হাক্কুল্লাহ
‘হাক্কুল্লাহ’ অর্থ আল্লাহর হক। বান্দার নিকটে আল্লাহর হক হ’ল তাঁর ইবাদত ও আনুগত্য করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُوْنِ ‘আমি জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছি কেবলমাত্র আমার ইবাদতের জন্য’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)। আল্লাহর ইবাদত মানুষ তখনই করবে, যখন তাঁর অদৃশ্য সত্তা ও অসীম ক্ষমতার ব্যাপারে মানুষ নিশ্চিত বিশ্বাস স্থাপন করবে। মূসা (আঃ)-এর কওম এজন্যই দাবী করেছিল যে, لَن نُّؤْمِنَ لَكَ حَتَّى نَرَى اللَّهَ جَهْرَةً ‘আমরা কখনোই তোমার কথা বিশ্বাস করব না, যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ্কে প্রত্যক্ষভাবে দেখতে পাব’ (বাকবারাহ ২/৫৫)।
স্বেচ্ছাচারী ও আত্মপূজারী মানুষ চিরকাল এভাবেই কপট দাবী ও অন্যায় যুক্তির মাধ্যমে নিজের হঠকারিতাকে আড়াল করতে চেয়েছে। অথচ সে কখনো নিজের সৃষ্টিকে নিয়ে চিন্তা করেনি। সে কিভাবে জন্ম নিল, কিভাবে বড় ও শক্ত-সমর্থ হ’ল, অতঃপর পৌঢ় ও বৃদ্ধ হ’ল- কিছুই সে ভাববার অবকাশ পায়নি। কিভাবে তার খাদ্য যোগানো হচ্ছে, তাকে আলো-বাতাস সরবরাহ করা হচ্ছে, বুদ্ধি-বিবেচনা খাটিয়ে সে কাজ করছে, অথচ তারই একজন পঙ্গু ও প্রতিবন্ধী ভাই বা বোন বুদ্ধিহীন অপগন্ড হয়ে তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে- এসব চিন্তা তার মাথায় আসেনি। শয়তানী ধোঁকায় পড়ে সে আত্মঅহংকারে মত্ত হয়ে পড়েছে এবং অবশেষে নিজের সৃষ্টিকর্তাকেই অস্বীকার করছে।
কারাগারের ঐ উঁচু দেওয়ালের ভিতরের খবর বাইরের লোকেরা কিছুই জানে না। তাই বলে কি তারা কয়েদখানায় বিশ্বাস করে না? অনুরূপভাবে পরকালের অদৃশ্য পর্দা উন্মোচিত হওয়ার পূর্বে কি সেখানকার খবরাখবরে বিশ্বাস করা যাবে না? সেই খবরদাতা যদি কোন নবী-রাসূল হন, তাহ’লেও কি নয়? তাই বাস্তব অভিজ্ঞতা হাছিলের জন্য শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে মি‘রাজে নিয়ে জান্নাত-জাহান্নাম ও অন্যান্য সবকিছু দেখানো হ’ল। তিনি সবকিছু স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে এসে জগদ্বাসীকে জানিয়ে দিলেন। এরপরেও কি অবিশ্বাস? আল্লাহ বলেন,
لَقَدْ كُنْتَ فِيْ غَفْلَةٍ مِّنْ هَذَا فَكَشَفْنَا عَنكَ غِطَاءكَ فَبَصَرُكَ الْيَوْمَ حَدِيدٌ ‘ইতিপূর্বে তুমি এ দিনটি সম্পর্কে উদাসীন ছিলে। আজ তোমার চোখ থেকে সেই পর্দা সরিয়ে দিয়েছি। ফলে আজ তোমার দৃষ্টি সুতীক্ষ্ণ’ (ক্বাফ ৫০/২২)। দুনিয়া স্বপ্নজগৎ সদৃশ। মৃত্যুর পর চর্মচক্ষু বন্ধ হওয়ার সাথে মানুষের এ স্বপ্নজগৎ শেষ হয়ে যাবে ও জাগরণের জগৎ শুরু হবে। অতঃপর পরকাল সম্পর্কিত সকল বিষয় তার সামনে এসে যাবে। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, اَلنَّاسُ نِيَامٌ فَإذاَ مَاتُوْا اِنْتَبَهُوْا. ‘পার্থিব জীবনে সব মানুষ নিদ্রিত। যখন তারা মরে যাবে, তখন জাগ্রত হবে’। অতএব পরজগতে প্রবেশ না করেও কি সেখানকার গায়েবী খবরে বিশ্বাস করা যাবে না? নিশ্চয়ই যাবে। কেবল প্রয়োজন আত্মঅহমিকা ও হঠকারিতাকে দমন করা।
‘হাক্কুল্লাহ’ তথা আল্লাহর নিয়মিত ইবাদত মানুষকে নিরহংকার বানায়। সে ক্রমে বিনয়ী হয়ে ওঠে। তার হৃদয় জগৎ আলোকিত হয়। বাকী দু’টি হক তথা হাক্কুন নাফ্স ও হাক্কুল ইবাদ আদায়ে সে তৎপর হয়ে ওঠে। আল্লাহর অস্তিত্ব যত বেশী সে অনুভব করে, আল্লাহভীতি তার মধ্যে ততবেশী প্রগাঢ় হয়। একারণেই হাদীছে জিবরীলে ‘ইহসান’-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, أنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأنَّكَ تَرَاهُ فَإِن لَّمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإنَّهُ يَرَاكَ. ‘তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত কর, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। যদি তাঁকে দেখতে না পাও, তাহ’লে এতটুকু বিশবাস রেখ যে, তিনি তোমাকে দেখছেন’।[1] মানুষ সর্বদা আল্লাহর চোখের সম্মুখে রয়েছে। দিনে হৌক, রাতে হৌক, ভূগর্ভে হৌক, ভূপৃষ্ঠে হৌক বা অন্তরীক্ষে হৌক, আল্লাহ্কে লুকিয়ে কোন কিছুই করার ক্ষমতা কারু নেই। ক্বিয়ামতের দিন মানুষের হাত-পা-দেহচর্ম সবই তার সারা জীবনের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দিবে। এসব অবিচ্ছেদ্য সাক্ষীদের এড়িয়ে মানুষের কিছুই করার ক্ষমতা নেই। এরপরেও তার সাথে রয়েছে দু’জন ফেরেশতা। যারা সর্বদা তার দৈনন্দিন আমলনামা নোট করছে। ক্বিয়ামতের দিন চূড়ান্ত হিসাবের সময় জীবন সাথী ঐ ফেরেশতা দু’জন তাদের প্রস্ত্ততকৃত আমলনামা আল্লাহর নিকটে পেশ করবে। অবশ্য তওবাকৃত পাপগুলো হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হবে। অতঃপর আল্লাহর হুকুমে তারা তাকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাবে তার যথাযোগ্য স্থানে (ক্বাফ ৫০/২১,২৩-২৪)।
অতএব আল্লাহর ইবাদত কুরআন ও ছহীহ হাদীছ মোতাবেক যথাযথভাবে আদায় করে যেতে হবে। উক্ত ইবাদত দৈহিক হৌক যেমন ছালাত-ছিয়াম ইত্যাদি, কিংবা আর্থিক হৌক যেমন যাকাত-ওশর-ফিৎরা-ছাদাক্বাহ ইত্যাদি, কিংবা দৈহিক ও আর্থিক সমন্বিত হৌক যেমন হজ্জ-ওমরাহ ইত্যাদি। সকল ইবাদতেরই লক্ষ্য হ’তে হবে আল্লাহর সস্ত্তষ্টি অর্জন। ছালাত হ’ল আল্লাহর যিকরের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানটি নিয়মিত সুন্দরভাবে আদায় করতে পারলেই বাকী সব ইবাদত সহজ হয়ে যায়। শরী‘আত নির্ধারিত এইসব ইবাদতের বাইরে বিভিন্ন সময়ে আবিষ্কৃত বিভিন্ন তরীকার যিকরের অনুসরণ করা নিঃসন্দেহে বিদ‘আত। এমন কিছু কিছু যিক্র রয়েছে, যা মুখে উচ্চারণ করা স্পষ্টভাবেই শিরক। আরবী-ফার্সী-উর্দূ ভাষায় অজ্ঞ বাংলাভাষী অন্ধ অনুসারীদের মুখ দিয়ে প্রতিনিয়ত এসব যিক্র বলিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আর অন্যদিকে নযর-নেয়াযের নামে ভক্তির চোরাগলি দিয়ে তাদের পকেট ছাফ করে যাচ্ছে একদল ধর্ম ব্যবসায়ী চতুর লোক। সবচাইতে ভয়াবহ যে বিষয়টি এরা তাদের ভক্তদের বিশ্বাসের অঙ্গীভূত করে দিয়েছে, সেটা হ’ল- ‘পীর-আউলিয়ারা মরেন না। কবরে গেলেও তাঁদের অসীলায় মুক্তি পাওয়া যায়’। তাই ভক্তরা খুশী ও নাখুশী সর্বাবস্থায় পীরবাবার কবরে টাকা ফেলেন তাঁকে খুশী রাখার জন্য। দুর্ভাগ্য, এগুলোই এদেশে ধর্ম নামে পরিচিত। অথচ এগুলো ধর্ম নয়, বরং ধর্মচ্যুতি। অতএব এদের কপোলকল্পিত বানোয়াট যিকর ও যিকরের অনুষ্ঠান হ’তে দূরে থেকেই আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করতে হবে।
অনেকে ইবাদত পালন করাকে বাহুল্য মনে করেন এবং ‘নিজে ভাল আছি’ বলে আত্মতুষ্টি লাভ করেন। অথচ কোন যুবক যদি নিজেকে শক্তিমান ভেবে খানাপিনা ত্যাগ করে, তাহ’লে সে যেমন দুর্বল হয়ে যাবে। কোন সৈনিক নিজেকে যোগ্য ভেবে তার দৈনিক নির্ধারিত অনুশীলন বাদ দিলে সে যেমন বাতিলযোগ্য হয়ে যাবে। কোন ছাত্র যেমন নিয়মিত সিলেবাস অনুসরণে পড়াশুনা না করলে যেমন সে ব্যর্থকাম হবে। অনুরূপভাবে নিয়মিত ইবাদতের মাধ্যমে রূহের খোরাক না যোগালে মানুষের রূহ মরে যাবে ও সেখানে পশু প্রবৃত্তি জয়লাভ করবে। মনোযোগ আসুক বা না আসুক ইবাদত করাটাই যরূরী। যদি কেউ সরকারের হুকুম মোতাবেক খাজনা-ট্যাক্স পরিশোধ না করে এই অজুহাতে যে মনে ভাল লাগে না। তাহ’লে সরকার যেমন তাকে মাফ করবে না। অনুরূপভাবে আল্লাহ নির্ধারিত ফরয ইবাদত আদায় না করলে তাকে মাফ করা হবে না, বরং জাহান্নাম ভোগ করতে হবে।
নিয়মিত খুশু-খুযুর সাথে ইবাদত করলে নফস অনুগত হবে, রূহ তাযা থাকবে। কর্মজগৎ সুন্দর হবে। যদি কেউ ইবাদতে গাফলতি করে বা মন বসাতে ব্যর্থ হয়, তাহ’লে সে তার অজান্তেই শয়তানের শৃংখলে আবদ্ধ হবে। যে শৃংখল থেকে বের হয়ে আসা তার জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। মানুষ কোন অবস্থাতেই শৃংখলের বাইরে নয়। হয় তাকে আল্লাহর শৃংখলে থাকতে হবে, নয় তাকে শয়তানের শৃংখলে থাকতে হবে। সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে হবে। আমাদেরকে অবশ্যই শয়তানের শৃংখল ছিন্ন করে আল্লাহর শৃংখল আবদ্ধ হ’তে হবে। তাতেই মুক্তি, তাতেই শক্তি, তাতেই জান্নাত ।