সামাজিক কর্মসূচী
১. গণসচেতনতা সৃষ্টি:
সূদ বর্জনের তথা সমাজ হ’তে সূদ উচ্ছেদের জন্য গণসচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই। এদেশের জনগণের প্রায় ৮৫% লোক মুসলমান। তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য জীবন দিতেও কুণ্ঠিত নয়। কিন্তু যথার্থ ইসলামী জ্ঞানের অভাবে সূদ যে সর্বৈব হারাম সে সম্বন্ধে অনেকেই জ্ঞাত নয়। কেউ কেউ বলেন, ঐ নির্দেশ চৌদ্দশত বছর আগে ঠিক ছিল, এখন নয় (নাঊযুবিল্লাহ)। তাদের যুক্তি, ব্যাংকের সূদ ও ব্যক্তির দাবীকৃত সূদ একই পর্যায়ের বিবেচিত হ’তে পারে না। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে ব্যাংক ব্যবস্থার উদ্ভবই হয়নি। আবার একদল বলেন, আরবী ‘রিবা’ এবং ইংরেজী Interest একই অর্থ বহন করে না। অথচ আভিধানিক ও ব্যবহারিক বিচারে রিবার অর্থ এবং ইংরেজী Interest-এর ব্যবহারিক অর্থ একই দাঁড়ায়। আল-কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, وَأَحَلَّ اللّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সূদকে করেছেন হারাম’ (বাক্বারাহ, ২৭৫)। দেশের সাধারণ জনগণের বিপুল অংশ প্রকৃতপক্ষে আল-কুরআনের এই নির্দেশ সম্বন্ধে অবগত নয়। এজন্যই তাদের কাছে এই ইলাহী নির্দেশ যথাযথ গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা অতীব যরূরী। সূদের ক্ষতিকর দিক সম্বন্ধে প্রথমেই যে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরা দরকার তা হ’ল সূদের আয় যেমন হারাম, সূদের সঙ্গে যেকোন ধরনের সংশ্লিষ্টতাও তেমনি হারাম এবং হারাম উপায়ে উপার্জন ইসলামে নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آكِلَ الرِّبَا وَمُوْكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ- ‘তোমাদের মধ্যে যারা সূদ খায়, সূদ দেয়, সূদের হিসাব লেখে এবং সূদের সাক্ষ্য দেয় তাদের সকলের উপর আল্লাহ্র লা‘নত’।[1]
ছহীহ হাদীছ অনুসারে আল্লাহ্র কাছে দো‘আ কবুল হওয়ার জন্য যে শর্তগুলো রয়েছে তার অন্যতম হ’ল হালাল রূযীর উপর বহাল থাকা।[2] সুতরাং একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যদি আমাদের উপার্জনই হালাল না হয় তাহ’লে আল্লাহ্র দরবারে যতই ফরিয়াদ করি না কেন তা কবুল হওয়ার কোনই সম্ভাবনা নেই। সেক্ষেত্রে আমাদের সকল ইবাদত বন্দেগীই বরবাদ হয়ে যাবে। এর চূড়ান্ত পরিণতি হ’ল আখিরাতে আল্লাহ্র আযাব হ’তে রেহাই না পাওয়া। তাই ঈমান বজায় রাখার স্বার্থেই আমাদের হালাল রূযী অর্জনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং যা হারাম তা পরিত্যাগে সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে হালাল অর্জন ও হারাম বর্জনের মধ্যেই রয়েছে মুমিন জীবনের যথার্থ সাফল্য। এই সাফল্য অর্জনের জন্য চাই নিরন্তর প্রয়াস।
ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই কেবল সূদ উচ্ছেদের লক্ষ্য অর্জিত হ’তে পারে। জনগণের চাহিদা এবং তার দৃঢ় বহিঃপ্রকাশ ছাড়া সরকার নিজ থেকে খুব কমই তাদের উপযোগী ও প্রয়োজনীয় কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে থাকে। তাই সূদ উচ্ছেদের কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে এক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। এজন্য সবার আগে চাই গণসচেতনতা। আমাদের দেশের জনগণের একটা অংশ এখনও শিক্ষিত নয়। তাই কাজটা একটু কঠিন ও আয়াসসাধ্য, তবে অসম্ভব নয়। কারণ এদেশের জনগণ ধর্মভীরু। তাদের যদি যথাযথভাবে ইসলামের দাবী কি এবং তা অর্জনের উপায় কি এটা বুঝানো যায়, প্রকৃতই উদ্বুদ্ধ করা যায়, তাহ’লে এদেশের অর্থনীতি ও সমাজ কাঠামোয় সূদ বর্জন সময়সাপেক্ষ হ’তে পারে, কিন্তু অসম্ভব নয়। এজন্য কতকগুলি উপায় অনুসরণ করা যেতে পারে।
প্রথমত: মসজিদে জুম‘আর খুৎবার সাহায্য গ্রহণ। বছরে বায়ান্ন দিন এলাকার জনগণ মসজিদে জুম‘আর ছালাতে শামিল হন। এই ছালাতের খুৎবায় নানা বিষয়ের অবতারণা করা হয়। সেসব বিষয়ের পাশাপাশি যদি খতীব বা ইমাম ছাহেব সূদী অর্থনীতির কুফল এবং তা দেশ ও জাতির জন্য কতখানি ক্ষতিকর তা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলেন তাহ’লে ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হবে।
দ্বিতীয়ত: দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়ায মাহফিল ও ইসলামী জালসায় ওলামায়ে কেরামগণ বক্তৃতা করে থাকেন। সেখানে হাযার হাযার লোকের সমাগম হয়। ঐসব অনুষ্ঠানে যদি ইসলামী অর্থনীতির কল্যাণময় দিক এবং সূদী অর্থনীতির কুফল সম্বন্ধে বিশদভাবে বুঝিয়ে বক্তব্য রাখা যায় তাহ’লে যে আলোড়ন সৃষ্টি হবে, জনমত গড়ে উঠবে তার ধাক্কাতেই সূদী অর্থনীতি উৎখাত হ’তে পারে, বাস্তবায়িত হ’তে পারে ইসলামী অর্থনীতি।
তৃতীয়ত: দেওয়াল লিখন ও পোস্টারিং। সূদের অপকার সম্বন্ধে আমজনতাকে ওয়াকিফহাল তথা সচেতন করে তুলতে হ’লে দেওয়াল লিখন ও পোস্টারিং একটা মোক্ষম উপায়। এর মাধ্যমে সহজেই সূদের ভয়াবহ কুফল ও হালাল রূযীর অপরিহার্যতা সম্বন্ধে মোটা দাগে প্রয়োজনীয় কথাগুলো সুন্দর ও আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা যায়। সুন্দর ডিজাইনে বড় বড় হরফে ছাপা পোস্টার লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। একইভাবে দেওয়াল লিখনের চমৎকার শ্লোগানগুলো দাগ কেটে বসবে লোকের মনে। পৃথিবীর সকল দেশেই বিশেষতঃ উন্নয়নশীল দেশসমূহে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলি ছাড়াও খোদ সরকারই এই পদ্ধতির আশ্রয় নিচ্ছে। ফলও পাচ্ছে হাতে হাতে।
চতুর্থত: রেডিও-টিভিতে নাটিকা, কথিকা ও আলোচনা অনুষ্ঠান ও টকশো প্রচলনের ব্যবস্থা গ্রহণ। বর্তমানে টেলিভিশনের প্রভাব বিপুল হ’লেও রেডিওর কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতা শেষ হয়ে যায়নি। বিশেষত: নদী, খাল, বিল পরিবেষ্টিত ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত পল্লী বাংলায় রেডিও এখনও বিপুলভাবে সমাদৃত গণমাধ্যম। তাই সূদের শোষণ ও নানাবিধ কুফল সম্পর্কেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচারিত হ’তে পারে রেডিও এবং টিভি থেকে। বাংলাদেশে এখন অনেক বেসরকারী রেডিও ও টিভি চ্যানেল রয়েছে। ইসলামী আদর্শ অনুসারী অনেক প্রোগ্রামও প্রচারিত হয় এসব গণমাধ্যম হ’তে। সেসব প্রোগ্রামেরই অন্তর্ভুক্ত করা যায় এ ধরনের অনুষ্ঠান। এর মাধ্যমে অগণিত দর্শক-শ্রোতার কাছে উপভোগ্যভাবে হারাম উপার্জন ও তার ভয়াবহ পরিণামের কথা তুলে ধরা যেতে পারে। সূদের অপকার সম্বন্ধে মনোজ্ঞ আলোচনা হ’তে পারে। টকশোর মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা প্রাঞ্জলভাবে বিষয়গুলো উপস্থাপন করলে অজস্র মানুষ এ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে পারতো, উপকৃত হ’তে পারতো। তাদের চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হ’ত। পরিণামে সূদ পরিত্যাগের জন্য তাদের অনেকেই যে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ নিতো নিঃসন্দেহে সে আশা করা যায়।
পঞ্চমত: পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ ও উপসম্পাদকীয় প্রকাশ। দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকায় সূদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিকতাবিধ্বংসী প্রসঙ্গসমূহ নিয়ে পরিকল্পিতভাবে নিয়মিত বিশদ আলোচনা প্রকাশিত হ’তে থাকলে তা যেমন গণসচেতনতা সৃষ্টি করবে তেমনি গণজাগরণেরও আবহ তৈরী হবে। একই উদ্দেশ্যে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে, দেশের কর্ণধারদের সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য উদাত্ত আহবান জানিয়ে উপসম্পাদকীয়ও প্রকাশিত হ’তে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে দৈনিক ইত্তেফাকের ‘রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ’ এই ধরনের ভূমিকাই রেখেছিল। দেশে এখন ইসলামী ভাবধারাপুষ্ট কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। সেসব দৈনিক এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসলে তা হবে প্রশংসনীয় এক বিরাট খিদমত।
২. আখেরাতে জবাবদিহিতার অনুভূতি জাগ্রত করা:
মুসলমানদের জীবনে রয়েছে দু’টি পর্ব- ইহকাল ও পরকাল বা আখেরাত। পরকালের জীবনটাই অনন্ত। ইহকালের জীবন ক্ষণস্থায়ী, নশ্বর। পরকালের জীবনে রয়েছে অপরিমেয় পুরস্কার অথবা কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আল্লাহ নির্দেশিত পথে ইহকালে জীবন যাপন করলে যেমন আখেরাতে রয়েছে আনন্দময় জীবন, তেমনি সেই নির্দেশের পরিপন্থী জীবন যাপনের জন্য রয়েছে অনন্ত দুঃখভোগ। আল্লাহ নিজেই বলেছেন, خَالِدِيْنَ فِيهَا وَبِئْسَ الْمَصِيرُ ‘অনন্তকাল জাহান্নামে সেই দুঃখভোগ চলতে থাকবে এবং জাহান্নাম নিঃসন্দেহে নিকৃষ্টতম স্থান’ (তাগাবুন ১০)। যেসব কারণে আখেরাতে বনী আদমকে ভয়াবহ পরিণামের সম্মুখীন হ’তে হবে, তার অন্যতম হ’ল হারাম পন্থায় উপার্জন ও হারাম বস্ত্ত ভোগ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّىَ بِالْحَرَامِ، ‘ঐ দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যা হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত’।[3] হারাম খাদ্য শুধু হারাম বস্ত্ত হ’তেই তৈরী হয় না, হারাম উপার্জন হ’তে সংগৃহীত খাদ্যও হারাম বলেই গণ্য হবে।
সূদ-ঘুষ, চুরি-দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, জালিয়াতি, ওযনে কম দেওয়া, ভেজাল দেওয়া, নকল করা, জুয়া, ফটকাবাজারী, প্রতারণা প্রভৃতি সবই ইসলামে হারাম। এসব হারাম পন্থায় উপার্জন করা বা বিত্তবান হওয়া যেমন হারাম তেমনি ঐ উপার্জন বা বিত্ত-সম্পদ ভোগ বা ব্যবহার করাও হারাম। পূর্বেই বলা হয়েছে হালাল রূযী দো‘আ কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত। সুতরাং, বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হারাম উপার্জন আখেরাতে আমাদের কোন কাজে তো আসবেই না, উল্টো এর পরিণামফল হবে ভয়াবহ। এজন্যই অন্যান্য সব হারাম উপার্জনের মতো সূদও অবশ্যই বর্জন করতে হবে। সূদ খাওয়ার পাশাপাশি সূদের হিসাব লিখে ও সাক্ষ্য দিয়েও উপার্জন করা সম্ভব। এই পথও বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ, কোন প্রকারেই সূদের সাথে কোনরূপ সংস্রব রাখা চলবে না। তা না হ’লে এই আয়ের জন্য, এই আয়ে জীবন ধারণের জন্য আখেরাতে ভয়াবহ ও ভীতিকর শাস্তির সম্মুখীন হ’তে হবে। জনগণের মধ্যে এই চেতনা, এই বোধ জাগিয়ে তোলা অতীব যরূরী।
এ দেশের আমজনতার মধ্যে ইসলামপ্রীতি ঈর্ষণীয়। কিন্তু এদের বিপুল অংশই ইসলামের মূল দাবী আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকারের অনুসরণের মাধ্যমেই যে আল্লাহ্র ইবাদত বা তাঁর বন্দেগী হয়, সে সম্বন্ধে প্রায় অনবহিত বললে অত্যুক্তি হবে না। এমন অজস্র লোকের সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে যারা ছালাত, ছিয়াম, যাকাত ও হজ্জের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই ইসলামকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। অর্থাৎ তাদের বিশ্বাস শুধু এগুলো পালন করলেই একজন মুসলমান হিসাবে আল্লাহ্র কাছে স্বীকৃত হবে এবং আখেরাতে নাজাত পেয়ে যাবে। আয়-রোযগার, ব্যয়, ভোগ, বিনিয়োগ ইত্যাদি সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশ কি সে সম্বন্ধে না তারা জানার চেষ্টা করেছে, না সেসব আমলের ব্যাপারে সতর্ক হয়েছে। তাই এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করাই হ’ল অত্যাবশ্যক কাজ।
হালাল রূযী উপার্জনের ব্যাপারে, হালাল খাদ্য ও হালাল সামগ্রী ভোগের ব্যাপারে খুলাফায়ে রাশেদীন, ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, এমনকি ইমামগণ কতদূর সতর্ক ছিলেন সে খবর আমরা কতজন রাখি? অথচ সেইসব উদাহরণই হওয়া উচিৎ ছিল আমাদের পালনীয় আদর্শ। বহু লোক আখেরাতকে ভয় করলেও আখেরাতের জবাবদিহিতা সম্পর্কে হয় অনবহিত, নয়তো গাফেল বা অসতর্ক। বর্তমানের প্রয়োজনের অজুহাতে অথবা শয়তানের কৌশলী প্রতারণা বা প্ররোচণার বশীভূত হয়ে তারা দুনিয়া তথা এর সম্পদ ও ভোগবিলাস অর্জনের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করছে। ফলে হালাল-হারামের বাছ-বিচার তার কাছে গৌণ বা তাচ্ছিল্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ভ্রান্তি এতদূর পর্যন্ত পৌঁছেছে যে, সূদের কারবার করে, সূদের লেনদেন করে, সূদী উপার্জনের অর্থেই এই উদ্দেশ্যে হজ্জ করতে যায় যে, হজ্জের কারণে আল্লাহ তার সমুদয় গুনাহ মাফ করে দিবেন। অথচ ছহীহ হাদীছের মর্মার্থ এর বিপরীত।
৩. পাঠ্যসূচীতে ইসলামী অর্থনীতি চালু করা:
বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু জনগণের তথা মুসলিম জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য এই যে, এ দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার বিষয়বস্ত্তর সঙ্গে তাদের ঈমান ও আক্বীদার কোন সংশ্রব নেই। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে প্রবর্তিত ইসলামী শিক্ষার কথা বাদ দিলে উচ্চতর শিক্ষা এবং বিশেষ শিক্ষার কোন পর্যায়েই ইসলাম যে একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা তা জানার কোন সুযোগই নেই। এই অবস্থার নিরসন হওয়া দরকার। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের পাঠ্যসূচীতে দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ঈমান-আক্বীদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত হ’তে হবে। এজন্য প্রয়োজন গোটা পাঠ্যসূচীর সংস্কার। যারা আগামী দিনে এদেশের প্রশাসন, বিচার, আইন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কল-কারখানার কর্ণধার হবে, তাদের যদি এখনই সূদী অর্থনীতির কুফল ও ধ্বংসাত্মক দিক সম্বন্ধে অবহিত করা না যায় এবং পাশাপাশি ইসলামী অর্থনীতির গঠনমূলক ও হিতকর দিকগুলো জানানো না যায়, তাহ’লে জাতি যে তিমিরে রয়েছে সেই তিমিরেই থেকে যাবে।
কিশোর বয়সেই যা শেখা যায়, যে বিষয়গুলো স্কুলের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত থাকে সারা জীবন তার প্রভাব রয়ে যায় মানুষের চিন্তা, চেতনা ও কর্মধারার উপর কখনো সচেতনভাবে কখনো অবচেতন মনে। সেজন্যই বিভিন্ন মতাদর্শের স্কুলের পাঠ্যসূচীর বিষয় নির্বাচন করা হয় যথেষ্ট সতর্কতার সাথে, প্রচুর যাচাই-বাছাই ও চিন্তা-ভাবনার পর। সরকার পরিচালিত স্কুল ও কলেজসমূহের পাঠ্যক্রমে জাতীয় আদর্শ ও লক্ষ্য, কল্যাণময় জীবন, সমৃদ্ধ ও নিরাপদ সমাজ গঠনের জন্য যেসব মৌলিক বিষয়ের জ্ঞান অর্জন অপরিহার্য সেসব বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত থাকে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর স্কুল পাঠ্যসূচী বা যেসব সিলেবাস অনুসরণ করা হয় সেগুলি একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এই সত্য সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়বে। আমাদের দেশেও বিগত দশকগুলিতে স্কুলের পাঠ্যসূচীর পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। দেশের মুক্তি সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল কাহিনী, বীরশ্রেষ্ঠদের জীবনগাঁথা, বৃক্ষরোপণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল, এমনকি একেবারে সাম্প্রতিক কালে এইডসের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কেও আলোচনা ঠাঁই পেয়েছে স্কুলের পাঠ্যসূচীতে।
অথচ গভীর পরিতাপের বিষয়, ইসলামী জীবনাদর্শ, আচরণ, ইসলামী শিক্ষা, অমর মুসলিম মনীষীদের জীবনকাহিনী এই পাঠ্যসূচীতে ঠাঁই করে নিতে পারেনি। ফলে লক্ষ লক্ষ শিশু, কিশোর-কিশোরীর ইসলামী ভাবধারাপুষ্ট হয়ে গড়ে ওঠার কোন সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে এদেশের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিকড়হীন জনসমর্থনহীন বাকসর্বস্ব মুষ্টিমেয় এইসব বুদ্ধিজীবীর সুকৌশলী পদক্ষেপ বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচীতে যেন কোনক্রমেই ইসলামী জীবনাচরণ সম্পর্কে জানার ও শেখার সুযোগ না থাকে সেজন্য এরা প্রায়শই সেক্যুলার পাঠ্যসূচীর যৌক্তিকতা, বিজ্ঞানমনষ্ক পাঠ্যসূচীর অপরিহার্যতা ইত্যাকার চটকদার ব্যানারে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-ওয়ার্কসপের আয়োজন করে গৃহীত সুপারিশসমূহ জাতীয় দাবী শিরোনামে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে পেশ করে। একই সঙ্গে তাদের ঘরানার পত্রিকাগুলোও জোর সমর্থন দিয়ে যায়। ফলে সরকারের নীতি নির্ধারকরাও বিভ্রান্ত বা বিচলিত না হয়ে পারে না।
অথচ দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ঈমান-আক্বীদার সাথে সম্পর্কিত বিষয় স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ ছিল। ইসলামী জীবনাচরণ, হালাল উপার্জনের অপরিহার্যতা, যাকাতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুফল, সূদের অবশ্যম্ভাবী ক্ষতিকর প্রসঙ্গ প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা খুবই যরূরী।
৪. সামাজিক প্রতিরোধ সৃষ্টি:
সূদের মতো ভয়াবহ এক অক্টোপাসের নাগপাশ হ’তে মুক্তি লাভ করতে প্রয়োজন মযবূত সামাজিক প্রতিরোধ। যথাযথ সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে বহু অন্যায়-অপকর্ম ও অসামাজিক কাজ হ’তে জনগণকে বিরত রাখা যায়। জনগণকে সত্যিকার উদ্বুদ্ধ করতে পারলে, সামাজিকভাবে সচেতন করতে পারলে বহু কঠিন কাজও সহজ হয়ে যায়। এদেশে বনায়ন কর্মসূচী তার জাজ্বল্যমান উদাহরণ। বছর ত্রিশেক পূর্বে দেশের অনেক এলাকায় মরুকরণের লক্ষণ ফুটে উঠেছিল। সেই সময়ে বৃক্ষরোপণের আবশ্যকতা সম্বন্ধে জনমত তৈরীর উদ্যোগ নেওয়া হয়। রেডিও-টেলিভিশন সংবাদপত্র প্রভৃতি গণমাধ্যমে নানা অনুষ্ঠান প্রচার ছাড়াও স্কুল-কলেজ মক্তব-মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রীদের এই কাজে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচী গৃহীত হয়। একাজের সামাজিক স্বীকৃতি স্বরূপ শহর, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আজ তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে।
সূদ উচ্ছেদের জন্য এ ধরনের জনমত গঠনের পদক্ষেপ নিতে হবে। এক সময়ে এদেশের সমাজে সূদবিরোধী মনোভাব বিদ্যমান ছিল। কিন্তু আজ সমাজে সূদখোরদের দাপট চোখে পড়ার মতো। গ্রামাঞ্চলে সূদখোররা মহাজন নামে পরিচিত। সূদী ব্যবসার কারণে সমাজপতিদের মধ্যেও তারা আসন করে নিয়েছে। শহরেও সূদের লেনদেনকারী ব্যবসায়ী-পুঁজিপতিরা সকল কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে। সূদকে আজ আর ঘৃণার চোখে দেখা হচ্ছে না। এর প্রতিবিধানের চেষ্টা না করলে এই সর্বনাশা পাপ ও সমাজবিধ্বংসী বিষ আরও ভয়াবহ রূপ নিবে। এজন্যেই প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ সৃষ্টি। এই প্রতিরোধ যতই ব্যাপক ও দুর্বার হবে সূদের নিষ্পেষণ ততই আলগা হ’তে বাধ্য। ক্রমে এক সময়ে তা খসে পড়বে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হ’ল-
ক. সূদখোরদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা : সমাজে যারা সূদখোর বলে পরিচিত, ধীরে ধীরে তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। তারা যেন বুঝতে পারে যে, সূদের সঙ্গে সংশ্রব থাকার কারণেই জনগণ তাদের সঙ্গ বর্জন করছে বা তাদের এড়িয়ে চলছে। কাজটা কঠিন মনে হ’তে পারে কিন্তু সকলে মিলে এগিয়ে এলে মোটেই দুঃসাধ্য নয়।
খ. সূদখোরদের জনপ্রতিনিধি না বানানো : জনপ্রতিনিধিত্বমূলক কোন কাজে সূদখোরদের নির্বাচিত হ’তে দেওয়া হবে না। তারা ভোটপ্রার্থী হ’লে যেন ভোট না দেওয়া হয় সেজন্য জোর প্রচারণা চালাতে হবে। জনগণকে বুঝাতে হবে এইসব লোকের কার্যক্রমের জন্যই সমাজে শোষণ-নির্যাতন-নিপীড়ন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকবে।
গ. সূদখোরদের সামাজিকভাবে বয়কট করা : যারা সূদের ব্যবসা করে, গ্রামে মহাজনী কারবারের (গ্রামাঞ্চলে সূদী ব্যবসার প্রচলিত নাম) সাথে যারা যুক্ত তাদের ছেলে-মেয়ের সাথে নিজেদের ছেলে-মেয়ে বিয়ে না দেওয়া এবং তাদের জানাযা না পড়ানোও উত্তম প্রতিষেধকের কাজ হ’তে পারে। বাংলাদেশেই আজ হ’তে পঞ্চাশ-ষাট বছর পূর্বে গ্রামাঞ্চলে সূদখোরের দাওয়াত কেউ সহজে গ্রহণ করতে চাইত না। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতির দাপটে এবং দ্বীনী শিক্ষা বঞ্চিত হওয়ার কারণে সেই অবস্থার দুঃখজনক পরিবর্তন ঘটেছে।
ঘ. ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা : সরকার যেসব ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবে সূদ প্রদান বাধ্যতামূলক করে রেখেছে সেগুলো রহিত করার জন্য ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা যেতে পারে। উদাহরণতঃ জমির খাজনা যথাসময়ে দিতে না পারলে তার উপর সূদ দিতে হয়। সূদের বদলে সরকার জরিমানা আরোপ করতে পারে। ঈমান ও আক্বীদাবিরোধী সূদ কেন দিতে হবে? অনতিবিলম্বে সরকার যেন খাজনার খাত থেকে সূদ প্রত্যাহার করে নিতান্তই অপরিহার্য ক্ষেত্রে জরিমানার ব্যবস্থা চালু করে সে লক্ষ্যে জনমত গঠন করা প্রয়োজন।
উপরে উল্লিখিত কাজগুলো কঠিন নিঃসন্দেহে। কিন্তু মুমিনের জীবনে কোন্ কাজটি সহজ? বরং আল্লাহ রাববুল আলামীনের উপর তাওয়াক্কুল করে তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সমবেতভাবে এসব উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে।
৫. অনাবশ্যক সামাজিক ব্যয় প্রতিরোধ :
সমাজে বসবাস করতে হ’লে নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে যেমন যোগ দিতে হয় তেমনি আয়োজনও করতে হয়। কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন ঐ সব অনুষ্ঠান আড়ম্বর ও ঐশ্বর্যের প্রদর্শনী হয়ে দাঁড়ায়। উপরন্তু অনেক অনুষ্ঠান ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলে চালু থাকলেও প্রকৃতপক্ষে ঐসব অনুষ্ঠানের কোন ধর্মীয় ভিত্তি নেই। যেমন কেউ মারা গেলে মৃত্যুর পর চল্লিশ দিনের মাথায় ধুমধাম করে দশগ্রামের বা মহল্লার লোকজন ডেকে খানাপিনার আয়োজন করা। ছেলের খাৎনা উপলক্ষ্যে বন্ধু-বান্ধব, পড়শী-স্বজন সকলকে ডেকে উৎসবমুখর পরিবেশ ও ভোজের আয়োজন এবং অভ্যাগতদেরকে উপঢৌকন প্রদানে বাধ্য করা। এছাড়াও রয়েছে জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী, বিবাহবার্ষিকী প্রভৃতি নানা বিদ‘আতী অনুষ্ঠান। রয়েছে বিচার আচার ও শালিশী বৈঠক। এসব বৈঠকের জন্য যে প্রচুর ব্যয় হয় তা বলাই বাহুল্য। বিয়ে-শাদীর কথা তো না বলাই ভাল। ইসলামের এই অপরিহার্য ও সরল সামাজিক অনুষ্ঠানটিতে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুসরণে ঢুকে পড়েছে পান-চিনি বা পাত্র দেখা, গায়ে হলুদ, বিয়ের তত্ত্ব পাঠানো এবং রয়েছে ঘৃণ্য যৌতুক প্রথা। সম্প্রতি যৌতুকবিরোধী মনোভাব দানা বেধে ওঠার প্রেক্ষিতে একে গিফট বা উপঢৌকনের লেবাস পরানো হয়েছে।
একজন বিত্তশালী ব্যক্তি অক্লেশে এসব অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার বহনে সক্ষম। অনেক ক্ষেত্রে নতুন বিত্তশালী বা হঠাৎ করে ধনী হওয়া লোকেরা সামাজিক পরিচিতি, প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা লাভের জন্য তাদের অর্জিত নতুন বিত্ত খরচ করেন অকাতরে। সমস্যার সৃষ্টি হয় যখন একই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বলা হয় মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত শ্রেণীর কাউকে। সমাজপতিরা রায় দেন- এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে, এটা দিতে হবে। না হ’লে সমাজচ্যুত হ’তে হবে। অথচ এসবের ব্যয়ভার বহনের সাধ্য তার নেই। নিরুপায় হয়ে তখন তাকে সহায়-সম্বল বিক্রি করতে হয় অথবা ঋণ নিতে হয় সূদ দেবার শর্তে। সাধারণতঃ এসব সামাজিক প্রয়োজনে গৃহীত ঋণের সূদের হার বেশ চড়া হয়ে থাকে। কারণ ঋণদাতা ভাল করেই জানে যে, ঋণ গ্রহীতার বিকল্প কোন উপায় নেই। সামাজিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য বাধ্য হয়ে নেওয়া এই ঋণ অতি অবশ্যই অনুৎপাদনশীল ও অপ্রয়োজনীয় খাতের। ফলে তা পরিশোধ করা হয়ে দাঁড়ায় আরও দুরূহ। তাই ঋণের বোঝা চেপে বসে গ্রহীতার মাথায় জগদ্দল পাথরের মতো। শেষ অবধি তাকে শেষ সম্বল চাষের জমিটুকু, এমনকি ভিটেমাটি পর্যন্ত বেচে দিতে হয় ঋণ পরিশোধের জন্য। এই পথে গ্রাম বাংলার হাযার হাযার মাঝারি ও প্রান্তিক কৃষক ভূমিহীন চাষীতে পরিণত হয়েছে। চাকুরীজীবিদের অনেকের ক্ষেত্রে এই ব্যয় পুষিয়ে নেবার অন্যতম উপায় ঘুষ, যার বোঝা বইতে হয় পরোক্ষভাবে সমাজের সকলকেই। এর প্রতিবিধান ও প্রতিরোধের জন্য চাই ব্যাপক গণসচেতনতা।[1]. মুসলিম, হা/১৫৯৮; তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত হা/২৮০৭।
[2]. মুসলিম, হা/১০১৫; মিশকাত হা/২৭৬০।
[3]. বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, মিশকাত হা/২৭৮৭; সিলসিলা ছাহীহাহ হা/২৬০৯।