ঐক্যের আন্দোলন (حَرَكَةُ إتِّحَادِ الْأُمَّةِ)
ইসলামের মধ্যকার বিভিন্ন মাযহাব অপর মাযহাবে গৃহীত অনেক ছহীহ সিদ্ধান্ত, যার পক্ষে কিতাব ও সুন্নাতের ছহীহ দলীল রয়েছে, তাকে শুধুমাত্র নিজেদের তাক্বলীদী গোঁড়ামীর কারণে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রত্যাখ্যান করেছে। অতঃপর নিজেদের এই অনুদারতা ঢাকবার জন্য অপর মাযহাবের গৃহীত ছহীহ হাদীছকে অস্বীকার করেছে অথবা ‘মানসূখ’ (হুকুম রহিত) বলে দাবী করেছে। কিংবা তার পরোক্ষ ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যায় লিপ্ত হয়েছে অথবা ‘এটাও ঠিক ওটাও ঠিক’ বলে সুন্দরভাবে এড়িয়ে গেছে। এঁরা জাঁকজমকের সাথে ‘খতমে বুখারী’-র অনুষ্ঠান করেন, অথচ বুখারীর হাদীছ মানেন না। ছহীহ বুখারীর অনুবাদক হ’তে গর্ব অনুভব করেন, অথচ অনুবাদে কারচুপি করেন। আবার অযৌক্তিক টীকা-টিপ্পনীর ছুরি চালিয়ে স্বীয় মাযহাব বিরোধী ছহীহ হাদীছগুলিকে যবেহ করেন। এইসব তাক্বলীদী গোঁড়ামীর ক্যান্সারে আক্রান্ত লোকদের দ্বারাই ইসলামী ঐক্য ইসলামের নামেই ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেছে এবং তা এখন সামাজিকভাবে স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে।
এক্ষণে যদি কেউ সত্যিকার অর্থে ইসলামী ঐক্য চান এবং ইসলামের বিধান ও অনুশাসনসমূহ সঠিকভাবে পালন করে ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি কামনা করেন, তবে তাকে সর্বপ্রথম তাক্বলীদী বন্ধন ছিন্ন করে মাযহাবী ও দলীয় সংকীর্ণতা পরিহার করতে হবে। অতঃপর সম্পূর্ণ খোলা মনে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সনিষ্ঠ অনুসারী হ’তে হবে। তা তার নিজ মাযহাবের, নিজ বংশের বা সমাজের এমনকি নিজ দেশের প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধেও যাক না কেন। এই কঠিন ঝুঁকি নিয়ে ‘হক্ব’ কবুল করতে পারলেই তবে জান্নাতের আশা করা যায়।
’৮০-এর দশকের প্রথম দিকে (الاتحاد مع الاختلاف) ‘মতপার্থক্য সহই ঐক্য’ নামক একটি নতুন ফর্মুলার কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু প্রায় দু’ দশক (১৯৭৮-৯৮) ধরে চেষ্টা করেও তাতে কোন ফলোদয় হয়নি।[1] কারণ বৈষয়িক অনৈক্যের চাইতে ধর্মীয় অনৈক্য মানুষের মনে বেশী রেখাপাত করে। আর সেকারণেই শ্রেষ্ঠ ইবাদত ‘ছালাতের’ মধ্যে বুকে হাত বাঁধা বা নাভীর নীচে হাত বাঁধা, রুকূতে যাওয়া ও ওঠার সময় রাফ‘উল ইয়াদায়েন করা বা না করা, ঈদায়নের ছালাতে ৬ তাকবীর না ১২ তাকবীর, জানাযার ছালাতে সূরায়ে ফাতিহা পড়তে হবে কি হবে না, ছালাত শেষে ইমাম-মুক্তাদী দু’হাত উঠিয়ে দলবদ্ধভাবে মুনাজাত (প্রার্থনা) করবে কি করবে না, জুম‘আর আযান একটা না দু’টা-ইত্যাকার ধর্মীয় পার্থক্য সমূহ ঘুচানো আজও সম্ভব হয়নি। অথচ এসব ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহজ-সরল ঐক্য ফর্মুলা হ’ল: ছহীহ হাদীছ দ্বারা যেটি প্রমাণিত হবে, সেটি সকলে মেনে নিবেন ও বাকীটি ছেড়ে দিবেন। যদি দু’টিই ছহীহ হাদীছে থাকে, তবে সর্বাধিক ছহীহ আমলটি করবেন অথবা দু’টি আমলই সকলে সুযোগমত করবেন। নির্দিষ্ট কোন একটির উপরে গোঁড়ামী করবেন না। বলা বাহুল্য, এধরনের পার্থক্য ফিক্বহের অধিকাংশ বিষয়ে রয়েছে।
অনেকে বলেন, আমাদের মধ্যে আক্বীদায় কোন বিরোধ নেই। যত বিরোধ কেবল শাখা-প্রশাখায়। কথাটি একেবারেই ভিত্তিহীন। বরং আমলের সাথে সাথে আক্বীদার ক্ষেত্রেও রয়েছে দুস্তর পার্থক্য। যেমন কেউ বলছেন, আল্লাহ নিরাকার, তিনি সর্বত্র বিরাজমান। অথচ কুরআন বলছে, আল্লাহর আকার আছে (ছোয়াদ ৩৮/৭৫, মায়েদাহ ৫/৬৪ ইত্যাদি)। তবে তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই (শূরা ৪২/১১)। তিনি আসমানের উপরে আরশে সমাসীন (ত্বোহা ২০/৫ ইত্যাদি)। তবে তাঁর ইল্ম ও কুদরত সর্বত্র বিরাজমান (ত্বালাক্ব ৬৫/১২, বাক্বারাহ ২/১৪৮ প্রভৃতি)। কেউ বলছেন ‘যত কল্লা তত আল্লাহ’। আমরা সবাই আল্লাহর সত্তার অংশ (নাঊযুবিল্লাহ)। অথচ কুরআন বলছে আল্লাহ সবকিছুরই স্রষ্টা। বাকী সবই তাঁর সৃষ্টি। স্রষ্টা এবং সৃষ্টি কখনই এক নয় (রা‘দ ১৩/১৬, নাহল ১৬/১৭ ইত্যাদি)। মূলতঃ এগুলি ইরানী ও হিন্দুয়ানী অদ্বৈতবাদী ও সর্বেশ্বরবাদী দর্শন, যা মা‘রেফাতের নামে সূফীবাদী দর্শন হিসাবে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। কেউ বলেন, নবী-রাসূল ও পীর-আউলিয়া মরেন না, বরং ভূপৃষ্ঠ হ’তে ভূগর্ভে বা কবরে ইন্তেকাল বা স্থানান্তরিত হন মাত্র। তাঁরা কবরে যিন্দা থাকেন ও ভক্তদের ভালমন্দের ক্ষমতা রাখেন। অথচ আল্লাহ ব্যতীত ‘কেউ কারু ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না’ (মায়েদাহ ৫/৭৬ ইত্যাদি)। এমনকি কেউ কেউ ‘যিনদা পীর’ নামেও অভিহিত হয়েছেন। অথচ আল্লাহ বলেন, ‘নবী-রাসূল সহ সকল মানুষ মৃত্যুবরণ করে থাকেন’ (মুমিনূন ২৩/১০০)। চরম অদৃষ্টবাদী একদল লোক বলছেন, ‘কিছু হইতে কিছু হয় না, যা কিছু হয় আল্লাহ হইতে হয়’ আমরা সবাই পুতুল সদৃশ। অতএব ‘যেমনে নাচায় তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ’? তার বিপরীতে আরেকদল বলছেন, অদৃষ্ট বলে কিছু নেই। ‘মানুষ নিজেই তার অদৃষ্টের স্রষ্টা’। অথচ আক্বীদা বিষয়ে সহজ-সরল ঐক্য ফর্মুলা হ’ল : আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সংক্রান্ত আয়াত ও ছহীহ হাদীছসমূহকে প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করা এবং সকল বিষয়ে ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম ও মুহাদ্দেছীনের মাসলাক অনুযায়ী ফায়ছালা প্রদান করা।
এছাড়াও রয়েছে হাক্বীক্বাত, তরীক্বাত ও মা‘রেফাতের নামে চিশতিয়া, ক্বাদেরিয়া, মুজাদ্দেদিয়া ও নকশবন্দীয়া নামক প্রধান চারটি সূফীবাদী দলের উপদলসমূহ মিলে প্রায় দু’শ তরীক্বা। যাদের পরস্পরে আক্বীদা ও আমলে কোন মিল নেই। যার ফলে দেশে সৃষ্টি হয়েছে ১৯৮১ সালে সরকারী হিসাব মতে ২ লক্ষ ৯৮ হাযার পীর। প্রত্যেক পীরের রয়েছে হাযার হাযার মুরীদ। এক পীরের সাথে অন্য পীরের ও তাদের মুরীদদের রয়েছে আক্বীদা ও আমলের মাঝে বিরাট ফারাক। তাই ১৩ কোটি তাওহীদবাদী মুসলিমের অবস্থা এখন ঘুণে ধরা বাঁশের মত। যাতে কোন শক্তি নেই। আর এর একমাত্র কারণ হ’ল, বিভিন্ন শিরকী আক্বীদা ও বিদ‘আতী আমল। যেসবের প্রচলনকারী হ’লেন, প্রথমতঃ দেশের এক শ্রেণীর দুষ্টমতি আলেম, যারা দুনিয়াবী স্বার্থে এগুলির প্রচলন ও লালন করেন। দ্বিতীয়তঃ এক ধরনের সমাজনেতা, যারা এগুলিকে সহযোগিতা করেন ও পাহারা দেন। তৃতীয়তঃ এক ধরনে ধনী লোক, যারা তাদের অঢেল ধন-সম্পদ এসবের পিছনে ব্যয় করেন সহজে জান্নাত পাওয়ার ধোঁকায়। চতুর্থতঃ দেশের সরকার, যারা ধর্মের নামে এগুলিকে নিরাপত্তা দান করে থাকেন। সত্য কথা বলতে কি, এদেশের অধিকাংশ পীর ও ইসলামী নেতারা তাওহীদ-এর সঠিক ব্যাখ্যা জানেন না কিংবা সুন্নাত ও বিদ‘আতের পার্থক্য বুঝেন না। সেকারণ সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন শিরকী আক্বীদা যেমন তাওহীদের নামে পার পেয়ে যাচ্ছে, তেমনি প্রচলিত বিদ‘আতসমূহ ‘বিদ‘আতে হাসানাহ্’র নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে যেন এখন আর শিরক ও বিদ‘আত বলে কিছুই নেই। যা আছে সবই তাওহীদ, সবই সুন্নাত, সবই ইসলাম। এসবের বিরোধিতাকারী আহলেহাদীছরাই আসলে বেদ্বীন ও লা-মাযহাবী। হা-শা ওয়া কাল্লা!
অতএব শিরক ও বিদ‘আতসমূহের ব্যাপারে মৌলিক ঐক্যমতে না এসে কেবলমাত্র ভোটের স্বার্থে সাময়িক ‘ইসলামী ঐক্যজোট’ করলে তা কখনই টেকসই হবে না। বরং স্লাইস্ড পাউরুটির মত যেকোন সময়ে স্বার্থদুষ্ট পাতলা পর্দার ঐক্য ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে।
বলা আবশ্যক যে, ইসলামের শত্রুরা রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের চাইতে আক্বীদাগত বা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকেই সর্বদা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। দেশের বহু জ্ঞানী-গুণী মুসলিম পন্ডিত ইতিমধ্যেই তাদের আগ্রাসনের শিকার হয়েছেন এবং ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। যারা দেশের প্রচার মাধ্যমসমূহে, শিক্ষা কেন্দ্রে, অর্থনৈতিক উপায়-উপাদানসমূহে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশে অনুপ্রবেশ করে তাদের কপট উদ্দেশ্য সাধন করে চলেছেন। ঐক্য প্রয়াসী ইসলামী নেতৃবৃন্দকে তাই মূল আক্বীদাগত বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য আমরা আহবান জানাই।
‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ ইসলামের মধ্যকার বিচ্ছিন্ন ফের্কাসমূহকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর সর্বোচ্চ অধিকার নিঃশর্তভাবে মেনে নেওয়ার একটিমাত্র শর্তে ঐক্যবদ্ধ মহাজাতিতে পরিণত করতে চায়। মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহীম (আঃ)-কে একাই একটি ‘উম্মত’ হিসাবে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে (নাহ্ল ১২০)। যদিও তাঁর যুগে তিনি কার্যতঃ একাকী ছিলেন এবং তাঁর পিতা ও নিজ গোত্র সহ সে যুগের প্রায় সকল মানুষ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
অতএব আজও যেকোন মূল্যে হক্ব-কে আঁকড়ে ধরতে হবে এবং মনকে উদার রেখে সকলকে হক্ব-এর দিকে আহবান জানাতে হবে। সংখ্যায় কম হৌক বা বেশী হৌক হক্বপন্থী সেই লোকগুলিই হবেন আল্লাহর নিকটে সত্যিকারের ঐক্যবদ্ধ একটি জামা‘আত। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সেদিকেই জগদ্বাসীকে আহবান জানায় এবং হক্বপন্থী সেই জামা‘আতই প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আল্লাহ্ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যিবাদীদের (হক্বপন্থীদের) সঙ্গে থাক’ (তাওবা ৯/১১৯)।
[1]. অধ্যাপক গোলাম আযম, ইসলামী ঐক্যমঞ্চ চাই (ঢাকা: জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, কেন্দ্রীয় প্রকাশনা বিভাগ, ফেব্রুয়ারী ২০০০) পুস্তক দ্রষ্টব্য।