জামা‘আতে আহলেহাদীছ যুগে যুগে (جَمَاعَةُ أَهْلِ الْحَدِيْثِ فِىْ مَرِّ الْعُصُوْرِ)
ছাহাবী ও তাবেঈগণ প্রথম যুগের আহলেহাদীছ ছিলেন। তাঁদের হাতে বিজিত ও তাঁদের মাধ্যমে প্রচারিত তৎকালীন পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার মুসলিমগণ সকলেই ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। ৩৭ হিজরীর পর থেকে বিদ‘আতীদের উদ্ভব হ’তে থাকলে তাদের বিপরীতে আহলুল হাদীছগণ স্বতন্ত্র নামে ও অনন্য বৈশিষ্ট্যে পরিচালিত হ’তে থাকেন। অতঃপর ৪র্থ শতাব্দী হিজরীতে তাক্বলীদ ভিত্তিক বিভিন্ন মাযহাব সৃষ্টির ফলে তৎকালীন পৃথিবীর মুসলিম অঞ্চলসমূহে আহলুল হাদীছের পাশাপাশি বিভিন্ন মাযহাবী দলেরও সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন প্রখ্যাত মুসলিম ভূ-পর্যটক শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আল-মাক্বদেসী চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর মাঝামাঝি নাগাদ পৃথিবীর মুসলিম এলাকাসমূহ পরিভ্রমণে বের হন। তৎকালীন বিশ্বের আহলেহাদীছ অধ্যুষিত এলাকাসমূহের কিছু কিছু তথ্য তিনি স্বীয় ‘আহসানুত তাক্বাসীম ফী মা‘রিফাতিল আক্বালীম’ নামক ভ্রমণ গ্রন্থে বিবৃত করেছেন। তিনি বলেন, ‘হেজায তথা মক্কা-মদীনার এলাকায় আহলে সুন্নাত (পৃঃ ৯৬) এবং আববাসীয় রাজধানী বাগদাদের অধিকাংশ ফক্বীহ ও বিচারপতি হানাফী ছিলেন (পৃঃ ১২৭)। উমাইয়াদের রাজধানী দামেশক ও সিরিয়ার লোকদের সমস্ত আমল আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরেই (وَالْعَمَلُ كَانَ فِيْهِ عَلَى مَذْهَبِ أَصْحَابِ الْحَدِيْثِ) আছে। এখানে মু‘তাযিলাদের স্থান নেই। মালেকী বা দাঊদীও নেই’ (পৃঃ ১৭৯-৮০)।
অতঃপর মাক্বদেসী ৩৭৫ হিজরীতে ভারতে তৎকালীন ইসলামী রাজধানী সিন্ধুর মানছূরায় আসেন। মানছূরা (করাচী) সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সেখানকার অধিকাংশ (মুসলিম) অধিবাসী আহলেহাদীছ’ (أَكْثَرُهُمْ أَصْحَابُ حَدِيْثٍ)। ক্বাযী আবু মুহাম্মাদ মানছূরী নামে সেখানে দাঊদী মাযহাবের একজন ইমাম আছেন। তাঁর লিখিত অনেক মূল্যবান কেতাব রয়েছে। মুলতানের অধিবাসীরা শী‘আ মতাবলম্বী। প্রত্যেক শহরেই কিছু কিছু হানাফী ফক্বীহ রয়েছেন। এখানে মালেকী বা মু‘তাযেলী কেউ নেই, হাম্বলীও নেই’।[1]
মাক্বদেসীর অর্ধশত বছর পরে ঐতিহাসিক আবু মানছূর আব্দুল ক্বাহির বাগদাদী (মৃঃ ৪২৯) তৎকালীন পৃথিবীতে আহলেহাদীছদের অবস্থান সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেন,
ثُغُوْرُ الرُّوْمِ وَالْجَزِيْرَةِ وَ ثُغُوْرُ الشَّامِ وَ ثُغُوْرُ آذَرْبَيْجَانَ وَبَابِ الْأَبْوَابِ كُلُّهُمْ عَلَى مَذْهَبِ أَهْلِ الْحَدِيْثِ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ وَ كَذَالِكَ ثُغُوْرُ أَفْرِيْقِيَّةَ وَ أَنْدَلُسَ وَ كُلُّ ثِغَرِ وَرَاءِ بَحْرِ الْمَغْرِبِ أَهْلُهُ مِنْ أَصْحَابِ الْحَدِيْثِ وَ كَذَالِكَ ثُغُوْرُ الْيَمَنِ عَلَى سَاحِلِ الزَّنْجِ ، وَأَمَّا ثُغُوْرُ أَهْلِ مَا وَرَاءِ النَّهْرِ فِيْ وُجُوْهِ التُّرْكِ وَ الصِّيْنِ فَهُمْ فَرِيْقَانِ: إِمَّا شَافِعِيَّةٌ وَإِمَّا مِنْ أَصْحَابِ أَبِيْ حَنِيْفَةَ-
‘রূম সীমান্ত, আলজিরিয়া, সিরিয়া, আযারবাইজান, বাবুল আবওয়াব (মধ্য তুর্কিস্তান) প্রভৃতি এলাকার সকল মুসলিম অধিবাসী ‘আহলেহাদীছ’ মাযহাবের উপরে ছিলেন। এমনিভাবে আফ্রিকা, স্পেন ও পশ্চিম সাগরের পশ্চাদবর্তী দেশসমূহের সকল মুসলমান ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। একইভাবে আবিসিনিয়ার উপকূলবর্তী ইয়ামনের সকল অধিবাসী ‘আহলেহাদীছ’ ছিলেন। তবে তুরস্ক ও চীন অভিমুখী মধ্য তুর্কিস্তান সীমান্তের অধিকারীদের মধ্যে দু’টি দল ছিল : একদল শাফেঈ ও একদল আবু হানীফার অনুসারী’।[2]
মাক্বদেসী ও আবদুল ক্বাহির বাগদাদীর উপরোক্ত বর্ণনা হ’তে প্রমাণিত হয় যে, বাগদাদী খেলাফতের স্কন্ধে সওয়ার হয়ে ‘আহলুর রায়’ ও মু‘তাযিলাদের চরম রাজনৈতিক ও মাযহাবী নির্যাতন সত্ত্বেও পঞ্চম শতাব্দী হিজরী পর্যন্ত খোদ মক্কা-মদীনা ও সিরিয়া সহ ইউরোপ, আফ্রিকা, সোভিয়েত রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, নিকটপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং সুদূর সিন্ধু পর্যন্ত আহলেহাদীছ জনগণের সংখ্যাধিক্য বজায় ছিল, যা সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার বৈ কি!
৩৭৫ হিজরীর কিছু পরে মানছূরার শাসন ক্ষমতা ইসমাঈলী শী‘আদের হাতে চলে যায়। অন্যদিকে ৬০২ হিজরী মোতাবেক ১২০১ খৃষ্টাব্দ থেকে দিল্লীতে ও বাংলাদেশে শুরু হয় ‘আহলুর রায়’ হানাফী শাসন। তখন থেকেই কখনও গযনভী, কখনও আফগানী, কখনও তুর্কীদের দ্বারা উপমহাদেশ শাসিত হয় এবং মূল আরবীয় শাসনের অবসান ঘটে। ফলে একদিকে রাজনৈতিক অনুদারতা, অন্যদিকে তাক্বলীদপন্থী আলেমদের সংকীর্ণতা, জনসাধারণের অজ্ঞতা ও আহলেহাদীছ আলেমদের স্বল্পতার কারণে আহলেহাদীছ আন্দোলন ভারতবর্ষে ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসে। দ্বাদশ শতাব্দীতে এসে আল্লাহ পাকের খাছ মেহেরবাণীতে শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬ হিঃ)-এর শাণিত যুক্তি ও ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে জনগণের মধ্যে নিরপেক্ষভাবে হাদীছ অনুসরণের জায্বা সৃষ্টি হয় এবং তাঁর পরে তদীয় পুত্রগণ ও মুজাহিদ পৌত্র শাহ ইসমাঈল শহীদ (১১৯৩-১২৪৬ হিঃ)-এর সূচিত ‘জিহাদ আন্দোলন’ এর মাধ্যমে সারা ভারতে একটি সামাজিক বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে, যা আহলেহাদীছ আন্দোলনে জোয়ার সৃষ্টি করে। পাক-ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বর্তমানে বসবাসরত প্রায় ছয় কোটি আহলেহাদীছ জনগণ সেই বিপ্লবেরই ফসল। যাদের রক্তে-মাংসে, অস্থি-মজ্জায় বালাকোট, বাঁশের কেল্লা, মুল্কা, সিত্তানা, আম্বালা, চামারকান্দ, আসমাস্ত ও আন্দামানের রক্তাক্ত স্মৃতিসমূহ, জেল-যুলুম, ফাঁসি, সম্পত্তি বাযেয়াফত, যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর ও কালাপানির অবর্ণনীয় নির্যাতন, গাযী, শহীদী রক্তের অমলিন ছাপসমূহ আজও ভাস্বর হয়ে আছে। যুলুম ও নির্যাতনের আগুনে পোড়া নিখাদ তাওহীদবাদী ‘জামা‘আতে আহলেহাদীছ’ তাই চিরকালীন জিহাদী উত্তরাধিকারের নাম। যেকোন মূল্যের বিনিময়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ্র সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারকে অক্ষুণ্ণ রাখার চিরন্তন শহীদী কাফেলার নাম। মহান আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَهِنُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ- ‘তোমরা হীনবল হয়ো না, দুঃখিত হয়ো না, ঈমানদার হ’লে তোমরাই শ্রেষ্ঠ’ (আলে ইমরান ১৩৯)।[1]. শামসুদ্দীন আল-মাক্বদেসী, আহসানুত তাক্বাসীম ২য় সংস্করণ (লন্ডন: ই, জে, ব্রীল ১৯০৬) পৃঃ ৪৮১।
[2]. আব্দুল ক্বাহির বাগদাদী, কিতাবুল উছূলিদ্দীন (ইস্তাম্বুল: দাওলাহ প্রেস ১৩৪৬/১৯২৮) ১/৩১৭ পৃঃ।