توحيد الأسماء والصفات) : এর অর্থ হ’ল আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর একত্বের ব্যাপারে যেমন বর্ণিত আছে তেমনভাবেই বিশ্বাস করা। কোন রূপক অর্থ ও কল্পিত ব্যাখ্যা ছাড়াই আহলেহাদীছগণ আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সংক্রান্ত আয়াত ও ছহীহ হাদীছ সমূহকে প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করে থাকেন। তারা বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহর নিজস্ব আকার আছে, যা কারু সাথে তুলনীয় নয়। তাঁরা আল্লাহর সত্তা ও আকৃতির কোন রূপ কল্পনা করেন না। তাঁর সত্তা ও গুণাবলীকে বান্দার সত্তা ও গুণাবলীর সদৃশ মনে করেন না, কিংবা মূল অর্থ পরিত্যাগ করে কোন গৌণ অর্থ গ্রহণ করেন না। তাঁরা আল্লাহকে নিরাকার ও নির্গুণ সত্তা মনে করেন না। তারা আল্লাহর নাম ও নামীয় সত্তাকে (الإسم والمسمى) এক ও অবিভাজ্য মনে করেন এবং আল্লাহর সত্তাগত ও কর্মগত গুণাবলীকে আল্লাহর সত্তার সাথে অবিচ্ছিন্ন ও ক্বাদীম (সনাতন) বলে বিশ্বাস করেন।
তাঁরা একথা বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহর অহি-র মাধ্যমেই কেবল ঈমান ও আক্বীদা বিষয়ে এবং বস্ত্তর ভাল-মন্দ বিষয়ে সঠিক ও নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। মুহাম্মাদ (ছাঃ) সহ দুনিয়ার সকল নবীই এ বিষয়ে কেবল অহি-র সাহায্যে জ্ঞান লাভ করেছেন। এমনকি ‘আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই’ এই মৌলিক বিষয়ে নিশ্চিত ঈমান আনয়নের জন্য কেবল মানবীয় জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, বরং ‘অহি’ প্রয়োজন (শূরা ৪২/৫১) এবং উম্মতের জন্য প্রয়োজন অহি-র নিকটে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। নইলে ঈমান আনার পরেও মুশরিক হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللهِ إِلاَّ وَهُمْ مُشْرِكُونَ) -ইউসুফ ১২/১০৬)।
ইসলামে উছূলী ফের্কাবন্দীর অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূল কারণ হ’ল ‘তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত’ সম্পর্কে আক্বীদাগত বিভ্রান্তি। উক্ত বিষয়ে মুসলিম বিদ্বানগণ মূলতঃ দু’দলে বিভক্ত হয়ে গেছেন। একদল আল্লাহর নিরেট একত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে তাঁকে নিরাকার এবং নাম ও গুণহীন সত্তা মনে করেছেন। এরা প্রধান তিন দলে বিভক্ত।-
(ক) জাহমিয়া (الجهمية) : যারা আল্লাহকে নাম ও গুণহীন সত্তা মনে করেন। এরা জাহ্ম বিন ছাফওয়ান সমরকন্দীর (নিহত ১২৮ হিঃ) অনুসারী, যিনি ইসলামে সর্বপ্রথম সর্বেশ্বরবাদ (الحلول المطلق) বা অদ্বৈতবাদী দর্শনের (وحدة الوجود) আমদানীকারী জা‘দ বিন দিরহাম খোরাসানীর (নিহত ১২৪ হিঃ) শিষ্য ছিলেন। এই ব্যক্তি ও তার অনুসারীরাই সর্বপ্রথম আরশে আল্লাহর অবস্থান, কুরআন আল্লাহর সনাতন কালাম হওয়া, আল্লাহর গুণযুক্ত সত্তা হওয়া ইত্যাদি সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। এরপর থেকেই আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর একত্ব সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যে সন্দেহ ও সংশয় প্রকাশ করা হ’তে থাকে, যা ইতিপূর্বে ছিল না। জাহমিয়াগণ এমন একটি শূন্য সত্তার ইবাদত করেন যাঁর শ্রবণ, দর্শন ও দয়াগুণ কিছুই নেই। এঁরা জাহমিয়া, নাজ্জারিয়া, যার্রারিয়া প্রভৃতি উপদলে বিভক্ত।
(খ) মু‘তাযিলা (المعةزلة) : এরা আল্লাহকে গুণহীন নামীয় সত্তা মনে করেন। তাঁদের মতে আল্লাহর সত্তা যেমন সনাতন (ক্বাদীম), তাঁর গুণাবলীকেও তেমনি সনাতন মনে করলে ‘শিরক’ করা হবে। সে কারণ তারা বলেন, আল্লাহ ইলম (জ্ঞান) ছাড়াই ‘আলীম’ (সর্বজ্ঞ), কুদরত (শক্তি) ছাড়াই ‘ক্বাদীর’ (সর্বশক্তিমান), হায়াত (জীবন) ছাড়াই ‘হাই’ (চিরঞ্জীব) ইত্যাদি। তারা আল্লাহর নাম ও নামীয় সত্তার (الإسم والمسمى) পার্থক্য করে থাকেন। তাদের কথিত কালেমায়ে শাহাদাতের অর্থ হ’ল- ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি সেই সত্তার যাঁর নাম আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি সেই ব্যক্তির যার নাম মুহাম্মাদ, তিনি আল্লাহর রাসূল’। মু‘তাযিলাগণ ওয়াছিল বিন আত্বা (৮০-১৩১ হিঃ)-এর অনুসারী। এরা ওয়াছিলিয়াহ, হুযাইলিয়াহ, নিযামিয়াহ প্রভৃতি ১২টি উপদলে বিভক্ত। জাহ্মিয়া ও মু‘তাযিলা সকলে ‘মু‘আত্ত্বিলাহ’ (নির্গুণবাদী) বলে অভিহিত।
(গ) আশ‘আরিয়া (الأشعرية) : এরা আল্লাহর ‘আলীম’ (সর্বজ্ঞ), ‘ক্বাদীর’ (সর্বশক্তিমান), ‘হাই’ (চিরঞ্জীব), ‘মুরীদ’ (ইচ্ছাকারী), ‘মুতাকাল্লিম’ (কথক), ‘সামী‘ (শ্রোতা), ‘বাছীর’ (দ্রষ্টা)-সহ মোট সাতটি গুণকে স্বীকার করেন ও বাকী সকল গুণকে অস্বীকার করেন। এরা আবুল হাসান আলী বিন ইসমাঈল আশ‘আরীর (২৬০-৩২৪ হিঃ) অনুসারী। ৩০০ হিজরীতে তিনি এই মত পরিত্যাগ করে আহলে সুন্নাতের অনুসারী হন। তবে তাঁর অনুসারী দল পূর্বমতে রয়ে যায়।
বিদ্বানদের দ্বিতীয় দলটি আল্লাহকে নাম ও গুণযুক্ত সত্তা মনে করেন। এই দলের কিছু বিদ্বান বাড়াবাড়ি করে আল্লাহকে মানব দেহের আকৃতি কল্পনা করেন, যারা ‘মুজাস্সিমাহ’ (কায়াবাদী) নামে পরিচিত হয়েছেন। কিছু বিদ্বান আল্লাহর গুণাবলীকে বান্দার গুণাবলীর সদৃশ মনে করে ‘মুশাব্বিহাহ’ (সাদৃশ্যবাদী) নামে অভিহিত হয়েছেন। এদের কেউ কেউ সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টার কল্পনা করে ‘সর্বেশ্বরবাদী’ (حلولية) হয়ে গেছেন। এরা বেশ কয়েকটি উপদলে বিভক্ত।
উপরোক্ত দুই মতের মধ্যবর্তী পথ হ’ল এই যে, আল্লাহ পাক অবশ্যই নাম ও গুণযুক্ত সত্তা। তবে তাঁর সত্তা ও গুণাবলী বান্দার সত্তা ও গুণাবলীর সাথে তুলনীয় নয়। বরং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে আল্লাহর নাম ও গুণাবলী যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, সেভাবেই তার উপরে ঈমান আনতে হবে। এই মধ্যবর্তী পথই হ’ল আহলেসুন্নাত আহলেহাদীছের পথ ও গৃহীত আক্বীদা, যা ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের গৃহীত আক্বীদার অনুরূপ।
লোকেরা আল্লাহর নামকেও বিকৃত করেছে। জাহেলী যুগের আরবরা তাদের কিছু কিছু উপাস্যের নাম আল্লাহর পরিবর্তে ‘লাত’, আযীযের বদলে ‘উযযা’, মান্নানের বদলে ‘মানাত’ রেখেছিল। বর্তমানে হিন্দুরা ঈশ্বর, ভগবান, খৃষ্টানরা ‘গড’, মুসলমানদের কেউ কেউ মৃত বুযর্গকে ‘গাউছুল আযম’ মুশকিল কুশা’ ‘দস্তগীর’ ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে ও প্রার্থনা নিবেদন করে থাকে। অথচ এসব কোন নামই আল্লাহর মনোনীত নয়। বরং তাঁর উত্তম নাম সমূহ রয়েছে, যা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সমূহে বর্ণিত হয়েছে। যেখানে আল্লাহর হাত, পা, চেহারা, আরশে অবস্থান, তাঁর কথা বলা, নিম্ন আকাশে অবতরণ, ক্বিয়ামতের দিন মুমিন বান্দাদের দর্শন দান ইত্যাদি অনেক বিষয় বর্ণিত হয়েছে। আহলেহাদীছগণ এই সকল বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করেন এবং সকল প্রকার দূরতম ব্যাখ্যা ও মন্তব্য হ’তে বিরত থাকেন। আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই’ ‘তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই’ ‘লোকদের প্রদত্ত বিশ্লেষণসমূহ হ’তে তোমার প্রভু মুক্ত ’ (শূরা ৪২/১১, ইখলাছ ১১২/৪, ছাফফাত ৩৭/১৮০)।
(৩) তাওহীদে ইবাদত (ةوحيد العبادة) : এর অর্থ হ’ল ‘সর্বপ্রকার দাসত্ব ও ইবাদতের জন্য আল্লাহকে একক গণ্য করা’। আল্লাহর জন্য সর্বাধিক ভালবাসা সহ চরম প্রণতি পেশ করাকে ‘ইবাদত’ বলা হয়। সামগ্রিক অর্থে ‘ইবাদত’ ঐ সকল প্রকাশ্য ও গোপন কথা ও কাজের নাম, যা আল্লাহ ভালবাসেন ও যাতে তিনি খুশী হন। ‘ইলাহ’ হ’লেন সেই সত্তা যার নিকটে আশ্রয় ভিক্ষা করতে হয় ও যাঁকে ইবাদত করতে হয় মহববতের সাথে একনিষ্ঠভাবে ভীতিপূর্ণ সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে।
মানুষের জীবনে আকবীদা ও আমলের দু’টি প্রধান দিক রয়েছে। এর মধ্যে আক্বীদাগত দিক বা বিশ্বাসের জগতই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বাস অনুযায়ী কর্ম হয় এবং স্ব স্ব আক্বীদা মতে মানুষের সার্বিক জীবন পরিচালিত হয়। একজন পূর্ণ মুমিন তার আধ্যাত্মিক জীবনে ছালাত-ছওম, যবহ-মান্নত, হজ্জ-ত্বাওয়াফ, প্রার্থনা-তাওয়াক্কুল ইত্যাদি ইবাদতের সকল পদ্ধতিতে যেমন ইলাহী বিধান মেনে চলবেন, বৈষয়িক জীবনেও তেমনি আল্লাহর কিতাব, রাসূলের (ছাঃ) সুন্নাত এবং যুগের শরী‘আত অভিজ্ঞ মুসলিম বিদ্বানগণের ইজতিহাদ অনুযায়ী স্বীয় কর্ম পরিচালনা করবেন। যে ইজতিহাদ হবে স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ও যুগের উদ্ভূত সমস্যাবলীর শরী‘আত অনুযায়ী সমাধান দেওয়ার জন্য।
আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-কে বাদ দিয়ে অন্য যার কাছ থেকেই ফায়ছালা নেওয়া হবে অথবা অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করা হবে সেই-ই হবে ‘ত্বাগূত’, যা থেকে দূরে থাকার জন্য এবং মানুষের সার্বিক জীবনের সকল প্রকার আনুগত্যকে ত্বাগূতমুক্ত করে স্রেফ আল্লাহর উদ্দেশ্যে খালেছ ও নিরংকুশ করার জন্য যুগে যুগে নবীগণ মানবজাতিকে আহবান জানিয়ে গেছেন। তাই ত্বাগূতকে অস্বীকার করা ব্যতীত আল্লাহর ইবাদত হাছিল হওয়া সম্ভব নয়। মূলতঃ এটাই হ’ল ‘তাওহীদে ইবাদত’ বা উলূহিয়াতের মূল কথা, যার উপরে দৃঢ় ঈমান পোষণ করা ব্যতীত কারু পক্ষে পূর্ণ মুমিন হওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ পাক জিন্ ও ইনসানকে কেবলমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তাই ইক্বামতে দ্বীন অর্থ ইক্বামতে তাওহীদ। সকল নবীই যে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য মানবজাতির নিকট প্রেরিত হয়েছিলেন। হুকূমত কায়েম অনেক সময় তাওহীদ কায়েমে সহায়ক হ’লেও তা কখনো মুখ্য নয় এবং পৃথিবীতে নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য কখনোই সেটা ছিল না।
আহলেহাদীছগণ উপরোক্ত তিন প্রকার তাওহীদকেই গ্রহণ করেন ও সেভাবেই আল্লাহর উপর ঈমান পোষণ করে থাকেন।
(২) ফিরিশতাগণের উপর ঈমান (الإيمان بالملائكة) : আহলেহাদীছের আক্বীদা হিসাবে বর্ণিত এক নম্বর ক্রমিকের ছয়টি বিষয়ের মধ্যে দ্বিতীয়টি হ’ল ফিরিশতাগণের উপরে ঈমান আনা। ফিরিশতাগণ নূরের তৈরী আল্লাহর এক বিশেষ সৃষ্টি, যারা অদৃশ্যভাবে সৃষ্টিকুলের সেবায় সর্বদা নিয়োজিত এবং আল্লাহর হুকুমে তৎপর আছেন। ফিরিশতাগণের সর্দার জিব্রীল (আঃ) আল্লাহর নির্দেশক্রমে নবীদের নিকটে ‘অহি’ বহনের মহান দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কুরআন ও হাদীছে ফিরিশতা সম্পর্কে যা কিছু এরশাদ হয়েছে, সবকিছুতে বিশ্বাস স্থাপন করা ওয়াজিব। এগুলি অদৃশ্য বিষয়ক জ্ঞান। এখানে ‘অহি’ ব্যতীত কল্পনার কোন স্থান নেই।
(৩) রাসূলগণের প্রতি ঈমান (الإيمان بالرسل) : ‘রাসূল’ বলতে আল্লাহর পক্ষ হ’তে বান্দার মধ্য থেকে নির্বাচিত আল্লাহর বাণীবাহকগণকে বুঝায়। কুরআনে বর্ণিত পঁচিশ জন নবী ও রাসূল এবং হাদীছে যে সর্বমোট ৩১৫ জন রাসূলসহ এক লক্ষ চবিবশ হাযার পয়গাম্বরের কথা বর্ণিত হয়েছে, তাঁদের সকলেই এতে শামিল হবেন। নবী ও রাসূলগণ সম্পর্কে এই বিশ্বাস পোষণ করা ওয়াজিব যে, তাঁরা সকলেই মানুষ ছিলেন এবং নবুঅত প্রাপ্তির আগে ও পরে স্বেচ্ছাকৃত যাবতীয় ছগীরা ও কবীরা গোনাহ হ’তে তাঁরা মা‘ছূম বা নিষ্পাপ ছিলেন। আল্লাহর যে সমস্ত বাণী তাঁরা প্রাপ্ত হয়েছিলেন, তা সবই নির্ভুল ও যথাযথভাবে তাঁরা স্ব স্ব উম্মতের নিকটে পৌঁছে দিয়েছেন। উম্মতের কোন বিশেষ ব্যক্তির নিকটে বিশেষ কোন ইল্ম তাঁরা লুকিয়ে রেখে যাননি। তাবলীগে দ্বীনের ব্যাপারে খেয়ানত, অলসতা, স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা ইত্যাদি যাবতীয় রকমের ক্রটি হ’তে তাঁরা মুক্ত ছিলেন। চারজন শ্রেষ্ঠ রাসূলের মধ্যে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছিলেন জিন্ ও ইনসান সহ সকল মাখলূক্বাতের জন্য প্রেরিত বিশ্বনবী। বাকী সকলে ছিলেন স্ব স্ব গোত্রের ও সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরিত নবী (বুখারী, মুসলিম)।
(৪) আল্লাহর কিতাব সমূহের উপরে ঈমান (الإيمان علي الكةب المنزلة) : শ্রেষ্ঠ চারখানা কিতাব তাওরাত, যবূর, ইঞ্জীল ও কুরআন ছাড়াও ইবরাহীম (আঃ) ও অন্যান্য নবী ও রাসূলের নিকটে প্রেরিত সকল গ্রন্থ ও পুস্তিকাকে আল্লাহ প্রেরিত কিতাব ও ছহীফা হিসাবে বিশ্বাস করা ওয়াজিব। পবিত্র কুরআন তার পূর্বেকার সকল কিতাব ও ছহীফা সমূহের সত্যায়নকারী ও সর্বশেষ ইলাহী কিতাব।
(৫) আখেরাতে বিশ্বাস (الإيمان بالآخرة) : দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবন শেষে আখেরাতের অনন্ত জীবন রয়েছে। মৃত্যুর পরেই যার সূচনা হয়। ক্বিয়ামতের দিন সকল মৃতব্যক্তি স্ব স্ব দেহে পুনর্জীবন লাভ করবে। অতঃপর আল্লাহর দরবারে সারা জীবনের আমলের জন্য বিচারের সম্মুখীন হবে। প্রত্যেকের আমলনামা তার ডান হাতে অথবা বাম হাতে দেওয়া হবে। অতঃপর সে অনুযায়ী সে জান্নাতে শান্তিময় জীবন যাপন করবে অথবা জাহান্নামের আগুনে দগ্ধীভূত হ’তে থাকবে।
(৬) তাক্বদীরে বিশ্বাস (الإيمان بالقدر) : আজাল (হায়াত), আমল, রিযিক, জানণাতী বা জাহান্নামী- এই প্রধান চারটি বিষয় সহ বান্দার সমগ্র জীবনের ভাল-মন্দ সকল কাজকর্ম আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বৎসর পূর্বে আল্লাহর ইল্মে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। তাছাড়া একদল মানুষকে আল্লাহ পাক জান্নাতের জন্য ও একদলকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছেন। যার খবর তিনি ব্যতীত অন্য কারু পক্ষে জানা সম্ভব নয়। জানা না থাকার কারণেই জান্নাত পাওয়ার আশায় মুমিন বান্দা তার তাক্বদীরের উপরে আস্থা রেখে পূর্ণ তাদবীর ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। বিপদে সে ধৈর্য হারায় না, আনন্দে সে আত্মহারা হয় না। ইহকালে সে সুষ্ঠু (balanced), নিশ্চিন্ত ও শান্তিময় জীবন যাপন করে। কারণ সে জানে যে, তাক্বদীরের লিখনের বাইরে সে কিছুই প্রাপ্ত হবে না। জাব্রিয়াগণ অদৃষ্টবাদী হয়ে নিজেদেরকে ইচ্ছাশক্তিহীন জড়পদার্থ ভেবেছেন। ক্বাদারিয়াগণ তাক্বদীরকে অস্বীকার করে নিজেদেরকে স্ব স্ব ভাগ্য বিধায়ক মনে করেছেন। প্রকৃত পথ এ দুইয়ের মাঝখানে, যা আহলেসুন্নাত আহলেহাদীছের পথ ও গৃহীত আক্বীদা।
২- আহলেহাদীছের অন্যতম আক্বীদা এই যে, ইবাদতের জন্য যেমন আল্লাহ্কে একক গণ্য করতে হবে, অনুসরণের জন্য তেমনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে একক গণ্য করতে হবে।
কালেমায়ে শাহাদাতের প্রথম অংশের দাবী হ’ল গায়রুল্লাহকে অস্বীকার করে সকল প্রকার ইবাদত ও দাসত্বকে স্রেফ আল্লাহর জন্য খালেছ করা। দ্বিতীয় অংশের দাবী হ’ল আল্লাহকে পাওয়ার জন্য তাঁর প্রেরিত পুরুষ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে অনুসরণের ক্ষেত্রে একক গণ্য করা। যারা মানুষের জীবনকে বিচ্ছিন্ন ভাবেন ও বৈষয়িক ব্যাপারসমূহ পরিচালনার জন্য ইসলামী শরী‘আত যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন, তারা প্রকারান্তরে মানবজাতির বৈষয়িক বিষয় সমূহের জন্য আরেকজন রাসূল কামনা করেন। আহলেহাদীছগণ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে নূরের নবী নন, বরং মাটির মানুষ (কাহ্ফ ১৮/১১০) বলে বিশ্বাস করেন। তারা শেষনবীর মাধ্যমে প্রাপ্ত ইলাহী বিধান ও তাঁর প্রদর্শিত ইসলামী শরী‘আতের যথাযথ ও সার্বিক অনুসরণকে মানবজাতির ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তির আবশ্যিক পূর্বশর্ত বলে বিশ্বাস করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, ইবাদতের বিষয়টি হ’ল ‘তাওক্বীফী’। যেখানে কোনরূপ কমবেশী করার অধিকার কারু নেই। অতএব শরী‘আত রচনার পরিমন্ডলে অন্য কারু প্রবেশাধিকার চিরকালের জন্য নিষিদ্ধ। সেমতে ‘ইস্তিহসান’ অনুযায়ী কোন সিদ্ধান্ত নিলে সেটা নতুনভাবে শরী‘আত রচনার শামিল হবে। আহলেহাদীছগণ আক্বীদা ও আহকাম বিষয়ে ‘যঈফ’ হাদীছ থেকে দলীল গ্রহণ করেন না। তবে কোন বিষয়ে ফাসিদ ক্বিয়াসের বদলে যঈফ হাদীছকে অগ্রগণ্য মনে করেন। তারা সর্বদা ছহীহ হাদীছের অনুসরণে সচেষ্ট থাকেন এবং ‘মুতাওয়াতির’ ও ‘আহা-দ’ পর্যায়ের ছহীহ হাদীছকে ইসলামী আইনের উৎস হিসাবে গণ্য করেন।
৩- আহলেহাদীছগণ ঈমানের হরাস-বৃদ্ধিতে বিশ্বাসী : তাঁদের মতে নেক আমলের দ্বারা ঈমান বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং গোনাহে হরাসপ্রাপ্ত হয়। তাদের প্রধান দলীল সমূহের কয়েকটি নিম্নরূপ :
(১) আল্লাহ পাক এরশাদ করেন যে, ‘মুমিন কেবল তারাই যাদের নিকটে আল্লাহর কথা বলা হ’লে ভয়ে তাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে এবং যখন তাদের নিকটে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তাদের প্রভুর উপরে তারা একান্তভাবে নির্ভরশীল হয়’ (আনফাল ৮/২-৫)।
(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা রয়েছে। যার মধ্যে সর্বোত্তম (فأفضلها) হ’ল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং সর্বনিম্ন (أدناها) হ’ল রাস্তা হ’তে কষ্ট (বাধা) দূর করা’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘ঈমানের সত্তরের অধিক স্তর রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোচ্চ স্তর (أعلاها) হ’ল.....(বুখারী, মুসলিম)।
(৩) ওমর ফারূক (রাঃ) বলেন, ‘পৃথিবীর সকল মুমিনের ঈমান আবুবকর (রাঃ)-এর ঈমানের সাথে ওযন করা হ’লে আবুবকর (রাঃ)-এর ঈমানের ওযন বেশী হবে’ (ইবনু আহমাদ, কিতাবুস সুন্নাহ)।
(৪) ইমাম হুসাইন বিন মাসঊদ বাগাভী (৪৩৬-৫১৬ হিঃ) বলেন, ‘সকল ছাহাবী, তাবেঈ ও পরবর্তীকাল সুন্নাহর পন্ডিতগণ এ ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছেছেন যে, আমল ঈমানের অংশ। ...তাঁরা সকলেই বলেন যে, ঈমান আনুগত্যের দ্বারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং গোনাহের দ্বারা হরাসপ্রাপ্ত হয়’ (শারহুস সুন্নাহ)।
খারেজী ও মু‘তাযিলীগণ আমলকে ঈমানের অংশ মনে করলেও তারা ঈমানের হরাস-বৃদ্ধিতে বিশ্বাসী নন। খারেজীদের মতে কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি ‘কাফির’ এবং মু‘তাযিলীদের নিকটে সে ‘মুমিনও নয় কাফিরও নয় বরং দুইয়ের মধ্যবর্তী স্থানে’ (منزلة بين المنزلتين) । মুরজিয়াদের নিকটে আমল ঈমানের অংশ নয় এবং ঈমানের হরাস-বৃদ্ধি নেই। তাদের মতে আবুবকরের ঈমান ও অন্যদের ঈমান সমান। এরা ‘শৈথিল্যবাদী’ হিসাবে অভিহিত।
৪- আহলেহাদীছের আক্বীদা মতে কবীরা গোনাহগার মুমিন ঈমান হ’তে খারিজ নয়। সে তওবা না করে মারা গেলেও স্থায়ীভাবে জাহান্নামী নয়। আল্লাহ পাক শিরক ব্যতীত বান্দার যে কোন গোনাহ মাফ করে থাকেন। গোনাহের কারণে তাকে ‘গোনাহগার’ (عاصي) , ‘দোষযুক্ত’ (ناقص) , ‘ফাসিক্ব’ (فاسق) ইত্যাদি বলা যাবে। কিন্তু ‘খাঁটি মুমিন’ (مؤمن حق) কিংবা ‘কাফির’ (كافر) বলা যাবে না। একজন ঘুমন্ত ব্যক্তি মৃতের ন্যায় হ’লেও তাকে যেমন প্রাণহীন মৃত বলা যায় না, তেমনি গোনাহে লিপ্ত হওয়ার কারণে ঈমানের দীপ্তি সাময়িকভাবে স্তিমিত হ’য়ে গেলেও কোন মুমিনকে ঈমান শূন্য কাফির বলা যায় না। তাছাড়া ক্বিয়ামতের দিন শেষনবীর শাফা‘আত তো মূলতঃ কবীরা গোনাহগার মুমিনদের জন্যই হবে।
কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি খারেজীদের নিকটে কাফির ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী। মু‘তাযিলাদের নিকটে ফাসিক এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামী। তবে কাফিরদের তুলনায় তাদের আযাব কিছুটা হালকা হবে। মুরজিয়াদের মতে আমল যেহেতু ঈমানের অংশ নয়, সেহেতু কবীরা গোনাহ তার ঈমানের কোন ক্ষতি করবে না।
৫- আহলেহাদীছের আক্বীদা মতে আললাহ বান্দার ভাল-মন্দ সকল কর্মের স্রষ্টা।
যেমন এরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহ তোমাদেরকে ও তোমরা যা কর সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন’ (ছাফফাত ৩৭/৯৬)। বান্দা হ’ল আল্লাহ সৃষ্ট কর্মশক্তি প্রয়োগে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। যেমন এরশাদ হয়েছে ‘আমরা রাস্তা বাৎলে দিয়েছি। এক্ষণে তোমরা তা অনুসরণ করে কৃতজ্ঞ হও অথবা অকৃতজ্ঞ হও’ (দাহর ৭৬/৩)। এই কর্মশক্তির ভাল-মন্দ প্রয়োগের উপরে নির্ভর করছে বান্দার পুরস্কার লাভ অথবা শাস্তি ভোগ। আল্লাহ বলেন, ‘স্ব স্ব আমলের বাইরে আজকের দিন কাউকে কোন বদলা দেওয়া হবে না বা সামান্যতম যুলুম করা হবে না’ (ইয়াসীন ৩৬/৫৪)। মোটকথা আল্লাহ হ’লেন কর্মের স্রষ্টা (خالق الأفعال) এবং বান্দা হ’ল কর্মের বাস্তবায়নকারী (فاعل الأفعال)। অদৃষ্টবাদী জাবরিয়াগণ বান্দাকে ‘ইচ্ছা ও কর্মশক্তিহীন বাধ্যগত জীব’ (مجبور فى أفعاله لا قدرة له ولا إرداة ولااختيار) বলে মনে করেন।
৬- আহলেহাদীছের অন্যতম আক্বীদা হ’ল ‘আল্লাহর কালাম সৃষ্ট নয়’ একথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা।
অন্যান্য সকল গুণের ন্যায় আল্লাহর কথা বলার গুণও ক্বাদীম বা সনাতন, যা আল্লাহর নিজ সত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে কুরআন আমরা পড়ি বা শুনি, যা স্মৃতিতে ধারণ করি বা লিখি, তা নিঃসন্দেহে আল্লাহর কালাম। কুরআনের প্রতিটি বর্ণ, শব্দ, অর্থ, আওয়ায সবই আল্লাহর, যা ক্বাদীম ও গায়ের মাখলূক্ব। কুরআন ‘লওহে মাহফূযে’ সুরক্ষিত ছিল। সেখান থেকে জিব্রীল মারফত ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপরে নাযিল হয়েছে। অতঃপর যে ভাষায় কুরআন আল্লাহর পক্ষ হ’তে নাযিল হয়েছে, আল্লাহর নবী (ছাঃ) সেই ভাষাতেই যথাযথভাবে তা বিশ্ববাসীর নিকটে পৌঁছে দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব হ’তে একটি বর্ণ পাঠ করল, সে নেকী পেল। প্রত্যেক নেকী তার দশগুণ হয়। আমি বলি না যে, আলিফ লাম মীম (الم) একটি হরফ। বরং ‘আলিফ’ একটি হরফ, ‘লাম’ একটি হরফ ও ‘মীম’ একটি হরফ’ (তিরমিযী)। তিনি বলেন, ‘তোমরা কি আমাকে আমার প্রভুর কালাম প্রচার করতে বাধা দিবে?(আবুদাঊদ)। এ থেকে বুঝা যায় যে, কুরআনের প্রতিটি বর্ণ আল্লাহর।
এক্ষণে যদি কেউ বলেন যে, কুরআন মাখলূক্ব কিংবা কুরআনের শব্দ মাখলূক্ব ও মূল ভাবটি (معنى) ক্বাদীম, কিংবা বর্তমান কুরআন আল্লাহর কালাম হওয়া সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই কিংবা যদি কেউ কুরআনের কোন একটি হরফকেও অবিশ্বাস বা অস্বীকার করে, সে মুমিন নয়।
৭- গায়েবে বিশ্বাস : আহলেহাদীছগণ ঐসব গায়েবী ব্যাপারে দৃঢ়বিশ্বাস পোষণ করেন, যে সকল বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় উম্মতকে খবর দিয়েছেন। যেমন মি‘রাজের ঘটনাবলী, কবরের সওয়াল-জওয়াব, আযাব ও শান্তি, ক্বিয়ামতপূর্ব কালে ইমাম মাহ্দী-র আগমন ও সমগ্র পৃথিবীতে সাত বছর যাবত ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানুষের সঙ্গে নিজ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, চাবুকের অগ্রভাগ, জুতার ফিতা এবং জীবজন্তুর কথোপকথন প্রভৃতি ছাড়াও ক্বিয়ামত প্রাক্কালের দশটি নিদর্শন, যেমন (১) পশ্চিম দিকে হ’তে সূর্যের উদয় (২) ‘দাববাতুল আরয’-এর আগমন (৩) দাজ্জালের আবির্ভাব (৪) ঈসা (আঃ)-এর অবতরণ (৫) ইয়াজূজ-মাজূজ-এর আগমন (৬) প্রাচ্যে (৭) পাশ্চাত্যে ও (৮) আরব উপদ্বীপে মাটিতে ধ্বস নামা (৯) ধোঁয়া উদগীরণ ও সবশেষে (১০) ইয়ামন অথবা অন্য বর্ণনা মতে এডেন-এর গর্তসমূহ (قعر عدن) হ’তে প্রচন্ডবেগে অগ্নি নির্গত হওয়া, যা লোকদেরকে হাশরের ময়দানের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাবে। অন্য বর্ণনা মতে ‘প্রচন্ড ঝড়’ যা লোকদেরকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করবে। অতঃপর সিংগায় ফুঁক দান, ক্বিয়ামত অনুষ্ঠান, মৃতদের পুনর্জীবন লাভ, হাশরের ময়দানে জমায়েত হওয়া, বিচারের সম্মুখীন হওয়া, দাঁড়িপাল্লায় আমলের ওযন হওয়া, হাউয কাওছার, পুলছিরাত সবকিছুকেই নির্দ্বিধায় সত্য বলে বিশ্বাস করা।
৮- জান্নাত, জাহান্নাম ও তার ভিতরকার সবকিছু বর্তমানে সৃষ্ট অবস্থায় আছেঃ যার প্রকৃত অবস্থা মানুষের জ্ঞানের বাইরে। মি‘রাজের সময়ে আল্লাহর নবী (ছাঃ) স্বচক্ষে এগুলি প্রত্যক্ষ করেছেন। কবরবাসীগণ জান্নাতের সুগন্ধি বা জাহান্নামের উত্তাপ কবরেই প্রাপ্ত হবে। প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় তাদেরকে স্ব স্ব ঠিকানা দেখানো হবে। ক্বিয়ামতের দিন সকল মাখলূক্বাত ধ্বংস হবে। কিন্তু জান্নাত, জাহান্নাম ও তার ভিতরকার বস্ত্তসমূহ অক্ষত থাকবে।
৯- আহলেহাদীছগণ ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহকে দর্শনে বিশ্বাস করেন :
পূর্ণিমার রাতে মেঘমুক্ত আকাশে স্পষ্টভাবে চাঁদ দেখার ন্যায় ক্বিয়ামতের দিন মুমিনগণ স্পষ্টভাবে আল্লাহকে প্রত্যক্ষ করবে। দুনিয়াতে এই দর্শন সম্ভব নয়। মুমিনদের জন্য ক্বিয়ামতের দিনে তাদের ঈমানের সর্বাপেক্ষা আনন্দদায়ক পুরস্কার হবে এটাই। কাফির-মুশরিক ও মুনাফিকগণ এই মহা সৌভাগ্য হ’তে চিরবঞ্চিত হবে তাদের অবিশ্বাসের মর্মান্তিক প্রতিফল হিসাবে।
১০- আহলেহাদীছগণ রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আতে বিশ্বাস পোষণ করেন :
শাফা‘আত হবে তিন ধরনের। (১) হাশরের ময়দানে উপস্থিত সকলের জন্য। (২) জান্নাতীদেরকে জান্নাতে পাঠানোর জন্য (৩) কবীরা গোনাহগার মুমিনদের জন্য। খারেজী ও মু‘তাযেলীগণ শেষোক্ত শাফা‘আতকে অস্বীকার করেন। কেননা তাদের মতে কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি চিরস্থায়ী জাহান্নামী।
১ম ও ২য় শাফা‘আত মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জন্য নির্দিষ্ট। তন্মধ্যে প্রথম শাফা‘আতটিই অধিক মর্যাদামন্ডিত। ৩য় শাফা‘আত মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও অন্যান্য সকল নবী, ফিরিশ্তা, উলামা, শুহাদা, ছিদ্দীক্বীন ও সকল নেককার মুমিন বান্দার জন্য উন্মুক্ত। যাদেরকে আল্লাহপাক সুফারিশের জন্য বিশেষ অনুমতি দিবেন। এতে বান্দার নিজস্ব কোন গৌরব নেই বা দুনিয়ায় থাকতে আগেভাগে কাউকে আল্লাহর নিকটে সুফারিশকারী মাধ্যম বা ‘অসীলা’ সাব্যস্ত করারও কোন উপায় নেই। এই মাধ্যম বেছে নেওয়ার ফলেই ইহুদী-নাছারা ও মুশরিকগণ দুনিয়াতে একদল মানুষকে রব-এর আসনে বসিয়েছে।
শাফা‘আতের ফলে কারু শাস্তি মওফূক হয় না। বরং শাফা‘আতের দ্বারা দয়াপরবশ হয়ে আল্লাহপাক কারো শাস্তি মওকূফ করে থাকেন। যেমন বৃষ্টি প্রার্থনার ফলে বৃষ্টি হয়না বরং দো‘আ কবুল হওয়ার কারণে আল্লাহ পাক বৃষ্টির রহমত বর্ষণ করে থাকেন। সকলে সকল অবস্থায় আল্লাহর রহমতের ভিখারী। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন।
১১- আহলেহাদীছগণ ‘খতমে নবুওতে’ দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করেন এবং এই বিশ্বাসকে মুমিন হওয়ায় দ্বিতীয় শর্ত মনে করেন।
মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে শেষনবী মানতে অস্বীকারকারী কিংবা এতে সন্দেহ পোষণকারী ব্যক্তি আহলেহাদীছের আক্বীদামতে নিঃসন্দেহে কাফির। তাঁকে শেষনবী হিসাবে স্বীকার করার পর তাঁর আনীত শরী‘আতকে সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ হিসাবে মানতে অস্বীকারকারী ব্যক্তি পূর্ণ মুমিন নয়।
মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে শেষনবী হিসাবে বিশ্বাস করার উপরেই নির্ভর করে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও অগ্রগতি। নির্ভর করে ইসলামের পূর্ণাংগ দ্বীন হওয়া, নবীর সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়া এবং কুরআনের সর্বশেষ আসমানী কিতাব হওয়া। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘নবীদের তুলনা একটি পাকা ভবনের ন্যায়, যাতে একটি ইটের জায়গা মাত্র খালি ছিল। আমিই সেই ইট এবং আমার মাধ্যমেই নবীদের সিলসিলা শেষ হয়ে গেছে’ (বুখারী, মুসলিম)। ‘আমার পরে ত্রিশজন মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব ঘটবে, যারা প্রত্যেকেই নিজেকে ‘আল্লাহর নবী’ ধারণা করবে। অথচ আমিই শেষ নবী। আমার পরে কোন নবী নেই (لاَ نَبِىَّ بَعْدِى) -বুখারী, মুসলিম)।
১২- আহলেহাদীছের অন্যতম আক্বীদা হ’ল ছাহাবায়ে কেরামের উচ্চ মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং তাঁদের সমালোচনা হ’তে বিরত থাকা।
ছাহাবায়ে কেরাম হ’লেন উম্মতের সেরা ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ পাক তাঁদেরকে তাঁর হাবীব, সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠতম রাসূলের সাথী হিসাবে নির্বাচন করেছিলেন। ক্বিয়ামতের দিন তাঁরাই হবেন রাসূলের শাফা‘আত লাভের প্রথম হকদার।
আহলেহাদীছের আক্বীদা মতে কোন ছাহাবীকে গালি দেওয়া বা সমালোচনা করা কবীরা গোনাহ। তাঁদের মধ্যে কোন পাপ চিন্তা বা দুনিয়াবী উচ্চাভিলাষ ছিল না। তবে তাঁরা নবীদের ন্যায় মা‘ছূম বা নিষ্পাপ ছিলেন না। অতএব ইজতিহাদী ভুলের কারণেই তাঁদের কারু কারু মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত হয়েছে। আহলেহাদীছগণ ছাহাবীদের ব্যাপারে শী‘আ ও খারেজীদের বাড়াবাড়ি হ’তে মুক্ত। তাঁরা ছাহাবীদের সমালোচনা থেকে বিরত থাকেন ও সকল মুমিনের ব্যাপারে হৃদয়কে খোলাছা রাখা ঈমানী কর্তব্য বলে মনে করেন। রাফেযী ও শী‘আদের ন্যায় তাঁরা ছাহাবীদের গালি দেন না। খারেজীরা ওছমান ও আলীকে কাফের ও অবৈধ খলীফা মনে করেন। শী‘আরা প্রথম তিন খলীফাকে কাফের ও আলীকেই একমাত্র বৈধ খলীফা মনে করেন এবং পরবর্তীতে তাঁর পরিবারেই মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব বা ইমামতকে সীমায়িত করে থাকেন।
১৩- আহলেহাদীছগণ এ আক্বীদা পোষণ করেন যে, খুলাফায়ে রাশেদীনের চারজন খলীফা হ’লেন উম্মতের চারজন সেরা ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হ’লেন আবুবকর (রাঃ), অতঃপর ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ), অতঃপর ওছমান গণী (রাঃ), অতঃপর আলী (রাঃ)। রাসূলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ত্রিশ বৎসর যাবত এঁদের হাতে ‘খিলাফতে রাশিদাহ’ পরিচালিত হয়েছিল।
১৪- আহলেহাদীছগণ এ আক্বীদা পোষণ করেন যে, আল্লাহর নবী (ছাঃ) যে দশজন ছাহাবীকে তাঁদের জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন, তাঁরা সবাই জান্নাতবাসী হবেন।
এতদ্ব্যতীত ছাহাবী ছাবিত বিন ক্বায়েস (মৃঃ ১২ হিঃ), উক্কাশা বিন মিহছান (মৃঃ ১২ হিঃ) ও আব্দুল্লাহ বিন সালাম (মৃঃ ৪৩ হিঃ) সম্পর্কেও আল্লাহর নবী (ছাঃ) জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। এছাড়াও ৩১৩ জন বদরী ছাহাবী এবং হোদায়বিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে ‘বায়‘আতুর রিয্ওয়ানে’ উপস্থিত ১৪০০ শত ছাহাবীর সকলেই ক্ষমাপ্রাপ্ত ও জাহান্নাম হ’তে মুক্ত।
১৫- আহলেহাদীছের অন্যতম আক্বীদা হ’ল রাসূল পরিবারকে মহববত করা ও তাঁদের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা।
‘রাসূল পরিবার’ (أهل البيت) বলতে চাচা আবু ত্বালিবের তিন পুত্র আলী, জা‘ফর ও আক্বীল এবং চাচা আববাস (মৃঃ ৩৩ হিঃ)-এর পরিবারবর্গকে বুঝায়, যাঁরা বনু হাশিমের অন্তর্ভুক্ত এবং যাঁদের জন্য ছাদাক্বা খাওয়া হারাম। এঁদের সঙ্গে বনু আব্দুল মুত্ত্বালিবের অনেকে যুক্ত আছেন। এঁরা জাহেলী ও ইসলামী উভয় যুগেই নবীর নিরাপত্তার জন্য জানমাল নিয়ে সদা সচেষ্ট ছিলেন। তাঁরাই প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী ‘খুম্ম কূয়া’র নিকটে একদিন সকল ছাহাবীকে জমা করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর পরিবারের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শনের জন্য উম্মতকে বিশেষভাবে তাকীদ দিয়ে গেছেন।
‘রাসূল পরিবার’ বলতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সম্মানিতা স্ত্রীগণকেও বুঝানো হয়। ‘উম্মাহাতুল মুমিনীন’ বা উম্মতে মুসলিমার মাতা হিসাবে তাঁরা চিরকাল বিশেষ মর্যাদার অধিকারিণী। জান্নাতেও তাঁরা রাসূলের (ছাঃ) স্ত্রী হয়ে থাকবেন। এদের মধ্যে মা খাদীজা ও মা আয়েশা হ’লেন সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারিণী। আহলে বায়তের প্রতি মর্যাদার ব্যাপারে আহলেহাদীছগণ খারেজী ও শী‘আদের বাড়াবাড়ি হ’তে মুক্ত।
১৬- আহলেহাদীছগণ ‘কারামাতে আউলিয়ায়’ বিশ্বাস পোষণ করেন।
তাঁদের মতে এটা আল্লাহর পক্ষ হ’তে তাঁর কোন নেক বান্দার প্রতি কারামত বা বিশেষ সম্মান প্রদর্শন বৈ কিছু নয়। আল্লাহ কখন কাকে কিভাবে এই মর্যাদা প্রদর্শন করবেন, এটা কেবলমাত্র তিনিই জানেন। এতে বান্দার নিজস্ব কোন গৌরব নেই।
পূর্বেকার উম্মতের মধ্যে ‘আছহাবে কাহফ’-এর মহানিদ্রা ও পুনর্জাগরণের ঘটনা, মসজিদের মেহরাবের মধ্যে বিবি মরিয়ামের জন্য জান্নাত হ’তে খাদ্য আগমন, তাঁকে স্বামী ছাড়াই সন্তান প্রদান, মাতৃক্রোড়ে শিশু ঈসা (আঃ)-এর বাক্যালাপ প্রভৃতি কারামাতের প্রমাণ বহন করেন।
আমাদের নবী (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় আবুবকর (রাঃ), আছিম বিন ছাবিত (রাঃ), খুবায়েব (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবার কারামত প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পরে ওমর, ওছমান, আলী (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবার কারামত প্রমাণিত হয়েছে। ছাহাবা, তাবেঈন, তাবে তাবেঈনের পরেও ক্বিয়ামত পর্যন্ত ‘কারামতে আউলিয়া’ জারি থাকবে। আহলেহাদীছের আক্বীদা মতে কারামতের কারণে কেউ উম্মতের ‘বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত’ ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হবেন না। তিনি মানুষের রোগ আরোগ্যকারী, প্রয়োজন পূরণকারী বা ইল্মে গায়েবের অধিকারী হ’তে পারেন না। জীবিত বা মৃত অবস্থায় তাঁর প্রতি তা‘যীমী সিজদা করা, নযর-নেয়ায পেশ করা, মৃত্যুর পরে তাঁর অসীলায় প্রাথর্না নিবেদন করা স্পষ্ট শিরক হবে। মু‘তাযিলাগণ ও কিছু কিছু আশ‘আরী বিদ্বান কারামাতে আউলিয়াকে অস্বীকার করে থাকেন।
১৭- যা স্বপ্নঘোর (أضغاث أحلام) নয়, মুমিনের সেই সকল শুভ স্বপ্নে الرؤيا الصالحة) আহলেহাদীছগণ বিশ্বাস পোষণ করে থাকেন।
নবীদের স্বপ্ন ‘অহি’ ছিল। বর্তমানে নবুঅত নেই, কিন্তু সুসংবাদ বা সত্যস্বপ্ন বাকী আছে। নেক স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় এবং স্বপ্নঘোর বা দুঃস্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে হয়। আহলেহাদীছের আক্বীদা মতে কারামাতে আউলিয়ার ন্যায় ‘সত্যস্বপ্ন’ শরী‘আতের কোন দলীল নয়।
১৮- আহলেহাদীছের আক্বীদা মতে ভাল-মন্দ সকল ইমামের পিছনে ছালাত আদায় করা জায়েয।
আল্লাহ বলেন ‘তোমরা রুকূকারীদের সাথে রুকূ কর’ (বাক্বারাহ ২/৪৩)। বিদ্রোহী ফাসেক দল কর্তৃক মদীনা অবরোধের সময় তাদের পিছনে ছালাত আদায়ে অনিচ্ছুক মুমিনদেরকে নিয়মিত জামা‘আতে ছালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়ে খলীফা ওছমান গণী (রাঃ) বলেছিলেন, ‘মানুষের সমস্ত আমলের মধ্যে ছালাতই সর্বোত্তম। অতএব যখন কেউ এই উত্তম কাজটি করে, তখন তোমরা তাদের অনুগামী হও এবং তাদের মন্দ কার্যসমূহ হ’তে বিরত থাক’। উমাইয়া সেনাপতি হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কর্তৃক মক্কা নগরী অবরোধকালে ছাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর (মৃঃ ৭৪ হিঃ) কখনও হাজ্জাজের সৈন্যদের পিছনে কখনও আব্দুল্লাহ বিন যোবায়ের (১-৭৩ হিঃ)-এর সৈন্যদের পিছনে ছালাত আদায় করতেন।
১৯- আহলেহাদীছের আক্বীদা হ’ল ভাল-মন্দ সব ধরনের মুসলিম আমীরের আনুগত্য করা।
অবশ্য শরী‘আত বিরোধী কোন হুকুম মানতে মুসলিম প্রজাসাধারণ বাধ্য নন। শাসক অপসন্দীয় হ’লে ছবর করতে হবে। তাঁর হেদায়াতের জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করতে হবে। ইছলাহের উদ্দেশ্যে তাঁর সম্মুখে হক কথা বলতে হবে। সংশোধনের অযোগ্য বিবেচিত হ’লে কোন কোন আহলেহাদীছ বিদ্বানের মতে তাঁকে পদচ্যুত করতে হবে। শত্রু কর্তৃক দেশ আক্রান্ত হ’লে ভাল-মন্দ সব আমীরের অধীনে জিহাদে অংশগ্রহণ করতে হবে। প্রকাশ্য কুফরী প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কিংবা সশস্ত্র অভ্যুত্থান করা চলবে না। নারীকে মুসলমানদের শাসন কর্তৃত্বে বসানো যাবে না। অমনিভাবে যারা নেতৃত্ব চেয়ে নেয় বা লোভ করে কিংবা আকাঙ্খা পোষণ করে তাদেরকে নেতৃত্ব দেওয়া যাবে না (বুখারী ও মুসলিম)।[1] اَلْإِيْمَانُ هُوَ التَّصْدِيْقُ بِالْجَنَانِ وَالْإِقْرَارُ بِاللِّسَانِ وَالْعَمَلُ بِالْأَرْكَانِ، يَزِيْدُ بِالطَّاعَةِ وَيَنْقُصُ بِالْمَعْصِيَّةِ، اَلْإِيْمَانُ هُوَ الْأَصْلُ وَالْعَمَلُ هُوَ الْفَرْعُ-