নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলন (اَلْحَرَكَةُ الْإِسْلاَمِيَّةُ الْخَالِصَةُ)
আল্লাহর উদ্দেশ্যে আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহর যমীনে প্রতিষ্ঠা করার যে আন্দোলন তাকেই সত্যিকারের ইসলামী আন্দোলন বলে। এ আন্দোলনের লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এর ভিত্তি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ। এর কাজ হ’ল কিতাব ও সুন্নাতের যথাযথ প্রচার ও প্রতিষ্ঠা। বস্ত্ততঃপক্ষে আহলেহাদীছ আন্দোলন ব্যতীত অন্য কোন ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য যথাযথভাবে বর্তমান নেই। আর সেকারণেই ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ বিশ্ব ইতিহাসের একমাত্র নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলন।
ইসলামী আন্দোলন যুগে যুগে হয়েছে, আজও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের নামে এযাবত যতগুলো আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই অবশেষে সংকীর্ণ মাযহাবী রূপ ধারণ করেছে এবং তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও শাসন সংবিধানে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিরপেক্ষ অনুসরণের বদলে কোন একটি মাযহাবী মতবাদ চেপে বসেছে। যার পরিণতি অতীব ভয়াবহ হয়েছে। বিগত যুগে আববাসীয় খেলাফতকালে খলীফা মামূন, মু‘তাছিম ও ওয়াছিক বিল্লাহ (১৯৮-২৩২ হিঃ) কর্তৃক মু‘তাযিলা মতবাদের নির্মম পৃষ্ঠপোষকতা, বর্তমানে ইরানে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী হুকুমত তথা শী‘আ হুকুমত এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশে একটি বিশেষ ইসলামী দল কর্তৃক সংখ্যাগরিষ্ঠ মাযহাবী (হানাফী) হুকুমত প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব এরই প্রমাণ বহন করে।[1] যেকোন দলীয় নামের সাথে ‘ইসলাম’ শব্দটি জুড়ে দিলে তা দ্বারা অবশ্যই কিছু সস্তা জনপ্রিয়তা লাভ করা সম্ভব হয়। কিন্তু নিজেদের দলীয় অনুদারতা ঢাকবার জন্য যেরূপ ঢালাওভাবে সকলে ইসলামকে রক্ষাকবচ হিসাবে ব্যবহার করছেন, তাতে ইসলামী আন্দোলন যেন গোলকধাঁধায় পরিণত হয়েছে। কোন্ ইসলামের দলভুক্ত হ’লে সত্যিকারের ইসলামী জামা‘আতভুক্ত হ’লাম, তা বুঝতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।
যে বৈশিষ্ট্যগত কারণে ছাহাবায়ে কেরাম স্বর্ণযুগের শ্রেষ্ঠ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও নিজেদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ নামে অভিহিত করতেন, সেই একই কারণে নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলনের ঝান্ডাবাহী আহলেহাদীছগণ সকল প্রকারের রাখ-ঢাক ছেড়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ্কে স্ব স্ব মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেদের পরিচালিত আন্দোলকে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ বলেছেন। তাতে সস্তা জনপিয়তা (Cheap popularity) অবশ্যই ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কিন্তু তবুও হক্বকে অগ্রাধিকার দিয়ে সম্পূর্ণ খোলা মনে যিনিই নির্ভেজাল ইসলামের অনুসরণে ব্রতী হবেন, তিনিই এ আন্দোলনে শরীক হ’তে পারবেন।
মোদ্দাকথা কালেমা পাঠকারী যে কোন মুসলমান, তিনি যতই অনৈসলামী ভাবাপন্ন হৌন না কেন, তাকে যেমন ‘কাফের’ বলা যায় না, তেমনি ইসলামের নামে পরিচালিত কোন আন্দোলন, তার মধ্যে যতই শিরক ও বিদ‘আতের জগাখিচুড়ি থাকুক না কেন, সাধারণভাবে তাকে ইসলামী আন্দোলনই বলতে হয়। কিন্তু ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ বলতে এসব ভেজালের কোন প্রশ্নই ওঠে না। কেননা ইসলামের নির্ভেজাল আদিরূপ প্রতিষ্ঠা করাই এ মহান আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য। অতএব সঙ্গত কারণেই এ আন্দোলনের কর্মীরা সকল প্রকারের শিরক-বিদ‘আত ও অনৈসলামী তৎপরতার বিরুদ্ধে হয়ে থাকেন আপোষহীন সংগ্রামী। তাই ‘সকলের মনরক্ষা নীতি’ অনুসরণে সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের কোন সুযোগ না থাকার ফলে আহলেহাদীছের সংখ্যা অন্যদের তুলনায় চিরদিনই কম। বরং বলা যেতে পারে যে, সংখ্যায় কম হওয়াটাই এদের গৌরব। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদত্ত সুসংবাদ কেবলমাত্র ঐ সকল মর্দে মুজাহিদের জন্যই নির্দিষ্ট, যারা বিরোধীদের ও দুশমনদের পরোয়া না করে দৃঢ়ভাবে হক্ব ও ন্যায়ের অনুসরণ করে চলেন (মুসলিম হা/১৯২৩)। তাছাড়া কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দার সংখ্যা চিরদিনই কম হয়ে থাকে (সাবা ৩৪/১৩)।
[1]. দ্রষ্টব্য: উর্দু সাপ্তাহিক আল-ইসলাম (লাহোর) ১৩ বর্ষ ২৩ সংখ্যা এবং বাংলা সাপ্তাহিক সোনার বাংলা (ঢাকা) ৩১শে জানুয়ারী ১৯৮৬ প্রশ্নোত্তরের আসর; অধ্যাপক গোলাম আযম, প্রশ্নোত্তর (ঢাকা: গ্রন্থমালঞ্চ ১৯৯৮) পৃঃ ১৮২।