আহলুল হাদীছ ও আহলুস সুন্নাহ (أََهْلُ الْحَدِيْثِ وَ أَهْلُ السُّنَّةِ)
‘হাদীছ’ অর্থ বাণী এবং ‘সুন্নাহ’ অর্থ রীতি। পারিভাষিক অর্থে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতিকে ‘হাদীছ’ বলা হয়। হাদীছ ও সুন্নাহ্র মধ্যে আভিধানিক অর্থে কিছু পার্থক্য থাকলেও পারিভাষিক ও প্রায়োগিক অর্থে কোন পার্থক্য নেই। কেননা উভয়ের বিষয়বস্ত্ত এক এবং সবকিছুই হাদীছের মাধ্যমে লিখিত রূপ লাভ করেছে। হাদীছ ও ফিক্বহে ‘আহলুস সুন্নাহ’ ও ‘আহলুল হাদীছ’ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে পরবর্তী যুগে ‘আহলুর রায়’-এর বিপরীতে ‘আহলুল হাদীছ’ নামটি বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করে।
৩৭ হিজরীর পর থেকেই ইসলামের স্বচ্ছ সলিলে কিছু কিছু ভেজাল মিশ্রিত হ’তে শুরু করেছিল। কিন্তু ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে ইযামের পবিত্র উদ্যোগ এসবের প্রসার রোধ করেছিল। তাঁরা এসব ফিৎনা হ’তে মুসলিম মিল্লাতকে মুক্ত রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং বিদ‘আতপন্থীদের বিপরীতে নিজেদেরকে ‘আহলুস সুন্নাহ’ ও ‘আহলুল হাদীছ’ নামে অভিহিত করেন। অতঃপর তাঁদের অনুসারী হক্বপন্থী মুসলমানরাও নিজেদেরকে ‘আহলুল হাদীছ’ নামে অভিহিত করেন। যেমন খ্যাতনামা তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (৩৩-১১০ হিঃ) বলেন,
لَمْ يَكُوْنُوْا يَسْأَلُوْنَ عَنِ الْإِسْنَادِ، فَلَمَّا وَقَعَتِ الْفِتْنَةُ قَالُوْا سَمُّوْا لَنَا رِجَالَكُمْ، فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ فَيُوْخَذُ حَدِيْثُهُمْ وَ يُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ الْبِدْعِ فَلاَ يُؤْخَذُ حَدِيْثُهُمْ-
অর্থাৎ ‘লোকেরা ইতিপূর্বে কখনও হাদীছের সনদ বা সূত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত না। কিন্তু যখন ফিৎনার যুগ এল, তখন লোকেরা বলতে লাগল আগে তোমরা বর্ণনাকারীদের পরিচয় বল। অতঃপর যদি দেখা যেত যে, বর্ণনাকারী ‘আহলে সুন্নাত’ দলভুক্ত, তাহ’লে তাঁর বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত। কিন্তু ‘আহলে বিদ‘আত’ দলভুক্ত হ’লে তার বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত না।[1] ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) এজন্য বলেন,
وَمِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ مَذْهَبٌ قَدِيْمٌ مَعْرُوْفٌ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ اللهُ أَبَا حَنِيْفَةَ وَ مَالِكًا وَ الشَّافِعِىَّ وَ أَحْمَدَ، فَإِنَّهُ مَذْهَبُ الصَّحَابَةِ الَّذِيْنَ تَلَقَّوْهُ عَنْ نَبِيِّهِمْ-
‘আবু হানীফা, মালেক, শাফেঈ ও আহমাদের জন্মের বহু পূর্ব হ’তে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের প্রাচীন একটি মাযহাব সুপরিচিত ছিল। সেটি হ’ল ছাহাবায়ে কেরামের মাযহাব, যাঁরা তাঁদের নবীর কাছ থেকে সরাসরি ইল্ম হাছিল করেছিলেন’।[2] ছহাবায়ে কেরামের জামা‘আতকে যে ‘আহলুল হাদীছ’ বলা হ’ত, সেকথা আমরা ইতিপূর্বে ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী, ইমাম শা‘বী, ইবনু হাযম আন্দালুসী প্রমুখের বক্তব্যে অবহিত হয়েছি (দ্রঃ টীকা ১, ২, ১১)।
আহলেহাদীছগণ বিভিন্ন হাদীছের কিতাবে ও বিশ্বস্ত ফিক্বহ গ্রন্থসমূহে ‘আহলুল হাদীছ’, ‘আছহাবুল হাদীছ’, ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’, ‘আহলুল আছার’, ‘আহলুল হক্ব’ ‘মুহাদ্দেছীন’ প্রভৃতি নামে কথিত হয়েছেন। সালাফে ছালেহীনের[3] অনুসারী হিসাবে তাঁরা ‘সালাফী’ নামেও পরিচিত। আহলেহাদীছগণ মিসর, সূদান, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশে ‘আনছারুস সুন্নাহ’, সউদী আরব, কুয়েত প্রভৃতি দেশে ‘সালাফী’, ইন্দোনেশিয়াতে ‘জামা‘আতে মুহাম্মাদিয়াহ’ এবং পাক-ভারত উপমহাদেশে ‘মুহাম্মাদী’ ও ‘আহলেহাদীছ’ নামে পরিচিত। যদিও বিরোধীরা তাঁদেরকে লা-মাযহাবী, রাফাদানী, ওয়াহ্হাবী, গায়ের মুক্বাল্লিদ ইত্যাদি বাজে নামে অভিহিত করে থাকেন।[1]. মুক্বাদামা মুসলিম: (বৈরুত: দরুল ফিক্র ১৪০৩/১৯৮৩) পৃঃ ১৫।
[2]. আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ, ‘মিনহাজুস সুন্নাহ’ (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইল্মিয়াহ, তাবি, ১৩২২ হিঃ মিসরী ছাপা হ’তে ফটোকপিকৃত) ১/২৫৬ পৃঃ ।
[3]. ছাহাবা, তাবেঈন ও হাদীছপন্থী বিগত বিদ্বানগণকে ‘সালাফে ছালেহীন’ বলা হয়। -লেখক