ফের্কাবন্দী বনাম আহলেহাদীছ (أَهْلُ الْحَدِيْثِ خِلاَفَ تَفْرِقَةِ الْأُمَّةِ)
আল্লাহ্র হুকুম ছিল, وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيعًا وَلاَ تَفَرَّقُوْا ‘ওয়া‘তাছিমূ বিহাবলিল্লা-হি জামী‘আঁও অলা তাফাররাক্বূ’। অর্থ: ‘তোমরা সকলে মিলে আল্লাহ্র রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর। (সাবধান)! দলে দলে বিভক্ত হয়ো না’ (আলে ইমরান ১০৩)। কিন্তু রাসূল (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইন্তেকালের কিছুকাল পর হ’তেই মুসলমানরা আপোষে দলাদলি ও ফির্কাবন্দীতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে অধঃপতন ত্বরান্বিত হয়।
মুসলমানদের মধ্যে এই দল বিভক্তির কারণ ছিল মূলতঃ চারটি।
১. ইহুদী-খৃষ্টানদের প্ররোচনা। ২. রাজনৈতিক স্বার্থদ্বন্দ্ব। ৩. বিভিন্ন বিজাতীয় প্রথা ও দর্শন চিন্তার অনুপ্রবেশ। ৪. শরী‘আতের ব্যাখ্যাগত মতভেদ।
প্রথমোক্ত কারণ হিসাবে আমরা দেখতে পাই যে, তৃতীয় খলীফা হযরত ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতের (২৩-৩৫ হিঃ) শেষ দিকে ইয়ামনের জনৈকা নিগ্রো মাতার গর্ভজাত ইহুদী সন্তান আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা বাহ্যিকভাবে মুসলমান হয় (২) পরে তারই কূট চক্রজালে মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম ‘সাবাঈ’ ও ‘ওছমানী’ দু’টি দলের সৃষ্টি হয়। অতঃপর বিদ্রোহী সাবাঈ দলের হাতেই মহান খলীফা ওছমান (রাঃ) নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। পরবর্তীতে হযরত আলী (রাঃ) ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মধ্যেকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে খারেজী ও শী‘আ দলের উদ্ভব ঘটে এবং চরমপন্থী খারেজীদের হাতে চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রাঃ) শহীদ হন (৩) এই সময়ে পৃথবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন মতাদর্শের লোক মুসলমান হ’তে থাকে। কিন্তু বংশ পরম্পরায় লালিত তাদের এতকালের অভ্যাস অনেকেই পুরোপুরিভাবে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে বহু বিজাতীয় রসম-রেওয়াজ মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করে। যা পরবর্তীতে সাধারণভাবে ইসলামী রীতি ও প্রথা হিসাবে চালু হয়ে যায় এবং এই সকল বিদ‘আতী রীতির অনুসারী ও বিরোধীগণ বিভিন্ন নামে অভিহিত হ’তে থাকেন। (৪) এমনিভাবে বিভিন্ন বিজাতীয় দর্শন চিন্তাও মুসলমানদের মাঝে ফের্কা সৃষ্টিতে বারি সিঞ্চন করে। যেমন উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের আমলে (৬৫-৮৬ হিঃ) ইরাকের বছরা নগরে ‘সূসেন’ নামীয় জনৈক খৃষ্টান বাহ্যিকভাবে মুসলমান হয়ে পরে ‘মুরতাদ’ হয়ে যায়। তার প্ররোচনায় মা‘বাদ নামীয় জনৈক ব্যক্তি সর্বপ্রথম মুসলিম সমাজে তাক্বদীরকে অস্বীকারকারী ‘ক্বাদারিয়া’ মতবাদের জন্ম দেয়। পরে তার বিপরীতে সৃষ্টি হয় ‘জাবরিয়া’ নামে সম্পূর্ণ অদৃষ্টবাদী এক বিভ্রান্তিকর মতবাদ।
এভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন দল ও মতসমূহ পরবর্তী কালে পৃথক পৃথক ‘মাযহাবে’ রূপ নেয়। এ সকল মাযহাবের অনুসারী দলের মধ্যে আবার বিভিন্ন তরীক্বা ও উপদল রয়েছে। ফলে ইসলামের মধ্যে ফের্কাবন্দীর ইতিহাস একটি দুঃখজনক অভিশাপ হিসাবে দিন দিন প্রলম্বিত হ’তে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, উপরোক্ত সকল মাযহাব ও তরীক্বার অনুসারীরা তাদের গৃহীত ফৎওয়াসমূহ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ থেকেই প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। পবিত্র কুরআনের যে সকল আয়াত ও রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যে সকল হাদীছ তাদের মাযহাবী সিদ্ধান্তের অনুকূলে হ’ত, সেগুলি তারা সানন্দে গ্রহণ করতেন। কিন্তু যেগুলি তার বিরোধী হ’ত, তারা সেগুলির পরোক্ষ ব্যাখ্যায় লিপ্ত হ’তেন কিংবা ‘মানসূখ’ বলে পরিত্যাগ করতেন। শী‘আরা তো রাজনৈতিক কারণে হযরত আলী (রাঃ)-এর মর্যাদা বর্ণনায় তিন লাখ জাল হাদীছ বানিয়ে নিয়েছেন।[1] প্রচলিত কুরআন শরীফ, যা ‘মুছহাফে উছমানী’ নামে পরিচিত, তার বিপরীতে তাদের আবিষ্কৃত এর তিনগুণ বড় ‘মুছহাফে ফাতেমা’ নামক তথাকথিত কুরআন গ্রন্থে প্রচলিত কুরআন শরীফের একটি হরফও নেই বলে তারা দাবী করেন।[2] এমনিভাবে উমাইয়া, আববাসীয়, শী‘আ, হানাফী, শাফেঈ প্রভৃতি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দলের লোকেরা নিজ নিজ দলের ও মাযহাবের পক্ষে ও অপর মাযহাবের বিপক্ষে যে কত জাল ও মিথ্যা হাদীছ রটনা করেছে, তার ইয়ত্তা নেই।[3]
[1]. ড. মুছতফা সাবাঈ, আস-সুন্নাহ, পৃঃ ৮১।
[2]. ইহসান ইলাহী যাহীর, আশ-শী‘আহ ওয়াস সুন্নাহ (লাহোর : ইদারাহ তারজুমানুস সুন্নাহ, তাবি) পৃঃ ৮০-৮১।
[3]. দ্রঃ আস-সুন্নাহ পৃঃ ৭৮-৭৯; ইউসুফ জয়পুরী, হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ (বোম্বাই : তাবি, তাহক্বীক্ব : দাঊদ রায) দুর্রে মুখতার-এর বরাতে, পৃঃ ১৮৩-৮৫; থিসিস পৃঃ ১৮০-৮২ টীকা ৫৯-৬০ দ্রষ্টব্য।